"ভাবনার অন্তরালে আমি"

লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ১৫ জানুয়ারি, ২০১৩, ০২:১৩:৩১ রাত

রিম ঝিম বৃস্টি পড়ছে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সারি সারি গাছগুলো তাদের পাতাগুলি মেলে দিয়েছে, ভিজে ভিজে একাকার পত্রপল্লবে বৃস্টির জলের অবগাহন প্রকৃতি কে দিয়েছে নতুন সৈান্দর্য!

সাত সকালের প্রকৃতির রুপটা উপভোগ করা হয় না,যান্ত্রিক ঘড়ির এ্যালার্মের শব্দ শুনে ঘুম ভাংগে তারপর সারাটা দিন যন্ত্রের মতোনই পেরিয়ে যায়! ছুটির দিন গুলোতেও তার ব্যাতিক্রম হয় না বরং কাজের পরিমান আরো বেড়ে যায়!

আজ সকালে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠার ফলেই জানালায় দাঁড়িয়ে বাহিরের অবস্হা অনুভবের সুযোগ পেয়েছি!কিছুদিন থেকেই একটা ভাবনা মাকড়সার জালের মতো বাসা বেঁধেছে,আমি ভেবেই চলছি কিন্তু ভাবনার ইতি টানতে পারছি না!

আমার ছোট বেলার কথা মনে পড়ছে!আমাদের রোজ ঘুম ভাংতো মায়ের সুললিত কন্ঠের কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে।তখনো আকাশ ফর্সা হয়নি,বাইরে খুব সম্ভবত চড়ুইপাখিদের কিচির মিচির শব্দ,একসময় মা পড়া শেষ করতেন, আমাদের ডাকতেন! এখনো মনে আছে আমরা সজাগই থাকতাম শুধু অপেক্ষা করতাম মায়ের কন্ঠের দরদমাখা ডাকের জন্য!যতক্ষম পর্যন্ত না উঠেছি মা ডেকেই চলতেন!আমি উঠে নামায পড়ার আগ পর্যন্ত মা নড়তেন না! কখনো যদি বলেছি মা আরেকটু ঘুমাই! অমনি আমার সহজ সরল মা প্রচন্ড রেগে যেতেন, বলতেন আগে নামাজ পড়ো তারপরো যদি ঘুম আসে ঘুমিয়ে নিও কিছু বলবোনা! এখন তোমার চোখে শয়তান ঘুমের আবেশ(পিপি) দিচ্ছে, নামাজের সময়টা যাক দেখবে ঘুম আর নাই আর অতক্ষনে তোমার নাম মুসলমানের লিস্টি থেকে কাটা হয়ে গেছে!

কি সাংঘাতিক ভয় পেতাম তখন!আর শয়তানের বিশেষ কর্মটিকে তো রীতিমতো ঘৃনা করতাম!!!

আমি এখন আমার আর আমার মেয়ের ছোটবেলার জীবনের সংগে মিল খুঁজি! সাথে সাথে একটা দীর্ঘ শ্বাষ ছাড়ি! আমার ঘুম ভাংতো আমার মায়ের কন্ঠের তিলাওয়াতে আর আমার মেয়ের ঘুম ভাংগে ব্যাটারি চালিত ঘড়ির এ্যালার্মে! কঠিন বাস্তবতার সাথে মিলিয়ে চলতে গিয়ে আমার সকালে তিলাওয়াত করা হয়না, আমরা মা- মেয়ে নামাজ শেষ করে তড়িঘড়ি করে নাস্তা খেয়ে দৌড় মারি কেউ কাজের তাড়নায়, কেউ স্কুলের কারনে!

সন্ধ্যা হলে আমরা সবাই বসি সম্মিলিতভাবে কোরাআন তিলাওয়াত করতে! যে যার তিলাওয়াত শেষ করে আবার নিজস্ব ব্যস্ততায় ব্যস্ত হয়ে পড়ি! এর মধ্যেই দ্বীনি এবং দুনিয়াবী দুই দায়িত্ব পালন করার অক্লান্ত প্রচেস্টা চালিয়ে যাওয়া!

আমরা আমাদের সময় অনেক বিষয় ছিলো যা আমরা আশে পাশের সবাইকে দেখে এমনিতেই শিখে নিয়েছি বা বুঝে নিয়েছিলাম,কেউ খুব একটা ব্যাখ্যা করে বুঝাতো বা পড়ে পড়ে শিখেছি বলে মনে পড়ে না কিন্তু আমাকে প্রতিটি বিষয়ই আমার ছেলে মেয়েকে বুঝিয়ে বলতে হয়।এর অবশ্য সবচাইতে বড় উপকারিতা হলো সমাজের কোন অন্ধ অনুকরন তাদের করতে হবে না, ভাসা ভাসা জ্ঞানে ও তাদের ভাসতে হবে না! তবে ইসলামের সঠিক ধারনা তাদের মধ্যে প্রবেশ করানোর জন্য যে সময় এবং শ্রম দেয়া দরকার তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল! এই ভাবনা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে!

সেদিন মাগরিবের নামাজের পর বসেছিলাম আমরা,কথায় কথায় মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম:

তুমি কি কখনো ভেবেছো কেন আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন?

আমাদের পৃথিবীতে আনতে!(সহজ ভাবে বলে সারা)

তা তো ঠিক আছে;কিন্তু পৃথিবীতে আমাদের আসার কারন কি বলে মনে হয় তোমার?

বড় হবো,স্কুলে যাব,বান্ধবী বানাবো,চকলেট খাবো,কম্পিউটারে গেমস খেলবো,তুমি আমাকে বকা দিবে,আফনান কে আদর করবে,আব্বু বাজার করবে (পটাপট বলে যায় সারা)

-

-থামো থামো,কি বললে!আমি তোমাকে বকা দেই আর আফনান কে আদর করি?(আহত আমি)

-বেশির ভাগ সময়ইতো এটা হয়!(সারা)

-ঠিক আছে,বুঝলাম!আর কি কোন কারন আছে বলে মনে করো?(আমি)

-

আম্মু তুমিই বলো কি জন্য আমরা পৃথিবীতে এসেছি!(সারা)

-

আমাদের সৃষ্টি করেছেন আল্লাহ এবং আল্লাহ আল কোরআনে নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন কেন তিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন,এই আয়াতটা আছে সূরা যারিযাতের ৫৬নং আয়াতে,সেখানে আল্লাহ বলেন"জিন ও মানুষকে আমি শুধু এ জন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার ইবাদত করবে৷" তারমানে আমরা পৃথিবীতে এসেছি ইবাদত করতে,বুঝেছো? আর এই আয়াতটা তুমি মুখস্হ করে ফেলবে,ঠিক আছে আম্মু! (আমি)

হুম,আমরা তো তাহলে ঠিক ভাবেই ইবাদত করি,কারন আমরা নামাজ পড়ি,কোরআন তিলাওয়াত করি,রোযা রাখি,তোমাদের কথা শুনি(সারা)

আসলে ইবাদত শব্দটির অর্থ অনেক বড়।তুমি যা বললে এগুলি তো মৌলিক বড় বড় ইবাদত,তার পাশাপাশি কিন্তু অনেক ছোট ছোট বিষয় আছে সে সবগুলি মিলে আমাদের ইবাদত কে পূর্নতা দেয়! (আমি)

-বুঝতে পারলাম(সারা)

-তাহলে আমাকে কিছু উদাহরন দাও যেন আমিও বুঝতে পারি! (আমি)

-বুঝানো কঠিন!(সারা)

-তুমি বলো আমিতো আছি (আমি)

-যেমন আমরা সবসময় চিন্তা করি সব খাবার খাওয়া যাবেনা,যেমন আমরা যখন জানতে পারলাম আইসক্রিমে ই-কোড আছে,তখন থেকে আইসক্রিম খাইনা, আবার খাওয়ার সময় ডান হাতে খাই,দাঁড়িয়ে খাইনা,বাসায় ঢুকলে সালাম দেই,সব কাজের আগে দোআ পড়ি, আম্মু আমি ঠিক বলছি? (প্রশ্ন করে সারা)

-খুব সুন্দর বলেছো!এগুলো সহ আরো অনেক অনেক বিষয়ের সমষ্টি হলো ইবাদত!(আমি)

-সকালে যখন ফজরের নামজের জন্য উঠতে হয়,তখন কি কষ্ট লাগে তাইনা?কিন্তু আমরা কম্বলের গরম আরাম রেখে উঠে যাই,নামাজ পড়ি,এই যে কস্ট করে আমরা নামাজ পড়ি এটাও ইবাদত,কিন্তু শুধু যখন খুব ভালো থাকি কস্ট ছাড়াই যেসব ইবাদত করি সেসব ছাড়া এই যে কস্ট করে যখন আল্লাহর আদেশ মেনে চলি তখন আল্লাহ খুব বেশী খুশি হন ।আমি তোমাকে যা বলতে চাচ্ছি সেটা হলো আমাদের কে সব সময় প্রতিটা কাজে আল্লাহ'র কথা মনে রাখতে হবে,মেনে চলতে হবে।

প্রায় সকালেই যখন আমি তোমার রুমে এসে তোমার জামাকাপড় সিলেক্ট করে দেই তোমার মনে হয় খুব মন খারাপ হয় তাইনা?

-একটু!(সারা)

-কিন্তু আমি কেন করি জানো?শুধু আল্লাহ'র কথা মেনে চলার জন্য করি,কারন জামা কাপড় পড়াটা ও ইবাদত যদি জামাকাপড় আল্লাহ'র নির্দেশ মতো পরা হয় ,পোষাকের ক্ষেত্রে আল্লাহ যেসব বিষয় গুলি আমাদের মেনে চলতে বলেছেন সেভাবে পোষাক পড়লেই ইবাদত হবে,আমি তোমাকে প্রথম থেকে সাহায্য করি যেন তুমি শুরু থেকেই আদেশ মেনে চলতে পারো।আর আমি যদি এসব বিষয়ে তোমাকে না জানাই তাহলে আমার মা হিসেবে ইবাদত পরিপূর্নতা পাবে,আমাকে শাস্তি পেতে হবে।তুমি কি চাও আমি শাস্তি পাই?আমি ও চাই না তুমি শাস্তি পাও!

-বুঝতে পেরেছি!!(সারা)

-তোমাদের কে ইসলামের সঠিক ধারনা দেয়া আমার জন্য অনেক বড় ইবাদত,আমি যদি এ ধারনা না দেই আমার গুনাহ হবে,দুনিয়াতে আমার আসার উদ্দেশ্য সফল হবেনা!আবার তোমাদের যদি আদর বা বকা দেয়ার সময় অন্যায় বা ভুল ভাবে শাষন করি,তার জন্য রয়েছে শাস্তি!!(আমি)

-হুম,মজা করেছিলাম তখন(সারা)

-আলহামদুলিল্লাহ! আমাদের পৃথিবীতে আসার উদ্দেশ্য হলো আমরা সব কাজ এমন ভাবে করব যেন তা ইবাদত হয়,সেটা চাই কস্টকর সময়ে বা সুখের সময়ে,সব সময় মনে রাখতে হবে আমাদের কাজ হলো ইবাদত করা, জীবনের প্রতিটি বিষয়ে আল্লাহ যে আদেশ দিয়েছেন সেগুলি মেনে চলা,যেগুলি করতে নিষেধ করেছেন তা না করা হলো ইবাদত!আমরা তো সব কিছু একদিনে শিখতে পারব না,তাই প্রতিদিন কিছু সময় আমাদের দিতে হবে জানার জন্য,তুমি রাজি আছো? !(আমি)

-সমস্যা নাই!(হেসে বললো সারা)

ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলি যদি ধীরে ধীরে বাচ্চাদের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়া হয় তবে বাকি জীবনের জন্য চিন্তাটা কম হবে! আমাদের দরকার শুধু আগ্রহ তৈরী করে দেয়া!বিষয়টা ভাবার জন্য যতোটা সহজ মনে হয় কজে পরিনত করা ঠিক ততোটাই কঠিন! তবে ইখলাস আর অধ্যবসায় থাকলে ইনশাআল্লাহ সফলতা উঁকি দিবে,আর জ্ঞানএর জগতে নিয়মিত পাড়ি দিলে সফলতাও অর্জন সম্ভব হবে আশা রাখি। আমার জানার পরিধি খুব কম,নিজে অনেক গুনাহ করেছি কিন্তু চাইনা আমার সন্তানদের সামান্য পরিমানও গুনাহ'র আঁচড় লাগুক! আল্লাহ আমাকে ও আমাদের পরিবার পরিজনদের জাহান্নামের আগুন হতে হিফাজত করুন।

বিষয়: বিবিধ

১৭৫৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File