নাস্তিকতা (৮)ঃ পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভুতি লব্ধ জ্ঞান ছাড়া আর কিছুই কি বিশ্বাসযোগ্য নয়!

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ০৯ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৭:৩৮:১৫ সন্ধ্যা

আমরা কি যুক্তিসম্মত ধারনার (rational concept) উপরও নির্ভর করব অনুভুতিলব্ধ বিষয় (perceptible through senses) ছাড়াও? পাশ্চাত্যের স্কলারদের কাছে এ এক বহুল বিতর্কিত বিষয়। সকল মুসলিম দার্শনিক এবং প্রাচীনকালের পাশ্চাত্যের অনেক দার্শনিকরা বিশ্বাস করতেন যে, আমরা যুক্তিসম্মত ধারনার উপর নির্ভর করব অনুভুতিলব্ধ বিষয় ছাড়াও।

পরন্তু তারা এমন মতামতের উপর দাড়িয়ে যে, একটি একাডেমিক ভিত্তিও কোন কিছু প্রমানার্থে শুধুমাত্র অনুভুতিলব্ধ বিষয়কে গ্রহণ বাস্তবসিদ্ধ মনে করেনা। কিন্তু অধুনা অনেক স্কলার, বিশেষত বৈজ্ঞানিকগন মনে করেন যে, অনুভুতিলব্ধ বিষয় (যা পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়েই প্রমান করা যায়) ছাড়া আর সব কিছু ই অগ্রহণযোগ্য। প্রমান হিসেবে তারা বলে থাকেন:

"খাটি যুক্তিসম্মত ধারনা অনেক সময় ভুল হতে পারে। ঐসকল (যুক্তিসম্মত) প্রমাণগুলোকে বা ধারণাগুলিকে উপলব্ধির জন্য কোন পরিক্ষা বা পর্যবেক্ষন নেই; ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝা যায়না! কিন্তু অনুভুতিলব্ধ বিষয় উপরোক্ত সমস্যা থেকে মুক্ত। কোন জিনিসকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝলে, আমরা ক্রমাগত (পুন:পুন: ) পরীক্ষা দিয়ে তা যাচাই করি। এই ক্রমাগত (পুন:পুন: ) পরীক্ষা চলতে থাকে যতক্ষন না আমরা নিশ্চিত হই পরীক্ষার অবজেক্ট-এর (বস্তুর) চরিত্র ও বৈশিস্ট সম্পর্কে। অতএব, অনুভুতিলব্ধ বিষয় কোন রকম সন্দেহ থেকে মুক্ত - কিন্তু যুক্তিসম্মত ধারনা সন্দেহের উর্ধে নয়।"

কিন্তু এ যুক্তির বেশ কিছু সমস্যা আছে:

[১] উপরের সবগুলো ফ্যাক্ট ই যুক্তিসম্মত। এদেরকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে বুঝা সম্ভব নয়। অন্য কথায়, ওই সকল স্কলাররা মূলত যুক্তিসম্মত ফ্যাক্টই উপস্থাপন করে থাকেন এক্ষেত্রে এটা প্রমান করার জন্য যে, "যুক্তিসম্মত ফ্যাক্ট /ভিত্তি র উপর নির্ভর করা যায়না"! কি বৈপরিত্য! তারা যদি যুক্তিসম্মত উপায়ে (পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভুতি ভিন্ন) তাদের বদ্ধমূল ধারনাকে বা ফ্যাক্ট কে প্রমান করতে সমর্থ হন, তবে তারা মূলত ভালভাবেই নিজেদের বদ্ধমূল ধারনাকেই ভুল প্রমান করলেন নিজেদের বুঝার অগোচরে!

[২] পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বা অনুভুতির মাধ্যমে অর্জিত ধারনাও কম ভুলের সম্মুখীন হয় না যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্ত বা ধারনার তুলনায়! কোন বইয়ের দিকে দৃষ্টিপাত মূলত আলোকচ্ছটার চোখের মাঝে পতিত হওয়া বৈজ্ঞানিকভাবেই ব্যখ্যা করে। এক্ষেত্রে দৃষ্টিপাত, শোনা আর অন্যান্য অনুভুতির মাঝে কত রকমের ভুল যে তৈরী করতে পারে বিভিন্ন মানুষের মাঝে তা সবাই জানে! যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্ত বা ধারনা যদি অনির্ভরযোগ্য হয়, তবে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে বা অনুভুতির মাধ্যমে অর্জিত ধারনাও একই কারনে অনির্ভরযোগ্য হওয়া উচিত!

[৩] এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সঠিক ধারনা আর ভুল ধারনার মাঝে একটি পৃথকীকরন উপায় থাকতে হবে। কিন্তু এটি "পুন:পুন: পরীক্ষা" নয় যা ওই পৃথকীকরন উপায় মনের মাঝে তৈরী করবে। পরন্তু, এটি যুক্তিসম্মত উপায়ে (পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভুতি ভিন্ন) তাদের বদ্ধমূল ধারনারই ভিত্তি রচনা করে। আমরা যখন কোন বস্তুর কোন বৈশিস্ট বা ধর্ম আবিস্কার করি এবং ঐ বৈশিস্ট যদি পুন: পুন: পরীক্ষার পরও অপরিবর্তিত হিসেবে পর্যবেক্ষন করি- তবে যুক্তিসম্মত ফ্যাক্ট /ভিত্তি কে নিচের লাইন্গুলির মাধ্যমে ব্যখ্যা করা যায়:

"যদি ওই বৈশিস্ট বা ধর্ম বস্তুর নিজস্ব বৈশিস্ট বা ধর্ম না হয়ে থাকে, তবে কোন না কোন পরীক্ষায় এর ব্যতিক্রম দেখা যাবে।

কিন্তু যদি ওই বৈশিস্ট বা ধর্ম সব সময়ই বস্তুর মাঝে পাওয়া যায় / দেখা যায়, তবে অবশ্যই তা ওই বস্তুর বৈশিস্ট বা ধর্ম।"


অতএব এটা সুস্পস্ট যে, পঞ্চ ইন্দ্রিয় লব্ধ জ্ঞান, ফ্যাক্ট বা বৈশিস্ট অবশ্যই লজিকালি যুক্তিসম্মত ফ্যাক্ট /ভিত্তি (যা উপরের বিবৃত লাইনগুলোর মাধ্যমে উল্লিখিত) র উপর নির্ভর করে তার প্রাপ্তিকে প্রমান করার্থে।

[৪] ধরি যে, বাস্তবিকভাবে প্রত্যেক অনুভুতিসিদ্ধ ধারনা পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু ওই পরীক্ষাটি কি আরেকটি পরীক্ষা দ্বারা প্রমাণিত নয়? তাছাড়া কিসের ভিত্তিতে প্রথম পরীক্ষাকে সত্য বলব? যদি তাই হয়, তবে একই প্রশ্ন এই দ্বিতীয় পরীক্ষার জন্য ও প্রযোজ্য হবে। এভাবে, অবশ্যই অসীম সংখ্যক নির্ভরশীলতার রূপরেখা আঁকা যাবে - যা অবশ্যই ঠিক হবে না! আমাদের অবশ্যই এমন একটি পরীক্ষায় এসে থামতে হবে যার সত্যতার প্রমান শুধুমাত্র অনুভুতি বা সেন্সর দ্বারা ই প্রমাণিত হলে চলবে না পরন্তু উপরে উল্লিখিত যুক্তি-ভিত্তিক্প্রমান দিয়েও বাখ্যা করা যাবে। এর অর্থ: কেউ শুধুমাত্র অনুভুতি বা সেন্সরলব্ধ ধারনার উপর নির্ভর করতে অক্ষম যদি না সে একই সাথে যুক্তি-ভিত্তিক্ ধারনার উপর নির্ভরশীল না হয়।

[৫] পঞ্চ ইন্দ্রিয় অ্যাবসলিউট বা পরম অবস্থা (যা আপেক্ষিক নয় ) বুঝতে বা সনাক্ত করতে সক্ষম নয়। তারা কেবল কোন নির্দিস্ট ও অপ্রধান বিষয়গুলোকেই সনাক্ত করতে পারে। 'জ্ঞান' অ্যাবসলিউট বা পরম অবস্থা (যা আপেক্ষিক নয় )র উপরই নির্ভর করে কেবল - যা কোন ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করা সম্ভব নয়, অথবা যাকে পঞ্চ ইন্দ্রিয় দ্বারা পূর্ণ অনুধাবন করা সম্ভব নয়।

বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে বুঝি! এনাটমির (anatomy) একজন প্রফেসর অপারেশন করেন না কাটা ছেড়া করেন 'অনেক গুলো ' জীবন্ত বা মৃত মানব দেহের উপর - এখানে এটা ব্যপার না যে, তিনি কতগুলো (অনেক বা কম) দেহের উপর অপারেশন করলেন! তিনি দেখেন যে, প্রত্যেক দেহেই - যা তিনি অপারেশন করেছেন বা কাটা ছেড়া করেছেন - একটি হৃদপিন্ড, একটি যকৃত ইত্যাদি রয়েছে। ঐসকল নির্দিস্ট কেইস দেখার পর, তিনি নিজেকে এ ব্যপারে কনফিডেন্ট মনে করেন এবং সেভাবে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা দেন যে, প্রত্যেক মানুষের একটি হৃদপিন্ড এবং একটি যকৃত রয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল: তিনি কি "সকল" মানুষের ভেতর দেখেছেন?

যদি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভুতি লব্ধ জ্ঞানের আলোকে সিদ্ধান্ত নেয়াকে ১০০% সত্য ধরা হয়, কিভাবে বিজ্ঞানের যেকোন শাখার অ্যাবসলিউট বা পরম কোন proposition বা প্রস্তাবকে সত্য হিসেবে ধরা যাবে?

আসল ফ্যাক্ট হল: পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভুতি লব্ধ জ্ঞান এবং যুক্তি-ভিত্তিক (rational) ধারনা উভয়েরই নিজস্ব অবস্থান রয়েছে জ্ঞানের সমুদ্রে! উভয়েই একজন আরেকজনের পরিপূরক ও সহায়ক| বুদ্ধিবৃত্তিক উপায়ে এবং বোধগম্যতার আলোকেই অ্যাবসলিউট বা পরম মূলনীতির (principles) উত্সের অনুষদ (faculty) সম্পর্কে ধারনা পাই। প্রত্যেকেই জানে যে, 'মানুষ' হল এমন ই এক অনুষদ বা দক্ষতা। কিভাবে একটি অনুষদ যা আল্লাহ সৃষ্টি করলেন তা সব সময়েই ভুল হবে? কিভাবে সে সব সময়েই অসফল হবে তার দায়িত্ব পালনে যা স্রষ্টা তাকে বিশ্বাসের সাথে দিয়েছেন? স্রষ্টা কখন ই তার এজেন্ট কে বিশ্বাস করে এমন কোন কাজের দায়িত্ব দিবেন না যতক্ষন না তিনি তার সৃষ্টির মাঝে একটি যোগসুত্র তৈরী করেন!

উপরে আলোচিত পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অনুভুতি লব্ধ জ্ঞান এবং যুক্তি-ভিত্তিক (rational) ধারনার 'ভুল/ত্রুটি' (মানুষ কর্তৃক) আরও কিছু বিষয় দিয়ে ও পরীক্ষা করা যায় - যেমন 'লজিক'।

( সূত্র: 'আল মিজান - কুরআনের তাফসির" ভলিউম-১, প-৬৯ - ৭১, আল্লামা আত-তাবাতাবাই )

বিষয়: বিবিধ

১৪৭০ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

292821
০৯ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০৯:২২
মোঃমাছুম বিল্লাহ লিখেছেন : সুন্দর তো

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File