ভাবনায় রংধনু
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ১৩ নভেম্বর, ২০১৩, ০৬:১২:৩০ সন্ধ্যা
শীতের সকালের হিমেল হাওয়ায় জড়সড় প্রকৃতি যেনো কুঁকড়ে আছে। কুয়াশার চাদরটা একটু একটু করে সরে যাচ্ছে, শিশির বিন্দুগুলো বড় বড় মুক্তোর দানার মতো পত্র পল্লবের সৌন্দর্য বিকশিত করছে আর ফুলকুঁড়িরা হাই তুলতে তুলতে একটু একটু করে আরমোড়া ভাংগছে, পাঁপড়িগুলো মেলে ধরছে, প্রস্ফুটিত হচ্ছে....
হুম্ বলছিলাম আমার ফুলকুঁড়িদের কথা! আরেকটি নতুন সূর্যোদয়, নতুন প্রভাত,সমীহ সম্ভাবনা নিয়ে আমাদের সাপ্তাহিক পাঠশালার আয়োজন। প্রতিটি শিশু প্রচুর সম্ভাবনাময়, উজ্জল ভবিষ্যতের বাহক। আর ওদের সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচনের দায়িত্ব আমাদের উপর। শিশুদের শিক্ষার পরিবশটা কেমন হওয়া উচিত ? অবশ্যই প্রানবন্ত আর আনন্দময়! আনন্দহীন শিক্ষা শিশুর মনোবল কে যেমন দুর্বল করে তোলে তেমনি শিশু শিক্ষার প্রতিও আগ্রহ হারিয়ে ফেলে।
এ সপ্তাহে বাচ্চাদের পড়ার পাশাপাশি অন্যরকম একটি কাজ করেছিলাম! আমাদের টপিক ছিলো "ভালোলাগা"। আমরা সবাই মন উজাড় করে দিয়ে আমাদের সবার ভালোলাগার বিষয়গুলো আলোচনা করেছি। ফলাফলটা চমৎকার! ফুলবাগানের ফুলকুঁড়িরা খিলখিল করে হাসতে লাগলো, কোথা থেকে দখিনা বাতাস সবার মনটাতে ভালোলাগার আনন্দঘন পরশের কোমল ছোঁয়া বুলিয়ে দিলো!
সত্যি বাচ্চাদের পছন্দ- অপছন্দ , ভালোলাগা মন্দ লাগা, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, আগ্রহ, ওদের আনন্দ এবং কষ্ট অনুভব করা এরকম খুঁটিনাটি অনুভূতিগুলো নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে ওদের সাথে ঘনিষ্ঠ ও অন্তরংগ সম্পর্ক তৈরি করার সবচাইতে কার্যকর দিকটি হলো এতে পারষ্পরিক বন্ধন যেমন দৃড় হয় তেমনি শিক্ষার পরিবেশটাকেও আনন্দময় করে তোলে।
প্রথমে আমাদের জানতে চাওয়ার বিষয় ছিলো - প্রিয় রং। সবাই বলতে শুরু করলো পছন্দের রং- গোলাপী, বেগুনী, মেজেন্টা, লাল,নীল তবে গোলাপী রংটাই বেশি পছন্দ ওদের কেননা চারিদিক থেকে শুনছিলাম গোলাপী, গোলাপী, গোলাপী!
প্রিয় ফুল-গোলাপ, গোলাপ, গোলাপ,গোলাপ,গোলাপ, গোলাপ, অতঃপর গোলাপ! একজন মার্গেরিতা, আরেকজন প্রিমুলা! এখানেও গোলাপের জয়জয়কার! গোলাপী রং আর গোলাপ ফুল দুটোই মনে হলো মেয়েদের একচ্ছত্র সম্পত্তি!
এবার প্রিয় খাবার- জানিনা কোন এক রহস্যময় কারনে সবাই একসাথে বললো- পোলাও! কেউ কেউ বললো কাবাব, স্পেগেট্টি, ফ্রেন্চ ফ্রাই!
ভবিষ্যত পরিকল্পনা- কি হতে ইচ্ছা করে? চাইল্ড স্পেশালিষ্টি, চাইল্ড স্পেশালিষ্টি, চাইল্ড স্পেশালিষ্টি, চাইল্ড স্পেশালিষ্টি! আমার চারিপাশে সবাই তাহলে সম্ভাবনাময় পেডিয়াট্রিকস? একজন বললো টিচার, ওর পাশের জন বললো আমি হব নার্স,আরেক জন কি বললো জানেন?
- আমি রাজকন্যা হতে চাই!
অবসরে কি করো? - ডিজাইন, ডিজাইন, ডিজাইন! কয়েকজন গল্পের বই পড়ে, কেউ কার্টুন দেখে!
কোন বিষয়টা কষ্ট দেয়?- কেউ আমাকে ভুল বুঝলে, আমি মার্কস কম পেলে, আম্মু বকা দিলে, আমার ছোট বোন যখন আমার স্কুলের জিনিষ নিয়ে নষ্ট করে, যখন টিচার আমাকে প্রশ্ন করে আর আমি উত্তরটা জানি না! শুধু মাত্র এই কষ্টের অনুভূতিগুলোতে ভিন্নতা পেলাম!
প্রিয় পশু বা পাখি? - বিড়াল ছানা, বিড়াল ছানা,খরগোশ, জিরাফ, প্রজাপতি, প্রজাপতি, প্রজাপতি, প্রজাপতি, প্রজাপতি.....
শিশুরা স্বভাবত প্রানবন্ত চরিত্রের হয়। হাসি খুশি, উচ্ছলতা, সরলতা, দুরন্তপনা,চঞ্চলতাই যেনো ওদের চিরন্তন বৈশিষ্ট্য।এ বৈশিষ্ট্যের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য প্রানবন্ত পরিবেশের বিকল্প নেই। আজকের কুঁড়িরাই আগামীর প্রস্ফুটিত ফুল। জ্ঞানী জনেরা বলেন -নি:সন্দেহে, যে-শিক্ষার জীবনীশক্তি নেই তা মানবিকও নয়। আসলেই শিক্ষাকে জীবনশক্তিতে ভরপুর করে তোলা উচিত ! তবেই শিক্ষা কার্যকরী হবে, জীবনকে বিকশিত করবে সত্যিকারের ফুলবাগানের মতো, ফুলকুঁড়িরা ওদের স্বপ্নগুলোকে গোলাপী রংএর মোড়কে জড়িয়ে রংগিন প্রজাপতি হয়ে ভেসে বেড়াবে, ভাবনাগুলো বাস্তবতা হয়ে ঠাঁই নিবে দূর আকাশে সাত রংএর রংধনু সাজিয়ে!
কুঁড়ি থেকে ধীরে ধীরে পাঁপড়ি সাজানো রং উজ্জ্বল ফোটা পুষ্পের সঙ্গে তুলনা চলে শিশুর মনোজগতের। সময়ের সাথে জ্ঞানের পরিধি আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। শরীরের সাথে মনেরও বর্ধন হতে থাকে, আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে শেখে সে, মানুষের সঙ্গে কথা বলা, মেলামেশা ও অন্যান্য বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করে পর্যায়ক্রমে। নিজেকে বুঝতে শিখে, মর্যাদা দিতে শিখে ইচ্ছা, অনুভূতি গুলোকে! নিজেকে স্পেশাল ভাবতে ভালোবাসে, তার চিন্তাচেতনায় আসে অগ্রগতি- বিকশিত হয় তার সত্ত্বা!
আমাদের উচিত ওদের অনুভূতিগুলোকে মূল্য দেয়া, জানতে চাওয়া, ওদের বুঝতে দেয়া ওরা আসলেই আমাদের কাছে অনেক স্পেশাল! খুব কঠিন কিছু না দরকার শুধু একটু খানি সাহচার্য দেয়া!আমরা কেউ চাই না নিজেদের ওরা দুর্বল ভাবুক, হীনমন্নতায় ভুগুক,অবেলায় অঝোরে ঝরে পড়ুক আমাদের ফুলকুঁড়িরা! বরং প্রসন্নতায় প্রস্ফুটিত হোক ওদের ভবিষ্যত!
“বাল্যকাল হইতে আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা কিছু নিতান্ত আবশ্যক তাহাই কন্ঠস্থ করিতেছি। তেমন করিয়া কোনোমতে কাজ চলে মাত্র কিন্তু বিকাশ লাভ হয় না।” [“শিক্ষার হেরফের”]
বিষয়: বিবিধ
২১২৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন