আলোকিত করো মোর জীবনটারে
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ০৪ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৪:২১:২৭ রাত
ফজরের সালাত শেষে ধীর পায়ে জানালার সামনে এসে দাঁড়াই! জানালার গ্লাসে জমে থাকা বিন্দু বিন্দু শিশির! বাইরে তখনো অন্ধকারের কালো চাদর ছড়ানো! সামনের বাগানে সারি বাঁধা গাছগুলো প্রকৃতির নিরব দর্শক! আমি আকাশের দিকে চোখ মেলি! দিগন্ত প্রসারিত দৃষ্টি তাকিয়ে তাকিয়ে কি যে খুঁজি নিজেও জানিনা! শুধু জানি এই মুহূর্তটা আমার খুব প্রিয় মুহূর্তগুলোর একটা!
আমি চোখ বন্ধ করি! ভাবতে থাকি ঠিক এই মূহুর্তটা- আমি , পৃথিবী নামক গ্রহটির ইউরোপ মহাদেশের ক্ষুদ্র একটি দেশের ছোট্র একটি শহরে জানালার সামনে দাঁড়ানো! পৃথিবী ঘূর্নায়মান কিন্তু আমি ছিটকে পড়ে যাই না, অদেখা মধ্যাকর্ষন শক্তির কারনে আমি স্হির কিন্তু আমার চিন্তাগুলো সৌরজগতের কক্ষপথের মতোই সদা ঘূর্নায়মান! এলোমেলো ভাবনাগুলো বিক্ষিপ্ত নক্ষত্রের মতোই আলোড়ন তোলে মনে-প্রানে!
কোরআনে কিছু আয়াতে আমাদের নিদ্রার কথা এসেছে! নিদ্রা বা ঘুমকে মৃত্যূর সাথে তুলনা করা হয়েছে - একটি হল প্রকৃত মৃত্যূ "মাউতি কুবরা" , আরেকটি নিদ্রাকে বলা হয় 'মাউতি সুগরা' বা 'ছোট মৃত্যূ'। এই নিদ্রা আমাদের জন্য মহান আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন। আমরা কেউ কি পারবো ক্রমাগত দিনের পর দিন জেগে থাকতে না ঘুমিয়ে? তা কি সম্ভব? আর ঘুমিয়ে থাকলে উঠাও কি সম্ভব যদি আল্লাহ আমাদের জাগ্রত না করেন?
প্রতিদিন প্রভাতে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে, আল্লাহ যেন আমাদেরকে নতুন জীবন দান করেন। আমাদেরকে পূণ্যআমল করার, বিশ্বাসী হবার, আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করবার জন্যে নতুন সুযোগ করে দেন। অথচ আমরা অধিকাংশই সেটা উপলব্ধি করি না। প্রতিটা দিন যেন আমাদের জন্য আল্লাহর দেয়া নিয়ামত। আমাদের নির্ধারিত হায়াত এই এক একটি দিনের সমষ্টি! একটি দিন অনেক মূল্যবান, একটি দিনের বিনিময়ে বান্দা যেমন অসংখ্য সৎ কাজ করতে পারে তেমনি তার দ্বারা হয়ে যাওয়া ভুলভ্রান্তির জন্য প্রভুর নিকট ক্ষমাও চাইতে পারে! একটি দিনের পরিনতি আমাদের জান্নাতী করতে পারে, জাহান্নামের আযাব থেকে রক্ষা করতে পারে!
রাতের ক্রান্তি লগ্ন শেষে ঊষার সূচনালগ্নের প্রথম প্রহর! সত্যি অসাধারন! এই বিশ্বজগত, মহাকাশ, সৌরজগত, নক্ষত্রপুঞ্জ , গ্যালাক্সি-নাম না জানা আরো কতো কিছু ! সমস্ত সৃষ্টির মাঝে উপলব্ধি করতে চাই আল্লাহ সুবহানাহু তা'য়ালার জ্ঞান, প্রজ্ঞা, ক্ষমতার বিশালত্ব! আমার মতো ক্ষুদ্র মানুষের পক্ষে এর সামান্যতম ধারনাও যে অসম্ভব বোধ করি! তারপরো এক গহীন কোন হতে আমার সত্ত্বা বলে উঠে- প্রভু! নির্জন এই নিশ্চুপ ধরনীতে আমি শুধু তোমার নির্দেশকে পালন করার জন্য জেগে উঠেছি! তুমি আমাকে সত্যের সাক্ষ্যদানকারীদের মাঝে শামিল করে নাও!
.
প্রভাতের পূর্ব আকাশে সুন্দরতম যে জিনিসটি দেখতে পাই তা হচ্ছে সূর্যোদয়। সূর্য- হাইড্রোজন আর হিলিয়াম গ্যাসের জ্বলন্ত গোলাক মাত্র ! এমন এক প্রদীপ যার চতুর্দিকে কয়েক কোটি মাইলের মধ্যে কোন অন্ধকার নেই! গবেষনা থেকে জানা যায় পৃথিবী থেকে সূর্যের গড় দূরত্ব প্রায় ১৪.৯৬ কোটি কিলোমিটার! এতো দূরত্বে থেকেও সূর্য থেকে আলো পৃথিবীতে আসতে ৮ মিনিট ১৯ সেকেন্ড সময় নেয়। এভাবেই প্রতিটি আঁধার রাতের অন্ধকার বিদীর্ণ করে দিনের আলো ও উজ্জ্বলতা নিয়ে আলোর বিচ্ছুরণ দিয়ে চারিদিক উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে! আমরা যাকে বলি শুভ সকাল! নিত্য প্রবাহমান এই ঘটনাকে গতানুগতিক নিয়ম মনে করি, একে নিয়ে চিন্তা করি না, কোন উপদেশও গ্রহণ করি না। এজন্য আল্লাহ সুবহানাহু তা'য়ালা সূরা ক্বসাসে বলেন- ‘তোমরা ভেবে দেখেছ কি, যদি আল্লাহ রাতকে তোমাদের উপর কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী করে দেন, তবে তাঁর পরিবর্তে কোন ইলাহ আছে কি যে তোমাদের আলো এনে দেবে? তবুও কি তোমরা শুনবে না’?
যদি এরকম হয়, অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি সূর্যোদয়ের কিন্তু তা হচ্ছে না! পৃথিবীকে আলোকিত করছে না! উদ্ভিদজগত থেকে শুরু করে প্রানীজগত আমরা সবাই সূর্যের আলোর প্রতি প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল! সালোকসংশ্লেষন প্রক্রিয়া চালু না থাকলে কোন গাছ সজীব থাকবে না, যে শ্বাষ গ্রহন করি অক্সিজেন দিয়ে, যে কার্বন ডাই অক্সাইড বিতরন করি প্রতিমুহূর্তে এই জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া ত থেমে গেলে আমাদের অবস্হা আর যাই হোক অনেক ভয়াবহ পরিনতি তো আছেই ছোট্র পরিনতি দু চোখ ভরে আর কোন দিন সবুজ প্রকৃতি অবলোকন করা হবে না!
আমরা যদি সৃষ্টিজগতটাকে নিয়ে একটু চিন্তা করতাম তাহলে সৃষ্টির ভাঁজে ভাঁজে আমাদের সৃষ্টিকর্তার নৈপুন্যতা,সৃষ্টিশীলতা এবং হিকমাহ উপলব্ধি করতাম, হিদায়াতের পথে আরো অটল থাকতে পারতাম!
প্রতিদিন সকালে আমাদের ঘুম থেকে জেগে ওঠা আর প্রভাতে সূর্যোদয় এর মাঝে অদ্ভুত একটা মিল আছে দুটিও আল্লাহ'র নির্দেশক্রমে হয়! আল্লাহ'র সকল সৃষ্টি আল্লাহ'র সমস্ত ইচ্ছার কাছে সমর্পিত, বাধ্যগত! শুধু মাত্র আমরা মানুষরাই সঠিকভাবে আত্নসমর্পন করিনা! আনুগত্য করিনা!
একটিবার যদি চিন্তা করি আজকের ঘুমের পর আর উঠব না,পৃথিবীর জীবনে এটাই আমার শেষ ঘুম! এই ঘুমে থাকা অবস্হায়ই মালাকাল মাউত আসবে আমার রুহ হরন করতে, আসলেই কি আমি নফসে মুতমাইন্নার অধিকারী হতে পেরেছি? আমার জন্য কি রহমতের ফরেশতারা আসবেন? দিবেন কি জান্নাতের সুসংবাদ?
যদি তুমি দেখতে পেতে, যখন অপরাধীরা তাদের প্রভুর সামনে মাথা নীচু করে [ বলবে ] : " হে আমাদের প্রভু ! আমরা দেখলাম এবং আমরা শুনলাম এখন তুমি আমাদের পুণরায় [ পৃথিবীতে ] প্রেরণ কর। আমরা সৎ কাজ করবো। কারণ [ এখন ] আমরা প্রকৃতই বিশ্বাস করি। কোরআনের এই আয়াতটি (সাজদা-১২) আমাদের প্রত্যেকের জন্য রিমাইন্ডার হিসবে কাজ করে, আজ বেঁচে আছি তাই পড়ে নিয়ে সংশোধিত হলে আমার আমল সুন্দর হবে কিন্তু এই আয়াতের ভয়বহতা পরকালে আমাদেরই কারো জন্য অপেক্ষা করছে! আমরা কি প্রস্তুত? পারবো কি সেই ভয়াবহ জাহান্নামের স্বাদ আস্বাদন করতে?
কোটি কোটি মাইল দূর থেকে সূর্যরশ্নি আসছে পৃথিবীকে আলোকিত করতে, মেঘ গুলো একটু একটু করে আলোর আভা ধারন করছে! শুনি পাখির কিচির মিচির! দেখি কচি সবুজ গাছের পাতাগুলো দুলছে! কি অপরুপ সৌন্দর্য! "সমস্ত প্রশংসা সেই আল্লাহর জন্য যিনি আমাদেরকে মৃত্যূ (নিদ্রা) দেবার পর জীবিত করলেন এবং তাঁরই দিকে আমাদের প্রত্যাবর্তন"। আল-কোরআন আমাদের জন্য আলো স্বরুপ। পাশা পাশি হাদিসগুলো! এই ওয়াহীর বানীগুলো অন্তরে ধারন করে পৃথিবীর পথটুকু পাড়ি দিলে এই জীবন নামক পথটিও সত্য,সঠিক ও সুন্দর আলোয় আলোকিত হয়ে উঠবে!
( আমাদের একজন ভাই গতকাল ঘুমন্ত অবস্হায় ইন্তেকাল করেছেন! ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউ'ন। সবাই ভাইটির জন্য দোআ করবেন।)
বিষয়: বিবিধ
২৩১০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন