সে আমার বড় ভাই

লিখেছেন লিখেছেন গন্ধসুধা ২৫ মার্চ, ২০১৩, ০৭:৪৯:১২ সন্ধ্যা

আম্মুর প্রথম বাচ্চাদ্বয় ছিল জময দুটি মেয়ে।ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে দুটি ইন্তেকাল করলো একজন দেড়মাস বয়সে আরেকজন আড়াই মাস বয়সে।তারপর আরো দুটি জময ভাই হারালাম আমরা ছয় মাসের মিসকারেজে।মাত্র বাইশ বছর বয়সে চার-চারটি বাচ্চা হারিয়ে আম্মু যখন শোকে বিপর্যস্ত ঠিক সে সময় তাঁর কোল আলো করে আল্লাহ পাঠালেন আমাদের সেজো ভাইয়া ওরফে বড় ভাইয়াকে।

আব্বু-আম্মুতো বটেই দাদুবাড়ি নানুবাড়ির সবাই তখন সীমাহীন আনন্দে উদ্বেল।মামা,চাচা,ফুফু,খালা সবার এতো আদর পেয়েছেন বড় ভাইয়া যা আমরা ছোটরাও পাইনি!এমন ভাবে সবাই তাকে রেখেছে যেন নীচে রাখলে পিঁপড়া খাবে আর মাথায় রাখলে উকুনে খাবে!আব্বু-আম্মুর খুব ইচ্ছা ছিল এতো শোকের পরে পাওয়া ছেলেকে মাদরাসায় পড়াবেন কিন্তু হেরে গেলেন মামা-চাচাদের ঐক্যবদ্ধজোটের কাছে!তাদের খুব শখ আদরের ভাতিজা-ভাগ্নাকে ডাক্তার করবেন!

অতঃপর শুরু হলো বড়ভাইয়াকে ডাক্তার বানানোর প্রক্রিয়া।দায়িত্ব নিলেন ছোট মামা যিনি নিজেও ডাক্তার।অবশ্য তিনি এখন দাকতুরগিরি বাদ দিয়ে পুরোদস্তুর বিজন্যাস ম্যান।মামা যতদিন দেশে ছিলেন তিনিই দেখলেন ভাইয়ার পড়ালেখা।তারপর জাপান যাওয়ার পর ওখান থেকেও চলতো খোঁজ।তিনি তার হবু ডাক্তার ভাগ্নের জন্য পাঠাতেন সায়েন্স ল্যাবের বহু জিনিস!যার মধ্যে ছিল স্লাইড ক্যালিপার্স,মাইক্রোস্কোপ,প্রেসার মাপার মেশিন ইত্যাদি।এগুলো ছিল আমাদের ছোটদের গবেষনার জিনিস!

বড়ভাইয়ার ছিল গল্পের বইয়ের প্রচন্ড নেশা যা তিনি আমাদের মধ্যেও সাফল্যের সাথে ঢুকাতে পেরেছেন!রাতজেগে বই পড়ার এ অভ্যাসে আব্বু কিছুতেই সম্মত ছিলনা ।তাঁর রুমে লাইট জ্বালিয়ে বই পড়লে দরজার নীচের ফাঁক দিয়ে যে আলো বের হবে তাতে আব্বু টের পাবে এই ভয়ে বহুরাত হারিকেন জ্বালিয়ে ঘরে-টয়লেটে বই পড়েছেন।আমার ছোট্টবেলার প্রথম নভেলবই সুকুমার রায়ের 'হযবরল' তিনিই আমার হাতে দিয়েছিলেন।প্রথম কমিক তাঁর দেয়া 'টিনটিন'!বই পড়াটা তাঁর কাছ থেকে শিখেছি বলে পড়ার স্টাইলটাও গড়ে উঠেছে তারই মত!সুকুমার দিয়ে শুরু তারপর সত্যজিৎ এর ফেলুদা,প্রফেসর শঙ্কু,সেবার তিন গোয়েন্দা,কুয়াশা,মাসুদ রানা,অনুবাদ,জাফর ইকবালের টোটাল সায়েন্স সমগ্র,হুমায়ুন আহমেদ হয়ে সুনীল,শীর্ষেন্দু,সমরেষ আরো কতকি!

আপাতদৃষ্টিতে রাশভারি গম্ভির,আবেগ বর্জিত এই ভাইয়াটাকে আমরা ছোটরা সবাই বাঘের মতোই ভয় পেতাম!!ছোটবেলা থেকেই খাওয়ার উপর আমার তীব্র অনিহা!আর কেউ পারতোনা তবে সে তার রুমে নিয়ে ঢাউশ এক প্লেট ভাত দিয়ে বসিয়ে রাখতো আর আমি কোন শব্দ না করে সুন্দর খেয়ে উঠতাম!!

এস.এস.সির পর ভাইয়া ভর্তি হল নটরডেমে,আমি তখন মাত্র গুট গুট পায়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছি।সেসময় একটা ঘটনা ঘটল।আমার দুই বছরের বড় আমার অটিস্টিক চাচাতো ভাইটা তার সমস্ত শরীর আগুনে পুড়িয়ে ফেললো।হসপিটালে দেখতে গিয়ে ওর পোড়া শরীর দেখে ভাইয়া ভয়ে সেন্সলেস হয়ে গেল।এবং সম্ভবত ঠিক তখনই ভাইয়া উপলদ্ধি করলো আর যাই হোক তাকে দিয়ে ডাক্তারি হবেনা!লজ্জা,ভয়,ঘৃনা এই তিনটি আঁকড়ে ধরে ডাক্তার হওয়া যায়না!

