ভালোবাসি
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৮:৩১:৪৩ রাত
বিষাদে ছেঁয়ে থাকা ভাবুক মন আজ আমার! ভাবনার লাগাম একটু একটু ঢিলে করে মন পাখিটা ডানা ঝাপটায় স্মৃতির আকাশে! পুরোনো দিনগুলির স্মৃতিবিজরিত মুহূর্তগুলো মনের ক্যানভাসে হঠাৎ জীবন্ত হয়ে উঠে!
এই বৈচিত্রময় জীবনে প্রতিদিন কতো কিছুই না ঘটে! কতো দুঃখ সুখের উপাখ্যান দিয়ে আমাদের জীবনের সাতকাহন রচনা হয়। একটু একটু করে তা মনের ঘরে রাখা আলমারিতে জমে থাকে। কখনো নাড়া পড়লেই তা আবারো নতুন করে তার অতীত ইতিহাসকে স্মরন করিয়ে দেয়!
সেই প্রথম দিন যখন বাবার হাত ধরে প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম, বাবা বেন্চে বসিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে দোআ করে বলেছিলেন যেনো লক্ষীমেয়েটির মতো পড়াশোনা করি! আমার আর আমার বাবার দুজনের চোখই ছলছল করছিলো,আমি তো কেঁদেই দিয়েছিলাম! যতক্ষন না আমি শান্ত হয়েছিলাম, বাবা আমাদের ক্লাসের সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। প্রথম দিন স্কুল শেষ হলেই বাবার সাথে আমি বাসায় ফিরেছিলাম!
আম্মুকে প্রায় কিছু জরুরী কাজে নানু বাড়ি যেতে হতো, তখন আমাদের কাউকে সাথে নিতে চাইতেন না। আম্মুর আঁচল ধরে কতো না কান্না করেছি, বায়না ধরেছি আম্মুর সাথে যাওয়ার জন্য! আম্মু আমাদের বলতেন, মাত্র দুই কি তিন দিনের জন্য যাচ্ছি। দেখতে দেখতে চলে আসব। তোমারা এই সময় তোমাদের আব্বুকে একদম কষ্ট দিবে না। নিজেদের এবং পরিবারের সবার খেয়াল রাখার কথা আমাদের বুঝিয়ে বলতেন! আম্মু চলে গেলে আম্মুর অবর্তমানে বাসায় যে কতো অসহায় লাগতো! বুকের জমানো মেঘের পাহাড় তখন বিরামহীন বৃষ্টি হয়ে ঝরতো!
আমার প্রথম সন্তান পৃথিবীত আসার কিছুক্ষন আগের ঘটনা, হাসপাতালে যাব! আমার বড় ভাইয়া আমাকে বিদায় দেয়ার সময় শুধু এদিক ওদিক মুখ ঘুরিয়ে রাখছিলেন। অনেক কষ্টে অস্ফুট স্বরে বলেছিলাম, ভাইয়া আমার জন্য দোআ করবেন! ভাইটি আমার এমন ভাবে কেঁদে উঠলেন! দু ভাই-বোন মিলে কাঁদতে কাঁদতে বিদায় নিয়েছিলাম!
প্রথমবারের মতো প্রবাসে আসি সেদিনের ঘটনা আজো বিস্মৃত হইনি! মনে পড়ে মায়ের কথা! আমাদের বাসা থেকে এয়ারপোর্টের দূরত্ব সব মিলিয়ে দুই-আড়াই ঘন্টা, সারাটা রাস্তা মা আমার হাতটা শক্ত করে ধরে বসেছিলেন! লম্বা ঝাপটি নিকাবের মধ্যে আবৃত থেকেও যে মা নিঃশব্দে কেঁদে চলেছিলেন পুরোটা রাস্তাটা, বুঝতে পারছিলাম। বুকের ভিতরটা দুমরে মুচরে আসছিলো, ভিতর জমিয়ে রাখা সকল ভলোবাসাগুলি বিদ্রোহ করে চিৎকার করে জানান দিতে চাইছিলো মা,তোমাদের সবাইকে আমি ভীষন ভালোবাসি! অনেক ভালোবাসি! আমি কিভাব থাকবো তোমাদের ছেড়ে এতো দূরে!!!!!
হাঁটি হাঁটি পা পা করে আমাদের চার জনের সংসারের বয়স আলহামদুলিল্লাহ প্রায় ১৫ বছর হতে চলেছে! ভালোবাসার রক্তিম সূর্যটা প্রতিদিন একটা নতুন ভোরের জানান দেয়! আমার যে মেয়েটা মাথায় দুটো ঝুটি বেঁধে চুলগুলোকে দুলিয়ে দুলিয়ে খেলতো তাঁর এখন সবকিছুতেই গাম্ভীর্ভতা, কেমন একটা বড় হয়ে গেছি গেছি ভাব! কোন কারনে আমার বাসায় ফিরতে দেরী হলে ফোন করে দুঃশ্চিন্তা প্রকাশ করে কখন বাসায় ফিরব! আমার কোন আচরনে ত্রুটি দেখতে পেলে সাথে সাথেই আমাকে তা সংশোধন করে দেয় বিজ্ঞের মত। বিকেলের অবসরে আমাকে কাপুচ্চিনো বানিয়ে দিবে আর বলবে আগামী এক মাস আমি ছুটি নিব কাপুচ্চিনো বানানোর দায়িত্ব থেকে! আবার একটু পরে নিজেই জিজ্ঞেস করে আম্মু কাপুচ্চিনো খাবে? আমার ছোট্র ছেলেটাও শিখে গেছে কিভাবে মায়ের সেবা করতে হয়। মাঝে মাঝে অসুস্হ হয়ে যখন ঔষধ খাই তখন কাছে এসে বলে, তোমাকে একটু ম্যাসেজ করে দিব? আজকে আমি ঘর গুছাব, পাস্টা রান্না করব তোমার কোন কষ্ট করতে হবে না!
স্বামী-সন্তান আর সংসারের ভালোবাসা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে, মায়ার বন্ধন দৃড় থেকে দৃড়তর হচ্ছে, এর সমাপ্তি কোথায় জানিনা!
প্রথম দিকে প্রবাসজীবনের সুখ- স্বাচ্ছন্দের মাঝে কোন কিছুর অভাব না থাকলেও অভাব ছিলো সজ্জনব্যক্তিদের! আলহামদুলিল্লাহ, এরমাঝে পরিচিত হয়েছি কতো অসংখ্য মানুষের সাথে! পেয়েছি কতো ভালোবাসার সাহচার্য! চেনা -জানা, পরিচিত আর ভালোলাগার মানুষদের ভালবাসার রকমারি ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে আমার সমগ্র ভালোবাসার বাগান!
এই ভালোবাসাময় জীবনটা যেনো স্বপ্নের ডানা মেলা কোন পাখি! এই পাখি শুধু ভালোবাসার সুর তুলে যায় জীবনের পরতে পরতে। ভালোলাগায় ভরিয়ে দেয় প্রতিটি মুহূর্ত!
আবার কখনো প্রিয় জনের অসুস্হতার বা কোন দুর্ঘটনায় মন ভারী হয়ে ওঠে, কারো সুসংবাদে উৎফুল্লতায় ভরে ওঠে মন প্রান!
ভাবছিলাম এতো গভীর যে ভালোবাসা কোথায় এই ভালোবাসার উৎস ? কে সৃষ্টি করলেন? শুধু মানবজীবনের নির্দিষ্ট গন্ডীর বাবা-মা,ভাই-বোন,স্বামী-স্ত্রী, সংসার-সন্তানের ভালোবাসাই নয় বরং সমগ্র বিশ্ব-প্রকৃতির মাঝে আড়ালে আবঢালে আনাচে কানাচে জড়িয়ে থাকা ছড়িয়ে থাকা সকল ভালোবাসার মূল একচ্ছত্র অধিপতি যিনি, যিনি পাহাড়, ঝর্না, সমুদ্রতট,ফল,ফুল পাখি,প্রজাপতি দিয়ে পৃথিবীটাকে এতো সুন্দর করে সাজিয়েছেন, সব কিছুতেই রেখেছেন নয়নজুড়ানো ভালোবাসার অতৃপ্ত রেশ, যার অসীম রহমতের ফলে প্রতিটি অন্তরে ভালোবাসার অনুভূতি সৃষ্টি হয়, সবাইকে এতো ভালোবাসি, সবার ভালোবাসা গ্রহন করি, যিনি আমাদের দিয়েছেন ভালোবাসার মতোন একটি অন্তর তাঁর ভালোবাসা ঠিক কতোটুকু অর্জন করতে পেরেছি?
আসলেই কতোখানি ভালোবাসি আমার প্রভুকে? যতোটুকু ভালোবাসি বাবা মা, ভাই বোন,স্বামী সন্তান, স্বজনদের তার ঠিক কতোটুকু ভালবাসি মহান সৃষ্টিকর্তাকে! যার অশেষ করুনাতে আজ এতো নিয়ামতের অধিকারী হয়েছি কতোখানি স্মরন করি তাঁকে শুকরিয়া প্রদর্শনে?
কোথায় ছিলাম এই আমি? আজকের পরিপূর্ন মানুষ! কারো মেয়ে, কারো মা, কারো স্ত্রী! যিনি আমাকে সৃষ্টি করলেন সবচেয়ে বেশী ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার যিনি রাখেন তাঁকে কতোখানি ভালোবাসি আমি? তিনি আমাকে অনস্তিত্ব থেকে অস্তিত্ব দান করেছেন, তারপর পর্যায়ক্রমে মাতৃগর্ভে কতই না ইহসানের সাথে দেহের রং, রুপ, আকৃতি সৃষ্টি করেছেন! সুস্হ অবস্হায় এই পৃথিবীতে এসেছি , চলছি, ফিরছি, যে চোখ দিয়ে দেখছি, যে হাত দিয়ে ধরছি, পা দিয়ে হাটছি, মস্তিষ্ক দিয়ে চিন্তা করছি, অন্তর দিয়ে অনুভব করছি সবকিছুি তো সৃস্টিকর্তার অসীম অনুগ্রহ!
আমি যখন মাতৃগর্ভে ছিলাম একটা ছোট্ট ভ্রুনশিশু হিসেবে , খাদ্য দিয়ে পুষ্টি দিয়ে তিনি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন! মহান প্রভু এখনো আমাকে অক্সিজেন, খাদ্য, পানীয়, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্হান, চিকিতৎসা, আমার অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যা কিছু প্রয়োজন সমষ্ত কিছু দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন! তারপরো কি আমি ফিরে আসব না তাঁর ভালোবাসার কাছে?
আজ যে দুটি চোখ দিয়ে পৃথিবীর এতো নিয়ামত অবলোকন করছি, প্রিয়জনদের দেখছি, প্রিয় সন্তানদের স্পর্ষ করছি, আদর করছি এমনওতো হতে পারত আমি কখনো দেখতে পেতাম না আমার মা কেমন? আমার সন্তান কেমন? কেমন আমার স্বামী? আজ দৃষ্টির মতো নিয়ামত যিনি আমায় দিলেন এই দৃষ্টিশক্তিকে আমি আমার প্রভুর নির্দেশ মোতাবেক ব্যবহার করছি কি?
ইদানিং বেশ আ্যজমায় ভুগছি। মাঝে মাঝে শ্বাষ নিতে গিয়ে মনে হয় এতো বিশাল পৃথিবী যা অক্সিজেনে পরিপূর্ন তবু আমি কেনো শ্বাষ নিতে পারছি না? বুকের ভিতর ফুসফুসটা চেঁপে আসে, মুখ টা হা করেও বাতাস নিতে পারি না! পিঠেও প্রচন্ড রকম ব্যথা শুরু হয়ে যায়! কি যে অসহনীয় কষ্ট তখন শুধু আমার চোখ ফেটে কান্না আসে!
অনেক আগে এস,বিতে থাকতে ভিশন-২০৫০ ভাইয়ের একটি পোষ্টে তারাচাঁদ ভাইয়ের একটা কমেন্ট পড়েছিলাম যা আমাকে অনেক উপকৃত করেছিলো বিষয়টি উপলব্ধি করার জন্য।
শ্বাসকষ্টের রোগীদের কৃত্রিম অক্সিজেন নিতে হয় । বাংলাদেশের মাঝারি মানের ক্লিনিকে প্রতিঘন্টায় অক্সিজেন নিতে ব্যয় হয় দুইশত টাকা । চব্বিশ ঘন্টায় খরচ মাত্র পাঁচ হাজার টাকা । একমাসে দেড়লাখ টাকা । এক বছরে আঠার লাখ টাকা ।
সারাজীবনে কতো টাকার শুধু অক্সিজেন ব্যাবহার করে যাচ্ছি আমরা সেই টাকার হিসাব করা কি সম্ভব? তারপরেও কি ফিরে আসবো না পরম দয়ালু প্রভুর নিকট?
সূরা বুরুজের وَهُوَ الْغَفُورُ الْوَدُودُ-(তিনি ক্ষমাশীল , প্রেমময়! ) এই আয়াত যতই পড়ি মনটা কেমন শিহরিত হয়! আল্লাহ'র সমস্ত করুনা, দয়া আর ভালোবাসার কাছে মাথা নত হয়ে আসে। নিজের অপারগতার কথা স্মরনে আসে স্পষ্টতই বুঝতে পারি দুনিয়ার স্বার্থজড়িত সকল ভালোবাসার মোহে জড়িয়ে এমনি মোহান্ধ হয়ে পড়েছি, প্রকৃত মালিকের ভালোবাসা অর্জন করা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি!
হে প্রভু, আমার ঈমান নামক বৃক্ষটিকে তুমি মজবুতী দান করো, উত্তম আমল দিয়ে ফুলে ফলে সুশোভিত করো, এর শিকড়কে দৃড়তা দান করো যেন তা তোমার ভালোবাসার রস সিন্চন করে আমৃত্যু ইবাদাহ করে যেতে পারে! তুই যা ভালোবাসো, যাদের ভালোবাসো, যে পথ ভালোবাসো আমার হ্রদয় তুমি সেদিকেই পরিচালিত করো!
বিষয়: বিবিধ
১৫২৯ বার পঠিত, ৩৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
নবী মোহাম্মদ
ভয় কি আর আছে বল
থাকলে মহব্বত
ভাল লাগল
আল্লাহতায়লা আমাদের জন্য কত নিয়ামত দিয়েছেন তা আমরা এই জীবনে ব্যবহার করেও শেষ করতে পারিনা। তবুও অনেকের মনে কেন থাকে না পাওয়ার বেদনা। আর আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতার অভাব।
অনেক ভালো আপু লেখাটা। সুস্থতার জন্য দোয়া রইলো
নিরন্তর শুভকামনা রইলো আপুনি।
আপনার প্রো-পিকটি বেশ ভালোলাগলো
আপু বানাতে গেলে কোন সমস্যা হলে বলবেন! খুবি সহজ! ইনশা আল্লাহ সুন্দর হবে, ভাববেন না!
লেখাটা অসাধারন হয়েছে আপু। ভাষাগত, বিষয় বিশ্লেষণ, শিক্ষা সবদিক থেকে মাশাল্লাহ! এমন মেধাকে চাপা দিয়ে রাখা অপরাধ। আবার হারিয়ে যেওনা যেন, নইলে আমিও কাজলা দিদির মত পালিয়ে যাব
আপু আপনি আমাদের বৃক্ষাপু যে, আপনি না থকলে হবে কি ভাবে?????? কোনভাবেই তা মেনে নেয়া যায় না!!!
শুভকামনা রইলো
মন্তব্য করতে লগইন করুন