চার ধরনের গ্রুপ - "আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি" (মূলঃ ইবনুল কায়্যিমের (রহ) লেখা থেকে)
লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ০২ মে, ২০১৫, ০৮:৪৫:২৫ রাত
যারা আল্লাহর বাণী "আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি" ধারন করেন, তাদের চারটি উপায়ে সবচেয়ে উত্তম ইবাদত ও কার্যসাধন করতে দেখা যায়।
প্রথম গ্রুপ মনে করেন সবচেয়ে উত্তম ও ভাল কাজ হল সবচেয়ে কঠিন কাজ। কারন তা পার্থিব বাসনা মুক্ত। তাদের দৃষ্টিতে এটাই ইবাদতের প্রকৃত মর্ম। কাজের পুরস্কার নির্ভর করে কাজ কত কঠিন তার উপর। তারা পুরোপুরি সন্দেহ মুক্ত নয় এমন একটি হাদিস এক্ষেত্রে উল্লেখ করে থাকেন: "সবচেয়ে ভাল কাজ হল তা যা কঠিন"।
এরা কঠিন কাজ করতে ইচ্ছুক। এরা নিজেদের কঠিন কাজে নিমগ্ন রাখেন । মনে করা থাকেন , এটাই নিজকে সঠিক রাখার জন্য প্রয়োজন। কেউ যখন নিজকে পার্থিব বাসনায় জড়িয়ে ফেলে, এদের মতে কোন মানুষ কখনই ধর্মের পথে সঠিক ও দৃঢ় থাকতে পারবেনা যদি না সে বিপদে পতিত না হয় কিংবা কঠিন অবস্থা দ্বারা জীবন ধারন না করে থাকে।
দ্বিতীয় গ্রুপ মনে করেন , ইবাদত পুরোপুরি আল্লাহর জন্যই হতে হবে। এদের দু'দলে ভাগ করা যায়:
(ক) বৈরাগ্য হল চূড়ান্ত উদ্দেশ্য। এর জন্য এরা চূড়ান্ত এবং জ্ঞান ও ইবাদতে সর্বোত্তম হওয়ার চেষ্টা চালায়।
(খ) এরা ভাবে বৈরাগ্য হল উপায় - কিন্তু শেষ নয়। এদের দু'দলে ভাগ করা যায়:
(খ.১) আল্লাহর জিকিরের নামে এরা ফরজ কাজ ত্যগ করে!
(খ.২) এরা ফরজ পালন করেন ঠিকই কিন্তু নফল, উপকারী কাজ যেমন মানবতার সেবা, উপকারী জ্ঞান আহরনে তেমন ইচ্ছুক নন।
তৃতীয় গ্রুপ ভাবেন , সবচেয়ে উত্তম ও উপকারী ইবাদত হল সেই ইবাদত বা কাজ যার মাঝে বহুধাবিস্তৃত (অল্প সময়ের জন্য নয়) উপকার বিদ্যমান থাকে। সাধারন লোকদের জন্য মহতী বা সেবামুলক কাজ করা, দরিদ্রের সেবা করা, তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করা, অন্য সকল কাজের থেকে ভাল। এক্ষেত্রে তারা যে রেফারেন্স ব্যবহার করেন তা হল: আবু ইয়ালা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স) বলেন, "সকল সৃষ্টি আল্লাহর; আর আল্লাহ তাকেই সবচেয়ে ভালবাসেন যে অন্য সৃষ্টির উপকার করেন।" (তাবরানী)
তারা মনে করেন, একজন ইবাদতকারীর উপকার কেবল নিজের মাঝেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু মানবতার জন্য উপকার অন্য সবার জন্য প্রযোজ্য। তারা ভাবেন, একজন স্কলারের মর্যাদা একজন সাধারন ইবাদতকারীর তুলনায় অনেক বেশি - যেমন একটি পূর্ণ চন্দ্রের মহিমা তারকার উপর। (আহমদ)
তারা বলে থাকেন, রাসুলুল্লাহ (স) এসেছেন মানবতার মুক্তির জন্য - পৃথিবী ও আখেরাত দুই জীবনেরই উত্কর্ষতার জন্য। তারা বিচ্ছিন্ন বৈরাগ্য জীবন ধরনের জন্য আসেননি। বরঞ্চ রাসুলুল্লাহ (স) এমন লোকদের ভত্সনাও করেছেন. এজন্য এ গ্রুপ মনে করে, অন্যের উপকার সাধন অন্য ইবাদত অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।
চতুর্থ গ্রুপ মনে করে থাকেন যে, আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ ই সবচেয়ে উত্তম কাজ এবং তা নির্ভর করে বিদ্যমান পারিপার্শিক অবস্থার উপর। উদাহরণস্বরূপ যখন কোন ছাত্র বা অজ্ঞ মানুষ তাদের কাছে জ্ঞান আহরণে আসেন , তখন তাকে জ্ঞানদান করা সবচেয়ে বড় ইবাদত মনে করেন। যখন জিহাদ কোন জায়গায় অতীব প্রয়োজন তখন জিহাদ ই সবচেয়ে উত্তম কাজ - তাতে নফল বা অতিরক্ত নামাজ (কিয়ামুল লাইল) বা নফল রোজা না রাখার প্রয়োজন হোক না কেন। যখন তাদের বাসায় কোন অতিথি আসেন , তখন অতিথির উত্তম সেবা প্রদানই তাদের কাছে সবচেয়ে অপরিহার্য হয়ে পড়ে আল্লাহর জিকির বা একই রকম কাজের তুলনায়।
এ গ্রুপ সর্বাবস্থায় ইবাদতের ধারনায় বিশ্বাস করে থাকেন উপরের পদ্ধতিতেই - পারিপার্শিক অবস্থার প্রেক্ষিতে।
যাদের 'ইবাদতের' বিস্তারিত ধারণা আছে, তারা কোন নির্দিস্ট ভাল কাজেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখেন না। তার পরিবর্তে তারা সর্বাবস্থায় আল্লাহর সন্তুষ্টি খুঁজে ফিরেন - যেকোন ছোট বা বড় সকল কাজের বা ইবাদতের মাধ্যমেই। তারা তাদের মানোন্নয়ন বা ঈমানের অবস্থার উন্নয়নে সচেস্ট থাকেন । তারা স্কলার, নিভৃতে ইবাদতকারী, কিংবা আল্লাহর পথে মুজাহিদদের সবার সাথেই থাকতে সমভাবে ভালবাসেন -- আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই।
এরা আল্লাহর প্রকৃত বান্দাহ। যারা কোন নির্দিস্ট কাজে বা ইবাদতের উপায়ে নিজেদের আবদ্ধ রাখেন না।
তারা নিজেদের লালসায় নিবদ্ধ রাখেন না - ইবাদত-চ্যুতির আশংকায়।
এরাই আল্লাহর বাণীর প্রকৃত ধারক - "আমরা কেবল তোমারই ইবাদত করি"।
এরা দুনিয়ার জীবনের আনন্দের কম ই মূল্য দিয়ে থেকে অন্তর থেকেন । তাদের খাবার, পানীয়, পোশাক সাধারন এবং যা সাধারনভাবে সহজপ্রাপ্য।
তারা আল্লাহর নির্দেশ পালনে ব্যস্ত থাকেন - সব সময়ে সব অবস্থায়।
যখন কোন মিটিংয়ে তারা যান , তারা প্রথম সারিতে বসতে ব্যস্ত হন না - চান ও না। বনঞ্চ তারা বিনয়ী, ভদ্র থাকেন - যেকোন খালি আসনে ই বসতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন না। তারা ফর্মাল আচরণ বা জড়তা দিয়ে বাধাগ্রস্থ হন না।
বরঞ্চ যেকোন সময়ে ও স্থানে তারা মুক্তভাবে ও খাটি উপায়ে স্রষ্টার আদেশ-নিষেধ মানতে একাগ্র থাকেন ।
তারা সামজিক প্রকৃতির, এবং ভালদের সাথে বন্ধু-সম আচরনের অধিকারী। আবার যারা আল্লাহর নিয়ম ভংগ করে বা তার বিরুদ্ধে সোচ্চার, তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রকৃতির এরা।
তারা সৃষ্টির সাথে শান্তির উপায়ে সহাবস্থান এবং নিজ স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতে মোটেও কার্পন্য করেন না।
তারা সব সময়ে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করেন এবং তার কাছেই নিরত হেদায়াত প্রত্যাশা করে থাকে।
তারা যখন আল্লাহর সান্নিধ্যে থাকেন, তখন লোকদের পুরোপুরি ভুলে যান।
এবং যখন এরা লোকদের সান্নিধ্যে থাকে, তখন নিজ ইচ্ছা ও লালসাকে ভুলে যান পরার্থে।
এরা (চতুর্থ গ্রুপ) কতই না মহান!
আল্লাহ আমাদের সফলতা দান করুন। আর সাহায্য চাইলে আল্লাহর কাছেই চাওয়া উচিত।
[ ইবনুল কায়্যিম, মাদারিজ আস-সালিকিন, পৃ: ৮৫ - ৯০ এর ভাবার্থ -- যা ইউসুফ কার্দায়ির 'ফিকহ অব প্রায়োরিটি' বই এর ১৩১ - ১৩৮ পৃ: এ হুবহু বর্ণিত হয়েছে ]
বিষয়: বিবিধ
১৬৫৪ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ইবাদতের উদ্দেশ্যটা্ নিয়েও আমাদের চিন্তা অনেক ভুল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন