"জবাবদিহিতা"
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ১৩ জানুয়ারি, ২০১৩, ০৪:১২:৪৪ রাত
সেদিন আমরা স্বপরিবারে বের হয়েছিলাম,উদ্দেশ্য "সারা"র জন্য বুট কেনা।আবহাওয়াবিদ গন জানিয়ে দিয়েছেন এ বছর শীত যেমন বেশী থাকবে তেমনি বরফ ও পড়বে তাড়াতাড়ি!তাই আমাদের জরুরী সফর "বুট কেনা"।
একঘন্টার বাস জার্নি করে নির্দিষ্ট গন্তব্য স্হলে পৈাঁছলাম।এবার কঠিন পর্ব শুরু বুট পছন্দ করা!সারাকে বললাম ঘুরে দেখ কোন টা তোমার পছন্দ হয়। আমরা দুজনেই খুঁজছি কিন্তু মিলানো যাচ্ছে না।সারা'র হিল পছন্দ না,কালো ছাড়া অন্য রং কিনবে না!আমি দেখি আরামদায়ক কিনা? ওর আব্বু দেখে মেইড ইন ... ?
অবশেষে সারা এক জোড়া বুট হাতে নিয়ে এলো,হাসি হাসি মুখ,বিশ্ব উদ্ধার না হলে ও বিশাল স্টোর থেকে "মনের মত বুট " আবিষ্কার করেছে তাই বা কম কিসে?
আমি হাতে নিয়ে দেখতে লাগলাম,হিল নাই,কালো রং,আরামদায়ক,মেইড ইন ইটালি,পারফেক্ট! আমি ও খুশি হতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত খুশি হতে বাদ সাধল একটা খুলি
ঠিক বুটের উপরের অংশে পায়ের কাছ টাতে একটা বিকট খুলি! দেখেই আমি চুপসে গেলাম! আমি সারা'কে বললাম এটা কি? সারা আমাকে উত্তর দেয় "Teschio"। আমি বলি এটা কিভাবে পছন্দ করলা?কেন আম্মু তোমার কাছে সুন্দর লাগছে না?আমাদের ক্লাসে ছেলেরা মেয়েরা সবাই এটা পছন্দ করে,ব্যবহার ও করে!
হতভম্ব আমি !জানি না এই মুহূর্তে কি ভাবে বুঝাব ওকে? আর এই বিষয়টা নিয়ে তো আগে কখন মুখোমুখি হতে ও হয় নি!জামা ,প্যান্ট,গেন্জি ,ট্রাউজার এ বিষয় গুলো নিয়ে পারিবারি ভাবে,ব্যক্তিগত ভাবে অনেক আলাপ হয়েছে, ইসলামিক ড্রেস আপ বুঝাতে তেমন বেগ পেতে হয়নি, স্কুলে হিজাব শুরুটা করা নিয়ে আমি অনেক উদ্বিগ্ন ছিলাম অথচ ও নিজেই স্বাবলীল ভাবে হিজাব পছন্দ করে নিয়েছিলো !
সারা আমার দিকে তাকিয়ে বলে আম্মু সমস্যা টা কি?
এই খুলি টা!
সুন্দর তো আম্মু!
একটা মরা মাথার হাড্ডির ছবি কিভাবে সুন্দর হতে পারে?
ওর চোখ ততোক্ষনে ছলছল!
চলো আব্বুকে দেখাই,কি বলে দেখি!
তুমি হ্যা বলো আম্মু!তুমি পছন্দ না করলে আব্বু ও করবে না!
না,আমার পছন্দ করা না,তুমি জানো আমরা সব কিছু পছন্দ করতে পারি না,আমাদের কিছু কন্ডিশন আছে তাই না?
ঠিক এসময় ই ওর আব্বু আমাদের কাছে এলো,তাহলে তোমরা পছন্দ করেছো?
আমি হাতে তুলে নিয়ে দেখালাম।প্রথমেই চোখে পড়ল "খুলি"টা!তোমরা দুজনে ই এটা পছন্দ করলা?
না,আমরা শুধু পর্যালোচনা করছিলাম বুট টার ভাল আর মন্দ দিক গুলি।
সারা মামনি চলো আমরা অন্য বুট দেখি,এটা নেয়া যাচ্ছে না তাই না?
কেন আব্বু?
ওহ্ তুমি জানো না?এই খুলিটা কোথা থেকে এসেছে জানো?
না।
খুব সহজ ভাবে বলি,এটা হলো চোর ডাকাতের চিহ্ন!মানুষকে ভয় দেখায়!দেখনা কেমন ভূতের মতো?তুমি কত সুন্দর,ভদ্র,শান্ত স্বভাবের হিজাব করা মুসলিম একটা মেয়ে,তুমি তোমার পোষাকের মাধ্যমে,হিজাবের মাধ্যমে প্রকাশ কর তুমি একজন ভালো মেয়ে,আর এই "খুলি"বুট যদি পড় যা কিনা চোরের ভাবপ্রকাশ করে,তুমি ই বলো ভাল মেয়ের মধ্যে কি এই ডাকাতি চেহারা থাকতে পারে? ভাল দেখায়?
আব্বু কেউ এটাকে চোর ডাকাত বলে না,সবাই এটাকে ফ্যাশন বলে!
ঠিক আছে তাহলে,তোমার আম্মুর পছন্দ হয়েছে?
দুর্ভাগ্যবশত না!
আমার ও হয়নি,কেন হয়নি তোমাকে বুঝিয়ে বলেছি।তুমি সিদ্ধান্ত নাও কি করবে অন্য বুট দেখবে না এটা নিবে।
আমি আর কিছু দেখব না,তোমরাই দেখ!
এতক্ষন চুপচাপ দেখছিলাম বাপ বেটির যুদ্ধ,বললাম চলো আম্মা আমরা এর থেকেও সুন্দর একজোড়া বুট কিনব।বলে ওকে জড়িয়ে ধরে নিয়ে গেলাম অন্য পাশে।অবশেষে আমরা একজোড়া চমতকার বুট পেলাম,সবার পছন্দ হলো।সারা'র মুখে হালকা বিষন্নতা থাকলেও এতক্ষনে হাসি ফুটেছে।পরদিন সকালে সারা স্কুলে গেল নতুন বুট পড়ে।ওর সব বান্ধবীরা নাকি বুটের খুব প্রশংশা করেছে।আমি বললাম খুলির জন্য কি মন খারাপ? ও বলল হ্যা মন খারাপ।মনে মনে বললাম আল্লাহ সাহায্য কর!
দুদিন পরের ঘটনা।সারা'র সমবয়সী এক ইটালিয়ান মেয়ে,সামান্টা।আমার সাথে দেখা অনেক দিন পর।সামান্টা'র পরনে একটা একটা গেন্জি,মধ্যখানে বিশাল সাইজের একটা খুলি,তার নিচে বড় বড় করে লেখা "kick us"।আমি বললাম তোমার গেন্জিতে যে লিখাটা আছে তার অর্থ জান? ও উত্তর দিল না।
আজকে গুগল সার্চ করে জেনে নিও।
তোমার ভাল লাগে এই ছবিটা?(খুলি)
হ্যা,আমরা সব বেস্ট ফ্রেন্ডরা এই গেন্জি টা কিনেছি,এটা তো এখন ফ্যাশন।দেখেছো কেমন রক রক লাগছে আমাকে।আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে সামান্টা কথা গুলি আমাকে বলল।আমার মাথার ভিতর দুশ্চিন্তা ভয়াবহ আকারে ঘুরপাক খাচ্ছিল!এই সব ছেলেমেয়েদের সাথেই সারাদিন স্কুলে সময় কাটায় আমাদের ছেলে মেয়েরা,বিপথে মোড় নেয়ার যথেস্ট ভয় আছে!
বাসায় এসে ইয়াহু,গুগল সার্চ করলাম,বিষয়টা ভালভাবে ক্লিয়ার করার জন্য।অবাক হলাম,নোটিশ গুলি পড়ে !২০১২ সালের সেরা ফ্যাশন হল "খুলি"।শুধু পুরুষ আর মহিলাদের জন্য ই নয় বরং উঠতি বয়স হতে শুরু করে ছোট শিশুদের জন্য এই আইটেম বাদ পড়েনি।শুধু গেন্জি,প্যান্ট ই নয় জুতা,মাফলার ঘড়ি,ব্রেসলেট,আংটি,কানের দুল,ব্যাগ কিছুই বাদ পড়েনি।খুলি সব দখল করে নিয়েছে!
জার্মানির জনপ্রিয় ফ্যাশন ডিজাইনার Philipp Plein ২০১২ সালের এক ফ্যাশন জর্নালে যে বক্তব্য দিয়েছে খুলি সম্পর্কে ছোট একটা উক্তি দিলাম "they used the pirates, if n 'is the possession Rock' n 'roll. It has to do with freedom, with the pleasure of breaking the rules. "And also - we might add - with the taste to get a good laugh in the face of ... bad thoughts!"
আমরা বাবা মায়েরা আমাদের শুধু এতটুকু দায়িত্ব না যে ছেলে মেয়ে বড় করা,পড়াশোনা করানো,ভাল চাকরির খোঁজ দেয়া ।আমরা যদি ওদের আমাদের জীবন বিধান সম্পর্কে অবগত না করি, ইসলামিক অনুশাষন শিক্ষা না দেই, আমাদের ব্যবহারিক প্রাত্যহিক জীবনে কোরআন আর হাদিসের কথা গুলি ওদের না জানাই আমরা কি আল্লাহর কাছে জবাবদিহিতা থেকে রক্ষা পাব?আমাদের ছেলে মেয়েরা আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া বিরাট নিয়ামত।এই নিয়ামত কে আল্লাহর পথের সৈনিক হিসেবে তৈরী করে দেয়ার মিশন আমাদের!গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দেয়া কি মুসলিমের সাজে? ইউরোপের প্রেক্ষাপটে সন্তানদের সঠিকভাবে গড়ে তোলা সহজ হতে পারে কঠিন ও হতে পারে।আমার মেয়ের ১২ বছর বয়স,চেষ্টা করি ইসলামের প্রতিটি বিষয় নিয়ে ওর সাথে আলোচনা করতে ,শুধু নামায,রোজা,পর্দা করানো এর মাধ্যমেই তো ইসলামের পরিধি শেষ হয়ে যায় না,স্কুলে গিয়ে ওরা কাদের সাথে মিশে,সেরা বান্ধবী কাকে বানিয়েছে,মনের ভিতর কি লালন পালন করে সব কিছু খেয়াল করাই বাবা মায়ের দায়িত্ব, বিশেষ করে উঠতি বয়সের ছেলে মেয়েদের সাথে আরো বেশি সতর্ক দৃষ্টি রাখা প্রয়োজন।
আমাদের ছেলেমেয়েরা আজকাল অনেক কিছু কে হিরো বানায়,কেউ জনপ্রিয় কার্টুনের ব্যক্তিত্ব,কেউ কোন ফুটবলার,কেউ ক্রিকেটার,কেউ সিনেমার নায়ক নায়িকাকে।অথচ দুঃখের সাথে বলতে হয় মুসলিমদের হিরো হওয়া উচিত মুসা (আঃ),ইউসুফ(আঃ) ,ইবরাহীম(আঃ), মুহাম্মদ (সাঃ) এর ব্যক্তিত্ব,সাহাবীগনের ব্যক্তিত্ব।এ জন্য কি আমরা ই দায়ী নই?
ভাবতে ইচ্ছা করছে ইশ! এমন যদি হত সব ফ্যাশন কোম্পানী গুলি "I love islam","Proud to be a muslim", "I love mekka", "I love medina" এই কথা গুলি ব্রান্ড হিসেবে ছড়িয়ে পড়ত কতই না সুন্দর হতো!
পৃথিবীতে যত সৃষ্টি আছে তার মধ্যে শুধু মানুষের ই আছে ভাষার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশের ক্ষমতা। পোষাকের মাধ্যমে ও মনের ভাব প্রকাশিত হয়,ব্যক্তিত্বের বিকাশ হয় ।অবশ্যই সেটা নির্ভর করে কি ধরনের পোষাক পরিধান করি! মৃত মানুষের সিম্বল ব্যবহার করার মধ্যমে যে ভাব প্রকাশ হয় সেটার মাধ্যমে আমারা জীবিত রা কিসের সাক্ষ দেই?আমাদের জবাবদিহিতা কোথায়?কিসের সাক্ষীদাতা আমরা?
পরিশেষে একটাই দোআ
৪০) "হে আমার রব আমাকে নামায প্রতিষ্ঠাকারী করো এবং আমার বংশধরদের থেকেও ।হে পরওয়ারদিগার! আমার দোয়া কবুল করো
৪১) হে পরওয়াদিগার! যেদিন হিসেব কায়েম হবে সেদিন আমাকে, আমার পিতামাতাকে এবং সমস্ত মুমিনদেরকে মাফ করে দিয়ো৷”(সূরা ইবরাহীম)
বিষয়: বিবিধ
১৭৭২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন