নাস্তিকতা (৬)ঃ পৃথিবীর দু:খ কস্ট এবং অন্যায়
লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ১৫ নভেম্বর, ২০১৪, ০৪:১৩:৩৬ বিকাল
১) প্রচলিত ধারনা: অনেক নাস্তিকের যুক্তি হল: এটি অবিশ্বাস্য যে একজন ভাল, শক্তিশালী স্রষ্টা আছেন; অথচ সারা পৃথিবী জুড়ে অন্যায়, দু:খ, কস্ট বিদ্যমান।
১.১) পাশ্চাত্য দর্শন:
ডেভিড হিউম বলেন,
"এপিকিউরাস এর পূরাতন প্রশ্নের উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি।
সে (GOD) কি মন্দ থামাতে চায়, কিন্তু মন্দ থামাতে অক্ষম? যদি অক্ষম হয় তবে সে নপুংসক। আর যদি সে থামাতে সমর্থ হয়, কিন্তু ইচ্ছা পোষন করেন না, তবে সে বিদ্বেষপরায়ণ। যদি সে সক্ষম ও হয় আবার মন্দ থামাতে ইচ্ছা ও পোষন করেন তবে সে কি শয়তান নয়?"
[David Hume, Dialogues Concerning Natural Religion: The Posthumous Essays on the Immortality of The Soul and Suicide. Edited by Richard Popkin. Hackett Publishing. 1980, p. 63.]
১.১.১) একটি সহজ যুক্তি এ তত্ত্বের বিরুদ্ধে:
সম্ভাবনার মূলনীতি (Likelihood Principle) অনুযায়ী আমরা জানি যে, যখন তথ্য-উপাত্ত (data) কোন একটি বিশেষ হাইপোথিসিসের স্বপক্ষে অধিক পরিমানে থাকে আরেক হাইপোথিসিসের থেকে, তখন যার স্বপক্ষে তথ্য-উপাত্ত বেশি তাইই ওই হাইপোথিসিস অধিক সত্য হওয়ার স্বপক্ষে প্রমান হিসেবে কাজ করে।
সম্ভাবনার মূলনীতি অনুযায়ী আপনি যদি দু:খ, দুর্দশা, কস্ট কে স্রষ্টার না থাকার পক্ষে শক্ত যুক্তি হিসেবে দাড় করাতে পারেন, তবে একই যুক্তিতে
বিশ্ব ব্রম্মান্ডের ফাইন টিউনিং বা নিখুত ভারসাম্য ব্যবস্থাকে সম্ভাবনার মূলনীতি অনুযায়ী স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে শক্ত যুক্তি হিসেবে স্বীকার করতে আপনি অসমর্থ কেন?
২) তিনটি সাহসী স্বতঃসিদ্ধ: (আস্তিক ও নাস্তিক উভয় দৃষ্টিকোণ থেকে)
(ক) প্রভু অবশ্যই ভাল এবং শক্তিমান
(খ) মন্দকে বাধা দেয়ার কোন পর্যাপ্ত কারন প্রভুর নেই — এটা কি আদৌ সত্যি?
(গ) মন্দ ই হল প্রভুর উদ্দেশ্য — এটা কি আদৌ সত্যি?
আমরা বিস্তারিত ব্যখ্যা করব এই তিন পয়েন্টে।
২.১) যুক্তি: প্রভু অবশ্যই ভাল এবং শক্তিমান:
২.১.১) জ্ঞান ও প্রগ্গা (wisdom):
তত্ব: যদি প্রগ্গা (wisdom) না দেখা যায় (আপাত দৃষ্টিতে - পরিপূর্ণ জ্ঞান ব্যতিরেকে), তার অর্থ এ নয় যে, প্রগ্গা (wisdom) অনুপস্থিত।
প্রমান:
(ক)
সুরা কাহাফ ৬৫ - ৮২ আয়াত: যেখানে মুসা (আ) কয়েকটি ঘটনার পেছনের অন্তর্নিহিত স্রষ্টার প্রগ্গা (wisdom) বুঝতে পারেন নি। অথচ ঘটনাগুলো প্রচলিত নীতি-বিরুদ্ধ এবং দূ:খ-কস্ট ভিন্ন কিছু ছিল না!
বিস্তারিত:
আয়াত ৬৫ - ৬৭:
এবং সেখানে তারা আমার বান্দাদের মধ্য থেকে এক বান্দাকে পেলো, যাকে আমি নিজের অনুগ্রহ দান করেছিলাম এবং নিজের পক্ষ থেকে একটি বিশেষ জ্ঞান দান করেছিলাম৷ মূসা তাকে বললো, আমি কি আপনার সাথে থাকতে পারি, যাতে আপনাকে যে জ্ঞান শেখানো হয়েছে তা থেকে আমাকেও কিছু শেখাবেন ? সে বললো, আপনি আমার সাথে সবর করতে পারবেন না৷
শিক্ষা ১: আপনি আমার সহযোগী হতে পারবেন না যখন আপনি আমাকে আশ্চর্য ধরনের কাজ করতে দেখবেন যা আপনার বোধগম্যের বা প্রচলিত রীতিনীতির বাইরের হবে। কারন, আল্লাহতায়ালা আমাকে এমন জ্ঞান দিয়েছেন যা আপনাকে অবগত করেননি। পরন্তু আল্লাহতায়ালা আপনাকে এমন জ্ঞান দান করেছেন যা আমাকে জানান নি।
[তাফসির ইবনে কাসীর]
আয়াত: ৬৮: আর তাছাড়া যে ব্যাপারের আপনি কিছুই জানেন না সে ব্যাপারে আপনি সবর করবেনই বা কেমন করে৷
শিক্ষা ২: আর আপনি (মুসা (আ)) আমার (খিজির (আ) এর) সমালোচনা করবেন নায্যভাবেই, কিন্তু আমার কাছে প্রভু প্রদত্ত বিশেষ জ্ঞান আছে এবং (তাদের মাঝে সংঘটিত) ঘটনার অন্তর্নিহিত কার্যকারন যা আমি দেখতে পাই, কিন্তু আপনি তা দেখতে/বুঝতে অক্ষম।
[তাফসির ইবনে কাসীর]
আয়াত ৬৯ - ৮২ ) মূসা বললো, “ইনশাআল্লাহ আপনি আমাকে সবরকারী হিসেবেই পাবেন এবং কোনো ব্যাপারেই আমি আপনার হুকুম অমান্য করবো না৷ সে বললো, আচ্ছা, যদি আপনি আমার সাথে চলেন তাহলে আমাকে কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করবেন না যতক্ষণ না আমি নিজে সে সম্পর্কে আপনাকে বলি৷ অতপর তারা দুজন রওয়ানা হলো৷ শেষ পর্যন্ত যখন তারা একটি নৌকায় আরোহণ করলো তখন ঐ ব্যক্তি নৌকা ছিদ্র করে দিল৷ মূসা বললো, “আপনি কি নৌকার সকল আরোহীকে ডুবিয়ে দেবার জন্য তাতে ছিদ্র করলেন ? এতো আপনি বড়ই মারাত্মক কাজ করলেন৷” সে বললো, “আমি না তোমাকে বলেছিলাম, তুমি আমার সাথে সবর করতে পারবে না ?” মূসা বললো, “ভুল চুকের জন্য আমাকে পাকড়াও করবেন না, আমার ব্যাপারে আপনি কঠোর নীতি অবলম্বন করবেন না৷” এরপর তারা দুজন চললো৷ চলতে চলতে তারা একটি বালকের দেখা পেলো এবং ঐ ব্যক্তি তাকে হত্যা করলো৷ মূসা বললো, “আপনি এক নিরপরাধকে হত্যা করলেন অথচ সে কাউকে হত্যা করেনি ? এটা তো বড়ই খারাপ কাজ করলেন৷”
সে বললো, “আমি না তোমাকে বলেছিলাম, তুমি আমার সাথে সবর করতে পারবে না ?”
মূসা বললো, “এরপর যদি আমি আপনাকে কিছু জিজ্ঞেস করি তাহলে আপনি আমাকে আপনার সাথে রাখবেন না৷ এখন তো আমার পক্ষ থেকে আপনি ওজর পেয়ে গেছেন৷”
তারপর তারা সামনের দিকে চললো৷ চলতে চলতে একটি জনবসতিতে প্রবেশ করলো এবং সেখানে লোকদের কাছে খাবার চাইলো৷ কিন্তু তারা তাদের দুজনের মেহমানদারী করতে অস্বীকৃতি জানালো৷ সেখানে তারা একটি দেয়াল দেখলো, সেটি পড়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল৷ সে দেয়ালটি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে দিল৷ মূসা বললো, “আপনি চাইলেএ কাজের পারিশ্রমিক নিতে পারতেন৷”
সে বললো, “ব্যাস, তোমার ও আমার সংগ শেষ হয়ে গেলো৷ এখন আমি যে কথাগুলোর ওপর তুমি সবর করতে পারোনি সেগুলোর তাৎপর্য তোমাকে বলবো৷
সেই নৌকাটির ব্যাপার ছিল এই যে, সেটি ছিল কয়েকজন গরীব লোকের, তারা সাগরে মেহনত মজদুরী করতো৷ আমি সেটিকে ত্রুটিযুক্ত করে দিতে চাইলাম৷ কারণ সামনের দিকে ছিল এমন বাদশাহর এলাকা যে প্রত্যেকটি নৌকা জবরদস্তি ছিনিয়ে নিতো৷
আর ঐ বালকটির ব্যাপার হচ্ছে এই যে, তার বাপ-মা ছিল মুমিন৷ আমাদের আশংকা হলো, এ বালক তার বিদ্রোহাত্মক আচরণ ও কুফরীর মাধ্যমে তাদেরকে বিব্রত করবে৷
তাই আমরা চাইলাম তাদের রব তার বদলে তাদেরকে যেন এমন একটি সন্তান দেন যে চরিত্রের দিক দিয়েও তার চেয়ে ভালো হবে এবং যার কাছ তেকে সদয় আচরণও বেশী আশা করা যাবে৷
এবার থাকে সেই দেয়ালের ব্যাপারটি৷ সেটি হচ্ছে এ শহরে অবস্থানকারী দুটি এতীম বালকের৷ এ দেয়ালের নীচে তাদের জন্য সম্পদ লুকানো আছে এবং তাদের পিতা ছিলেন একজন সৎলোক৷ তাই তোমার রব চাইলেন এ কিশোর দুটি প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যাক এবং তারা নিজেদের গুপ্তধন বের করে নিক৷ তোমার রবের দয়ার কারণে এটা করা হয়েছে৷ নিজ ক্ষমতা ও ইখতিয়ারে আমি এটা করিনি৷ তুমি যেসব ব্যাপারে সবর করতে পারোনি এ হচ্ছে তার ব্যাখ্যা৷
উপরের আয়াত ৬৯ - ৮২ থেকে দুটি ঘটনার বিশেষ তাত্পর্য যা কেবল খিজির (আ) অবগত ছিলেন - কিন্তু মুসা (আ) এর কাছে সে বিষয়ের ভবিষ্যত জ্ঞান না থাকার দরুণ এবং প্রচলিত রীতি অনুযায়ী স্বভাব-বিরুদ্ধ মনে হয়েছিল :
(গল্প ১)
"আর ঐ বালকটির (যাকে খিজির (আ) হত্যা করেছিলেন) ব্যাপার হচ্ছে এই যে, তার বাপ-মা ছিল মুমিন৷ আমাদের আশংকা হলো, এ বালক তার বিদ্রোহাত্মক আচরণ ও কুফরীর মাধ্যমে তাদেরকে বিব্রত করবে৷ তাই আমরা চাইলাম তাদের রব তার বদলে তাদেরকে যেন এমন একটি সন্তান দেন যে চরিত্রের দিক দিয়েও তার চেয়ে ভালো হবে এবং যার কাছ থেকে সদয় আচরণও বেশী আশা করা যাবে৷" (কাহাফ: ৮০, ৮১)
আবু বশীর (রা) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (স) "আমাদের আশংকা হলো" এ আয়াতাংশ সম্পর্কে বলেন:
"এর অর্থ তিনি (খিজির (আ)) আশংকা করলেন যে বালকটি বড় হয়ে তার পিতামাতাকে কুফরীর দিকে আহবান জানাবে এবং তার পিতামাতাও তাতে সায় দিবে (আল্লাহর অপছন্দনীয় পথে পা বাড়াবে) তাদের ছেলে সন্তানের প্রতি অত্যধিক ভালবাসার কারনে।"
উসমান (রা) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ (স) এ আয়াতাংশ "তাই আমরা চাইলাম তাদের রব তার বদলে তাদেরকে যেন এমন একটি সন্তান দেন যে চরিত্রের দিক দিয়েও তার চেয়ে ভালো হবে এবং যার কাছ তেকে সদয় আচরণও বেশী আশা করা যাবে" সম্পর্কে বলেন:
"ওই (ধর্মপ্রাণ) পিতামাতাকে আল্লাহতায়ালা এক মেয়ে দান করলেন যার ঔরশে একটি পুত্রসন্তান এসেছিল যিনি পরবর্তীতে নবী হয়েছিলেন।"
** ** ** **
(গল্প ২)
"এবার থাকে সেই দেয়ালের ব্যাপারটি (যা খিজির (আ) ঠিক করে দিয়েছিলেন)৷ সেটি হচ্ছে এ শহরে অবস্থানকারী দুটি এতীম বালকের৷ এ দেয়ালের নীচে তাদের জন্য সম্পদ লুকানো আছে এবং তাদের পিতা ছিলেন একজন সৎলোক৷ তাই তোমার রব চাইলেন এ কিশোর দুটি প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে যাক এবং তারা নিজেদের গুপ্তধন বের করে নিক৷।.. (কাহাফ: ৮২)
বায়্হাকির শুয়ায়ব আল-ইমান থেকে বর্ণিত, আলী ইবনে আবি তালিব (রা) ওই 'গুপ্তধন' সম্পর্কে বলেন,
এটি একটি স্বর্ণের ফলক ছিল যাতে লিপিবদ্ধ ছিল: (১) আল্লাহ ছাড়া আর কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (স) তার প্রেরিত রাসুল, (২) এটা বিস্ময়কর যে (ব্যক্তি) বিশ্বাস করে যে মৃত্যু এক অতিসত্য বিষয় - তারপর ও সে আনন্দে মগ্ন থাকে, (৩) এটা বিস্ময়কর যে বিশ্বাস করে যে জাহান্নাম এক অতিসত্য বিষয় - তারপর ও সে হাসিতে লিপ্ত হয়, (৪) এটা বিস্ময়কর যে বিশ্বাস করে যে ভাগ্য বা তাকদীর এক অতিসত্য বিষয় - তারপর ও সে হতাশাগ্রস্থ/দু:খিত হয়, (৫) এটা বিস্ময়কর - যে পৃথিবীর মানুষের অবস্থার উত্থান-পতন প্রত্যক্ষ করে, তারপরও সে (ব্যক্তি) দুনিয়ার জীবন নিয়ে অনেক আস্থাবান থাকে!
( সূত্র: 'আল মিজান - কুরআনের তাফসির" ভলিউম-২৬, আত-তাবাতাবাই )
উপরের গল্প থেকে প্রমাণিত যে, যদি প্রগ্গা (wisdom) না দেখা যায় (আপাত দৃষ্টিতে - পরিপূর্ণ জ্ঞান ব্যতিরেকে), তার অর্থ এ নয় যে, প্রগ্গা (wisdom) অনুপস্থিত।
(খ) কোরআন (২: ৩০): প্রভূ জানেন কিন্তু আমরা জানি না:
"আবার সেই সময়ের কথা একটু স্মরণ কর যখন তোমাদের রব ফেরেশতাদের বলেছিলেন , “আমি পৃথিবীতে একজন খলীফা- প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে চাই ৷” তারা বললো , “আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে নিযুক্ত করতে চান যে সেখানকার ব্যবস্থাপনাকে বিপর্যস্থ করবে এবং রক্তপাত করবে? আপনার প্রশংসা ও স্তুতিসহকারে তাসবীহ পাঠ এবং আপনার পবিত্রতা বর্ণনা তো আমরা করেই যাচ্ছি৷ আল্লাহ বললেন, “আমি জানি যা তোমরা জানো না ৷ ”
শিক্ষা ১) অর্থাৎ এ ধরনের সৃষ্টির (মানুষের) উপকারিতা অবশ্যই যা অপকার হবে তার থেকে বেশি হবে - যে বিষয়ে তোমাদের (ফেরেশতাদের) কোন জ্ঞান নেই।
[তাফসির ইবনে কাসীর]
শিক্ষা ২) অর্থাৎ আমি (আল্লাহ) তাদের মধ্য থেকে নবী-রাসুল বাছাই করে বার্তাবাহক হিসেবে পাঠাব। আমি তাদের মধ্য থেকে সত্যবাদী, শহীদ, সত্কর্মশীল বিশ্বাসী, বিনীত, ধার্মিক, জ্ঞানী পাঠাব যারা তাদের জ্ঞানকে প্রয়োগ করবে ব্যবহারিক জীবনে, মানূষের কাছে বিনয়ী হবে এবং তাদের কাছেও যারা প্রভুকে ভালবাসে; তাদের রাসুলদের অনুসরণ করবে।
[তাফসির ইবনে কাসীর]
২.১.২) সুগভীর প্রজ্ঞাময় উদ্দেশ্য:
"যে জিনিসই তিনি সৃষ্টি করেছেন উত্তম রূপে সৃষ্টি করেছেন.." (৩২:৭)
ইবনে তাইমিয়া বলেন, " প্রভু সৃষ্টি করেছেন 'ভাল' এবং 'খারাপ' এ উদ্দেশ্যে যে তার পেছনে গভীর প্রগ্গা জড়িত - প্রকৃতিগতভাবেই তার সকল কাজ উত্তম এবং নিখুত। স্রষ্টা দূ:খ, জ্বরা, ব্যথা, দুর্গন্ধ, কুত্সিত আকার এবং বিষাক্ত শরীর যেমন সাপ, মানুষের বর্জ পদার্থ ইত্যাদি এ উদ্দেশ্যে যে তার পেছনে গভীর উদ্দেশ্য বিদ্যমান।
[Minhaj As-Sunnah 3:142/2:25]
২.১.৩) স্রষ্টা নিখাদ খারাপি সৃষ্টি করেন না:
"স্রষ্টা নিখাদ কারাপি তৈরী করেন না। পরন্তু, প্রতি জিনিস বা বিষয় তিনি যা তৈরী করেন উত্তম উপায়েই তৈরি করেন এবং তার পেছনে একটি প্রগ্গা থাকে (যার উদ্দেশ্য)। যদিও কোন কোন ক্ষেত্রে খারাপি থাকতে পারে কোন কোন মানুষের জন্য, কিন্তু তা অবশ্যই আংশিক (পুর্নাংগ নয়) এবং তা আপেক্ষিক ভাবেই খারাপ। পুর্নাংগ খারাপ বা পরম (absolute) খারাপ যদি চিন্তা করা হয়, স্রষ্টা তা থেকে পুরোপুরি মুক্ত।
[Ibn Taymiyya. Hasana, MF 14:266]
২.২) মন্দকে বাধা দেয়ার কোন পর্যাপ্ত কারন প্রভুর নেই — এটা কি আদৌ সত্যি?
স্রষ্টা কর্তৃক (আমাদের জীবনে আগত) দুঃখ-দুরদশা, খারাপিকে (তিনি) বাধা না দেয়ার ক্ষেত্রে তিনি আমাদের ভাল কোন যুক্তি দেখান কি না? আমরা ৬ টি পয়েন্ট এ দেখাব বা প্রমান করব যে, তিনি স্বয়ং (আমাদের জীবনে আগত) দুঃখ-দুরদশা, খারাপিকে (তিনি) বাধা না দেয়ার ক্ষেত্রে কি প্রগ্গা (wisdom) স্বত: প্রজ্জ্বলিত করে রেখেছেন আবহমানকাল ধরে।
২.২.১) জীবনটা একটি পরিক্ষা মাত্র:
"অতি মহান ও শ্রেষ্ঠ তিনি যাঁর হাতে রয়েছে সমগ্র বিশ্ব-জাহানের কর্তৃত্ব ৷ তিনি সবকিছুর ওপর ক্ষমতা রাখেন৷ কাজের দিক দিয়ে তোমাদের মধ্যে কে উত্তম তা পরীক্ষা করে দেখার জন্য৷ তিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন৷ " (৬৭:১-২)
অতএব, পরীক্ষার অংশ হিসেবে দু:খ-দুর্দশা থাকা স্বাভাবিক!
২.২.২) আমাদের জীবনের উদ্দেশ্য:
"জিন ও মানুষকে আমি শুধু এ জন্যই সৃষ্টি করেছি যে, তারা আমার দাসত্ব করবে" (৫১-৫৬)
২.২.৩) স্রষ্টাকে জানা: স্রষ্টার একটি নাম 'আল-ওয়ালী (রক্ষাকারী); অতএব, দু:খ-দুর্দশা বিদ্যমান থাকা স্বাভাবিক।
২.২.৪) উন্নতমানের ভালত্ব অর্জন:
সাধারন মানের (প্রথম অর্ডার) ভাল হল শারীরিক আনন্দ এবং সুখ। একইভাবে, প্রথম অর্ডার খারাপি (evil) হল দৈহিক ব্যথা এবং দু:খ। দ্বিতীয় অর্ডার ভালত্ব হল সাহসিকতা (যেমন)। সাহসিকতা একমাত্র তখন ই অর্জিত হতে পারে যখন দু:খ-কস্ট পৃথিবীতে বিদ্যমান থাকবে। তাছাড়া 'সাহসিকতার' তাত্পর্য ই বা কি?
২.২.৫) স্বাধীন ইচ্ছা: স্রষ্টা আমাদের স্বাধীন ইচ্ছা দিয়েছেন। স্বাধীন ইচ্ছার মাঝে অবশ্যই খারাপ কাজ থেকে বাছাই করার প্রক্রিয়াও বুঝায়। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি ব্যতীত 'ভাল' এবং 'খারাপ' উভয় ই অর্থহীন। অতএব, এ স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি 'দু:খ-কস্ট থাকার যুক্তি দেখায়।
২.২.৬) ভবিষ্যত পাপ বা গুনাহ: মানুষ তার অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের পাপ বা গুনাহের কারনে কস্ট পেতে পারেন। কারন, স্রষ্টার কাছে সকল সময় ও কালের জ্ঞান রয়েছে।
২.৩) মন্দ ই হল প্রভুর উদ্দেশ্য। — এটা কি আদৌ সত্যি?
২.৩.১) হৃদয় পরিশুদ্ধ করা:
"এটি এ জন্য ছিল যে, তোমাদের বুকের মধ্যে যা কিছু গোপন রয়েছে আল্লাহ তা পরীক্ষা করে নেবেন এবং তোমাদের মনের মধ্যে যে গলদ রয়েছে তা দূর করে দেবেন ৷ আল্লাহ মনের অবস্থা খুব ভালো করেই জানেন৷" (৩:১৫৪)
২.৩.২) মুক্তি এবং জান্নাত অর্জন:
"প্রকৃত কথা এই যে, সংকীর্ণতার সাথে প্রশস্ততাও রয়েছে৷
আসলে সংকীর্ণতার সাথে আছে প্রশস্ততাও।" (৯৪: ৫-৬)
রাসুলুল্লাহ (স) বলেন,
"যে-ই প্লেগে মৃত্যুবরন করে, সে-ই শহীদ।
যে-ই পেটের পীড়ায় মৃত্যুবরন করে, সে-ই শহীদ।
যে-ই পানিতে ডুবে (যেমন- সুনামি) মৃত্যুবরন করে, সে-ই শহীদ।"
(সহীহ মুসলিম)
২.৩.৩) সব কিছুই ভাল কেবল:
"মুমিনদের বিষয়টাই আশ্চর্য জনক; তার প্রতিটি কার্জ্কলাপই উত্তম। এর কোন ব্যতিক্রম নাই। যদি কোন উত্তম/সুখের ঘটনা ঘটে, সে তার (স্রষ্টার) প্রতি সন্তুস্ট থাকে এবং এটা তার জন্য ভাল। যদি কোন দু:খজনক ঘটনা ঘটে, সে ধৈর্য ধারণ করে এবং এটাও তার জন্য ভাল।"
(সহীহ মুসলিম)
২.৩.৪) গুণাহ থেকে পরিত্রান:
"কোন বিপদই মুসলিমের উপর পতিত হয়না যার মাধ্যমে প্রভূ মুমিনের কোন গুণাহ (ওই বিপদ দেয়ার মাধ্যমে) মোচন না করেন। এমনকি একটি কাটা বিদ্ধ হওয়ার ব্যথাও।"
(বুখারী)
২.৩.৫) জান্নাতে অনুপ্রবেশের শর্ত - কষ্ট-ক্লেশ ও বিপদ-মুসিবতের পরীক্ষা :
আল্লাহতায়ালা বলেন,
"তোমরা কি মনে করেছো, এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে? অথচ তোমাদের আগে যারা ঈমান এনেছিল তাদের ওপর যা কিছু নেমে এসেছিল এখনও তোমাদের ওপর সেসব নেমে আসেনি ৷ তাদের ওপর নেমে এসেছিল কষ্ট-ক্লেশ ও বিপদ-মুসিবত, তাদেরকে প্রকম্পিত করা হয়েছিল ৷ এমনকি সমকালীন রসূল এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা চীৎকার করে বলে উঠেছিল, অবশ্যিই আল্লাহর সাহায্য নিকটেই ৷" (২:২১৪)
২.৩.৬) ভাল এবং খারাপ সমার্থক নয়:
আল্লাহতায়ালা বলেন,
"হে নবী ! এদেরকে বলে দাও, পবিত্র ও অপবিত্র সমান নয়, অপবিত্রের আধিক্য তোমাদের যতই চমৎকৃত করুক না কেন৷ কাজেই হে বুদ্ধিমানেরা! আল্লাহর নাফরমানী করা থেকে দূরে থাকো আশা করা যায়, তোমরা সফলকাম হবে৷" (৫:১০০)
২.৩.৭) প্রভুর প্রেরিত বাণীর সত্যায়ন:
ইবনে তাইমিয়া বলেন, "প্রত্যেক সময় একজন বান্দাহর জ্ঞান এবং বিশ্বাস (স্রষ্টার প্রতি) বৃদ্ধি পেলে, প্রভুর প্রগ্গা এবং দয়ার কোন না কোন উদাহরন তার সামনে উপস্থিত হয় - যা তার বুদ্ধিবৃত্তিকে যেন ঝলসিয়ে দেয়। এটি তার সম্মুখে এমন সত্যতা সহকারে উপনীত হয় যেভাবে স্বয়ং প্রভূ তার কলামে পাকে জানিয়েছেন: 'অচিরেই আমি এদেরকে সর্বত্র আমার নিদর্শনসমূহ দেখাবো এবং তাদের নিজেদের মধ্যেও ৷ যাতে এদের কাছে একথা পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এ কুরআন যথার্থ সত্য। ..' (৪১:৫৩)"
[Ibn Taymiyya. Irada, MF 8:97]
২.৩.৮) প্রভুর প্রজ্ঞাময় উদ্দেশ্য:
হেনরি লাউস্ট উল্লেখ করেন,
"প্রভু অবশ্যই দূরদর্শিতাসম্পন্ন। খারাপি (evil) এ পৃথিবীতে অবশ্যই প্রকৃত অস্তিত্ববিহীন। স্রষ্টা এ পৃথিবীতে যাই-ই ইচ্ছা করেন,তা একটি স্বাধীন ন্যয়বিচার এবং অসীম ভালোত্ব এর ফলাফলস্বরূপ। এ ফলাফল অবশ্যই ঘটনার সম্পূর্ন দৃশ্যপট (ভবিষ্যত ফলাফল যার অন্তর্গত) থেকেই বিচার করা সম্ভব। আংশিক ঘটনা কিংবা অসম্পূর্ণ জ্ঞানের আলোকে এ সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভব নয়।"
[Cited in Jon Hoover. Ibn Taymiyya’s Theodicy of Perpetual Optimism. Brill. 2007, p.4.]
২.৩.৯) খারাপি (Evil) কখনই স্রষ্টার কোন বৈশিস্ট নয়:
"একারণেই খারাপিকে স্রষ্টার কোন গুণের সাথে কোন অবস্থাতেই জড়ানো ভুল। যদিও প্রভূ বান্দাহের যেকোন কাজের স্রষ্টা - তার সৃস্ট বাধ্যতা বা ভাল কাজ একটি রহমত স্বরূপ, পক্ষান্তরে তার সৃস্ট খারাপ কাজের মাঝে একটি গভীর প্রগ্গা এবং দয়া-অনুগ্রহ বিদ্যমান।"
[Ibn Taymiyya, Hasana.]
২.৩.১০) খারাপি (Evil) কে কখনই স্রষ্টার কোন বৈশিস্ট- এর সাথে জড়ানো যাবে না:
ক) আল্লাহতায়ালা বলেন,
"তাদের পথ যাদের প্রতি তুমি অনুগ্রহ করেছ, যাদের ওপর গযব পড়েনি এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়নি ৷" (১: ৬-৭)
'যাদের ওপর গযব পড়েনি' - এ ক্রিয়া-বোধক বাক্যাংশ স্রষ্টার সাথে জড়িত নয়। কোরআন পাকে একটি ভাষাগত শালীনতা বিদ্যমান - যেখানে 'খারাপি' কে কখনই প্রভুর সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়নি।
খ) মুসা এবং খিজির (আ) এর গল্পে খিজির (আ) তার অনুমানকৃত ভুল গুলোকে নিজের সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছিলেন। পক্ষান্তরে, তার কাজের অন্তর্নিহিত প্রজ্ঞাকে স্রষ্টার সাথে সম্পর্কযুক্ত করেছিলেন।
বিষয়: বিবিধ
১৫৬৮ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জাজাকাল্লাহু খাইরান।
মন্তব্য করতে লগইন করুন