রেখো না মোদের গাফিল করে...
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ১৯ এপ্রিল, ২০১৪, ১২:৪৮:৪৮ রাত
ভোরের মৃদু বাতাসে ঝির ঝির পত্র পল্লবের মিতালি যেনো মরমে বিশুদ্ধ অবগাহন, সবুজ কচি ঘাষের ডগায় জমে থাকা বিন্দু বিন্দু শিশির নয়নে আনে জাগরন , সদ্য প্রষ্ফুটিত রক্তবর্ন গোলাপের মায়াকাড়া সুবাসের ঘ্রানে হই মাতোয়ারা, শরতের বিকেলে দূর ঝিলের পাড়ে কাশফুল ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাওয়ার কোমলতার স্পর্শ, জৈষ্ঠ্যের তপ্তদাহে পাকা আমের সুমধুর স্বাদের তৃপ্তি , গোধূলীলগ্নে নীড়ে ফেরা পাখিদের জাদুমাখা কিচির মিচির শ্রবনে আনে ভালোবাসার শ্রুতি.......... আলহামদুলিল্লাহ!
পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা নয়ন জুড়ানো অসংখ্য নিয়ামত প্রত্যক্ষ করতে পারছি কোনোটা দৃষ্টিপাতের মাধ্যমে, কোনোটা সুঘ্রানে, কোনটা স্পর্শে, কোনটা স্বাদ গ্রহনে আবার কোনটা শ্রবনের মাধ্যমে আলহামদুলিল্লাহ!আমাদের জীবনে যাদের এই প্রতিটি ইন্দ্রিয় সক্রিয় আছে, সঠিক এবং সুচারুরুপে কাজ করে যাচ্ছে আমরা আসলেই অনেক অনেক ভাগ্যবান! এই ইন্দ্রিয়গুলো যে কত বড় নিয়ামত তা ভোগ করতে এতোটাই অভ্যস্হ হয়ে পড়েছি নিয়ামতের গুরুত্ব যথাযথ অনুধাবনে ব্যর্থ হই।আশেপাশে একটু সচেতন দৃষ্টি মেললে অহরহ অনেক দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠে। যা আমাদের নির্জীব অনুভূতিগুলোত দাগ টেনে সতেজ পার্থক্য বুঝিয়ে দেয় ।
এমন একজনের কথা ভাবুন যার দৃষ্টিশক্তি নেই কোনদিন যে অবলোকন করেনি স্বর্নালী সূর্যোদয়, আলোয় আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে যাওয়া পৃথিবীর মোহনীয় চিত্র! যে অবলোকন করেনি সূর্যাস্তের দৃশ্য, আঁধারে আাঁধারে ছেয়ে যাওয়া ধরনীর নিকষ কালো অন্ধকারের রুপ! আকাশ থেকে নেমে আসা বর্ষার ঝর ঝর বর্ষনে মুখর মুষলধারে বৃষ্টির সৌন্দর্য, মুগ্ধ নয়নে রংধনুর সাত রং, কখনো দেখেনি তার জন্মদাত্রী মমতাময়ী মায়ের মুখখানি, আদর্শ লিপি হাতে নিয়ে স্লেটে আঁকেনি স্বরলিপি বা আরবী বর্নমালা! সে আর আমি কি এক?
এমন একজনের কথা ভাবুন যার বাকশক্তি নেই ছোট ছোট আধো আধো বুলি বাক্যে যার কখনো হয়নি বাক্যালাপ, সুপ্রিয় মা কে মধুর স্বরে ডাকেনি "মা" বলে, কি ভালো লাগা কি কষ্টে ছেঁয়ে যাওয়া অন্তরের অনুভূতির হয়নি প্রকাশ, টসটসে পাকা জাম বা পাকা আমের স্বাদ যে কতো মধুর তা হয়নি নিজ ভাষায় প্রকাশ করা, মক্তবের মাদুরে বসে সুর করে পড়েনি এক নাম্বার মাখরাজ ..., কন্ঠে যে ধারন করতে পারেনি কখনো পবিত্র কালামের তিলাওয়াত! সে আর আমি কি এক?
এমন একজনের কথা ভাবুন যার বাহ্যিক শারীরিক অবয়ব সুস্হ মানুষের মতন, স্নায়ুতন্ত্রের অতি সূক্ষ কোন জটিলতা বা সমস্যার কারনে যখন ইন্দ্রিয়ের কাজগুলো সঠিকভাবে সম্পাদিত হয় না, তখন ঐ ব্যক্তি যার সামনে দাউদাউ জ্বলতে থাকা আগুন দেখেও পুড়ে ঝলসে যাওয়ার ভয়ে আতংকিত হয় না কিংবা উঁচু ছাদ থেকে পড়ে গেলে আহত হয়ে মৃত্যু ঘটতে পারে এই অনুভূতি যার মস্তিষ্ক তাকে সরবরাহ করে না সে আর আমি কি এক?
এমন ব্যক্তিদের দেখলে আমরা প্রত্যেকেই আমাদের নিজ নিজ জীবনের অসংখ্য নিয়ামতগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পারি।মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত অসংখ্য নিয়ামতে আকন্ঠ ডুবে আছি ! শুধু তাই নয় সমস্ত নিয়ামত গুলোর মধ্যে ইন্দ্রিয়জাত নিয়ামতগুলো যে আরো কতো বেশি তাৎপর্যপূর্ন, অর্থবহ সেটাও বোধগম্য হয় সহজেই।
আমরা যদি আল কোরআনের আয়াতগুলোর দিকে লক্ষ্য করি দেখতে পাব অসংখ্য আয়াত আছে যেখানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালা আমাদের এই ইন্দ্রিয়গুলো যে দিয়েছেন এগুলোকে নিয়ামত হিসবে উল্লেখ করেছেন এবং এগুলোর যথযথ ব্যবহার করার নির্দেশ দান করেছেন।
আল্লাহ তোমাদের মায়ের পেট থেকে তোমাদের বের করেছেন এমন অবস্থায় যখন তোমরা কিছুই জানতে না৷ তিনি তোমাদের কান দিয়েছেন, চোখ দিয়েছেন, চিন্তা-ভাবনা করার মতো হৃদয় দিয়েছেন, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো৷ (নাহল ৭৮)
আল্লাহই তো তোমাদের সৃষ্টি করেছেন, তিনিই তোমাদের শ্রবণশক্তি, দৃষ্টিশক্তিও বিবেক-বুদ্ধি দিয়েছেন৷ তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো৷ (মূলক২৩)
তিনিই আল্লাহ যিনি তোমাদের শোনার ও দেখার শক্তি দিয়েছেন এবং চিন্তা করার জন্য অন্তঃকরণ দিয়েছেন, কিন্তু তোমরা কমই কৃতজ্ঞ হয়ে থাকো(আল মুমিনূন ৭৮)
আমি কি তাকে দু’টি চোখ, একটি জিহ্বা ও দু’টি ঠোঁট দেইনি? (বালাদ ৮-৯)
সূরা নাহলের ৭৮নং আয়াতে ইন্দ্রিয়গুলোর উল্লেখ করার পর আল্লাহ বলছেন, যেন তোমরা শুকরিয়া আদায় করো! আমাদের এই ইন্দ্রিয়গুলো দেয়ার উদ্দেশ্যই হলো আমরা শুকরিয়া আদায় করব বা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করব। আমরা কি সত্যিকার ভাবে তা করি?
যে আল্লাহ অগণিত নিয়ামত দান করেছেন এ নিয়ামতগুলোর ব্যাপারে এর চেয়ে বেশী অকৃতজ্ঞতা আর কি হতে পারে যে, কান দিয়ে আমরা সব কিছু শুনি কিন্তু শুধুমাত্র আল্লাহর আদেশগুলো শুনি না, চোখ দিয়ে সবকিছু দেখি শুধুমাত্র আল্লাহর নিদর্শনাবলী দেখি না! আমাদের মস্তিস্ক অনেক জটিল কাজ করতে পারে,সবকিছু চিন্তা করতে পারে শুধুমাত্র আল্লাহর নিদর্শনাবলী দেখে না এবং এ কথা চিন্তা করে না আমাদের প্রভু আমাদের উপর যে এতো অনুগ্রহ করেছেন তিনি কে ? আমাদের কি দায়িত্ব তাঁর প্রতি?
সূরা মুলকে ২৩ নং আয়াতে ইন্দ্রিয়গুলো নিয়ামত হিসেবে উল্লেখ করার পর আল্লাহ বলছেন, তোমরা খুব কমই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে থাকো! অর্থাৎ আমরা যে শুকরিয়া করি তা খুবই কম, অপ্রতুল- নগন্য বলা যায়!
চোখ, কান এবং মস্তিষ্কতো এজন্যই দেয়া হয়েছে যে আমরা সুন্দর ও সঠিক বিষয় দেখব, ন্যায় ও সত্যকে চিনব! সত্য ও মিথ্যার পার্থক্য করব, বিচার বিবেচনা করব অথচ আমরা জাগতিক সব উদ্দেশ্য ইন্দ্রিয়গুলোর মাধ্যমে সম্পাদন করছি শুধু যতটুকু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার দরকার তা করছি না!
আমরা যখন সদ্য ভূমিষ্ঠ কোন নবজাতক শিশুকে দেখি, তার তুলতুলে নরম হাত, পা, ছোট ছোট চোখ, নাক, মুখ কতোই না মায়ার সৃষ্টি করে! ফুটফুটে শিশুর একটু চাহনি, একটু হাসি, একটু স্পর্ষ পাওয়ার জন্য কতোইনা আকুলতা জাগায়! একটু যদি চিন্তা করি পৃথিবীতে যত প্রানী আছে তার মধ্যে নবজাতক মানবশিশুই জন্মের পর সবচাইতে অসহায় অবস্হায় জন্মগ্রহন করে। সে না পারে নিজের খাদ্যের ব্যবস্হা করতে, না পারে চলাফেরা করতে, না পারে অপ্রীতিকর কোন পরিস্হিতি থেকে নিরাপদ থাকতে। এবার ভাবুন এমন একটি স্পর্শকাতর মুহূর্তের উল্লেখ করে আল্লাহ জানিয়ে দিচ্ছেন যে, তিনি আমাদের দিয়েছেন কান, চোখ এবং হৃদয় । আমরা প্রত্যেকেই আজ এতো বড় হয়েছি, জীবনের এতোগুলো ধাপ পাড়ি দিয়ে এসেছি একদিন আমরাও ঐ অসহায় নবজাতক শিশুটির মতোন ছোট ছিলাম! ধীরে ধীরে আল্লাহ আমাদের বড় করেছেন, প্রয়োজনীয় সমস্ত উপকরন দান করেছেন আমরা কি একটিবার পিছনে ফিরে তাকাই? একটু চিন্তা করি এই নিয়ামতগুলির কৃতজ্ঞতা বা শুকরিয়া আদৌ আদায় করছি কিনা?
আমাদের এই ইন্দ্রিয়গুলোর ব্যবহার কি শুধু ভোগবিলাস কিংবা জাগতিক সীমিত কিছু স্বার্থেই সীমাবদ্ধ ? নাহ, এতেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এর পরিসর অনেক বিস্তৃত, ব্যাপক এবং মহৎ! সমস্ত পৃথিবীর মায়া, রূপ, রস, গন্ধকে উপভোগ করতে পারছি যিনি আমাদের এত মহেরবানী করেছন, এই নিয়ামত দান করেছেন এজন্য কি আমাদের সুমহান প্রতিপালক আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালার প্রতি খালেছভাবে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা উচিত নয়?
কিভাবে আমরা আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালার প্রতি কৃতজ্ঞতা বা শুকরিয়া আদায় করব?
কৃতজ্ঞতার হক আদায়ের জন্য তিনটি ধাপ আছে। প্রথম ধাপ হলো -নিয়ামতের উৎস কী? কে আমাদের এই নিয়ামত দিলেন? তা চিন্তাভাবনা করা।
দ্বিতীয় ধাপ মৌখিক শুকরিয়া- অন্তর থেকে বুঝে ‘আলহামদু লিল্লাহ’ বলা। এই কৃতজ্ঞতার বাণীটি মুখে উচ্চারণ করলেই হক আদায় শেষ হয়ে যায় না বরং মুখে উচ্চারণ করার সাথে কাজেকর্মে বাস্তব প্রমাণ করাটাই আসল কাজ!
তৃতীয় ধাপ -আমলের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা। আল্লাহ আমাদেরকে এই সমস্ত নিয়ামত কী উদ্দেশ্যে দিয়েছেন তা নিয়ে যথার্থ চিন্তাভাবনা করা এবং সে অনুযায়ী সেসব নিয়ামতকে কাজে লাগানো।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা'য়ালা আমাদের প্রত্যেককে তাঁর শোকরগুজার বান্দা-বান্দী হিসেবে কবুল করে নিন! সত্যিকার অর্থেই যন আমার নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি! এই নিয়ামতগুলো যেন পরকালে আমাদের বিরুদ্ধে বিপরীত সাক্ষা না দেয়! আমাদের আযাবের কারন না হয়! ববরং নিয়ামতের যথাযথ হক আদায় করতে পারি তা যেন আমাদের জন্য বারাকাহ বয়ে আনে। আমীন!
তারা যেন সেদিনের কথা ভুলে না যায় যেদিন তাদের নিজেদের কন্ঠ এবং তাদের নিজেদের হাত-পা তাদের কৃতকর্মের সাক্ষ দেবে। (নুর -২)
যদি তোমরা আল্লাহ'র নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করো তবে অবশ্যই তোমাদের নিয়ামত আরো বৃদ্ধি করে দিবেন।” (সুরা ইবরাহীম -৭)
বিষয়: বিবিধ
১৫৬২ বার পঠিত, ২৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ঈমানের নবায়ন বুঝি এভাবেই হয় !!
শুরুটা দেখে ভেবেছিলাম পুরো পোস্টটি কাব্যিক হবে। মাঝপথে কাব্যকে ব্রেক দিয়ে কাব্যের কথাগুলো বাস্তবতায় এনে পোস্টে যে আবহ তৈরী হয়েছিল, সেই আবহকে যেন আরো ক্ষুরধার করে দিয়েছে আসমানী দলীলগুলো। অসাধারন । যাযাকিল্লাহ আপু ।
@ধ্রুব নীল
আল্লাহর নিয়ামত সমুহ অস্বিকার করেই আমরা মনে করছি উন্নত হচ্ছি।
শুকরিয়া আপুনি
অনেক অনেক শুকরিয়া আপুকে
জাজাকিল্লাহ্ খাইরান আপি। আল্লাহ্ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দিন। আমীন
বারাকাল্লাহু ফিক! আল্লাহ আমাদের নিয়মতের সঠিক হক আদায় করার তৌফিক দান করুন
মন্তব্য করতে লগইন করুন