একদিন বনভোজনে
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ২২ এপ্রিল, ২০১৫, ০৭:১০:৩৩ সন্ধ্যা
স্বদেশের কথা ভাবতেই যে সবুজ খন্ডটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে তা হলো আমাদের বেড়ে ওঠার চির সুন্দর স্থানটি!
আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা এমনকি বিয়েও এই কলোনীতে হয়েছে। কলোনীর নাম দিলাম "পলাশ" । বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে সবুজ কলোনী যার ভিতরেই রয়েছে দুটো মসজিদ, স্কুল এবং কলেজ! কড়া নিরাপত্তা বেস্টিত কলোনীতে বাইরে থেকে মানুষ প্রবেশের ব্যাপারে ছিল খুব কড়াকড়ি নিয়ম!
এই কলোনীর নীল আকাশ যা দেখে প্রথম বার আমার ইচ্ছে হয়েছিলো পাখির মতোন রংগিন ঘুড়ি হয়ে উড়ে বেরাতে, সবুজ জমীনে উচ্ছল প্রজাপতি হয়ে স্বপ্ন কুড়াতে!
আমাদের সমবয়সী বান্ধবীরা সবাই খুব কাছাকাছি থাকতাম! পাশাপাশি বিল্ডিং এ থাকার কারনে সকালে উঠে সবাই একসাথে মক্তবে যাওয়া, সুর করে সূরা, দোআ পড়া, স্কুলে যাওয়া আসা,বিকেলে খেলাধূলা সব একসাথে হতো!
মক্তবে কায়দা থেকে আমপারায় উঠলে বিস্কিট নিয়ে যেতাম, আর আমপারা থেকে কোরআন শরীফ নিলে মিস্টি! সেদিন খুব এক্সাইটেড থাকতাম কারন নিজ হাতে সবাইকে মিস্টি বিতরন করা , উস্তাদের কাছে প্রথম সবক পড়া সবমিলিয়ে খুবি আনন্দঘন মুহূর্ত ছিলো সেদিনগুলো!
সকালের মক্তব শেষে আবারো স্কুলে যেতাম একসাথে দল বেঁধে !ক্লাসে আমাদের নির্দিষ্ট জায়গা থাকতো কে কার সাথে কোন বেন্চে বসবো তা নিয়ে! স্কুলের সামনে বসতো হজমি ওয়ালা চাচা! বাদাম আর হজমি ছিলো আমাদের সবার প্রিয়! ইশ কি পরিমানে খেয়েছি আর টিচার থেকে শুরু করে আম্মার বকা খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই! স্কুলের সেই ঘন্ট বাজার শব্দ আজো কানে ভেসে আসে!
তখন আমরা মনে হয় ক্লাস টুতে পড়ি! সবার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ! ডিসেম্বর মাস কনকনে শীত পড়েছিলো! উদ্যোগ নেয়া হলো সবাই মিলে বনভোজন করবো! বনে তো যাওয়া যাচ্ছে না তাই সিদ্ধান্ত হলো ছাদের উপর রান্না হবে। রান্না করে দিবেন আমাদের সিনিয়ার আপুরা! রান্না হবে সব্জি খিঁচুড়ি! সবাই তো খুব খুশি! সবাই যার যার বাসা থেকে একটু চাল, ডাল, পেঁয়াজ, লবন,তেল নিয়ে আসলাম। সবাই যেহেতু বাগান করতাম সাথে ছিলো বাগানের তাজা সব্জি!
সবাই মিলে সব কিছু নিয়ে ছাদের উপর উঠলাম আমরা! বিশাল এক পাতিল আনা হলো! খুঁজে কয়েকটা ইট আনলাম চুলা বানানোর জন্য! এবার লাকড়ি খোঁজার পালা! আবার দে ছুট! সবাই মিলে শুকনো পাতা, লাকড়ি, খালাম্মাদের বাগানের মাচা থেকে পাটকাঠি, শুকনা ডাল যে যা পেরেছি সব নিয়ে এসেছিলাম! পরে অবশ্য মাচা ভাংগার দায় আমাদের সবার কাঁধেই এসেছিলো!
আপুরা বিজ্ঞ রাঁধুনীর মতোন রান্না করছিলেন! বড় আপুরা সবাই সাহয্য করছিলো! আমাদের দায়িত্ব ছিলো শুধু চাল , ডাল আর লাকড়ি জোগাড় করে দেয়া! এবার আপুরা আমাদের সবাইকে বাসা থেকে গোসল করে ফ্রশ হয়ে প্লেট নিয়ে আসতে বললেন!
সবাই তো এমনিতেই বাগানে বাগানে , গাছের নিচে ঘুরে চেহারাটাই জংলা করে ফেলেছিলাম! প্রচন্ড উৎকন্ঠা আর সীমাহীন আগ্রহ নিয়ে বাসায় এসে গোসল করলাম! সুন্দর জামা পড়লাম! শোকেজ থেকে কাঁচের প্লেট নামালাম! আমাদের আগ্রহ দেখে আমাদের মায়েরাও খুব খুশি ছিলেন! তাই চেহারা যতই জংলা হোক না কেনো একদিনের জন্য কিছু বলেন নি!
সবাই সবাইকে ডাকাডাকি করে একসাথে হয়ে ছাদে উঠলাম! ততক্ষনে আপুদের খিঁচুড়ি রান্না শেস! আরো কিছু বান্ধবীদের আসা তখনো বাকি তাই আমরা অপেক্ষা করছিলাম! সবাই গ্যাসের চুলায় রান্না খেয়ে অভ্যস্থ তাই এবারের লাকড়ির রান্নাতে এমনিতেই আমাদের সবার প্রচন্ড কৌতুহল ছিলো! আর লাকড়ির আগুনের ধোঁয়া কি এক লোভনীয় খাবারের আয়েশ সৃষ্টি করেছিলো সেই ধোঁয়ার ঘ্রানে খিঁচুড়ির লোভে পেটের ভিতর তো অবিরাম চক্কর অনুভব করছিলাম!
অবশেষে আমরা সবাই গোল হয়ে আমাদের প্লেট নিয়ে বসলাম! যে আপু রান্না করেছেন তিনি বিশাল পাতিল নামিয়ে মাঝখানে এনে রাখলেন! আমরা সবাই উঠে পাতিলের চারিদিকে ঘিরে দাঁড়ালাম! ঢাকনা খোলা হলে তো ইয়াম্মি খিঁচুড়ির অসাধারন সুঘ্রান এসে নাকে লাগলো! সবাই আরেকটু ঘ্রান পাওয়ার আশায় আরো কাছাকাছি এসে দাঁড়ালাম!
নিঃশ্বাস প্রশস্থ করে আরো বেশি করে খিঁচুড়ির সুঘ্রান নিতে লাগলাম! এক জনের দেখাদেখি আরেক জন ,ধীরে ধীরে সবাই এরকম করতে লাগলো! শীতকাল বলে কয়েকজনেরই সর্দি ছিলো! এখানেই ঘটে গেলো ভয়াবহ দুর্ঘটনা! একজন খিঁচুড়ির ঘ্রান নিতে গিয়ে যেই নিঃশ্বাস ছেড়েছে, সেই নিঃশ্বাসের সাথে সাথে নাকের ভিতরের পাতলা মূল্যবান পদার্থ বেরিয়ে একেবারে গরম খিঁচুড়ির ভিতর গিয়ে পড়লো! সবাই সমস্বরে চিৎকার - নাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআা! ?
আমাদের দুঃখে চুলার গমগম আগুনও বুঝি নিভে যায়! নীল আকাশের রংগিন ঘুড়িও ছিটকে মাটিতে পড়ে যায়! সবুজ জমীনের উচ্ছল প্রজাপতিও ডানাভেংগে আহত হয়ে গেলো! এবার আমাদের চোখের পানি কে দেখে!
প্রচন্ড ক্ষুদা থাকা সত্ত্বেও ঐ খিঁচুড়ি আমরা কেউ খেতে চাইলাম না! আমাদের ভিকটিম বান্ধবী তো লজ্জায় মরি মরি হয়ে কখন যে পালান দিয়েছে! কি আর করা আপুরা বললে সবাই প্লট নিয়ে যার যার বাসায় চলে যাও! আমরা পরে আবার বনভোজন করব!
