ইশিতার সংসারের ইতিবৃত্তি-২
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ০৫ মার্চ, ২০১৫, ০৭:৪৮:১৩ সন্ধ্যা
ভেবেছিলো বিয়ের পর জীবনটা রংগিন প্রজাপতির মতো বর্নালী হবে, আনন্দচ্ছোল জীবন কাটাবে কিন্তু প্রথম থেকেই মানিক বরাবর অন্যরকম ছেলে! মাস পেরিয়ে গেছে বিয়ের, একটা দিন বলে নি, চল আমরা কোথাও একটু ঘুরতে যাই ! আত্নীয়- স্বজনদের বাসায় দাওয়াত দিচ্ছে সেখানে সাবার সাথে যাওয়া আবার ফিরে আসা! বাসায় তো শ্বাশুড়ি আর ছেলে সারাক্ষন কথা বলতেই থাকে! মানিক যে এক সদ্য বিবাহিত ছেলে, একটি মেয়ে- ওর নব বিবাহিতা বঁধু অধীর অপেক্ষায় ওর জন্যই বসে আছে, ওর সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করছে, গল্প করার জন্য প্রহর গুনছে - এই বোধটুকু পর্যন্ত নেই মানিকের! যেহেতু দেখে বুঝেনি তাই ইশিতা ওকে মুখেই সরাসরি বলছিলো! হিতে বিপরীত হয়েছে! মানিক গিয়ে ওর মাকে সব বলে দিয়েছে! শ্বাশুড়ি ওকে যে কড়া কথা শুনিয়েছেন তাতে ইশিতার আর সাহস নেই নতুন কিছু বলার!
পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে আসছিলো পড়াশোনা এবংহেল্প দুটোই দরকার! ইশিতা যখন ওর শ্বাশুড়িকে বলেছিলো পড়াশোনার কথা, উনি বিষয়টাকে গুরুত্বই দিলেন না! বললেন, বিয়ে শাদী হয়ে গেছে তোমার, এখন আর পড়ে কি হবে? আর এতোই যখন তোমার পড়ার শখ তখন তোমার বাবা তোমাকে বিয়েই দিলেন কেন? পড়তে তুমি বাপের বাড়িতে থেকেই! আমরা তো আর জোড় করে আনিনি তোমাকে?
কিন্তু আপনারাই তো বলেছেন আমার পরিক্ষা- পড়াশোনা শেষ করার সুযোগ দিবেন! ভয়ে ভয়ে কথা গুলো বলেছিলো ইশিতা।
তুমি আমার মুখে মুখে কথা বলছো? বেয়াদবি করছো? পড়াশোনা শিখে আর কোন পন্ডিত হবে তুমি! ভাল করে জেনে রাখ, এই বাড়িতে আর কোন পড়ালখা হবে না মনে রেখো!
সারাটা দিন ইশিতা এতো কেঁদেছিলো , মানিক চুপচাপ হয়ে কিছু ক্ষন পাশে বসে থেকে বাইরে চলে গেলো... ইশিতা বুঝতে পারলো শিক্ষার পরিবশের কত গুরুত্ব! কিছুদিন আগেও পড়াশোনার এতো গুরুত্ব বুঝেনি, আকুলতাও অনুভব করে নি! এখন সব হারিয়ে হারানো দিনগুলোতেই ফিরে যেতে চাইছে সে!
আর এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো দিন গুলি...........মলিন,বিবর্ন, ঝরে যাওয়া পাতার মতোই..
বছর গড়িয়ে গেলো ইশিতার আর এস,এস,সি পাশ করা হয়নি! ইশিতার বাবা- মা চেস্টা করেছে এ বিষয়ে কথা বলতে কিন্তু কোন লাভ হয়নি! শ্বশুড় এতোই ভালো মানুষ উনি উনার স্ত্রীর বিপরীতে কথা বলার কোন সাহস রাখেন না!
এর মাঝেই ইশিতা জানতে পারে মানিকের আগে বিয়ে হয়েছিলো। প্রথম স্ত্রী দুই বছর সংসার করার পর ডিভোর্স নিয়ে চলে গেছে।বিশ্বাস করতে কস্ট হয়েছিলো অনেক, কাঁদতে কাঁদতে যখন মাকে বলছিলো ঘটনা, ওপাশ থেকে ওর মা বলছিলো তোর বাবা জানতেন, ওরা বলেছিলো আগের বউ নাকি চরিত্রহীনা ছিলো, কার সাথে পূর্ব সম্পর্কের জের ধরে চলে গেছে! ইশিতা ভালোভাবেই বুঝেছিলো এই সংসারে কোন মেয়েই বেশিদিন সুস্থ ভাবে সংসার করতে পারেনা! মানিক নিজের মুখেই সব স্বীকার করেছিলো ইশিতার কাছে, প্রথম বিয়ের পর মানিক আর বিয়েই করতে চায় নি! ওর মাই আবার জোর করে বিয়ে দিয়েছে!
সব পরিস্থিতি সামনে রেখে ইশিতা অনেক বোঝানোর চেস্টা করেছে মানিক কে কোন একটা চাকরিতে জয়েন করতে। মানিকের মায়ের এক কথা আমার ছেলের খেটে খেতে হবে না! আমাদের যা আছে তাতেই চলবে! চেয়েছিলো সাধারন মানুষের মতোন জীবন যাপন করুক সেখানেও আপত্তি! সারা রাত নিশাচরের মতোন বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা না দিয়ে সে নিজেও থাকতে পারে না! বহু কালের গড়ে তোলা অভ্যাস বলে কথা!
ইশিতার সব চাওয়া পাওয়াতেই আপত্তি দেখে এক সময় ইশিতাও এসব বলা বন্ধ করে দিয়েছে! শ্বাশুড়ির একনিষ্ঠ বউ হতে চেয়েছে। সেটা সে পেয়েছেও। শ্বাশুড়ি -ইশিতার অন্যান্য কোন চাহিদা অপূরন রাখেন না, ভালো খাওয়া-দামী পোশাক কোন কিছুর অভাব বোধ করতে দেন না! ধীরে ধীরে সুন্দর আচরন, আময়িক ব্যবহার দিয়ে অন্যান্য সব আত্নীয় স্বজনদের প্রিয় পাত্রী হয়ে উঠলো ইশিতা!
সময়ের পরিক্রমায় ইশিতা স্বপ্ন দেখে মাতৃ্ত্বের। একটা গোপন -সুপ্ত ভয় জাগতো মনের মাঝে শ্বাশুড়ি এই স্বপ্নেও যদি বাঁধ সাধেন! তারপরো এক প্রতিক্ষীত আগমনের আনন্দে মনটা বাঁধন হারা হয়ে যেতে চেয়েছিলো! ইশিতা ভেবেছিলো এই সংবাদটা এই পরিবারের সাথে ওর গড়ে ওঠা সকল দূরুত্ব ঘুচিয়ে দিবে, ওদেরকে এক সুন্দর স্বপ্নীল জীবনের নতুন বাঁকে পৌঁছে দিবে...........
তারপর যা ঘটেছে তা কোন সুস্থ মানুষের জন্য চিন্তা করাও সম্ভব না! ডাক্তার দেখানোর নাম করে ইশিতার অ্যবরশন করিয়ে এনেছে ওর শ্বাশুড়ি! হুশ আসার পর কান্না বিজড়িত অস্ফুট কন্ঠে ও শুধু জিগগেস করেছিলো- কেনো মা? কেনো?
শ্বাশুড়ি উপস্থিত সবাইকে সামনে রেখেই বললেন, তোমার বয়স এখনো অনেক কম! আরেকটু বড় হও তোমার বুদ্ধি শুদ্ধি হোক, সময় তো পড়েই আছে! ক্লিনিকের সবাই ভাবলো আহা !কত ভাল শ্বাশুড়ি!
এই ঘটনার পর থেকে ইশিতা তাঁর শ্বাশুড়ি আর স্বামী মানিক কারো প্রতি শ্রদ্ধা রাখতে পারে না মন থেকে! সিদ্ধান্ত নেয় কিছু দিনের জন্য মায়ের কাছে গিয়ে থেকে আসার!
মানিকই সাথে করে নিয়ে আসে ইশিতাকে, মানিকও ভাবতে পারে নি ওর মা এতো বড় ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবেন। প্রচন্ড রকম অনুশোচনা বোধ কাজ করে তারপরেও মা কে একটা বারের জন্যো জিজ্ঞাসা করে নি এর পিছনে মূল কারন কি?
মানিক ভাবে, প্রথম বিয়েটা ভেংগে যাওয়ার পর মানিক আর চায় নি বিয়ে হোক! সমাজের মানুষ খারাপ বলে এই জের ধরে মা ই আবার পাত্রী ঠিক করেছিলেন।মানিক সবকিছু ইশিতার বাবাকে বলেছিলো কিন্তু বউ- শ্বাশুড়ির দ্বন্দের কথা কি বলা যায়? ছোটবেলা থেকেই মানিক ভিন্ন রকম কখনো পারেনি মায়ের অবাধ্য হতে সেটা হোক বৈধ বা অবৈধ কোন বিষয়ে!
বিয়ের পর থেকেই ইশিতাকে দেখেছে বেশ অমায়িক একটা মেয়ে, হয়তো অন্যান্য সব মেয়ের মতোন ওর একটা স্বপ্ন ছিলো স্বামীকে নিয়ে ছোট্র সুখের নীড় গড়ে তোলার। দিনের পর দিন মানিক চোখের সামনে দেখেছে ইশিতার স্বপ্নগুলো ধূলিস্মাৎ হয়ে যেতে, ভেংগে চুড়ে চুড়মার হয়ে যেতে! তারপরেও কোন দিন মানিক কিছু বলেনি , কি এক কঠিন বোধ এসে ঘিরে ধরেছে মানিক কে, না পেরেছে স্ত্রীকে সমবেদনা জানাতে, না পেরেছে মায়ের অবাধ্য হতে!
কিন্তু এবার সম্পূর্ন ভিন্ন বিষয়টি! ইশিতাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার কথা মানিক শুনেছিলো কিন্তু আ্যবরশন? তার মা করিয়েছে? মাথার উপর বিশাল আকাশটা যেনো ভেংগে পড়েছিলো মানিকের! আর ইশিতা? ক্লিনিক থেকে ফেরার পর কোন কথাই বলে নি মানিকের সাথে! অভিমানের নিকষ কালো মেঘ ভর করেছিলো ওর মায়াবী মুখটাতে! মরার মতো চুপচাপ শুয়ে থাকতো আবার কখনো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতো... সেই চোখের পানিটুকু মুছিয়ে দেয়ার অধিকারও বুঝি মানিক হারিয়ে ফেলেছিলো...
নিজের সাথে অনেক বোঝাপরা করেও মানিক কোন সুরাহা করতে পারে নি, কিভাবে ওদের জীবনটাকে স্বাভাবিক করা যায়? প্রথম সংসার টিকে নি দ্বিতীয় বার আবার কোন ভুল এসে ওর জীবনটাকে প্লাবনের মতো ভাসিয়ে নিয়ে যাক এটা মানিক চায় না!
আর তাই ভেবেছে ইশিতাদের বাড়িতে কিছু দিন থাকলে অন্তত ইশিতার কাছ থেকে কিছুটা ক্ষমা হয়তো পাওয়া যেতে পারে! ইশিতাদের বাড়িতে আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেলো। সবাই খুব খুশি, একসাথে দুজনকে পেয়ে! কেননা বিয়ের পর মাত্র একবার মানিক এসে ইশিতাদের বাড়িতে ছিল!
বিকেলে একসাথে যখন চা খাচ্ছিলো এটা সেটা গল্প করতে ফোন বজে উঠলো মানিকের! ওপাশ থেকে ওর মা! প্রেশার অনেক হাই হয়ে গেছে! রাতের মধ্যেই মানিককে ফিরতে বলছে! ইশিতা হাসি মুখেই মানিককে বিদায় দিয়েছে, নিজেও সাথে ফিরে যেতে চেয়েছিলো, মানিক রাজি হয়নি! বলেছে কিছুদিন পর মানিক আবার এসে ওকে নিয়ে যাবে !
মানিক বেড়িয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিলো! ইশিতাকে রেখে বিদায় নেয়ার সময় এই প্রথম বুকের ভিতর এক অজানা ব্যথা অনুভব করলো! নিজের এক মহামূল্যবান অস্তিত্বকে এতোটা কাল ধরে এতো অবহেলা করেছে, অযত্ন করেছে সেটার কঠিন অনুশোচনা বোধ তার মনকে তীব্র থেকে তীব্রতর ভাবে দহন করতে লাগলো...
এ কয়েকদিনের ধকলে ইশিতার চেহারটা একেবারে ম্লান হয়ে গিয়েছে তারপরো সেই মলিন মুখের এক টুকরো হাসি কি নির্মল -পবিত্র, কতো স্নিগ্ধতার আবশে পরিপূর্ন ! সূর্য তখন বিদায় নেয় নয় ভাব, বিকেলবেলার সেই শেষ আলোটুকু ইশিতার মুখের উপর পড়ে, ছল ছল করে ওঠা আঁখিযুগল শত অভিমান সত্তেও বাড়িয়ে দিয়েছিলো এক তীব্র ভালোবাসার হাতছানি...
বিষয়: বিবিধ
১৬৫২ বার পঠিত, ২১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সংসারে যত অশান্তি সেটা যদি হিসেব করি তবে এমন!
১০০ টা পরিবারে অশান্তি!
রেশিও:
বউয়ের প্রবলেম এর কারনে: ৯৭টা পরিবারে যত সমস্যা।
শাশুড়ীর প্রবলেম এর কারনে : ৩টা পরিবারে।
একান্ত ব্যাক্তিগত ভাবে দেখা ।
এবং বাস্তব।
ভয় পেয়ো না আপু!জীবন তো পরীক্ষার সমন্বয় প্রয়োজন শুধু উত্তীর্ন হওয়া!
আন্তরিক শুকরিয়া ও শুভকামনা রইলো!
উপস্থিতি ও মন্তব্যের জন্য আন্তরিক শুকরিয়া ও শুভকামনা রইলো
মন্তব্যের জন্য আন্তরিক শুকরিয়া ও শুভকামনা রইলো
জাজাকাল্লাহু খাইর আপুজ্বি।
আপনার জন্য অনেক অনেক দোয়া ও শুভেচ্ছা রইলো।
আপু সময় করে স্কাইপে আসার অনুরোধ রইলো!
শুকরিয়া সুন্দর মন্তব্য ও উপস্থিতির জন্য!
(বর্তমানে ওরা ভালো আছে আলহামদুলিল্লাহ!
মন্তব্য করতে লগইন করুন