"বিজয়" শব্দের একটি অর্থ: ইসলামের প্রেক্ষিত
লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ১৬ মার্চ, ২০১৩, ০৯:৩০:২৭ রাত
'বিজয়' শব্দের একটি অর্থ: ইসলামের প্রেক্ষিত
মূল: শহীদ ইউসুফ ইয়েরী
ভাষান্তর ও পরিবর্ধন: মঞ্জুর আশরাফ
------
ইসলাম 'বিজয়' শব্দকে প্রথাগত এবং পারিভাষিক অর্থে সীমাবদ্ধ রাখেনি। ইসলাম এই শব্দকে এক নতুন তাত্পর্য দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম অনেক পুরনো শব্দের পরিমার্জন করেছে। প্রাক-ইসলামিক যুগে আরবে, 'সালাত' শব্দের অর্থ ছিল ‘দোয়া’- কিন্তু ইসলাম আসার পর এই শব্দটি একটি নতুন অর্থ পেয়েছে এবং 'সালাত' বলতে আমরা একটি বিশেষ ইবাদতকে তথা 'নামাজকে' বুঝিয়ে থাকি। 'সিয়াম' শব্দের মূল অর্থ কোন কিছু থেকে দুরে থাকা। ইসলাম এই শব্দকে পরিবর্তন করে যে অর্থ দিয়েছে তা হল খাবার, পানীয় এবং স্ত্রী মিলন থেকে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বিরত থাকা। অতএব যখন আমরা 'বিজয়' নিয়ে কথা বলি, তখন লক্ষ্য করব যে, আল্লাহ তায়ালাও বিজয় শব্দকে একটি নতুন তাত্পর্যে মন্ডিত করেছেন।
অনেকে ভেবে থাকেন মুমিনের বিজয়ের জন্য যুদ্ধক্ষেত্রে জয়ের প্রয়োজন। কিন্তু আমরা যদি নিবিড়ভাবে কুরআন অধ্যয়ন করি তবে দেখব যে, আল্লাহ তায়ালা মুমিনদের জন্য বিজয়ের কোন নিশ্চয়তা দেননি। একজন মুমিন যিনি জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহে নিয়োজিত থাকেন, প্রতিটি যুদ্ধে তার বিজয়লাভ সম্ভবপর নাও হতে পারে।
আল্লাহ বলেন,
"এখন যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে, তাহলে এর আগে এমনি ধরনের আঘাত লেগেছে তোমাদের বিরোধী পক্ষের গায়েও ৷ এ – তো কালের উত্থান পতন, মানুষের মধ্যে আমি এর আবর্তন করে থাকি ৷ এ সময় ও অবস্থাটি তোমাদের ওপর এ জন্য আনা হয়েছে যে, আল্লাহ দেখতে চান তোমাদের মধ্যে সাচ্চা মুমিন কে ? আর তিনি তাদেরকে বাছাই করে নিতে চান, যারা যথার্থ ( সত্য ও ন্যায়ের ) সাক্ষী হবে --কেননা জালেমদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না।"
(ইমরান: ১৪০)
এই আয়াতটি ওহুদ যুদ্ধের পর পরই নাজিলকৃত। মুমিনরা আশ্চর্য হয়েছিলেন যে তারা ওহুদ যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন। কেন? কারণ তাদের পারদর্শিতা এবং বদরের যুদ্ধের বিজয় তাদের এই চিন্তার খোড়াক এনে দিয়েছিল যে তারা সকল যুদ্ধের জয়ী হবেন। এ কারণে আল্লাহ মুমিনদের এই শিক্ষা দিয়েছেন যে, বিজয় একমাত্র আল্লাহর ইচ্ছাধীন। এক দিন তোমরা জয়ী হবে আরেকদিন হারবে আয়াতটি এ শিক্ষা নিয়ে নাজিল হয়েছিল যে, আল্লাহতায়ালার এক বিধান/আইন সব সময়ের জন্য প্রযোজ্য।
আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে যদি প্রসারিত করি, এ বোধোদয় হবে যে, যারাই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহের পথে অংশ নিবেন তারা কখনই পরাজিত হতে পারেন না। সব সবয়েই বিজয়ী হবেন। তবে প্রচলিত বিজয়ের সংগানুসারে তারা সফল (বিজয়ী) নাও হতে পারেন। বস্তুত ইসলাম 'বিজয়ের' ১১ টি তাত্পর্য দিয়েছে। এ লেখায় ১টি প্রধান তাত্পর্য আলোচনা করা হবে ইনশাল্লাহ।
বিজয়ের প্রথম অর্থ হল ৮ টি প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে বিজয়! তবে সবচেয়ে বড় বিজয় হল নিজের বিরুদ্ধে বিজয়; শয়তান এবং দুনিয়ার সম্পৃক্ততা থেকে বিজয়। উম্মতের অধিকাংশ সদস্যই যেখানে পরাজিত - সেখানে মুজাহিদরাই জয়ী। তারা আল্লাহর পথেই বের হন এবং আল্লাহর পথেই উত্সর্গীকৃত হন।
আল্লাহ বলেন,
" হে নবী! বলে দাও, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান ও তোমাদের ভাই তোমাদের স্ত্রী ,তোমাদের আত্মীয় -স্বজন , তোমাদের উপার্জিত সম্পদ , তোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাক এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ কর-এসব যদি আল্লাহ ও তার রসূল এবং তার পথে জিহাদ করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশী প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর। আল্লাহ ফাসেকদেরকে কখনো সত্য পথের সন্ধান দেন না৷ "
(তওবা: ২৪)
এই আয়াতে মুমিন এবং তার জিহাদে অংশগ্রহনের মধ্যবর্তী ৮টি বাধার উল্লেখ করা হয়েছে। যদি আর কোনো বাধা থেকে থাকে বোধ করেন তবে তা উল্লিখিত কোন পয়েন্টের সাথেই সম্পর্কিত। নিচে প্রতিটি বাধা বর্ণিত হল:
(ক) তোমাদের পিতা: বর্তমান সময়ে ইসলামের দায়িত্ববোধ বোঝার ব্যপারে এই উম্মত বেশ দুর্বল। তাদের দাবি যে তারা আল্লাহ এবং তার রাসুলকে ভালবাসেন। কিন্তু তারা বোঝেন না আল্লাহ তাদের কাছে কি প্রত্যাশা করেন এবং কি আদেশ করেছেন। বর্তমানে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ এক অবশ্য পালনীয় কর্তব্য অথচ কদাচিতই আমরা পিতামাতাদের দেখি যারা সন্তানদের জিহাদ করার ব্যপারে উত্সাহ দিয়ে থাকেন। অতএব 'পিতা' এই উম্মতের জন্য জিহাদের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে সবচেয়ে বড় শক্তি।
পিতা তার পুত্রকে আল্লাহর পথ যুদ্ধ করার ব্যপারে কখনো সমর্থন করবেনা ।
এজন্যই হজরত খাব্বাব (রা) বলেন, "আমরা যদি পিতাদের আদেশ অমান্য না করতাম, তবে আমাদের কেউই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহে অংশ নিতে পারতাম না।" অতএব পিতার আদেশ অমান্য জিহাদে অংশ নেয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ন গুন যেহেতু এক্ষেত্রে আপনি আল্লাহর আদেশকে মান্য করছেন। আল্লাহর আদেশ মানার জন্য শরিয়তসিদ্ধ যেকোন কিছু অমান্য করাই বৈধ এবং অপরিহার্য।
যে মুহুর্তে পিতা আপনার সাথে সংঘাতে জড়িয়ে পরবে, আপনি আল্লাহকে ধারণ করবেন এবং কেবল তারই আদেশের অনুবর্তী হবেন। যে ব্যক্তিই আল্লাহর আদেশ মানার ব্যপারে নিজ পিতামাতার আদেশ অমান্য করেন সেই প্রমান করেন যে তার পিতামাতার প্রতি ভালবাসাও আল্লাহর খাতিরেই সম্পন্ন হয়। এটি মূলত আল্লাহ তায়ালাকে সন্তুষ্ট করারই এক উপায়।
(খ) তোমাদের সন্তান-সন্ততি: যেকোন পিতামাতার জন্যই সন্তান-সন্ততি একটি প্রিয় বিষয়। রাসুল (দ) বলেন যে, সন্তান-সন্ততি মানুষকে ভিরু এবং কৃপন করে দেয়।এ দুটো বদগুণ মূলত একটি অসুখ আকারে মানুষকে পেয়ে বসে যদি না সে আল্লাহর সাহায্য চায়। পিতামাতা কেন কৃপন হন? সন্তান-সন্ততি থাকার দরুন তাদের আহার, বস্ত্র, খেলনা ইত্যাদি কিনতে হয়। তারা হিসেবী হন। যেকোন খরচের ব্যপারে চিন্তায় পরে যান। কেউ যদি তাদের প্রশ্ন করে যে, "আপনি জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহে অংশ নেন না কেন"? তারা বলবে, "আমার জিহাদ হল আমার পরিবারের দেখাশোনা করা" - এক্ষেত্রে তার "পরিবার" আল্লাহর পথে জিহাদের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক্ স্বরূপ কাজ করে।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই রোগ তাদেরকেও গ্রাস করেছে যারা জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ বুঝে থাকেন বা যারা জীবনের এক পর্যায়ে মুজাহিদ ছিলেন এবং পরবর্তিতে বিয়ে করেছেন, সন্তান-সন্ততি হয়েছে। যেকোন উপায়ে কিছু একটা অজুহাত হিসেবে দাড় করেন পিছনে বসে থাকার ব্যপারে। এটা একটা ফিতনা যা তদের পিছনে টেনে ধরে। অতএব, আল্লাহর তরফ থেকে পুরস্কার প্রাপ্তির ব্যপারে সম্ভাবনা বেড়ে যায় যখন সে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহে অংশ নেন পরিবার পরিজন বিদ্যমান থাকার পরও।
সাহাবাদের লক্ষ্য করুন। তারা সবচেয়ে বেশি ফিতনার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তারা অনেকে একাধিক বিয়েও করেছিলেন। এক বা একাধিক সন্তান-সন্ততিও ছিল। তাদের জীবিকা নির্বাহের সংস্থান ও খুব অল্পই ছিল। তবু আল্লাহর পথে যুদ্ধের ব্যপারে তারা বৃহৎ পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। রাসুল (দ) যখন মক্কা থেকে মদিনা হজরত করেন, কিছু মুসমলান পিছনে থেকে গিয়েছিলেন। পরিবার পরিজনের দুশ্চিন্তা তাদের আটকে রেখেছিল। সপ্তাহ পেরিয়ে গেল - মাস, বছর পেরিয়ে গেল। পরিশেষে মুসলমানরা মক্কা বিজয় করলেন। যে সকল মুসলমান পিছলে (মক্কায়) রয়ে গিয়েছিল ইতিমধ্যে তারা বিরাট বিরাট সুযোগ থেকে বঞ্চিত থাকল। যেমন রাসুল (দ) এর সাথে যুদ্ধ-সমূহ, রাসুল (দ) এর আলোচনা, মসজিদে নববীতে রাসুল (দ) এর খুতবাহ, তারবিয়াতে অংশগ্রহণ, মদিনার ইসলামী সমাজে বসবাস, ইত্যাদি।
তারা উপরোক্ত সকল প্রকার মূল্যবান কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বঞ্চিত হল মাত্র একটি কাজে অংশগ্রহনের অভাবে। কাজটি হল 'হিজরত'।ইবনুল কাইয়ুমইমামিবনুল
ইবনুল কাইয়ুম (র) বলেন, "ভাল কাজ গুনিতক হারে বৃদ্ধি পায় এবং গুনাহের কাজ ও গুনিতক হারে বৃদ্ধি পায়"। 'হিজরতে' অংশ না নেয়ার গুনাহের কাজটিও গুনিতক হারে বেড়েছিল - এতে তারা প্রায় সবকিছু থেকেই বঞ্চিত হয়েছিল। ভাল কাজ যে গুনিতক হারে বাড়ে তার একটি উদাহরণ হল যদি কেউ জামায়াতে নামাজ আদায়ের নিমিত্তে মসজিতে যাত্রা শুরু করে। প্রতি পদক্ষেপে নেকি। প্রত্যেক ভাইয়ের সাথে মুসাহাবার সময় নেকি। মসজিদে প্রবেশের পর 'তাহিয়াতুল মসজিদ' নামাজে নেকি পান। জামায়াতে নামাজে সওয়াব আসে। বাড়ি ফেরার সময়েও প্রতি পদক্ষেপে সওয়াব যুক্ত হয়।
খারাপ কাজের গুনাহ যে গুনিতক হারে বৃদ্ধি পায় তার একটি উদাহরণ হল মদপান করা। এতে ব্যক্তি-বিশেষ মদ্যপ হয়। তখন সে জ্বেনা করতে পারে। খুনও করতে পারে। গাড়ি নিয়ে বের হরে দুর্ঘটনাও ঘটাতে পারে এবং কাউকে নিহত করতে পারে।
এখন ওই সকল মুসলমান যারা মক্কায় থেকে গিয়েছিল, তারা দেখল যে মক্কা বিজয়ান্তে সাহাবীরা মর্যাদার দিক দিয়ে - জ্ঞান, গরিমা, সাধনা, সকল দিক দিয়ে অনেক উচু আসনে সমাসীন। অনেক বেশি পুত-পবিত্র। কুরআন মুখস্ত আর জানার ব্যপারে অনেক অগ্রসর। অথচ পেছনে পরে থাকা মানুষদের কিছু মাত্রই আয়াত জানা ছিল। পরন্তু বদর, ওহুদ, খন্দক, ইত্যাদি যুদ্ধে অংশগ্রহনের সুযোগ-বঞ্চিত ছিল। এমতাবস্থায় এসকল মুসলমানগন পরিবার পরিজনকে নিয়ে দারুন হতাশ হয়ে পড়ল। এর মূল কারনই ছিল তাদের হিজরত না করা এবং পিছনে পরে থাকা। আল্লাহ তায়ালা তখন এই আয়াত নাজিল করেন -
"হে সেই সব লোক যারা ঈমান এসেছো, তোমাদের স্ত্রী ও সন্তানদের মধ্যে কেউ কেউ তোমাদের শত্রু৷ তাদের ব্যাপারে সতর্ক থাক"৷ (তাগাবুন: ১৪: ১ম অংশ )
এই পৃথিবীর বুকে যারা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মানুষ বা সহযোগী তারাই প্রকৃতপক্ষে সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিনত হল। আপনাদের ক্ষেত্রেও এরাই পিছনে টেনে ধরবে যখন আপনি জিহাদের ময়দানে আগাবেন। তাই হতাশ গ্রস্ত পিছনে থেকে যাওয়া লোকেরা তাদের স্ত্রী, পুত্র-কন্যা পরিজনদের পিটাতে লাগল আর বলতে লাগল, "দেখ! তোমাদের জন্য আমাদের কি অবস্থা হয়েছে। আমরা মুসলমানদের সকল প্রকার অর্জন থেকে বঞ্চিত শধু তোমার কারণেই"।
এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ বলেন,
"আর যদি তোমরা ক্ষমা ও সহনশীলতার আচরণ করো এবং ক্ষমা করে দাও তাহলে আল্লাহ অতিব ক্ষমাশীল, অতিব দয়ালু৷ "
(তাগাবুন: ১৪: ২য় অংশ )
এখন স্ত্রী ও সন্তান-সন্ততিদের মারপিট করাতে ভাল কিছু অর্জন হবেনা। এটা কোন পরিবর্তন ও আনবেনা। ইতিমধ্যে অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। তারা এখন তাই ই করতে পারে যা হল - "ক্ষমা করা এবং ইসলামের কাজে ঝাপিয়ে পরা"।
অতএব, আমাদের পরিবার পরিজনের ব্যপারে অত্যন্ত সতর্ক হওয়া উচিত যেহেতু তারা আল্লাহর প্রতি দায়িত্ব পালনের ব্যপারে বড় বাধা হতে পারে - বিশেষত জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহে অংশ নেয়ার ব্যপারে।
(গ) তোমাদের ভাই: এটা অসম্ভব নয় যে আপনাদের ভাইয়েরা জিহাদে অংশ নেয়ার ক্ষেত্রে বাধাস্বরূপ দাড়াতে পারে। সাহায্য সহযোগিতা নাও করতে পারে। পরন্তু যা কিছু আপনি পিছনে ফেলে রাখবেন (সন্তান-সন্ততি, ধন-সম্পদ ইত্যাদি) তাও যথাযথ দেখাশোনা নাও করতে পারে।
(ঘ) পরিবার-পরিজন: বর্তমান সময়ে আমরা জাতি, মাতৃভূমি, জাতিয়্তা, ইত্যাদি ভিন্ন অর্থে ব্যবহার করি। এসব কিছুই বাধা হিসেবে কাজ করে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহে অংশগ্রহনের বিরুদ্ধে। লোকেরা 'জাতিয়্তার' প্রতি উত্সাহ দেখাবে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহর অপরিহার্যতার পূর্বেই। তারা বলবে যে বিভিন্ন দেশের মাঝে শান্তি বজায় রাখা কর্তব্য। কেন? কারণ এটাই হল 'জাতিয়্তার' মাস্লাহা। এটা ভুল। প্রথমত আমাদের দ্বীন তথা আল্লাহ প্রদত্ত ধর্মের মাসলাহা সবার আগে দেখা উচিত - 'জাতিয়্তার' নয়। 'জাতি' আসে এবং যায়। কিন্তু আল্লাহর দ্বীন এমন এক চিরন্তন জিনিস যার প্রতি সর্বাগ্রে দায়িত্বানুভূতি জাগ্রত হওয়া কর্তব্য। অনেক ভাই এবং ইসলামী সংগঠন জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ থেকে নিজেদের বিরত রাখেন জাতিকে সমস্যা থেকে দুরে রাখার স্বার্থে। এটা মূলত মুসলমানের জিহাদে অংশগ্রহনের এক প্রতিবন্ধকতারই নামান্তর। যেমন, কিছু মুসলিম দেশে অনেকে বলে থাকেন তারা জিহাদ চান না কারণ কুফরী শক্তি এতে আগ্রাসন চালাবে এবং সমস্যা তৈরী করবে। কিন্তু আপনি তাই ই করবেন যা আল্লাহ চাইবেন। ফলাফলের প্রতি উদগ্রীব হবেন না - এবং এটাই হল তাওয়াক্কুল। ফলাফল হল পুরো আল্লাহর হাতে। আল্লাহ আপনাকে ধ্বংস করতে পারেন আবার আল্লাহ আপনার হৃদয়-মনকে ইসলামের জন্য উম্মোচিত করে দিতে পারেন। আপনি এটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনি তো বিশ্ব-ব্রম্ম্যান্ড চালাচ্ছেন না। আল্লাহই সব কিছু পরিচালনা করছেন। আল্লাহ আপনাকে বলেছেন জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহে অংশগ্রহনের জন্য।
অনেকে আবার জাতিয়তার আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহে অংশ নিয়ে থাকেন - যা মূলত জিহাদ নয়।
অথচ যখন তারা শুনে যে কোরআনকে, রাসুলকে অপমান করা হয়েছে, তারা আলোড়িত হন না। তারা শুনে যে মুসলিম মহিলাদের অপমান করা হয়েছে অথবা ধর্ষণ করা হয়েছে - কিন্তু তারা নির্লিপ্ত থাকে। কিন্তু যদি কোন প্রেসিডেন্ট বা রাজা একটি মুসলিম জাতিকে যুদ্ধ করতে বলে, তারা কাতারবন্দী হয়ে যুদ্ধে দাড়িয়ে যায়। তারা প্রকৃত পক্ষে ইসলামের জন্য জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ করছে না।
(উ) ধনসম্পদ যা আপনারা অর্জন করেছেন এবং ব্যবসা যার মন্দা হবার ভয় করেন: এদুটো বড় বাধা পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। ধনসম্পদ যা আপনারা সঞ্চয় করেছেন এবং ব্যবসা বানিজ্য যা আছে - তাই ই অনেককে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহে অংশ গ্রহণে পিছনে টেনে ধরে। কারণ, তাদের দোকান, রেস্টুরেন্ট অথবা তাদের চাকুরী - ইত্যাদির কারণে। অনেকে বিশেষ স্টেটাস-সম্পন্ন চাকুরী যেমন ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, শিক্ষকতা ইত্যাদির অজুহাত ও দেখান জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহে অংশ গ্রহণে না করার্থে। বেশ, যদি জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ ফরজে আইন হয় তবে তা আপনাদের করতেই হবে তথাকথিত স্টেটাস-সম্পন্ন চাকুরী থাকুক বা নাই ই থাকুক দুই ক্ষেত্রেই। জিহাদ, সালাত, অথবা সাওম এদের মাঝে কোন পার্থক্য নেই। সবই ফরজে আইন এবং ইবাদত।
আনসাররা (রা) আল্লাহর রাসুলের কাছে শপথ নিয়েছিলেন যে তাকে রক্ষার্থে জানপ্রাণ প্রচেষ্ঠা চালাবেন যেভাবে তারা পরিবার পরিজনের রক্ষার্থে জানপ্রাণ প্রচেষ্ঠা চালান এবং জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহে অংশগ্রহণ করবেন। এতে তাদের ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষতি হয়েছিল। তারা তাদের ফার্ম/ব্যবসা-বানিজ্যের খবরাখবর নিতে পারেননি। এসকল প্রতিষ্ঠানে নিবিড় পরিচর্যা এবং খেয়াল রাখা আবশ্যক যা তারা করতে পারেননি। তাদের আয়-উন্নতি হ্রাস পেয়েছিল। কিন্তু যখন রাসুলুল্লাহ (দ) মক্কা বিজয় করলেন - তখন তারা বললেন - "আলহামদুলিল্লাহ - আমরা নবিজীকে (স) সর্বদা সহযোগিতা করেছি এবং এখন তার জন্মভূমি উম্নুক্ত। তাই আমরা আমাদের ফার্ম/ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ফিরে যেতে পারি"।
এ প্রেক্ষিতে আল্লাহ তায়ালা নাজিল করলেন -
"আল্লাহর পথে ব্যয় করো এবং নিজের হাতে নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না ... ৷" (বাকারা: ১৯৫)
আনসাররা (রা) যা করতে উদ্যত হয়েছিলেন আল্লাহ তাকেই "ধ্বংসাত্মক কাজ" বলে অভিহিত করলেন। অথচ তারা যা করতে চেয়েছিলেন তা হল মদিনায় ফিরে যাওয়া এবং কাজে কর্মে নিবিষ্ট হওয়া। তথাপি আল্লাহতায়ালা এ কাজকে "ধ্বংসাত্মক কাজ" বললেন অথচ জিহাদ তখন ছিল "ফরজে কিফায়া"।
আবু আইয়ুব (রা) বলেন " এই আয়াতটি আমাদের (আনসারদের) সম্পর্কে নাজিলকৃত। যখন আল্লাহতায়ালা তার নবী (দ) কে সাহায্য করেছিলেন এবং ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন, তখন আমরা বললাম (অথবা চিন্তা করলাম), " আস! আমরা আমাদের ধন-সম্পদ নিয়ে থাকি এবং আয়-উন্নতি আনার চেষ্ঠা করি।" (সুনানে আবু দাউদ: ১৪/২৫০৬)
(চ) বাসস্থান যা তোমরা পছন্দ কর: বাসস্থানের আরবি প্রতিশব্দ হল 'মাসকান' যার মূল ধাতু হল 'সকিনা' (শান্তি ও নিরাপত্তা );
আপনি শান্তি ও নিরাপত্তা অনুভব করবেন যখন বাড়িতে থাকেন। স্বাভাবিকভাবেই বাসস্থানের সাথে সম্পর্কযুক্ত হল নিজেদের বাড়ি এবং মাতৃভূমি। আমরা নিজেদের বাড়িতে নির্দিস্ট কিছু নিয়ম পদ্ধতি মেনে চলতে অভ্যস্ত। খাওয়া দাওয়া, ঘুমানো, রুটিন, ইত্যাদি একটি বিশেষ ধারা মেনে চলে। যখনি এই ধারার পরিবর্তন ঘটে তখনই অশান্তি এবং নিরাপত্তাহীনতা তৈরী হয়। একজন মুজাহিদ ফি সাবিলিল্লাহ একটি রুটিন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যান। খাবার যা তিনি গ্রহণ করেন সম্ভবত তা বাড়ির খাবারের থেকে পুরো আলাদা ধরনের। বিছানাও ভিন্ন রকম। ঘুমানোর নিয়ম পরিবর্তিত হয়। সব কিছুই মোটেও আরামদায়ক নাও হতে পারে। এসব প্রতিকুল অবস্থা একজনকে বাড়ি ফিরে যেতে বাধ্য করতে পারে। অথবা সে বাড়ি ফিরে যাওয়ার তীব্র আকাঙ্খা বোধ করে।
একজন ইসলামী আন্দোলনের কর্মী যখন অত্যাচারী সরকারের গোয়েন্দা বা নিরাপত্তা কর্মীদের থেকে বাচতে এবং লুকিয়ে থেকে জিহাদকে বেগবান করতে সচেস্ট হন -- তার বাস স্থান, খাবার, ইত্যাদিও এক ভয়াবহ অনিশ্চয়তায় পড়ে। এক রূড় রুটিন পরিবর্তন এবং প্রতিকুল অবস্থা দিয়ে তাকে দিনযাপন করতে হয়।
অনুরূপভাবে একজন আরব মুজাহিদ যখন চেচনিয়ার পার্বত্য অঞ্চলে মুজাহিদদের সাথে যোগদান করেন, তার খাবার ভিন্ন রকমের হতে পারে যাতে তিনি অভ্যস্ত নাও থাকতে পারেন - আবহাওয়াও অপরিচিত থাকে - দৈনিক রুটিন পরিবর্তিত হয়।
আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা) যখন আরব থেকে বের হয়ে আর্মেনিয়াতে জিহাদে অংশ নিয়েছিলেন - গরম আবহাওয়াতে যিনি অভ্যস্ত ছিলেন - ঠান্ডা আবহাওয়া যার কাছে অচেনা - সেই তিনি ই কয়েক ফুট তুষারপাতের অঞ্চলে যুদ্ধ করেছিলেন। এটা সহজ কোন বিষয় ছিল না। প্রকৃতপক্ষেই তা এক বড় ধরনের ত্যাগ ছিল। এজন্যই হজ্জ জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহের সাথে সম্পর্কিত - কারণ এসময়ে মানুষের রুটিন পরিবর্তিত হয়। যদিও জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহের সাথে তুলনা করলে হজ্জের কাঠিন্য কম। তথাপি হাজীদের দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করতে হয় মুজাহিদদের মতই। কাপড়চোপড় হজ্জে যা পরেন তা সাধারণ কাপড়চোপরের মত নয়। চুল কাটতে পারেন না। নখ ও কাটতে পারেন না। এ বিষয়গুলো ফিতরাতের সুন্নাত কিন্তু সে সময় তারা এগুলো করতে পারেন না। পরন্তু হজ্জে অর্থ সংকুলান ও প্রয়োজন।
আপনার বাড়িঘরের প্রতি তীব্র আকাঙ্খা ও ভালবাসা আপনাকে জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ থেকে দুরে রাখতে পারে। কখনও মুজাহিদদের বছরের পর বছর বাসস্থান থেকে দুরে থাকতে হতে পারে। এ প্রতিবন্ধকতার সমাধান হল "ধৈর্য ধারণ" করা।
এজন্যই আল্লাহ সুরা তওবাতে বলেছেন " হে নবী! বলে দাও, যদি তোমাদের পিতা, তোমাদের সন্তান ও তোমাদের ভাই তোমাদের স্ত্রী ,তোমাদের আত্মীয় -স্বজন , তোমাদের উপার্জিত সম্পদ , তোমাদের যে ব্যবসায়ে মন্দা দেখা দেয়ার ভয়ে তোমরা তটস্থ থাক এবং তোমাদের যে বাসস্থানকে তোমরা খুবই পছন্দ কর-এসব যদি আল্লাহ ও তার রসূল এবং তার পথে জিহাদ করার চাইতে তোমাদের কাছে বেশী প্রিয় হয়, তাহলে আল্লাহর ফায়সালা তোমাদের কাছে না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা কর .." (আয়াত ২৪)
"আল্লাহর ফয়সালা" বলতে এখানে শাস্তিকে বুঝানো হয়েছে।
একজন মুসলিম উপরোল্লিখিত আটটি বাধার উপর যখন বিজয়ী হতে পারবেন তখন সেটাই হবে সবচেয়ে বড় বিজয়। তিনি এক্ষেত্রে আরেকটি বড় বিজয় অর্জন করলেন; তা হল: "ফাসেক না হওয়ার বিজয়" - কারণ আল্লাহ বলেন যারাই উপরোক্ত বাধাগুলো অতিক্রম করতে অপারগ, তারাই 'ফাসেক'।
আপনারা "বিজয়" অর্জন করতে পারেন এটা প্রমানের মাধ্যমে যে, আপনি আল্লাহকে, তার নবী (স) কে ভালবাসেন জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহকে ব্যবহারিক ও বাস্তব জীবনে প্রয়োগের মাধ্যমে - "মুখের বক্তৃতা/বিবৃতি"র মাধ্যমে নয়।
অনেকে বলে থাকেন যে তারা আল্লাহ ও রাসুলের (স) প্রতি ভালবাসা প্রদর্শন করেন। তারা 'নাসিদ (সংগীত) গেয়ে থাকেন', কোরআন তেলাওয়াত করে থাকেন, সুন্নতের অনুসারী হন, ইত্যাদি। কিন্তু আপনি যদি বাস্তবিকপক্ষেই আল্লাহ ও রাসুলের (স) প্রতি ভালবাসা প্রকাশ করতে চান, তবে একজন ইসলামী আন্দোলনের মুজাহিদ হিসেবে নিজকে গড়ে তুলুন। তখন আপনাকে আর কথা বলতে হবেনা। কাজের মাধ্যমেই তা প্রমান করলেন। আসলে 'ঈমান' হল কাজের মাধ্যমে প্রমান করারই বিষয়!
বিষয়: বিবিধ
১৩৭৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন