লাল-সবুজের দেশে..
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ১৩ আগস্ট, ২০১৫, ০৯:১৩:১৭ রাত
"প্রবাসী' উপাধি লাভ করার পর প্রায় দশ বছরে বিশটি ঈদের আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়েছি । যতবার রমাদান আসতো মনের মণিকোঠায় আনন্দের পাশাপাশি সূক্ষ একটা দুঃখের রেশ রেখে যেতো । হারিয়ে যেতাম শৈশব , কৈশরের প্রাণচঞ্চল দিনগুলোতে! বাবা-মা আর ভাই-বোনদের নিয়ে আনন্দঘন সেই পরিবেশে ফিরে যেতে চাইতো দূরন্ত এই মন !
সবচাইতে বেশি খারাপ লাগতো ঈদের দিনগুলোতে। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠা , গোসল সেরে পাটভাংগা কাপড় পরা, সালামির জন্য উন্মুখ হয়ে থাকা, মায়ের হাতের রান্না করা সেমাই, পায়েশ-পিঠা …...উফ ! চোখ বুজলে এখনো বুঝি সেইদিন গুলোর সুবাস ভেসে আসে!
এই রমাদানে মায়ের সাথে এক সেহরী সময়ে কথা বলছিলাম। কি খাবেন, কি খাচ্ছেন এই নিয়ে কথা শেষ হওয়ার পর আচমকা খুব তীব্র এক টান অনুভব করলাম! মরুভূমির মতোন শুষ্ক মনে হলো বালুকাময় হৃদয়! মায়ের আদর পাওয়ার জন্য উতলা মনে মরুঝড় বইতে লাগলো! এক পলক দেখা, একটু খানি মায়া নেয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা আমার মনকে কোন কিছু থেকেই প্রবোধ করাতে পারছিলো না!
মনটা হয়ে উঠলো ইচ্ছেরানী সরকার। এ্তো এতো স্মৃতি মনে পড়তে লাগলো হুট করে, যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠছিলাম দিন কে দিন!
যেহেতু আগে থেকে দেশে যাওয়ার কোন প্রস্তুতি আমাদের ছিলো না তাই বেশ বেগ পেতে হলো! কেননা সময়টা হলো সামার টাইম এবং ঈদ সন্নিকটবর্তি । টিকিটের দাম আকাশচুম্বী। টিকিটের দাম দেখে নিরাশার কালো আঁধারে মন ঢেকে যাচ্ছিলো বারংবার!
দেশে যাওয়ার ইচ্ছেপ্রদীপটার আলো প্রায় নিভু নিভু এমনি এক বিকেলে আলাদীনের আশ্চর্য চেরাগের মতো পতিজ্বি হাজির হলেন টিকিট সমেত! আলহামদুলিল্লাহ বলে লাগেজ গুছানো শুরু করলাম কেননা মাত্র এক সপ্তাহ পড়েই উড়াল দেয়ার পালা.........
খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে সিদ্ধান্ত নিয়ে যাওয়া ফলে কেনাকাটার কোন পূর্ব প্রস্তুতি ছিল না! ভাগ্য খুবি সু প্রসন্ন ছিলো এজন্য যে আমাদের আশেপাশের ভাই বোনরা যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন এ ব্যাপারে। কিছুই নিব না, কিছুই কিনব না করেও আমার নির্ধারিত ওয়েট ওভারলোড হওয়ার প্রান্তে ছিলো! অবশেষে চড়াই উৎরাই পেড়িয়ে দিনটি ঘনিয়ে এলো চোখের পলকে …...
যেহেতু রমাদান মাস ছিলো তাই বাড়তি জার্নি যতটুক সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। ভ্রমণের জন্য এমিরাত এয়ারলাইনস পছন্দের তালিকায় শীর্ষে থাকলেও এমিরাতে যেতে হলে নিজের শহর ছেড়ে আরো ২৫০কি,মি দূরে যেতে হবে। অগত্যা নিজ শহর থেকে টার্কিশ এয়ারলাইন্সে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। টার্কিশে এবারই প্রথম যাওয়া তাছাড়া কারো কাছ থেকেই খুব একটা ভালো সংবাদ পাই নি ওদের ব্যাপারে , ডিলে করে যাওয়াটা নাকি খুব স্বাভাবিক এছাড়া আফরোজা গতবছর টার্কিশে যে ভোগান্তি সয়েছে তা জেনে মনে খুব শান্তি পাচ্ছিলাম না!
আল্লাহ ভরসা বলে লাল সবুজের দেশে আমার দীর্ঘ চার বছর পর আবারো উড়াল দেয়া......
টার্কিশ এয়ারলাইন্স সম্পর্কে ধারণাটা পাল্টানোর জন্য কি না বুঝলাম না প্লেন ঠিক সময়মতো আকাশের বুক চিড়ে ডানা মেলে উড়াল দিলো …...
সারি সারি মেঘের রাজ্য পাড়ি দিয়ে আমরাও ছুটে চললাম কাঙ্ক্ষিত সেই লক্ষ্য পানে......
দশ বছর আগে আমি যখন ইতালি আসি তখন এতোকম বাংলাদেশী দেখেছি কদাচিৎ দু এক জনকে রাস্তায় দেখতে পেতাম! তারপর স্পন্সরশিপের কল্যানে প্রচুর বাংলাদেশী চোখে পড়েছে শুধু রাস্তায় নয় বাসে উঠলে দু চার জন দেশী মানুষ পাওয়া যাবেই! এয়ারপোর্ট এসে পেয়ে গেলাম ৬টা বাংলাদেশী পরিবার। এরমধ্যে একজন আমাদের শহরের এবং আমার স্টুডেন্ট ছিলো।
জার্নিতে আমি কখনোই ঘুমাতে পারি না, এ বারেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। আশে পাশে তাকিয়ে দেখি পরিচিতজনেরা সবাই ঘুমের ঘোরে ভেংগে পরেছেন। অগত্যা কিছুক্ষণ বই পড়লাম, এরি মধ্যে পাশের সিটের ভাবী উঠে গেলেন এবং টুকটাক গল্প করলাম আমরা দুজনে! কথা বলার একজন সঙ্গী পেয়ে পুরো রাস্তাটা আমার ভালো কেটেছে আলহামদুলিল্লাহ !
তুর্কীতে ট্রানজিট ছিলো চার ঘন্টার। নেমে কিছুক্ষণ ঘুরলাম। বারবার দুবাই এর কথা মনে পড়ছিলো! এবং কেনো জানি না তুর্কী আমাকে ভীষণভাবে হতাশ করছিলো!
এবারে আমার পাশের সীটে যে বাংলাদেশি পরিবার আসলেন তাদের দেখে আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম! উনারা আমার টাইপ তো নন ই আচারে ব্যবহারে খুব ইংলিশ ভাব! লম্বা সময় একা চলতে হবে ভেবে কিছুটা বিষাদে ঘিরে ধরছিলো আমাকে! যতই ইংলিশ ভাব দেখাক হাজার হোক বাংগালীতো , মুসলিম তো বিষাদেও আমি হালকা হর্ষ শিখার আলোড়ন অনুভব করলাম! সালাম দিয়ে কথা বলতেই মহিলা খুব অমায়িক ভাবে আমার সাথে কথা শুরু করলেন। আমিও নিশ্চিত হলাম এত লম্বা সফরটা আমার কিছুটা হলেও কথা বলে কেটে যাবে! ( উনার সাথে কি কথা হয়েছে তা নিয়ে অন্য পোস্টে আসবে ইনশা আল্লাহ)
প্লেনের জানালার গ্লাস উঠিয়ে বারবার দেখছিলাম আর সময় মিলাচ্ছিলাম! অবশেষে প্লেন অবতরণ করতে লাগলো! উপর থেকে মায়া জড়ানো ছোট বাংলাদেশ দেখছিলাম! প্লেনের চাকা রানওয়ের মাটি ছুঁয়ে দিলে আল্লাহর নিকট শুকরিয়ার তাসবিহ পড়লাম! জানালা দিয়ে দেখছি আকাংখিত প্রিয় বাংলাদেশ! আমার দেশের মাটিতে এসেছি আমি! মনেহলো অদৃশ্য কোন এক মায়ার বাঁধন আমাকে জড়িয়ে আলিংগন করছে পরম মমতায়! কখন যে সেই মায়া বাঁধ ভাংগা জল হয়ে চোখের নদী অতিক্রম করেছে টের পর্যন্ত পেলাম না......
ইমিগ্রেশন পার হয়ে বেল্টে চলে আসলাম, খুব অল্প সময়ে আমাদের সব লাগেজ পেয়ে গেলাম। ধীরে এগিয়ে চললাম সামনের দিকে...
ল্যান্ডিং টাইম ছিলো ভোর সাড়ে পাঁচটা। রমাদান মাস এবং শেষ দশ দিন হওয়ায় আব্বা ইতিকাফে ছিলেন। আমার দুই ভাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন আমাদের জন্য!
ভাইয়াকে দেখেই ট্রলি রেখে দৌড়ে ভাইয়ার কাছে চলে আসলাম, ভাইয়া তো আগেই দু হাত উঁচু করে রেখেছিলেন আমাদের আদরের আলিংগনে জড়িয়ে নিতে...... সবসময় চোখের পানি কিন্তু কষ্টের কারণে আসে না! কিছু সময়ে অশ্রু ঝরে শুধু আনন্দের ফল্গু ধারায়..
গাড়ি ছুটলো, প্রথমেই আমরা মসজিদে গিয়ে আব্বার সাথে দেখা করলাম! আব্বা বসে তিলাওয়াত করছিলেন। উঠে দাঁড়ালেন, ঝাপিয়ে পড়লাম বাবার কোলে! আমার বাবা ছিলেন ভীষণ রকম দৃঢ়, প্রতাপশালী, ক্ষমতাবান মানুষ । কিন্তু আমার সেই বাবা বয়সের ভারে এতটাই নুয়ে আছেন, চুল দাড়ি সব পেকে একাকার! চামড়া ও কুঁচকে যাওয়ার প্রারম্ভে? আমি বেশিক্ষন তাকিয়েও থাকতে পারছিলাম না! চোখ ফেটে কান্না আসতে লাগলো! আব্বা আমাদের নিয়ে দুয়া করলেন! সুবহানাল্লাহ! এত সুন্দর কন্ঠে মোনাজাত করলেন আমার বহু বছরের তৃষিত মনকে মুহূর্তেই শীতল ঝর্ণাধারায় বিগলিত করে ফেললো......
ভাবছিলাম চার বছর আগে বাবা-মাকে দেখেছি, অথচ এই কয়েক বছরের ব্যবধানে উনাদের যে পরিবর্তন তা মেনে নিতে অনেক ক্ষ্টদায়ক মনে হচ্ছিলো। শুধু অনুশোচনা হচ্ছিলো আরো আগে আসা উচিত ছিল। ব্যথিত হৃদয়ে তবু এটুকু সান্তনা তবু তো আসতে পেরেছি আলহামদুলিল্লাহ!
বিষয়: বিবিধ
১৩৯০ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
স্বতস্ফুর্ত ও আন্তরিক মন্তব্যের জন্য শুকরিয়া!
০ তার মানে প্রবাসে থাকলে দেশের জন্য সবসময়ই খারাপ লাগতো ।
১.এত খারাপ লাগলে কি কারণে দেশে ফিরে যাচ্ছেন না ?
২.থাকার জন্য একেবারেই কি অযোগ্য ছিল এই দেশ ?
৩.আর কেউ কি দেশে থাকছে না ? কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সমস্যার মোকাবেলা করছে না ?
৪.যে বাবা মা আপনাকে লালন পালন করেছে শৈশব থেকে , তাদের প্রয়োজনের মুহূর্তে তাদেরকে ছেড়ে প্রবাসী হওয়াটা কি তাদের প্রতি দ্বায়িত্ব থেকে পালিয়ে থাকা নয় ?
৫. নাকি বাবা মায়ের জন্য প্রবাস থেকে কাড়ি কাড়ি টাকা পাঠাচ্ছেন বলে সেটাকে সবচেয়ে বড় দ্বায়িত্ব পালন বলে মনে করেন ?
আপনার অনুভূতি প্রকাশের জন্য শুকরিয়া! আল্লাহ আপনাডের ভালো রাখুন! দোআ ও শুভকামনা রইলো নিরন্তর!
ভালো লাগা প্রকাশের জন্য শুকরিয়া! দোআ ও শুভকামনা রইলো নিরন্তর!
আলহামদুলিল্লাহ ভালও আছি আপুজ্বি! তোমরা?
আলহামদুলিল্লাহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে একসাথে ছিলাম আনণ্দধারা বহিয়াছিলো ভূবনে ..
দোআ ও শুভকামনা রইলো তোমার জন্য!
আসলে প্রবাসীরা ঈদ মৌসুম গুলো খুবই বেদনায় পার করে....!! প্রবাসী ছাড়া একথা হয়তো কেউ অনুভব করতে পারেনা।
অনেক দিন পর ফিরে এসেছেন ব্লগে.... আশা করি নিয়মিত পাব ধন্যবাদ।
অনেকদিন পর কম্পিউটারের সামনে বসা ও লিখা তাই বেশ ভুগতে হচছে আমাকে, খুব স্লো হয়ে যাচ্ছে লিখা!
