তবুও সবুজ দ্বীপে ঘাষফুল বুনে যাই
লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৭:৫৯:৪৯ সন্ধ্যা
বাসায় ফিরতে এতোটা রাত হয়ে যাবে ভাবেনি রিহান! পেরেশানী নিজের জন্য নয়, বাচ্চারা তাঁর অপেক্ষায় রাত জেগে থাকবে! ছোট ছোট বাচ্চাদের কষ্ট দেয়ার কোন মানে হয়না! গাড়ি থামিয়ে দ্রুত পা ফেলে রিহান!
দরজায় তালা খোলার শব্দ পেয়ে মাহিয়া আর নুবাইদ দুজনেই দৌড়ে এসে দুপাশ থেকে বাবাকে জড়িয়ে ধরে সালাম দেয়!
-আসসালামু আ'লাইকুম বাবা! (নুবাইদের মিষ্টি আদুরে কচিকন্ঠের সালাম সারা দিনের ক্লান্তি নিমিষে মুছে যায় রিহানের!)
-ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়ারহমাতুল্লাহি ওয়াবারকাতুহ! মাই লিটল এন্জলস কেমন আছো তোমরা? এখনো জেগে আছো?
-নুবাইদ আর মাহিয়া বাবার জন্য বসে আছি। তুমি আসলে ঘুমতে যাব। (চার বছর বয়সের নুবাইদ সব সময় নিজের নাম উল্লেখ করে কথা বলে!)
-আই য়্যম সো সরি সোনামনিরা! আজ একটু দেরি হয়ে গেল। চল এখন রাত না জেগে আমরা ঘুমোতে যাই। নুবাইদ আর মাহিয়াকে দুই কোলে নিয়ে বেড রুমে এসে ওদের শুইয়ে দিয়ে কিছুক্ষন গল্পের বই পড়ে শোনালো। বাচ্চারা ঘুমিয়ে গেলে ওদের আদর দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসে রিহান।
- আজ রিহানের ওদের সেই বেডরুমে ঢুকতে ইচ্ছা করলো! যেখানে ও ছাড়া আর কারো প্রবেশাধিকার নেই!
কতো স্মৃতিবিজড়িত এই ঘর! এখানেই হয়েছিলো ওদের প্রথম ফুলশয্যার রাত! সেই বিছানা, আলমারি, ড্রেসিংটবিল!
টাংগাইলের মোটা পাড়ের শাড়ি, মাটির গহনা, কাঁচের চুড়িগুলো সেভাবেই রাখা আছে ঠিক যেভাবে আদ্রিতা রেখে গিয়েছিলো! এলোমেলো, অযত্ন তো নয়ই, সামান্য ধূলোও জমতে দেয়া হয়নি!
আদ্রিতাকে বিয়ের পর অনুভূতিটা ছিলো সে পৃথিবীর সবচাইতে সৌভাগ্যবান পুরুষ ! যে বালিকা নববধুর বেশে চরনযুগলে নুপুর বাজিয়ে ছোট্ট কুটির আলোকিত করে ছিলো , যার স্পর্শে নিকষ কালো অমাবশ্যাও জোস্না ভরা পূর্নিমা মনে হতো! মনের উঠোনে মনময়ুরি পেখম মেলে নেচেছিলো আর আকাশে নীল মেঘেরা ভালবাসার ওড়না বিছিয়ে দিয়েছিলো, কৃষ্ণচূড়া ফুলেরা রক্তিম আভা ছড়িয়ে ভালোবাসার পতাকা উড়িয়ে দিয়েছিলো! হৃদয়ের তন্ত্রিতে যে সুর বেজেছিলো -আমি পাইলাম তাঁহারে পাইলাম!!!
একবার রিহান-আদ্রিতা দু'জন মিলে বাইরে বেড়িয়েছিল, জমজ বাচ্চা দেখে আনন্দে ছোট্ট একটা বাচ্চা মেয়ের মতো উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিলো আদ্রিতা! ব্যাকুল হয়ে প্রশ্ন করেছিলে জমজ বাবু হওয়ার সাইন্টিফিক কোন পদ্ধতি আছে কি না, রিহান হেসে বলেছিলো তুমি নিজেই এখনো একটা বাচ্চা মেয়ে আবার জমজ বাবুর স্বপ্ন দেখ? বিষাদ ভর করেছিলো তাঁর সমস্ত মুখজুড়ে!
এক শুভ্র সুন্দর সকালে নিখাদ ভালবাসার প্রথম ফসলের সুসংবাদ আসে সে যেনো উপছে পড়া বাঁধ ভাঙ্গা আনন্দের জোয়ার ! সময়ের সাথে দুজনের ভালোবাসার গভীরতা ও যেনো বাড়তে থাকে !
একদিন বাসায় ফিরায় পথে পিছন থেকে গাড়ি এসে ধাক্কা দিলে আদ্রিতা ছিটকে পড়ে গেলো, প্রচন্ড ব্লিডিং নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া হলো, তখন এমন নাজুক অবস্হা যে রিহান কে মনে হচ্ছিলো বিধ্বস্হ উদভ্রান্ত কোন নাবিক দিক হারিয়ে দিশেহারা ! ব্লিডিং বন্ধ হচ্ছিলো না কোন ভাবেই, আদ্রিতা , গর্ভস্হ সন্তান মৃত্যুর মুখোমুখি! ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিলো অপারশন করার! তখনি জানা গেলো আদ্রিতা- রিহানের টুইন বাচ্চা ছিলো! কি নির্মম পরিহাস আদ্রিতাকে জানাবার সুযোগটুকুও পেলো না রিহান!
এক ভয়ংকর কালবৈশাখী ঝড়ে অতল সমুদ্রের গহ্বরে ডুবে যাওয়ার মতো হারিয়ে যাচ্ছিলো রিহান, জীবনের সমস্ত আলো টুকু নিভে গিয়েছিলো প্রায়, সহায় সম্বলহীন হয়ে যাওয়া রিহান পাঁচ মাসের টুইন বাচ্চাদের পেয়ে যেনো খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখলো!
ইনকিউবেটরে দীর্ঘ সময় থাকতে হয়েছে টুইনদের ! ধীরে ধীরে ওরা জেগে উঠেছে, সমুদ্র সেঁচে মুক্তো আহরনের মতোই দুঃসাধ্য ছিলো বাচ্চাদের নিজের কাছে ফিরে পাওয়া! আদ্রিতার ভালোবাসা রিহানকে সাহস যুগিয়েছে কঠিন সময়ে হতাশ না হতে দৃড় পদ থাকতে!
একসময় রিহান বাচ্চাদের নিয়ে বাসায় এসেছে, রিহান বাচ্চাদের ঠিক ঠিক মায়ের আদর, ভালোবাসা সব কানায় কানায় ভরিয়ে দেবার প্রানপন চেষ্টা করেছে! ওরা রিহানকে যতটুকু ভালোবাসে ওদের মাকে বাসে তারচাইতেও বেশি! আদ্রিতা-রিহানের সংসার জীবনের কথা, ছবি, ভিডিওগুলো দেখে দেখে মায়ের কোন কিছুই ওদের অজানা নেই ! মাহিয়া যেনো ঠিক আদ্রিতার প্রতিমা! আর নুবাইদ ? মায়ের দুষ্টুমি, উচ্ছলতা আর প্রানচান্চল্যতার সবটুকু ওর মাঝে আছে!
একরাতে নুবাকে ফিডার দিতে গেলে, দুধটকু খেলো সে , ঘুমের ঘোরেই প্যান্টের পিছনের পকেটে হাত দিলো! কি বের করলো ? তাঁর মায়ের ছবি! সবসময় মায়ের ছবি সাথে নিয়ে নিয়ে ঘুরে! একটু খানি দেখলো, বুক পকেটে রেখে তার উপর হাত দিয়ে আবার ঘুমিয়ে গেলো!
রিহান আদ্রিতাকে ভালো বেসেছিলো মনে প্রানে বললে ভুল হবে ভালোবেসেছিলো রিহানের আত্না দিয়ে, রুহ দিয়ে এমন ভালোবাসা পৃথিবীর কেউ কাউকে বাসেনি ! এতো সময় অতিবাহিত হয়েছে এই ভালোবাসা সামান্যতম ফিকে হয়নি, মুছে যাওয়া দূরে থাক!
আজ আমি এখানে আর তুমি সূদুরিকা
মনের আকাশে নীল মেঘেরা যেনো কুহেলিকা
বেশি স্বপ্ন ছিলোনা ভালোবেসেই সুখ চেয়েছিলাম
তারাভরা রাতে জোস্নার শিশিরে অবগাহন
সূদুর সবুজ দ্বীপে কাশ ফুলদের নিমন্ত্রন
তোমার প্রানের সাথে বাঁধা পড়ে আছে এ প্রান!
মনের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে
তোমারি তরে প্রিয়া আমার এই নিবেদন
ঘাষফুলের দ্বীপ গড়েছি জানিয়ে আমন্ত্রন!
বিষয়: বিবিধ
৪৩৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন