ইলিশমাছ এবং বৃষ্টিতে এক দম্পতি
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ২৮ এপ্রিল, ২০১৫, ০৮:৪৮:০৫ রাত
দুদিন ধরে ঝির ঝির টানা বৃষ্টি হচ্ছে! একেই বুঝি বলে ইলশে- গুঁড়ে বৃষ্টি! বেশ ঠান্ডা অনুভূতি! প্রকৃতি যেনো শীতের চাঁদরে মুড়িয়ে রেখেছে নিজেকে! যদিও এখন শীতকাল নয় , বরং শীতের বিদায় নেওয়ার ঘন্টা বাজছে! আর তাই বুঝি সমস্ত আকাশ জুড়ে মেঘেদের অভিমান বৃষ্টির জলে ভেসে আসছে!
বারান্দার কার্নিসে দাঁড়িয়ে নাজিয়া কথাগুলো আপনমনে ভাবছিলো! রান্নার মেন্যু কি হবে তাই ভাবতে ভাবতে বারান্দায় এসেছিলো সে! ঝুড়ি থেকে সব্জি নিতে গিয়ে ভাবলো, অনেকদিন সব্জি খিচুড়ি রান্না হয়নি! বৃষ্টির দিনে নরম করে সব্জি খিচুড়ি সাথে গরুর গোশত ! হুম! চমৎকার মেন্যু ভাবা মাত্রই রান্নার কাজে হাত লাগালো কারন কিছুক্ষনের মধ্যেই বাইরে একটা জরুরি কাজে বের হতে হবে তাঁকে !
শৈশব আর কৈশরের সেই সোনালীদিনগুলোর কথা মনে পড়লো নাজিয়ার! লুকিয়ে লুকিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে কতোই না বকা খেয়েছে সে! বাসার গেট সংলগ্ন পেয়ারা গাছে উঠে পেয়ারা খাওয়া আর বৃষ্টিতে ভিজে জ্বর আসার ঘটনা মনে হলে এখনো হাসি পায়! অথচ এখন বৃষ্টি পড়লে বাইরে বের হতেই ইচ্ছে করে না! সময়ের ব্যবধানে কতো বিশাল পরিবর্তন ঘটে যায় মানুষের ইচ্ছাগুলোর!
বাইরে তখনো রিমঝিম বৃষ্টি! এই বৃষ্টি উপভোগ করা যায় বিছানায় কম্বলের নিচে শুয়ে, জানালা থেকে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে, গরম ইলিশ ভাজা আর খিচুড়ি খেয়ে, অবসর বিকেলে আড্ডায় চা আর টোস্ট বিস্কিট দিয়ে! কিন্তু বৃষ্টির দিনে বাইরে বের হওয়া খুবি বিরক্তিকর নাজিয়ার কাছে! কারন এক হাতে ছাতা ধরে রাখা আর যদি বৃষ্টির সাথে বাতাসও থাকে তাহলে তো কথাই নেই! বোরখার নিচ পুরোটাই ভিজে একাকার হয়ে যায়! তারপরেও বের হতেই হলো!
কাজ শেষ করে ফেরার পথে বিল্ডিং এর নিচ থেকেই ইলিশ মাছ ভাজার সুঘ্রান পৌঁছলো নাজিয়ার নাকে! মনে মনে হাসলো নাজিয়া! একেই কি সুঘ্রানপ্যাথি বলে কিনা!
সালাম দিয়ে ঘরে ঢুকে পতির সন্ধানে বেড রুমে এলো! রুমে নেই তাহলে কি এখনো বাইরে থেকে ফিরে নি ? নাজিয়া কিচেন অভিমুখে রওয়ানা দিতে যাবে এমন সময় দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন সাজিদ! সালাম দিয়ে স্ত্রীকে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেতে ডাকলেন সাজিদ!
নাজিয়ার কাছে কিছু একটা গড়বড় লাগছে! কেমন একটা চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছিলো সাজিদের চেহারায় সেটা নজরে পড়েছে নাজিয়ার! কি হতে পারে ভাবতে ভাবতে কিচেনে এলো নাজিয়া! চোখ ভরা বিষ্ময় নিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো টেবিলে বিশাল সাইজের ইলিশমাছ ভাজা, সাথে শুকনো মরিচ আর পিঁয়াজ বেরেস্তা করা! এগুলো সব সাজিদ করেছে! আর পাশে রাখা আছে নাজিয়ার রান্না খিচুড়ি আর গোশত সব একসাথে করে টেবিল সাজিয়ে রেখেছে সাজিদ!
পতির দিকে তাকিয়ে হাসি মুখে বললো কখন করা হলো এতোসব? তোমার না আরো দেরিতে ফেরার কথা? আমি কতো তাড়াহুড়ো করে রান্না করে বাইরে গেলাম!
কাজটা শেষ হয়ে গেলো অল্প সময়ের মধ্যেই! বাজারে গিয়ে দেখলাম চমৎকার ইলিশ বেচারা ফ্রিজের মধ্যে বসে কাস্টমারের অপেক্ষায়! আমিও দেরি না করে কিনে ফেল্লাম! বাসায় এসে দেখি তুমিও ফিরছো না! গরম খিচুড়ি আর গোশতের সাথে ভাজা ইলিশ খারাপ লাগবে না! তাই আমি নিজেই করে ফেললাম তোমাক একটু সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য!
এজন্যই তো বলি বাইরে কেনো ইলিশের এতো সুঘ্রান পাচ্ছিলাম!
কথা বলতে বলতে খাচ্ছিলো দুজনে! এক প্রসংগে সাজিদ বললো আজকে আম্মার সাথে কথা হলে বলবে ইলিশ মাছ খেয়েছি আমরা!
ভ্রু কুঁচকে নাজিয়া জিজ্ঞেস করলো, আম্মাকে বলার মতো কি এতো গুরুত্বপূর্ন হলো এটা?
না মানে, জানা উচিত আমরাও প্রবাসে বসে দেশের জিনিষ খাই! শ্বাশুড়ি আম্মাতো মনে করেন উনার আদরের কন্যাকে বুঝি কতো দেশি খাবার থেকে বঞ্চিত করা হয়!
এই, আম্মা তোমাকে কবে বললো এই কথা শুনি! কৃত্রিম রাগ প্রকাশ পায় নাজিয়ার স্বরে!
ওভাবে বলেনি , তবে যেভাবে তোমাকে জিজ্ঞেস করে কি খাও , না খাও মনে করে আমরা বুঝি খুবি কষ্টে দিনাতিপাত করছি আমরা! বেচারা জামাই বুঝি অর্থাভাবে কেমন করে চলে?
দূর থেকে সবাই ওরকম টেনশন করেই। তোমার বোনরাও তো করে তাই না?
হুম করে তা ঠিক! যদি কথা বলো আজকে তাহলে বলবে যে ইলিশ মাছ খেয়েছি সেটা উনাদের জামাইবাবা বাইশশো টাকা দিয়ে কিনে এনেছে!
খাওয়া বন্ধ করে নাজিয়া এবার তাকায় সাজিদের দিকে! বাইশশো টাকা মানে কি?
মানে বাইশ ইউরো! হেসে জবাব দেয় সাজিদ!
মুহূর্তেই জ্বলে উঠলো গিন্নী, তুমি এতো দাম দিয়ে ইলিশ কিনেছো?
আরে একি! তুমি এমন ভাব করছো আমি জীবনে কিছু কিনি না!
তুমি সব কিছুই কিনো কিন্তু তাই বলে এই কাঁটা ওয়ালা ইলিশ তুমি বাইশ ইউরো দিয়ে কিনবে?
আরে কাঁটা ওয়ালা কই? কি সুন্দর বিশাল সাইজের ইলিশ! নিচ থেকে পর্যন্ত সুবাস পেয়েছো আর এখন বলছো পঁচা মাছ! একি খাওয়া বন্ধ কেনো? খাও আর আলোচনা করো- হাসতে হাসতে বলে সাজিদ!
দাম শুনে আমার খাওয়ার রুচি শেষ! তা এতো দামি মাছ কয় পিস হলো সব মিলিয়ে ?
মাথা লেজ বাদ দিয়ে আট পিস! শোনো বাকিগুলো দিয়ে একদিন রান্না করবে সরিষা ইলিশ, আরেকদিন ইলিশ পোলাও, একদিন লাউপাতা জড়িয়ে ইলিশ, কান মাথা লেজ দিয়ে পুঁইশাক বুঝেছো! আরে খাও তো , এমন কিপ্টা বউ আর দেখিনি!
তোমার ইলিশ খেতে ইচ্ছে করলো যে হঠাৎ!
আচ্ছা আমরা লাস্ট কবে ইলিশ খেয়েছি মনে আছে তোমার?
মাথা ঝাঁকিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো নাজিয়া , দেড় বছর আগে! স্পেনের মেহমান যখন আসলো তখন!
এবার দেখো, দেড় বছর পরে একটা ইলিশ কিনলাম আর তুমি ঝগড়া শুরু করলে আমার সাথে! আমাকে কি না খাইয়ে রাখতে চাও নাকি তুমি? বলতে বলতে আরো একবার খিচুড়ি নিলো সাজিদ!
কি আশ্চর্য আমি আবার কবে না খাইয়ে রাখলাম তোমাকে! আমি শুধু অতিরিক্ত দামী জিনিষ কেনার বিপক্ষে! আ্যল্টারনেট অনেক কিছু আছে যা দিয়ে ইলিশের বিকল্প হয়!
মোটেই না ইলিশের কোন বিকল্প নেই! তালগাছ উনার এমন মনোভাব সাজিদের!
আচ্ছা ঠিক আছে , তুমি রাইট! ঠিক আছে এবার খাও! তুমি দুই পিস খাও! এতো দামের মাছ ভালো করে খাও! তারপরেও বউকে আর অপবাদ দিও না !
খাওয়া শেষে বেসিনে জমানো প্লেট ধুতে লাগলো নাজিয়া! সাজিদ চুলায় চা বসালো! চা বানানো হলে দুজনে বারান্দায় এলো গরম ধূমায়িত চা নিয়ে সাথে ! অপলক বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রইলো নাজিয়া! সাজিদ সেই ধ্যান ভাংগালো-
কি ভাবছো এতো?
বৃষ্টিতে দোআ কবুল হয় তাই ভাবছিলাম! বাসার সবার কথা মনে পড়ে গেলো! সবার জন্য দোআ করলাম! বৃষ্টিও নিয়ামত! শুধু ইলিশ আর খিচুড়ি খেলে হবে? দোআ করাটাও তো জরুরি!
কাঁধ ঝাকিয়ে সম্মতি দেয় সাজিদ!
তখনো বৃষ্টি পড়ছে বাইরে! তবে বেশ পরিষ্কার নীলাকাশ ! সবুজ গাছপালাগুলো বৃষ্টিতে স্নাত হয়ে আরো চির সবুজ রং ধারন করেছে! এর মাঝে দুই পতি পত্নী ধূমায়িত চা পানে মগ্ন হয়ে উঠলো!
বিষয়: বিবিধ
২০৯০ বার পঠিত, ৪১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
শুকরিয়া ভাইয়া!
শুকরিয়া আপানাকে নিমু ভাই!
মনে মনে ভাবছি আর হাসছি ছোট আপির খাওয়ার আয়োজনের সাথে কী অদ্ভুত মিল!! সুন্দর অনুভূতির মিষ্টি গল্পটি শেয়ার করার জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর আপিম্নি।
পড়া এবং মন্তব্যের জন্য শুকরিয়া আপুনি!
পড়তে যে ইচ্ছে করছে না আপু
শুকরিয়া!
আসলেই কি তাই আপু ?
এবং
আপনার সৌজন্যে আপু! শুকরিয়া
চমৎকার দোআ সম্বলিত মন্তব্য এবং আপনার উপস্থিতি দুটোতেই অনেক আনন্দিতো হলাম! শুকরিয়া আপনাকে!বারাকাল্লাহু ফিক!
আপনাকেও আন্তরিক শুকরিয়া
? ? ?
ভাপু = ভাইয়া + আপু এখন যেটাই হওনা কেনো!
একটা টিপস দিই। ইলিশ মাছ ভাজার পরে যে তেল থাকবে তাতে করলা ভাজুন। করলাভাজিটা খেতে অসাধারণ টেস্ট হবে।
দোকানদারকে বলতে হবে ইলিশের সাথে করলা ফ্রি দেন কারন বাসায় হয় ইলিশ থাকে করলা নাই, নয় করলা আছে ইলিশ নাই!
সামনের বার আমি অবশ্যই ট্রাই করবো ইনশা আল্লাহ কারন করলা আমার খুবি পছন্দের সব্জি!
জাযাকাল্লাহু খাইর আপনাকে চমৎকার টিপসটি দেয়ার জন্য ! শুকরিয়া
আচ্ছা আপু এমন গল্পকি বাস্তবে সম্ভব?
বাস্তবে সম্ভব হলে বর কনেকে কতটা রোমান্টিক হতে হয়?
ইশশ কি মিত্তি লেখা
গত ইদুল ফিতরে মামা বাড়িতে গিয়েছিলাম মামা আস্ত ইলিশ ভাজা দিয়েছিলেন খেতে।
এবার আমার একবন্ধু একটা ইলিশের চারটা পিস কিনেছে ৬হাজার টাকায়। একটুকরা ইলিশ ১৫০০টাকা আমিতো বড় বড় চোখ করে তাকিয়েছিলাম ৬হাজার টাকা!!!!!!!
১৫০০টাকা দিয়ে মাছের একটা খন্ড?!!!!!!
যাইহোক সে সেটিসফাইড।
আপু আপনার বাড়িতে রান্নাঘড়ের হাড়িতে চায়ের কাপে আমার এবং আমার ইয়ের দাওয়াত রইলো অগ্রিম দাওয়াত। জাজাকাল্লাহ খুব ভালো লাগলো।
৬হাজার টাকায় ইলিশ কিনলে আমি ইসটোক করতাম ! খাওয়ার জন্য মানুষ তাহলে এতো ব্যয় করে? জানা ছিলো না!
তোমাদের দাওয়ত কনফার্ম করা হলো! হাড়িতে চা ফুটছে তো ইয়ের খবর কি? কোথায় আছেন উনি )
বারাকাল্লাহু ফিক!
পুরা একটা ইলিশ না
একাতো সাবার করেছি যতটুকু মনে আছে অন্য ইলিশেও ভাগ বসিয়েছি।
বুঝতে হবেতো খাওয়াতো ভাইয়ের ছোট ভাই আমি।
শুধু শুধুই কি আপনার হাড়িতে অভিজান চালানোর কথা বলেছি?!
আপনার আর দুলাভাইয়ের গল্প বুঝি এতই রসিক হয়। আমৃত্যু আপনাদের ভালোবাসা অটুট থাকুক। ভাগীনি ও ভাগীনার প্রতি দোয়া রইল, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে মানুষের মত মানুষ হিবাসে কবুল করুক। আমার জন্য দোয়া করবেন। জাযাকিল্লাহ খাইর।
অতি উত্তম দোআর জন্য শুকরিয়া! আপাদের জন্যেও অনুরুপ দোয়া রইলো! ভাগীনি ও ভাগীনার দোআ যথাস্থানে পৌঁছে দিয়েছে! সালাম গ্রহন করবেন! ফি আমানিল্লাহ! বারাকাল্লাহু ফিক!
আপনার খাবারে ছবিতে তেলাপোকা হোয়াইইইই
স্লেভ ভাই একমাত্র তেলাপোকা ইটকরে আপনি কবে থেকে স্টারর্ট কোরলেন
আমিতো ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!
আপনার দুষ্টামিবুদ্ধির প্রশংসা না করলেই নয়!
শুকরিয়া হাজিরা দেয়ার জন্য!
মন্তব্য করতে লগইন করুন