আসলে অনেকদিন সবার সাথে ঈদ করা হচ্ছিলো না, আমাদের বাচ্চারাও দেশের ঈদের আমেজ কখনো অনুভব করেনি -সব মিলিয়ে যাওয়া!
ইনশা আল্লাহ চেষ্টা করবো ভাই! অনুপ্রেরণা দেয়ার জন্য শুকরিয়া!
শুভকামনা রইলো
ইনশা আল্লাহ নিয়ত আছে ধীরে ধীরে সব লিখার! দোআ করবেন!
শুভকামনা জানবেন!
চট্টগ্রামের ঝড়-বৃস্টির কাহিনী জানার অপেক্ষায় রইলাম।
ইনশা আল্লাহ আপু লিখবো!
শুভকামনা জানবেন!
ভালো লাগলো ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
এতো স্বল্প সময়ের সিদ্ধান্তে গিয়েছি যে আপনাদের কাউকে বলে যেতে পারিনি! চিটাগং থাকা কালীন সময়ে আপনাদের কথা মনে পড়েছিলো স্পেশালী মেজবানী গোশত খাওয়ার সময়!
দোআ করবেন ভাই আমাদের জন্য!শুভকামনা জানবেন
সুখের নেইত শেষ
আমরা বলি জন্মভূমি
সোনার বাংলাদেশ।
দেশ ছাড়ার পরেই মায়াটা অনুভব করা শিখেছি!ভালো লাগা প্রকাশের জন্য শুকরিয়া! শুভকামনা রইলো নিরন্তর!
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
হটাৎ মায়ের কথা ও স্মৃতিগুলো মনে পড়ে দেশের জন্য মন অস্থির হওয়া, টিকিটের দাম প্রতিকূলে হওয়া সত্বেও আল্লাহর রহমতে আলাদিনের চেরাগের মত টিকিট নিয়ে হাজির হওয়া, প্রথমবারের মত তার্কিশে ভ্রমন করা, কথোপকথনের সঙ্গীনি মিলিয়ে যাওয়া, বন্দরে ভাইদের দিকে দৌড়ে যাওয়া অতঃপর সর্বপ্রথম বাবার সঙ্গে মসজিদে ইতেক্বাফে দোয়ায় শরীক হওয়া আল্লাহ তায়ালার মহান অনুগ্রহ আর দয়ায়ই সম্ভব।
সারাটি জীবন মহানপ্রভূ আপনাদের সবাইকে তার দয়ায় এভাবে ডুবিয়ে চুবিয়ে রাখুক।
রমজানে ভিজিটর হিসেবে মাঝে মাঝে ব্লগে আসা হত, কিছু আপনজনকে খুজে পাওয়া যাচ্ছিল না। বিশেষ করে কয়েকজন আপু ও খালামনি একেবারে অনুপস্থিত। রমজানে হয়তো সবাই ইবাদাতে মশগুল ছিলেন, কিন্তু রামাদানের পরেও অনেককে ফিরতে না দেখায় চিন্তিত ছিলাম।
আলহামদু লিল্লাহ শেষতক ফিরে এলেন, কিন্তু সন্ধাতারা এখনো মেঘে ঢেকে রইলেন। জানি না কবে মেঘ কাটবে।
এখন কি দেশে? নাকি প্রবাসে ফিরে গেছেন?
পরিবারের সবার প্রতি সালাম ও দোয়া রইল।
জাযাকাল্লাহ খাইর
ভীশন মনোযোগী পাঠক হিসেবে আসলেই আপনি তূলনাহীন!আল্লাহ আপনাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন!
আমি ফিরে এসেছি আলহামদুলিল্লাহ!মাত্র ২৩ দিনের সফর ছিলো!
সন্ধাতারা আপু আরো কিছু দিন ব্যস্ত থাকবেন! উনার সাথে কথা হয়েছিলো বেশ কিছু দিন আগে!
বারাকাল্লাহু ফিক! জান্নাতমণি ভালো তো?
আমার লিখায় আমাকেই কুইজ? ধরে নিলাম পেরেছি
ব্যস্ততার মাঝেও সময় করে পড়ার ও মন্তব্য করার জন্য আন্তরিক শুকরিয়া!
মন্তব্য করতে লগইন করুন