ইশিতার সংসারের ইতিবৃত্তি- শেষ পর্ব।
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ০৬ মার্চ, ২০১৫, ০৮:০৮:২৬ রাত
সময় বসে থাকে নি,বহতা নদীর মতোই বয়ে চলেছে। দিন, মাস, বছর গড়িয়ে ইশিতা-মানিকের দাম্পত্য জীবনের বয়স ৪ বছরে পা দিয়েছে। ভালো না থেকেও ভালো থাকার অভিনয় করাটা ইশিতার স্বভাবে পরিনত হয়ে গেছে! জীবনে খুব বেশি কি চাওয়া পাওয়া ছিল ইশিতার?
বাস্তবতা অত্যন্ত নির্মম ভাবেই চেহারা ইন্মোচন করেছে ইশিতার সামনে! এই সংসারে সব কিছু আছে, শুধু সুখটুকু নেই! সুখের সেই শান্তির সাদা পায়রা আদৌ কি কোনদিন ইশিতার কুটির দেখা দিবে?
ইশিতা যতবার বাবার বাসায় গিয়েছে ওর মা, খালা, ফুফু
সবাই ওকে বোঝাতো শুধু ধৈর্য ধরতে! সবার পরামর্শ ছিলো শুধু চুপ করে থাকার, নামাজ পড়ার, ইসলামি বই পড়ার! ইশিতা চুপচাপ শুনতো! অবাক হতো মানুষের জীবনে যখন শুধু সমস্যা আসে তখন সবাই এতো উপদেশ দেয় অথচ এই উপদেশগুলো স্মরনে রেখে যদি প্রতিটা কাজ আগে থেকেই শুরু করা যেতো জীবনটা এতো জটিল হতো না! আর যাদের জীবনে ইসলামই নেই, ইসলামের কিছুই যারা মানে না সেখানে ঠিক কতখানি উপকারে আসে?
মানিককে অনেক বুঝিয়েছে ইশিতা, তুমি এভাবে আর কতো দিন কাটাবে? বাসা ভাড়া, দোকান ভাড়া উঠিয়ে যে জীবন যাপন করছো তাতে এখন কোন সমস্যা নেই! কিন্তু ভবিষ্যতে কি হবে? আমাদের সন্তানদের বাবা কি করে- এর কি উত্তর হবে? এভাবে সারাদিন ঘুমানো, সারা রাত আড্ডা দেয়া অলস বেকার জীবন যাপন করা আর কতো দিন করবে তুমি? মানিক করি করছি করবো, সব ঠিক হয়ে যাবে এই শুধু উত্তর দেয় কিন্তু কিছুই হয় না!
দুর্ভাবনায়- পেরেশানীতে- অনিদ্রায় অনেক রাত কাটিয়েছে ইশিতা, ভেবে ভেবে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে নিজের জীবনের কূল খুঁজতে গিয়ে! দুটো পথ দেখতে পেয়েছে সামনে। এক- ডিভোর্স নেয়া, দুই- সব কিছু হজম করে সহ্য করা! ডিভোর্স ওর কাছে কোন সমাধান মনে হয়নি! এটা হতো পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া! আর কি ই বা হতো? ওকে আবার অন্য কাউকেই বিয়ে করতে হতো!
সব কিছু হজম করা যদিও অনেক কষ্টসাধ্য তবু এটাই সমস্যার সমাধানের পথ! পালিয়ে না গিয়ে বরং বিপদ মোকাবেলা করে যদি হেরেও যাওয়া হয় তারপরো কিছুটা সান্তনা পাওয়া যাবে!
অনাকাংখিত ভাবেই ইশিতা শ্বাশুড়ির একটা কথা শুনে ফেললো। ওর শ্বাশুড়ি বলছিলো, ইশিতা এজন্যই বাচ্চা নিতে চায় যেনো উত্তরাধিকারী পাওয়া যায় এ বাড়ির! বাড়ি,টাকা পয়সা আর সম্পত্তির লোভেই নাকি ওর বাচ্চার শখ জেগেছিলো! আর সহ্য করতে পারে নি ইশিতা, শ্বাশুড়িকে সামনা সমনি বলেছিলো আপনি এরকম একটা কথা বলতে পারলেন আমার সম্পর্কে? আমার কোন আচরন আপনাকে লোভী প্রতিপন্ন করছে? এক কথা দুই কথা ঝগড়া ফলাফল শোচনীয় অবস্থায় মোড় নেয়!
একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে এই দুরাশায় বুকে পাথর বেঁধে সব যাতনা নিরবে সহ্য করে যাচ্ছিলো, হতাশ হতে হতে আবারো আশার আলোয় স্বপ্ন দেখেছে! সেখানে শেষ পর্যন্ত এই অপবাদ নিতে হলো! ওর শ্বাশুড়ি এই ভাবতো ওকে, ও মা হয়ে সম্পত্তির মালিক হয়ে মানিক কে ডিভোর্স দিয়ে সব ওর নামে লিখিয়ে নিতো? মানুষ এতো নিচু চিন্তা করে কিভাবে?
মানিকের সামনেই ঘটেছে দুর্ঘটনা! ইশিতা শুধু বললো, তুমি চেয়ে চে্যে দেখো আমাকে আর কতো ভাবে অপমান করা বাকি আছে? সমস্ত কষ্ট আমি একা একা বহন করে চলছি তুমি শুধু নিরব শ্রোতা! তোমার জীবনে আমার প্রয়োজন কতটুকু সেটা বোঝা হয়ে গেছে আমার। তুমি সিদ্ধান্ত নাও কি করবে! আমি মা হতে চাই আমার অধিকার তুমি ফিরিয়ে দাও!
ইশিতা চলে এসেছিলো বাবার বাড়ি! মানিকের কোন পরিবর্তন নেই! ইশিতার বাবা সমাধানের জন্য বসলে, ওর শ্বাশুড়ি সরাসরি ডিভোর্সের কথাই বললেন। ডানা ভাংগা পাখির মতোন আহত হয়েই বাড়ি ফিরেছিলেন মিজান সাহেব!
দুই পক্ষই নিরবতা পালন করছিলো ! অপেক্ষমান কোন পক্ষ উদ্যোগ নিবে ডিভোর্সের! ইশিতা সম্পূর্ন দায়ভার ওদের উপর ছেড়ে দিলো!
তিন মাস পার হয়ে যায়! একদিন সকালে হঠাৎ মানিক আর তার বাবা এসে হাজির। ইশিতা ভাবলো বালির প্রাসাদ গুড়িয়ে যাওয়ার প্রান্তিক সময় বুঝি চলেই এলো...........
দেড়ঘন্টা ধরে আলাপ আলোচনা চললো ঐ ঘরে! ইশিতা চুপচাপ নিজের রুমে বসে অতীতকেই ভাবছিলো! কত শখ, স্বপ্ন আর আশা নিয়ে বড়লোক ছেলের কাছে ইশিতাকে বিয়ে দিয়েছিলেন ওর বাবা! সব কিছু ছিলো ঐ সংসারে! শুধু ছিলনা মানবিক অধিকার! বদ্ধ সংকীর্ন কিছু ধ্যান ধারনায় আবদ্ধ ছিলো ঐ বাড়ির মানুষগুলি! ইশিতা কেনো গুলো মেনে নিতে পারলো না? মেনে নিলেই তো সমস্যার সমাধান হতো! কিন্তু ইশিতা সেটা পারেনি! সে চেয়েছিলো একটা সুস্থ সুন্দর জীবন!
দরজা খুলে রুমে ঢুকে মানিক বললো,আমি তোমাকে নিতে এসেছি ইশিতা! রেডি হয়ে নাও! ইশিতা উঠে দাঁড়ায়, চোখের কোনে আনন্দাশ্রু চিক চিক করে উঠলো ইশিতার..
মানিক বললো, জিগগেস করলা না কোথায়?
কেন বাড়িতেই তো!
নাহ! সেন্টমার্টিন! নতুন সূর্যোদয় দিয়ে নতুন করে সব কিছু শুরু করতে চাই! তারপর সেখান থেকে আমরা আালাদা বাসা নিব! আর কোন সমস্যা হবে না!
আমিতো চাই নি আলাদা হতে। শুধু দুটো জিনিস চেয়েছি তোমার কাছে। তুমি স্বাবলম্বী হও আর আমাকে একটি স্পেশাল গিফট দাও! বলতে গিয়ে জড়িয়ে আসে ইশিতার গলাটা!
বিজয়ী হয়েছো তুমি! তোমার দাবী পূরনের নিউ কন্ট্রাক্ট নিয়েই এসেছি আমি! হাসতে হাসতে ইশিতাকে জড়িয়ে ধরে বললো মানিক।
পথে পথে মানিক বলছিলো, দীর্ঘ তিনটা মাস কতো কঠিন সময় পার করেছে সে! ইশিতা চলে যাবে এই ভয় ওকে ক্রমাগত তাড়িয়েছে!অনেক কষ্ট পেলেও জীবনের কঠিন সিদ্ধন্ত নিতেও সমর্থ হয়েছে সে! সে নতুন বাসা নিয়ে এসেছে। ওর বাবা সব ঠিক করে দিয়েছেন। মা কোনো অমত করেন নি !কিছু দিনের মধ্যেই ফার্নিচার উঠে যাবে! বাবা ব্যবসার জন্য টাকা দিয়ছেন আর ইতিমধ্যেই কাজ শুরু করে দিয়েছে মানিক!
ইশিতা ভাবছিলো চার বছরে এই প্রথম ওরা একসাথে বের হচ্ছে দুজন একাকী নিরিবিলি সময় কাটাতে! এইটুকু সিদ্ধান্ত নিতে ওর এত সময় লাগলো! যাক বুঝতে তো পেরেছে অবশেষে!
ইশিতা বললো- আমরা নতুন বাসায় উঠবো না! তুমি না করে দাও! আমরা আমাদের আগের বাসাতেই ভালো থাকব!
মানিক বিষ্মিত হয়, ভালোও লাগে ওর কাছে!
ঝিকঝিক করে ছুটে চলা চলন্ত ট্রেনে মানিকের কাঁধে মাথা রেখে ইশিতা চোখ বুজে নিশ্চিন্তে! এখন স্বপ্ন দেখতে কোনো বাঁধা নেই, ভয় নেই! স্বর্নালী আশার আলো নিয়ে ছুটে চলেছে ওরা দুজন এক নতুন গন্তব্যের পানে.....................
( আমার দেখা একটি বাস্তব ঘটনা এটি ! পরিশেষে বলবো- যে নারী তার ডান হাত দিয়ে দোলনা দোলাতেজানে সে তার বাম হাত দিয়ে পুরো পৃথিবী কাঁপিয়ে দিতে পারে, প্রয়োজন শুধু সঠিক সিদ্ধান্ত ও বুদ্ধিমত্তা।)
বিষয়: বিবিধ
১৩৩৭ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এর পর ছেলে হল মেয়ে হল তারা সুখে সংসার করতে লাগল তাই না আপু ।
শুভকামনা ও শুকরিয়া রইলো!
আমার নানার মা ও নাকি এমন ছিলেন, নানা মাতা পিতার একমাত্র ছেলে ছিলেন বিধায় দুটি বউ ত্যাগ করতে হল, তৃতীয় বউ আমার নানী ইশিতার মতই ধৈয্যশীলা ছিলেন বলে টিকে থাকতে পেরেছেন। মূলত অশিক্ষিত শাশুড়ীদের কারণেই এমন ঘটনা ঘটে। অনেক ধন্যবাদ আপু।
আমাদের সংসার জীবনে আমরা প্রত্যেকেই কেউ না কেউ নানারকম পরীক্ষার সন্মুখীন হয়েছি! কারো স্বামী ধরে বউ পেটায়, কারো শ্বাশুড়ি বউকে অত্যাচার করে, কারো স্বামীর আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য নাই, কারো বা বউ কথা শোনে না,কারো স্বামী প্রবাসী কত সমস্যা!
এর মধ্যে কিছু আছে মানুষের মানবিক গুনের বিকাশের সঠিক অভাবের ফলে ঘটিত রোগ বা অসুস্থতা! এই রোগ শিক্ষিত অশিক্ষিত যে কারো হতে পারে!
আমার মতে ইসলামী সুশাসনের চর্চা সঠিকভাবে করলেই আমারা মুক্তি পেতে পারি!একটা মেয়ে স্ত্রী বা শ্বাশুড়ি যার ভূমিকায় থাকুক না কেনো আল্লাহর ভয় থাকলে বিন্দু জুলুম ও সে কারো প্রতি করবে না!আজকের সমাজে এটাই প্রয়োজন!
চমৎকার মন্তব্য ও উপস্থিতির জন্য শুভকামনা ও শুকরিয়া রইলো
আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া ও শুভেচ্ছা রইলো।
মন্তব্য করতে লগইন করুন