হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ১৪ নভেম্বর, ২০১৩, ০৮:৩৭:১২ রাত
লাল টকটকে আপেলটা কচ কচ করে চিবুচ্ছিলো নিকিতা। আপনমনে লম্বা কড়িডোর দিয়ে হাঁটছে আর খাচ্ছে। মনে হচ্ছে এই কড়িডোরে হেঁটেই বিশ্বভ্রমন করে ফেলবে। নিকিতার মা রিমিলা রান্না করছিলেন আর আড় চোখে মেয়ের কর্মকান্ড দেখছিলেন। মেয়েটা কিভাব চোখের পলকে বড় হয়ে যাচ্ছে! মাঝে মাঝে এমন হয় ওর মতি গতিও বোঝা দায় হয়ে পড়ে! মুখের মাঝে আলো ছায়ার অদ্ভুত খেলা অবিরাম চলতে থাকে! এইতো মেঘলা আকাশ তো পরক্ষনেই রোদলা বিকেল, কিছুক্ষন পরে ঝর ঝর বর্ষা! রিমিলা রান্না শেষ করে হাত মুছতে মুছতে রুমে ঢুকবেন ভাবছিলেন- কন্যার লম্বা পায়চারী বাদ সাধলো!
- নিকি, এভাবে কড়িডোরের এ মাথা ও মাথা হাঁটছো কেনো?
- কারন হাঁটা স্বাস্হ্যর জন্য ভালো! ঝটপট জবাব নিকিতার।
- আজ আমার হাতে একটু সময় আছে চলো দুজনে মিলে তোমার আলমারিটা গুছাই।
-নাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআা! চিত্কার করে দৌড়ে এসে আলমারির সামনে দাড়িয়ে পিছন থেকে দুহাত দিয়ে ধরে রাখলো!
-কি হলো? বিষ্ময় চোখে রিমিলার প্রশ্ন!
-না আম্মু আজ না! অন্য দিন! কেমন?
-না, কেনো?
-আমার আলমারির ভিতরের সূর্যটা আজ একটু তাড়াতাড়ি ডুবে গিয়েছে, ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত। দরজাটা খুললেই ক্যা ক্যা করে বাদুড়েরা বের হয় আসবে, লাল লাল চোখ দিয়ে দেখে, বিভত্স দাত দিয়ে ক্যাক করে কামড় দিবে তোমাকে! প্লিজ আম্মাউ আজ থাক! প্লিজ প্লিজ!
- নিকির অভিনয় দেখে মা ফিক করে হেসে ফেললেন। তোমার নাটক আমার জানা আছে নিকি ! আসো হাত লাগাও দুজনে মিলে করলে শেষ হয়ে যাবে একদম সময় লাগবে না!
যেই না মেয়েকে টেনে আলমারির সামনে থেকে সরিয়ে দরজা খুললেন সাথে সাথে উপর থেকে ধুপধাপ করে জমিয়ে রাখা জামা কাপড় পড়তে থাকলো! রিমিলা কিছু বলার আগেই নিকিতা শুরু করে-
-আমি আগেই বলেছিলাম খুলোনা! আমার কোনো দোষ নেই!
-কিভাবে এতো অগোছালো করে রাখো আলমারিটা? তাইতো বলি ঘুরেফিরে একই জামা পড়ে স্কুলে যাও কেনো?
-একটা সুবিধা আছে, কি জানো? আলমারির সামনে দাড়ি্যে মাথা খারাপ করতে হয়না কোন জামা পড়ব? কোন টা আজ কোনটা কাল!
-থাক্ আর সাফাই গাইতে হবেনা, দিনে দিনে ফাজিলের হাড্ডি হয়েছো একটা!
মা মেয়ে দুজন হাত লাগালো আলমারি গোছাতে। কোন জামা লম্বায় খাট তো কোনটা পাশে টাইট, কোনটা ওর আর পছন্দই নয় আচ্ছা এই জামাটা আর পড়তে দেখি না কেনো তোমাকে?
-কারন জামাটা গোলাপী! আমি আর সাত বছরের বাচ্চা নই! খুব বেশি ফেম্মিনিল কালার মনে হয় গোলাপীকে !
-কি! গোলাপী কালার ফেম্মিনিল ! এই তো কিছু দিন আগেও এই গোলাপী রং ছাড়া তুমি বাঁচতে না! অবাক স্বরেই কথটা বললেন রিমিলা!
সেদিনের ছোট্র মেয়েটা একটু একটু করে বড় হয়ে যাচ্ছে! ওর চিন্তা চেতনা, ধ্যানধারনাতেও পরিবর্তন এসেছে। একটা অজানা শংকা মনটাকে নাড়া দিলো! মায়েদের কি ভয় হয় সন্তানদের এভাবে বড় হয়ে যেতে দেখে? কি জানি!
বলছিলে গোলাপী রং তোমার আর পছন্দ নয়, তো কি রং পছন্দ আমার সুইট হার্টের?
- সুইট হার্ট বলবানা, টু মাচ ফেম্মিনিল! বলছিলাম রং এর কথা-আকাশী, বেগুনি, সাদা, কালো, লাল,নীল ডিপেন্ড করে কম্বিনেশনটা কেমন! মাঝে মাঝে লাল রংটা তো ভালো লাগে মনে হয় পুরো পৃথিবীটাকে লাল মোড়কে পেঁচিয় রাখা যেত!
-আর ফুল ? সাদা গোলাপ, নীল গোলাপ, ইরিস অনেক ফুল ভালো লাগে! তবে স্পেশালি টিউলিপ-বিশাল বাগান জুড়ে সারি সারি টিউলিপ, আমি হেটে বেড়াই, আমার হাতে একটা ঝুড়ি আমি তাতে টিউলিপ কুড়াই, টিউলিপ লাগাই- বলতে বলতে কিছুক্ষন আগে ওর মা যে কাপড় গুলো উঁচু উঁচু করে ভাঁজ করে রেখেছিলো দুহাত দিয়ে তা দুপাশে ছিটিয়ে ফেলেদিলো- ফুল ছড়ানোর মতো করে!
নিকিতাআাআাআাআাআআাআাআাআাআাআাআাআাআাআাআা!
আমার কি দোষ? তুমিই তো বললে পছন্দের কথা বলতে! আর আমি বলতে বলতে আমার ফ্যান্টাসি কিংডমে চলে গিয়েছিলাম! আচ্ছা আমি গুছিয়ে দিচ্ছি! তাও তুমি রাগ করোনা, পৃথিবীতে সবচাইত কষ্টের বিষয় তোমার রাগান্বিত চেহারা দেখা!
-আমি কি এতো বেশি বেশি রাগ করি নাকি?
-করো না আবার? থাক পরে বলব রাগলে তোমাকে কেমন দেখায়! এখন বলি, কোথায় যেনো ছিলাম ? আচ্ছা আম্মু তোমার প্রিয় রং কি শুধু সবুজ?
-আসলে আমি না কখনো সত্যি ভাবি নি ঠিক কোন রংটা আমি প্রচন্ড ভালোবাসি, মনে হয় সেভাবে ভাবার সুযোগ পাই নি, আমার কাছে বলতে গেলে সব কালার ভালো লাগে, নির্দিষ্ট কিছু আলাদা করতে পারিনা কেনো জানি। যেমন ধরো অনেক ফুলই তো ভালো লাগে, ফুলের গন্ধ ভালো লাগে, ফুলের রং ভালো লাগে, ফুল সাজাতে ভালো লাগে, সবই ভালো লাগে বললাম না ওভাবে ফিক্সড করা হয়নি কখনো! আমার কি মনে হয় জানো আমি মনে হয় কখনো স্পেশাল ছিলাম না তাই কেউ জানতেও চায় নি, আমারো ভাবা হয়নি!
-না আম্মু তুমি ঠিক সেটা না! তুমি কখনো নিজেকে সময় দাও নি, নিজকে জানতে চাও নি,নিজর পছন্দ অপছন্দ গুলো নিয়ে ভাবো নি, কারন তুমি যে পরিবেশে বড় হয়েছো সে পরিবেশে নিজের পছন্দের চাইতে অন্যের পছন্দকেই বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়! সচরাচর আমাদের দেশে যা হয় আর কি! বিখ্যাত দার্শনিক সক্রেটিস কি বলেছে জানো? তার বিখ্যাত উক্তি ছিল: নিজেকে জানো। তুমি যদি তোমাকেই ভালো ভাবে না জানো অন্যকেও বুঝতে পারবেনা কখনো!
মনে মনে চমকে উঠলো রিমিলা, মেয়ে যে দার্শনিক তত্ত্ব দিয়ে ওকে বুঝিয়ে দিচ্ছে! এটা রিমিলার ভাবনার বাইরে ছিলো! অবাক হলো কিন্তু মেয়ের দূরদর্শিতা ভালোও লাগলো! নিকিতা বলছিলে যে আমার রাগান্বিত চেহারা দেখলে কষ্ট পাও আর কিসে কষ্ট পাও?
-আমি যখন দেখি আফ্রিকার ছোট ছোট শিশুরা পানির আর খাবারের জন্য কষ্ট করছে, যখন ওদের হাড্ডিসার শরীরটা চোখে পড়ে অনেক খারাপ লাগে, আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে হলে, আমার পছন্দের কার্টুন যখন দেখি তখন যদি এসে বলো, উঠ, এখন আমি বসবো! কম্পিউটার এখন আমার! টেরিবল! কার্টুনে নায়ক বা নায়িকা মরে গেলে হু হু হু করে কৃত্রিম কান্নার অভিনয় করলো কিছুক্ষন নিকিতা, আর যখন তুমি আমাকে বকা দাও, কথা বলা বন্ধ করে দাও, আমি পাশে দাড়িয়ে আছি আর দেখাও যে আমাকে দেখোইনি খুব খুব কষ্ট লাগে তখন! অভিমানে চোখ দুটি জ্বল জ্বল করতে লাগলো নিকিতার!
ইস আমার মা টাকে আমি একদম কষ্ট দিতে চাই না, আম্মু রাগ হই এমন কাজ না করলেই তো হয়! বলে মেয়েকে আদর দিতে গেলেন আর ঝট করে সরে গেলো নিকিতা, আম্মু আমি আর বাচ্চা মেয়ে নই যে কথায় কথায় আমার গাল ধরে আদর করবে!
- উফ্ ঠিক আছে ঠিক আছে হার মানলাম! নিজের মেয়েকে ইচ্ছে মতো আদরও করতে পারবোনা! আচ্ছা আমি কি করলে তোমার ভালো লাগে?
-তুমি যখন তোমার বান্ধবী স্বাতী আন্টির সাথে গল্প করো তখন! তোমাকে আর আন্টিকে দেখলে মনে হয় ঠিক যেনো দুজন শিশু আপন মনে গল্প করছো, কোন বাঁধা নাই, ভয় নাই , দ্বিধা নাই নিশ্চিন্ত আলাপ! আর জানো তখন তোমাদের দুজন কে না তখন কারো আম্মু মনে হয় না, যাস্ট ফ্রেন্ড! আমি খুব এনজয় করি তোমাদের বন্ধুত্ব!
রিমিলা হাতের কাপড়টা একপাশে সরিয়ে রাখলো, তার কখনোই জানা ছিলো না তার মেয়ে তাকে এত নির্ভুল ভাবে পর্যবেক্ষন করে, বুকের ভিতরটা ভালোলাগায় কেঁপে কেঁপে উঠলো! গলার স্বরটা একটু ভারী হয়ে আসলো রিমিলার-
নিকি, আমার কাছে মনে হতো আমি কখনোই স্পেশাল ছিলাম না, কিন্তু তোমার কাছে থেকে কথাটা জানার পর আমার নিজেকে অনেক স্পেশাল মনে হচ্ছে!
আম্মু তুমি আমাদের কাছে সব সময় স্পেশাল ছিলে, আছো! আমরা অনেক সৌভাগ্যবান তোমার মতো এমন স্পেশাল মা আছে আমাদের! যদিও মাঝে মাঝে তুমি এই আরকি (দুষ্টুমি খেলা করে নিকির চোখে...)
ছোট্র মেয়েটা তাঁকে কিভাবে বুঝে! কখনোই মেয়ের সাথে এভাবে বিষয়টা আলোচনা হয়নি জানাও হয়নি! সামনে থেকেও লুকিয়ে ছিলো মেয়েটা!রিমিলার চোখে তখন স্পষ্ট পানি,তা ঢাকতে তিনি বললেন এবার আলমারিটা খোলো দেখো কিভাবে গুছিয়েছি!
প্রচন্ড রোদের আলো থেকে বাঁচার জন্য যেভাবে মুখের সামনে হাত দিয়ে ছায়া সৃষ্টি করে, নিকি ঠিক সেভাবে আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে দু হাত চোখের সামনে মেলে ধরলো, আহ্ আহ্ এত্তো আলো তাকানো যাচ্ছে না! উফ্ উফ্ আলমারির ভিতর সূর্য উঠেছে আজ..........।
রিমিলা, নিকিতার কান্ড দেখে না হেসে পারলো না! মা মেয়ে দুজনে একসাথে হেসে উঠলো!
বিষয়: বিবিধ
২৬৩১ বার পঠিত, ৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
একটু বড় হয়ে গেছে কী!
অনেক শুকরিয়া সফরের কিছু অংশ আমার গল্পে এসে ভ্রমন করার জন্য! শুভকামনা জানবেন!
গল্প পড়েছেন কিনা তাই বলেন ?
মন্তব্য করতে লগইন করুন