অন্তিম ক্ষন

লিখেছেন লিখেছেন সাদিয়া মুকিম ০৭ জুন, ২০১৩, ০৬:০৯:২৯ সন্ধ্যা



১) মা তার দুই মেয়েকে নিয়ে বসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা বলছিলেন। দুষ্টুমাখা কথা আর খুনসুটি চলছিলো! বড় মেয়ে খুশী তো ছোট মেয়ে নারাজ! পিঠেপিঠি বয়সের(১২-১৩) দুই মেয়ে! ছোট মেয়ে মায়ের কাছে আব্দার পেশ করলো -মা আজ পিজ্জা বানাও না! মা হেসে বললেন- ঠিক আছে মামনি তোমারা দুজনে মিলে আমাকে সাহায্য করো তাহলে। পিজ্জা তৈরী করতে গিয়ে দেখলেন ময়দা নেই! পিঁয়াজ, টমেটো আর সব উপাদান প্রস্তুত করে মা বললেন তোমরা থাকো আমি নিচে গিয়ে ময়দা নিয়ে আসি আমার হাটাও হয়ে গেলো ! মা নিচে গেলেন সুপার স্টোর থেকে ময়দা আনতে !

ময়দা নিয়ে ফিরার পর হঠাত্ৎ বুকে ব্যথা অনুভব করলেন! মেয়েদের বললেন আমার গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা বেড়েছে মনে হয় আমর ঔষধটা আনতো মা! এক মেয়ে গেল ঔষধ আনতে আরেক মেয়ে পানি.....ফিরে এসে দেখে অচেতন মা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে..। মেয়েদের আকুল আকুতি করুন ডাকাডাকি কিছুই আর মাকে ফিরিয়ে আনতে পারে নি....ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউ'ন...।

২)প্রবাসী মেয়ে দেশে ফিরলেন! আপন পরিবারের কাছে ফিরে আসা! বাড়ি ভর্তি আনন্দ আর আনন্দ। সুদূর ইটালি থেকে আনা অনেক খাবারের মধ্যে বাবা পছন্দ করলেন মিক্সড ভেজিটেবল স্যুপ! পরিবারের সবাই মিলে সেই স্যুপ খাওয়া, ঘুরতে যাওয়া, একসাথে সময় কাটানো! এভাবেই কেটে যায় এক মাস! হাসি আনন্দের দিন ফুরিয়ে এলে মেয়েকে আবার পাড়ি জমাতে হয় সুদূর প্রবাসে!

বাড়ির সকলের কান্না ভেজা আলিংগন ছেড়ে বিদায় নিয়ে গাড়িতে উঠলেন -গন্তব্য এয়ারপোর্ট। প্রতিটি মূহুর্ত মনের মাঝে স্বজন ছেড়ে যাওয়ার বেদনা, চারপাশে যেনো ভাংগা গড়ার কঠিন স্তব্ধ বাতাস, একরাশ শূন্যতা...। আপনজনদের বিদায় দিতে এত কষ্ট এত হাহাকার! চোখের পানি মুছতে গিয়ে গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়ে দেখলেন পিছন থেকে বৃদ্ধ বাবা ছুটতে ছুটতে আসছেন... গাড়ি থেকে নেমে কন্যা দৌড়ে এসে বাবার কোলে ঝাপিয়ে পড়ে..।বাবার কোমল স্পর্শ, আদর মাখানো হাতদুটি মাথায় রেখে দোআ করা, আবার কবে দেখা হবে বলতে বলতে বাবা মেয়ের কান্নায় ভেংগে পড়া.. এভাবেই মেয়ে বাবাকে বিদায় দিয়ে আসে!

এক প্রতিবেশী ভাই দেশে যাচ্ছেন শুনে প্রিয় বাবাকে প্রশ্ন করলেন বাবা তোমার জন্য কি পাঠাবো? বাবা বললেন কিছুই পাঠাতে হবে না মা! তারপরও কথা বলে একপর্যায়ে দুজনে মিলে ঠিক করলেন সেই ভেজিটেবল স্যুপ যেটা বাবা খুব পছন্দ করেছিলেন সেটাই পাঠানো হবে।নির্দিষ্ট দিনে সেই ভাইকে প্যাকেট দিয়ে আসা হলো। সকালে ফোন এলো দেশ থেকে ..... বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন.........ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউ'ন...।

৩)তাসলিমা ভাবী শারীরিক অসুস্হতা বোধ করায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো । যদিও উনার মনের মধ্যে তাড়না ছিলো মংগলবারের মধ্যে বাসায় ফিরার কেননা মংগলবার মেয়ের জন্মদিন, সেদিন বাসায় না থাকলে মেয়েটা সারাদিন মন খারাপ করে থাকবে! শারীরিক অবস্হা অবনতির দিকে পৌঁছলো ডাক্তাররা বললেন আরো কিছুদিন থাকতে হবে হাসপাতালে!

এক প্রতিবেশী বোন উনাকে দেখতে হাসপাতালে এলে বললেন -ভাবী আমার মেয়েটার আজ জন্মদিন, বাসায় কিছুই রান্না করা নেই, আপনি একটু কষ্ট করে বিরিয়ানী রান্না করে দিয়েন ! সেই ভাবী ছুটতে ছুটতে বাসায় আসলেন ! বাসায় ফিরে বিরিয়ানী রান্না করলেন, কিছুক্ষন পর ফোন আসলো তাসলিমা ভাবী শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন..।ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউ'ন...।

আমরা অহরহ এরকম অনেক মৃত্যু সংবাদ শুনি, যেগুলো আমাদের অনুভূতিকে নাড়া দেয়, অন্তরকে আন্দোলিত করে, চোখ অশ্রুসিক্ত হয়! সময়ের সাথে আমরা আবার তা ভুলেও যাই!

মৃত্যু আমার জন্য অবশ্যম্ভাবী চির সত্য আমার সামনে ও হাজির হবে তার ঘন্টাধ্বনি বাজিয়ে, আমি আমার প্রিয় সকল স্বজনদের ছেড়ে , সকল আশা আকুলতা, চাওয়া পাওয়া রেখে, সকল স্বজনদের বেদনাময় করুন আহাজারি,আর শোকাশ্রু কিছুই আমাকে রুখতে পারবে না! তারপরো কেনো সচেতন হই না?

যখন কোন মৃত্যুসংবাদ শুনি সবার আগে মনে হয় আহা উনার ছেলে মেয়ে, স্বামী-স্ত্রীর কি হবে? কিভাবে জীবনের বাকি পথ একাকী প্রিয়জন ছেড়ে পাড়ি দিবেন? নিজের মৃত্যুর কথা ভাবতে গেলেও নিজের স্বামী-সন্তানের কথাই মনে হয় খুব বেশী!

যে চিন্তা আমাদের আচ্ছন্ন করে রাখে আমার মৃত্যুর পর ছেলে-মেয়েদের কী হবে? কীভাবে চলবে লেখাপড়া অথবা ঘরসংসার? এভাবে চলতে চলতে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসেও হৃদয়ের প্রতিটি ভাঁজে বিরাজ করে ছেলেসন্তানের পার্থিব ভবিষ্যতের ভাবনা। মত্যু-পরবর্তী সময়ে আমাদের নিজের কী হবে সে বিষয়ে আমরা হয়ে যাই উদাসীন। মনে হয় যেন মৃত্যুর পর কেবল তার ছেলে সন্তানেরই অস্তিত্ব অবশিষ্ট থাকবে; নিজের অস্তিত্বের চিহ্ন থাকবে না কোথাও। অবস্থা এমন হয়েছে- মৃত্যুর পর আরো-একটি জীবন রয়েছে এ বিষয়টি আমাদের অনুভূতির জগতে জাগ্রত নেই বিন্দুমাত্র ।

অথচ আমাদের জীবন এক অন্তহীন জীবন, মৃত্যু জীবনের শেষ নয় বরং অনন্তকালের জীবনের শুরু মাত্র! আর মৃত্যু আমাদের এ ক্ষনস্হায়ীজীবন ও চিরস্হায়ী জীবনের দুটি পর্বের মধ্যবর্তী সীমানা!

কিছুদিন আগে পড়েছিলাম আমাদের জীবন আর মৃত্যু নিয়ে -

কৃষক জমীনে ফসল বুনে, পরিচর্যা করে, ফসল প্রস্তুত হয়, কৃষক তা কাটে, গোলায় তুলে নেয়, সারা বছরের খাওয়ার ব্যাবস্হা করে। প্রথমে কৃষক চেষ্টা সাধনা করে,সময় দিয়ে, শ্রম দিয়ে, পয়সা খরচ করে ফসল বোনে পরবর্তীতে সে যে মেহনত করেছে, কষ্ট করেছে তা থেকে উপকৃরত হয়!

আমাদের জীবনটাও এমন। আমরা আমাদের পরকালের ফসল বুনছি, যত্ন নিচ্ছি। আমাদের প্রত্যেকের পরকালে একটি করে খামার আছে, কেউ চাষ করি কেউ পতিত ফেলে রাখি! কেউ তিক্ত গাছ লাগাই কেউ সুস্বাদু ফলের গাছ! কেউ সমস্ত সময়, শ্রম দিয়ে জমিনকে উর্বরা করতে ব্যায় করে কেউ সময়ই দেয় না! এ ফসল তৈরীর সময় মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত। মৃত্যু পরকালের ফসল কাটার দিন। আমরা মৃত্যুবরন করে যে চোখ বন্ধ করি পরকালে সেই চোখ মেলি সেখানে সবাই সবার খামার দেখতে পাব!

কতোইনা সৌভাগ্যবান সেই ব্যাক্তি যিনি পরকালের খামার সুজলা শ্যামলা শষ্যে পরিপূর্ন দেখতে পান! কতোইনা আনন্দিত হন তিনি, দৃষ্টির সীমানা পর্যন্ত সমস্ত কষ্টের সুন্দর পরিনাম হিসেবে অপরুপ সৌন্দর্য অবলোকন করেন! আজ শুধু আনন্দিত হবার দিন, চির সুখে থাকার দিন!

কিন্তু সেদিন যারা ফসল বোনার ব্যাপারে সময় দেয়নি, সময় গুলোকে অপচয় করেছে অনর্থক কাজে সে নিজের খামার কেমন দেখতে পাবে? না সেই খামার তার আনন্দের কারন হবে না তার সুখের জীবন হবে পরকাল! তখন শুধু আফসোস করা হবে একমাত্র কাজ কিন্তু তা কি কোন উপকারে আসবে? আর তো ফিরে আসা যাবে না পূর্বের জীবনে, আর তো সময় নেই ফসল বপনের! তখন তো সময় শুধু পরিনাম ভোগ করার !

আমরা আমাদের মূল্যবান সময় আর সম্ভাবনা ব্যয় করে যেনো আখিরাতের ফসল উত্পাদন করতে পারি, আখিরাত কে সুন্দর করি কেননা ফসল বপনের সময়টা এখনি, জানি না কখন শেষ হয়ে যাবে এই সুবর্ন সুযোগ! কখন মালাকাল মাউত উপস্হিত হবেন! কখন রওনা হব পরাপারের একাকী যাত্রী হয়ে বারযাখের অনন্তকালের সফরে ......

বিষয়: বিবিধ

৩০৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File