চোখের পানি মুছতে মুছতে সবাই বাসায় আসলাম! আমাদের চেহারা দেখেই আম্মাজানেরা আন্দাজ করেছিলেন কুছ গড়বড় হো গেয়া! যাই হোক অবশেষে মায়ের হাতের গ্যাসের চুলার রান্না খেয়েই সেদিনের ক্ষুদা মিটিয়েছিলাম সবাই!
সেই বান্ধবীর পরিবার সব শুনে পরদিন আমাদের সবাইকে খুঁচুড়ির দাওয়াত দিলেন সাথে ছিলো গরুর গোশত! ছাদে বসে বনভোজন না হলেও বারান্দায় বসে খালাম্মার রান্না সম্মিলিতাভবে সবার একসাথে খাওয়ার সেই সুমধুর স্মৃতি এখনো মনের পাতায় চির অমলিন হয়ে আছে!
(কলোনী লাইফের স্মৃতি!)
বিষয়: বিবিধ
১৮৬৯ বার পঠিত, ৩৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক দি পর মনে পড়লো তাই লিখে ফেললাম! সবসময় সিরিয়াস লিখা লিখতে একটু বিরতি নিলাম!
জাযাকিল্লাহু খাইর
পুরোনো দিনগুলোর কথা আসলেই অন্যরকম ভালোলাগয় পরিপূর্ন! আপনাদের কথা জেনেও ভালো লাগলো!
জাযাকাল্লাহু খাইর!
যাহোক পরিশেষে দুধের স্বাদ ঘোলে মিটিয়ে মনের ও পেটের অতৃপ্ত ক্ষুধা নিবারণ করেছো জেনে বড়ই আনন্দিত হলাম। মজাদার লিখাটি শেয়ার করার জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর আপু।
আপু যতবার আমার ঘটনাটি মনে হয় আমিও প্রচুর হাসি! রোনো দিনগুলোর কথা আসলেই অন্যরকম ভালোলাগয় পরিপূর্ন! আপনাকে সামান্য বিনোদন দিতে পেরেছি তাতেও আমি বেজায় আনন্দিত!
জাযাকিল্লাহু খাইর!
জাযাকাল্লাহু খাইর!
কি আর বলবো!
সবসময় সাবধান থাকি সুগন্ধ নেয়ার ব্যাপারে! আপনারাও থাকবেন
জাযাকাল্লাহু খাইর!
আপনার ভালোলাগাতে আমিও আনন্দিত! জাযাকিল্লাহু খাইর!
আপনার অতীত জেনে অনেক ভালো লাগলো।
খুব পড়তে ইচ্ছে হচ্ছে আপনার শৈশবকাহন! লিখে ফেলুন সময় করে একদিন!
আপনার সুক্ষ দৃষ্টির প্রশংসা না করে পারা যায় না! সব কিছু নিখুত ভাবে পড়েন আপনি!
জাযাকাল্লাহু খাইর!
আমরাও দেশে যত জায়গায় ছিলাম কলোনীতে ছিলাম। অফিস থেকেই নির্দিষ্ট বাসা বরাদ্ধ ছিল । প্রতি বছর জানুয়ারীতে স্কুলের পিকনিক, কলোনীর পিকনিক এসব মিলে অনেকগুলো পিকনিক এ যাওয়া হত
ভালো লাগলো আপনার স্মৃতিচারণ
জ্বি আপু ! বান্ধবীর কথা এখনো মনে পড়ে! আমরা ছোট থাকতেই ওরা ট্রান্সফার হয়ে চলে যায়, তখন ছোট ছিলাম, মোবাইলের যুগও ছিল না তাই আর যোগাযোগ হয়নি!
কলোনী লাইফের মজাই আলাদা আপু! সবাই খুব আপন!পড়ার জন্য শুকরিয়া! জাযাকিল্লাহু খাইর!
সমস্বরে চিৎকার - নাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআা!
চিৎকার কোরতে অনেক কষ্ট হয়েছে তাই না
শুকরিয়া!
জ্বি ভাইয়া, অতি দুঃখের সাথে চোখের পানি মুছতে মুছতে সেখানেই ইতি টানতে হয়েছিলো!
শুকরিয়া ভাইয়া!
শুকরিয়া তোমাকে! কিছুটা হলেও বিনোদিত হয়েছো!
নীলখেত নীলখেত
শুকরিয়া ভাই বনভোজনে অংশগ্রহনকরার জন্য!
মন্তব্য করতে লগইন করুন