এইচ.এস.সির পর মেডিকেল আর ইঞ্জিনিয়ারিং উভয় ভর্তিযুদ্ধে সাফল্যের সাথে উতরে গেলেও ভাইয়া মেডেকেলে ভর্তি না হয়ে কাউকে কিছু না জানিয়ে ভর্তি হল এক বিভাগীয় পাবলিক ইউনিভার্সিটির কম্প্যুটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে!সম্ভবতঃ মুরুব্বীরা বাঁধা দিবে এরকম কোন আশংকা থেকে সে কাউকে জানায়নি!তবে ব্যাপারটা জানার পর মামা-চাচারা কিছুটা কষ্ট পেলেও আব্বু আম্মু তাঁর এই নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেয়ার ক্ষমতায় খুশীই হল।

ধরা-বাঁধা চার বছরের মধ্যে অনার্স কমপ্লিট করে বের হয়ে এলো ভাইয়া।আব্বুতো এমএস করার আগে কিছুতেই চাকরী করতে দেবেনা কিন্তু সে করবেই তাই আব্বু-আম্মু আর কি করবে!

প্রথমে একটি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে তার কয়েকমাস পরেই একটি স্বনামখ্যাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার পদে যোগ দিল পরে সেখানে এমএসটাও করে ফেললো।আল্লাহর অপার কৃপায় আমরা পেয়েও গেলাম মনের মতো একজন ভাবী।আলহামদুলিল্লাহ!শুরু হল আমার ভাইয়ের জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায়।

পৃথিবীতে বহু ধরনের মানুষ!কেউ শুধু দিতে জানে বিনিময়ে কিছু নিতে জানেনা,কেউ শুধু নিতে জানে কিছু দিতে জানেনা,কেউ দিতে জানে আবার নিতেও জানে,কেউ নিয়ে বিনিময়ে দেয় অনিষ্ট আর ক্ষতি!আমার ভাইটি সেই দলের মানুষ যারা শুধু মানুষকে দিয়েই যায়,দিয়েই যায়, বিনিময়ে কিছু নিতে জানেনা!

ভাইয়া চাকরী নেয়ার পর আব্বুর উপার্জন আর ভাইয়ার উপার্জন এমন মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল আমরা বুঝতেই পারিনা কারটা খাই কারটা পরি ভাইয়েরটা নাকি বাবারটা!!আমার জীবনে দেখা উদার,নির্লোভ আর নিঃস্বার্থ গুটিকয় মানুষের মধ্যে আমার এই ভাইটি অন্যতম!তাঁর উদারতার কিছু পাগলামি শুনুন__

একবার আমাদের মাত্র তিনবছরের পুরনো একটি ফ্রিজের গ্যাস শেষ হয়ে গেছে।মাত্র কয়েক হাজার টাকা দিয়ে গ্যাস ভরলেই ফ্রিজটি সচল হবে।ওর্কশপে নেয়ার পর কে যেন তাকে বললো 'স্যার এই নষ্ট ফ্রিজ আমাকে দিয়ে দেন'।

ওমনি সে তাকে ফ্রিজটি দিয়ে আরেকটি নতুন ফ্রিজ কিনে বাসায় ফিরেছে!এরকম কান্ড সে দুবার করেছে!তাঁর পকেটে টাকা আছে আর কেউ তার কাছে সাহায্য চেয়ে খালি হাতে ফেরত গেছে এমন কোন রেকর্ড নেই।অবশ্য সবসময় যে চাইতেই হবে এমন নয় যেচেও সে মানুষকে দেয়!

তাঁর পোষাক-আষাক এতো সাধারন!এখন পর্যন্ত তিনটি বাচ্চার বাবা হওয়ার পরও আব্বু কিনে দিবে তারপর সে পড়বে!একজন ইউনিভার্সিটি টিচারের এতো সাধারন চলাফেরার উদাহরন আর আছে কিনা আমার সন্দেহ!

আমার ব্লগে হাতেখড়িও তাঁর হাত ধরেই।আজ থেকে অর্ধযুগ আগে সামহয়্যারইনের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি সামুর সাথে।নিক বললে প্রত্যেক সিনিয়র ব্লগার চিনবেন এই ডানপন্থী ব্লগারকে,তাই বলবোনা!আমাকেও সে বছরই একটি অ্যাকাউন্ট খুলে হাতে পাসওয়ার্ড ধরিয়ে দেন।প্রিয়জনের সাথে অভিমান করে নিজেকে কষ্ট দেয়ায় আমার জুড়ি মেলা ভার!সে বছরই ব্লগ ছাড়লাম তার সাথেই রাগ করে!অনেক কষ্ট হয়েছিল কিন্তু প্রচন্ড জেদী আমি পারলামও! নিজের ইমম্যাচুরিটির কারনে যা এক সময় মনে হত বড়ভাইসুলভ হিটলারি সময়ের আবর্তনে আজ বুঝতে পারি তা ছিল আসলে পান্ডিত্যপূর্ন গাইডেন্স!

আজ যখন আমার এখান থেকে চলে যাওয়ার বিদায়ের ঘন্টা প্রায় বাজল বলে তখন প্রতিটি মূহুর্তে বুঝতে পারছি আমাদের জীবনটাকে সুন্দর করে সাজানর জন্য এই মানুষটার ছোট ছোট কাজগুলোও কত গুরুত্বপূর্ন ছিল!

বিষয়: বিবিধ

৩২৭২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File