প্রতীক্ষার প্রহরগুলো

লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৮:২৫:৪৬ রাত



জানালার গ্রিল দিয়ে বাগানের নারিকেল গাছের সরু সরু পাতাগুলোর ফাঁকে এক ফালি চাঁদের আলো তমার রুমে এসে পড়ে। বাইরে থেকে ঘন ঝোপের আড়ালে ওর রুমটা দেখা যায় না, কিন্তু ও সবই দেখতে পায়। সন্ধার পরে রাস্তাটা খুব নিরিবিলি থাকে। দু একটা রিক্সা রাস্তায় চলাচল করছে, কলোনীর আংকলরা বাজার শেষ করে ঘরে ফিরছেন! জীবনের সকাল-সন্ধার অবিরত খেলা সবাইকে ব্যস্ত রাখে!

তমার সেদিকে মন নেই, আজ আর সময় কাটছে না। বার বার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে প্রতীক্ষিত সময়ের অপেক্ষায়। নয়টার দিকে ফোন আসার কথা। তমা- সাকিবের বিয়ের বয়স দেড়মাস। ঘরোয়া আয়োজনে হুট করেই বিয়েটা হয়েছিলো। সাকিব বিয়ের পর প্রতি সপ্তাহের উইক এন্ডে আসে তমাদের বাসায়। এক- দুদিন থেকে আবার কর্মস্হলে ফিরে যায়।

যে মানুষটাকে বিয়ের আগে সামান্যতম চেনা বা জানা হয়নি কিভাবে, কি করে এতো ভালোবাসা তৈরি হয়েছে সেই প্রশ্ন এখন অবান্তর তমার কাছে। তমা শুধু বুঝতে পারে মাত্র কিছুদিন আগে যে আজনবী তার জীবনসাথী হয়ে এসেছে সেই ব্যক্তিটি তার সমস্ত জীবনে এক নতুন ঝড় তুলেছে! সে এক দূর্নিবার অপ্রতিরোধ্য ভালোবাসার ঝড়! এই মানুষটিকে প্রতিটি মূহুর্তের জন্য চোখের সামনে দেখার জন্য তার মনে-প্রানে কিরকম অস্হিরতা বিরাজ করে। নতুন ভালোবাসার ছোঁয়ায় অস্হির -উতলা মনটা খুঁজে ফিরে তার কাছে গিয়েই স্হির হতে চায়! শান্ত হতে চায়! এক স্বপ্নীল ভালোবাসার নীড় গড়তে চায়!

বিশাল মরুভূমি পার হয়ে প্রচন্ড পিপাসার্ত পথিক যেভাবে তৃস্নার্ত নয়নে পানির খোঁজ করে ঠিক সেভাবে পাশে রাখা মোবাইলের দিকে আকুতি ভরা দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তমা। নিস্তব্ধতা ভেংগে ফোনটা বাজতে শুরু করলো। আশ্চর্য কি এক অসাড়তা কাজ করে তমার সমস্ত শরীরে, ফোনটা রিসিভ করার শক্তিই বুঝি হারিয়ে ফেলেছে সে! হাতের মুঠোয় ফোনটা নিয়ে কোনরকমে সালাম দেয়-

-আসসালামুআলাইকুম।

-ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো? অনেক্ষন ধরে অপেক্ষা করছো?

-আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, নাহ্ তেমন কিছু না!( মনে মনে বলে তুমি কি করে বুঝবে সে যাতনা! )

-ওহ্ তাহলে ঠিক আছে। বাসায় সবাই ভালো আছেন? একে একে সবার খোঁজ নেয় সাকিব।

-তমা চেষ্টা করে স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দিতে। সবাই ভালো আছে, কেউ ব্যস্ত, কেউ বাইরে এইতো! (আমি কেমন আছি তোমার কি জানতে ইচ্ছা করে না? যদিও মুখ ফুটে বলার দুঃসাহস নেই)

-তুমি কেমন আছো? তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে?

-হুম! ভালো! পড়াশোনায় একটু পিছিয়ে আছি। ঠিক হয়ে যাবে। (কি ই বা বলবে আর! আর যে কিছু জানা নাই, বলারও নাই!)

-শোনো, মনে হয় আমি এ সপ্তাহে আসতে পারছি না। অফিসে প্রচুর কাজ জমে আছে, আর তুমিও পড়াশোনায় যেহেতু একটু পিছিয়ে গেছো ভালই হবে সুযোগটাকে কাজে লাগানো যাবে কি বলো?

-তমা কিছুই বলেনি! একটা নিরাশার কালো মেঘ বিস্তার করেছিলো সমস্ত মন জুড়ে!

সাকিব ফোন ছেড়ে ভাবছিলো, যদিও আমার প্রচুর কাজ জমে আছে ও তো একটি বারও আমাকে যেতে বললো না? তবে কি ও চায় না আমি যাই ওর কাছে? পড়াশোনা নিয়ে কি ও এতই ব্যস্ত! বন্ধু মহলে সেদিন সবাই বলছিলো বিয়ের পর নাকি ঘন ঘন শ্বশুরবাড়িতে যাতে হয়না , কিন্তু আমি তো শুধু ওর টানেই......

তমা সিদ্ধান্ত নেয় এ কয়টি দিন ভীষন ব্যস্ত থাকবে সে। কোনভাবেই যেনো তার সাকিবের কথা মনে না পড়ে! পারবে কি সে? তবু চেষ্টা করবে। কালকেই বান্ধবীদের বলে দিবে চলে আসতে, সবাই মিলে পড়াশোনা আর আড্ডা দিলে সময় কিভাবে চলে যাবে টেরই পাবে না! যেই ভাবা সেই কাজ! ঘনিষ্ঠ বান্ধবীদের বলে দিল আগামীকাল যেনো সবাই চলে আসে!

সব বান্ধবীদের নিয়ে পড়াশোনা আর গল্পে গল্পে কেটে গেলো বিকেলটা। ভালোই আনন্দ করেছে সবাই মিলে। অবশ্য মনের ভিতরের কষ্টটুকু বারবার জেগে উঠতে চাইলেও তমা শক্ত হয়ে শাষন করেছে অবচেতন মনকে! সময়টুকু দ্রুত কেটে গেলো! সন্ধায় একে একে সবাই যার যার বাসায় চলে গেছে! সারাদিনতো গেলো রাতটা পার হলেই হয়! একটা দীর্ঘশ্বাষ এসে গ্রাস করে নিতে চায় তমার স্বর্বস্ব! তমা ভাবে আমি কি এতোই অসহায়? আমার কি কোনই মূল্য নাই? পরক্ষনেই বুঝে নেয় সাকিবের ভালোবাসা ওকে ওর সমস্ত অহংকার, আভিজাত্য, নিজস্বতা থেকে অসহায় করে তুলেছে, নি:স্ব, ভংগুর করে তুলেছে! আমি কি একা একাই কষ্ট পাচ্ছি? উনি তো দিব্যি পা ঝুলিয়ে আয়েশ করে কফি পান করছেন আর অফিসের কাজ করছেন! একটা বার তো জিগ্গেষ করলো না আমি না আসলে কি তোমার কষ্ট হবে?

মাকে বলে এসেছে ক্ষিধে নেই ! আর যেনো ওকে ডাকাডাকি না করে! ভীষন ঘুম পেয়েছে এই অজুহাতে নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে কিছুক্ষন শুয়ে ছিলো! সমস্ত বিছানা গড়াগড়ি করে দেখলো ঘুমের লেশমাত্র নেই! তমা উঠে বসে, কি করবে? একটা গল্পের বই পড়বে? নাহ্ সমস্ত সুখকর গল্প এই মুহূর্তে বিষাদ ছড়ানো ছাড়া আর কিছুই করবে না!

জানালাটা তার ভীষন প্রিয়! মন ভালো কি খারাপ এখানে এসে বাইরে তাকালে মনে হয় প্রকৃতি সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দেয়! বাইরে মৃদুমন্দ বাতাসে নারকেলের পাতাগুলো ঝিরঝির করে কাঁপছে! বাতাস আর পত্রের অদ্ভত মিতালি! দূর আকাশে চাঁদ এতোক্ষনে যেনো শক্তি ফিরে পেয়েছে! চাঁদনীরাত, বাতায়নে পত্রমিতালী সবকিছুর মাঝে কি নাই! আবার সেই কষ্টগুলো বরফ হয়ে জমতে শুরু করে মনের মাঝে! ধীরে ধীরে সরে এসে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে তমা!

চোখ দুটি বন্ধ! হাজার চেষ্টা করেও ঘুম আসছে না!সুফিয়া কামালের লিখা প্রিয় একটা কবিতার চরন মনে পড়ছে -

"কুহেলি উত্তরূ তলে মাঘের সন্ন্যাসী-

গিয়াছে চলিয়া ধীরে পুষ্পশূন্য দিগন্তের পথে

রিক্ত হস্তে! তাহারেই পড়ে মনে, ভুলিতে পারি না কোন মতে।"


কি করছে ও? আমার মতোই কি কষ্ট হচ্ছে ?নাকি ভুলেই বসে আছে? ও কি পারেনা সব কিছু জলান্জলি দিয়ে ছুটে চলে আসতে ?

রাত বারোটার বেশি তখন! এমনি এলাকাটা নিরিবিলি! তমার মনে হয় একটা গাড়ি এসে বুঝি থামলো রাস্তার ওপাশে! কেউ একজন হেঁটে আসছে , চলে আসছে ঠিক জানালাটা বরাবর! কেউ যেনো ডাকছে -তমা!

স্বপ্ন দেখছে নাতো? নাহ্ সজাগই তো আছে তমা! ত্রস্তপদে জানালার কাছে আসে - সে এসেছে!

দরজাটা খুলে দৌড়ে ছুটে চলে রাস্তার পাশে, কোথায় মধ্যরাতের নির্জণতার ভয়! কোথায় বাবা -মায়ের আদেশের পরোয়া!

- থাকতে পারিনি, চলে এসেছি আমার তমার কাছে, একেবারে শূন্যহাতে..

তমা সাকিবের হাতে হাত রাখে, অস্ফুট স্বরে বলে এখন আর শূন্য নয়...

বিষয়: বিবিধ

২৭২২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File