উৎকৃষ্ট বনাম নিকৃষ্ট
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ১৩ এপ্রিল, ২০১৪, ০৪:৩৫:০৯ রাত
বোনেরা মিলে আলাপচারিতার মাঝে একটি হাদীসের প্রসংগ আসলো।
হাদীসটি ছিল-
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
« أَحَبُّ البلاد إلى الله مساجدها، وأبغض البلاد إلى الله أسواقها »
আল্লাহর নিকট সর্বাধিক প্রিয় স্থান হল, মসজিদসমূহ, আর আল্লাহর নিকট সর্বাধিক নিকৃষ্ট শহর হল, বাজারসমূহ। (সহীহ মুসলিম )
এই হাদীসের ব্যাখ্যা স্কলারগন খুব সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন এভাবে-
ইমাম নববী রাহিমাহুল্লাহু أحبّ البلاد إلى الله مساجدها হাদিসটির ব্যাখ্যায় বলেন, "মসজিদগুলো হল- আল্লাহর ইবাদাত-বন্দেগীর ঘর এবং এগুলোর বুনিয়াদ হল, তাকওয়া নির্ভর। আর ا«وأبغض البلاد إلى الله أسواقه » বাজার হল -ধোঁকা, প্রতারণা, সুদ-ঘুষ, মিথ্যাচার, মারা-মারি, হানা-হানি, ওয়াদা ভঙ্গ করা, আল্লাহর জিকির হতে বিরত রাখা ইত্যাদির স্থান।"
ইমাম কুরতবী রাহিমাহুল্লাহু «أحبّ البلاد إلى الله مساجدها» হাদিসটির ব্যাখ্যায় বলেন, "শহরের ঘরসমূহ হতে সর্বাধিক প্রিয় ঘর এবং সর্বাধিক প্রিয় ভূ-খণ্ড হল, মসজিদ সমূহ। কারণ মসজিদসমূহকে ইবাদাত-বন্দেগী, জিকির-আযকার, মুসলিমদের মিলনকেন্দ্র, ইসলামের নির্দেশনসমূহের বহি:প্রকাশ ও ফেরেশতাদের একত্র হওয়ার স্থান হিসেবে খাস করা হয়েছে। আর বাজার আল্লাহর নিকট সর্বাধিক নিকৃষ্ট হওয়ার কারণ, বাজারকে খাস করা হয়েছে, দুনিয়া উপার্জনের জন্য, মানুষের পার্থিব উদ্দেশ্য লাভের জন্য এবং আল্লাহর জিকির হতে গাফেল রাখার জন্য। কারণ বাজার হল, মিথ্যাচারিতার স্থান, শয়তানের রণক্ষেত্র। শয়তান এখানেই তার ঝাণ্ডা স্থাপন করে ওত পেতে আছে।"
অনেক সময় অনেক বোনদের ( দুঃখের সাথে বলতে হয় বোনদের মাঝেই এই প্রবনতা বেশি) দেখা যায় প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় বাজারে শপিং করতে ব্যস্ত! প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সময় নষ্ট করে শুধু এই কারনে কতো বেশি দরদাম করা যাবে বা পুরো মার্কেটের মধ্যে সেরা জিনিষটা ক্রয় করা যাবে সেই প্রতিযোগী মনোভাবের কারনে।
আবার অনেকের শপিং করাটা একটি হবি বা নেশার মতো কাজ করে। কিছু কেনাকাটার প্রয়োজন থাকুক আর নাই থাকুক নিত্য মার্কেটে একটি বার চক্কর দেওয়াই চাই! লেটেষ্ট মডেলের কি আসলো, কেমন দাম, কোথায় কম কোথায় বেশি ইত্যাদি যাচাইএর পিছনে শ্রম দেয়া অনেক গুরুত্বপূর্ন উনাদের কাছে!
আফসোস লাগে আমাদের এই ভাইবোনদের জন্য! কেননা আমরা আমাদের বহু মূল্যবান সময় নষ্ট করে যে সময়টা শপিং বা বাজারে অনর্থক সময় ব্যয় করি এর ফলে সবচাইতে বড় ক্ষতি হয় যা তা হলো অনেক ক্ষেত্রেই সলাতের সময় পার হয়ে যায় আর অনেকেই সালতের গুরুত্বের চাইতে শপিং শেষ করে বাসায় আসার গুরুত্ব টাই বেশি দেন। আর এটা করা হয় পার্থিব কিছুটা দামের লাভের (?)জন্য! আজকাল এমন কোন শপিংসেন্টার খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য যেখানে মিউজিক বাজানো হয় না! এটা একটা পলিটিক্স, ক্রেতা শপিং এ ঢুকবেন, মিউজিকের তালে তালে শপিং করবেন, আস্তে ধীরে পছন্দ করবেন, তারপর দরদাম!!!!একদিকে সময়ের অপচয়, সালাত নষ্ট , সাথে কতো ফাহেশা কাজ আর ঈমান তো নড়বড়ে ততক্ষনে!
মসজিদ মানেই তো সিজদার স্হান! কতো পবিত্র স্হান!আমাদের প্রভুর সাথে কথোপকথনের স্হান! মুসলিম উম্মাহর ভ্রাতৃত্বের বন্ধন জোড়ালো হয় এখানে, ভালোবাসা বাড়ে একে অপরের প্রতি! কি ধনী কি গরীব সকলেই এক কাতারে সলাত আদায়ের ফলে বৈষম্যের ভেদাভদে ভুলে ভাইয়ে ভাইয়ে পরিনত হয়!
নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায়ের জন্য যারা মসজিদে গমন করে তাদের প্রতি পদক্ষেপে গুনাহ মাফ হওয়ার প্রতিদানের কথা উল্লেখ হয়েছে। যাদের মন মসজিদে লেগে থাকে কিয়ামতের কঠিন পরিষ্হিতির সেই ভয়াবহ দিনে তাদের আল্লাহর আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেয়া হবে বলা হয়েছে! যতক্ষন মানুষ মসজিদে থাকে পবিত্র ভালোবাসায় মনটা ভরে থাকে! আরো বেশি সময় মসজিদে থাকতে ইচ্ছে করে!
অপর দিকে মানুষের সহজাত প্রবনতা এই যে দুনিয়াবি চাকচিক্য তাকে আকর্ষন করবেই। যত বেশি সময় বাজারে, দোকানে বা শপিং মলে কাটানো হবে ততই মনের মধ্যে এই চিন্তা ঘুরপাক করবে যে ইশ! কতো সুন্দর ঐ জিনিষটা! কয়টা টাকার জন্য নিতে পারলাম না!এই আফসোস মনের মধ্যে বাজতে থাকবে! যত বেশি সময় বাজারে ব্যয় করা হয় বাজারের জিনিষপত্র দেখে অপ্রয়োজনীয় জিনিষটাও কিনতে ইচ্ছে হয়, তখন পকেটে যত টাকাই থাকুক না কেনো তা অপ্রতুল মনে হয়! উচ্চাকাংখার জন্ম নেয় মনে! লোভের সৃষ্টি হয়! যা আমাদের দুনিয়াবি করে তুলে!
তাই বলে কিন্তু হাদীসে বাজারকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়নি। বরং তুলনা করে বোঝানো হয়েছে আল্লাহর নিকট অপেক্ষাকৃত অধিক পছন্দনীয় স্হান হলো মসজিদ আর অপছন্দের বা নিকৃষ্ট স্হান হলো বাজার! আমাদেরকে মসজিদের প্রতি ভালোবাসা বাড়ানো, মসজিদে পদচারনা বাড়ানো, মসজিদের সাথে যেনো আমাদের অন্তরের যোগাযোগ বা সম্প্রীতি বেশি থাকে, আমরা যেনো মসজিদকেই বেশি ভালোবাসি এটাই উদ্দেশ্য। পক্ষান্তরে বাজার যেনো হয় শুধু প্রয়োজন পূরনের তাগিদেই যাওয়া আসা করা। অহেতুক সময় নষ্ট যেনো না হয় কঠোর খেয়াল রাখা, বাজারের প্রীতি বা আসক্তি যেনো মনে শক্ত অবস্হান না নেয় , আমরা যেনো খুব দুনিয়ামুখী হয়ে না যাই, পার্থিব লালসা যেন আমাদের মনে স্হান না নিতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখাটাই অত্যন্ত অত্যাবশ্যক।
ইসলামী শিষ্টাচারের অন্যতম একটি সৌন্দর্যমন্ডিত বৈশিষ্ট হলো প্রতিটি কাজের শুরুতে দোআ করা। আর দোআ আমাদের আল্লাহর নৈকট্যলাভের অন্যতম বিশেষ বাহন ও মাধ্যম। আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা এবং সাহায্য কামনার মাধ্যমে মানুষ আরো আল্লাহর নিকটবর্তী হয়। দোআর মাধ্যমে আমরা যখন কোন কাজ শুরু করি তা আমাদেরকে আমাদের মহান প্রভুর ইবাদতের মধ্যেই নিয়োজিত রাখে । ফলে আমরা আমাদের মূল উদ্দেশ্যে সফল করতে সক্ষম হব এবং এই কাজটির মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করতে পারব ইনশা আল্লাহ!
মসজিদে প্রবেশের দো‘আ «أَعُوذُ بِاللَّهِ العَظِيمِ، وَبِوَجْهِهِ الْكَرِيمِ، وَسُلْطَانِهِ الْقَدِيمِ، مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ» [بِسْمِ اللَّهِ، وَالصَّلَاةُ] [وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ] «اللَّهُمَّ افْتَحْ لِي أَبْوَابَ رَحْمَتِكَ»
"আমি মহান আল্লাহ্র কাছে তাঁর সম্মানিত চেহারা ও প্রাচীন ক্ষমতার ওসীলায় বিতাড়িত শয়তান থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।”আল্লাহ্র নামে প্রবেশ করছি সালাতও সালাম আল্লাহ্র রাসূলের উপর। “হে আল্লাহ! আপনি আমার জন্য আপনার রহমতের দরজাসমূহ খুলে দিন।” (মুসলিম, আবু দাউদ)
মসজিদ থেকে বের হওয়ার দোআ -
«بِسْمِ اللَّهِ وَالصّلَاةُ وَالسَّلَامُ عَلَى رَسُولِ اللَّهِ، اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ مِنْ فَضْلِك، اللَّهُمَّ اعْصِمْنِي مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيمِ».
“আল্লাহ্র নামে (বের হচ্ছি)। আল্লাহ্র রাসুলের উপর শান্তি বর্ষিত হোক। হে আল্লাহ! আপনি আমার গুনাসমূহ মাফ করে দিন এবং আমার জন্য আপনার দয়ার দরজাগুলো খুলে দিন। হে আল্লাহ, আমাকে বিতাড়িত শয়তান থেকে হেফাযত করুন” (মুসলিম, আবু দাউদ)
বাজারে প্রবেশের দোআ -
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ، وَلَهُ الْحَمْدُ، يُحْيِي وَيُمِيتُ، وَهُوَ حَيٌّ لاِ يَمُوتُ، بِيَدِهِ الْخَيْرُ، وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ».
ভাবার্থ- "আল্লাহ তায়াল ব্যতীত ইবাদতের যোগ্য কোন ইলাহ নেই, তাঁর কোনো শরিক নেই, রাজত্ব তাঁরই, প্রশংসা মাত্রই তাঁর। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মারেন। আর তিনি চিরঞ্জীব, মৃত্যু তাঁকে স্পর্ষ করতে পারেনা, সকল প্রকার কল্যাণ তাঁর হাতে নিহিত। তিনি সব কিছুর উপর ক্ষমতাবান।" (তিরমিযী, ইবন মাজাহ)
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাঃ থেকে বর্ণিত, তিনি বলেণ যে, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি বাজারে প্রবেশ করার সময় এই দোআটা পাঠ করবে আল্লাহ তায়ালা তার আমল নামায় দশ লক্ষ নেকি লিপিবদ্ধ করেন,দশ লক্ষ পাপ মোচন করেন, দশ লক্ষটি মর্যাদা বৃদ্ধি করেন ও জান্নাতে তার জন্য একটি গৃহ নির্মাণ করেন।[তিরমিযী শরীফ] (সুবহানাল্লাহ)
বাজারে প্রবেশের পূর্বে একজন ভাই বা বোন যখন প্রথম পদক্ষেপ ফেলবেন, উনি যখন চিন্তা করবেন অত্যন্ত জরুরী কাজেই তিনি বাজারে এসেছেন, সেটা হতে পারে চাল, ডাল ,সবজি বা নিত্য প্রয়োজনীয় কোন জিনিষ, হতে পারে পরিবার -পরিজনের পোষাক পরিচ্ছদ, হতে পারে ইলেক্ট্রনিক্স কোন কিছু! প্রয়োজন যাই হোক না কেন উনি প্রবেশের পূর্বে যখন দোআর কথা স্মরন করবেন এবং পড়বেন তখন এই জিনিষটাই কাজ করবে যে, বাজারে প্রবেশ করেও উনি আল্লাহর বান্দা! এই বাজার করার সময়টাও উনার ইবাদাহ র অন্তর্ভুক্ত! উনি যথেচ্ছে ব্যবহার করতে পারেন না উনার সময় কিংবা সম্পদের! প্রতিটি বিষয়ের জবাবদিহি আল্লাহর কাছে করতে হবে, প্রতিটি চাহিদার, প্রতিটি নিয়ামতের হিসাবও আল্লাহর কাছে দিতে হবে। যে অর্থ আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন তা কোন খাতে ব্যয় করছি এই জবাবও দিতে হবে! তখন কিন্তু লাগামহীনভাবে সময়, সম্পদ, শ্রম নষ্ট করা অন্ত কোন মুমিনের পক্ষে সম্ভব হবে না! ইনশা আল্লাহ!
এই সুন্দর দোআটি আমাদের অনেকেরই মুখস্হ আছে, হয়তো কখনো পড়ি বা কখনো দোআর গুরুত্ব সম্পর্কে না জানার কারনে পড়া হয় না! আমরা যেনো সচেতন হই এবং গুরুত্ব উপলব্ধি করি। কি সুন্দর প্রতিদানের কথা উল্লেখ করা হয়েছে দোআটিতে সুবহানাল্লাহ! আমরা যেনো আল্লাহর পছন্দনীয় কাজগুলো বেশি বেশি করতে পারি, অপছন্দনীয় কাজ গুলো থেকে দূরে থাকতে পারি। প্রতিটি কাজে যেনো আমরা সুন্নাহ অনুসরন করি, দোআর মাধ্যমে কাজ শুরু করি। আমরা বিপদগ্রস্হ হব না ইনশা আল্লাহ ।
বিষয়: বিবিধ
১৭৮৬ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমাদের দেশের বেশিরভাগ মহিলারাই্ নিয়মিত মার্কেটে না গেলে মনে করেন তিনি পিছিয়ে যাচ্ছেন অন্যদের থেকে।
আল্ট্রা মডার্ন হতে গিয়ে দৌড়ের উপ্রে থাকেন তারা।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে বুঝে চলার তৌফিক দিন আমরা যেন আমাদের সময়কে উত্তম কাজে লাগাতে পারি পোস্টের জন্য জাজাকাল্লাহ আপু
ভালো লাগ্লো...
মন্তব্য করতে লগইন করুন