কিতাব ও প্রজ্ঞা (wisdom) শিক্ষার হাকীকত

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৯:০৪:০৪ সকাল

আল্লাহতায়ালা বলেন: "হে আমাদের রব! এদের মধ্যে স্বয়ং এদের জাতি পরিসর থেকে এমন একজন রসূল পাঠাও যিনি এদেরকে তোমার আয়াত ('আয়াহ') পাঠ করে শুনাবেন , এদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন এবং এদের জীবন পরিশুদ্ধ করে সুসজ্জিত করবেন ৷ অবশ্যি তুমি বড়ই প্রতিপত্তিশালী ও জ্ঞানবান ৷"

(বাকারা: ১২৯)

শাব্দিকভাবে, 'আয়াহ' অর্থ কোনকিছু প্রমানার্থে পেশকৃত যুক্তি। বিশ্বব্রম্মান্ডের সকল কিছুই এ অর্থে 'আয়াহ' বা 'চিহ্ন' বা 'যুক্তি' - সর্বশক্তিমান আল্লাহ তায়ালার মহত্ত্ব, প্রশংসা, গৌরব, দান, দয়া এবং সুবিচার প্রমানার্থে। নবী-রাসূলগণের মিরাকল বা অলৌকিক ঘটনাবলীও সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে উপস্থাপিত 'আয়াহ' বা 'চিহ্ন' স্বরূপ। এই শব্দটি কোরআন শরীফের প্রতিটি বাক্যকে উল্লেখ করতে মূলত বাবহৃত হয় - যেহেতু প্রতিটি বাক্য স্রস্টার স্বপক্ষে একটি পরিস্কার প্রমান এবং যুক্তি পেশ করে, মহান আল্লাহতায়ালার গুণকে উল্লেখ করে এবং তার আদেশ-নিষেধ, আইন, মূলনীতি, তার পছন্দ-অপছন্দকে বর্ননা করে।

ক) "যিনি এদেরকে তোমার আয়াত পাঠ করে শুনাবেন":

এ বাক্যাংশ মহান আল্লাহপাকের শক্তি ও শাসন-কতৃত্ব উল্লেখ করে যা তিনি তার রাসুলকে দিয়েছেন। একজন রাসূল (স) কেবল আসমানী গ্রন্থ কে তেলাওয়াত করবেন - লোকদের কাছে কেবল একজন সুমিস্ট ক্বারী বা তেলাওয়াতকারী হিসেবে উপস্থাপিত হবেন তা নয়! বরঞ্চ তিনি মহান আল্লাহপাকের দূত (অ্যাম্বাসেডর) হিসেবেই পৃথিবীবাসীর কাছে এসেছেন - সেই আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের যিনি বিশ্ব ব্রম্মান্ডের একচ্ছত্র অধিপতি, শক্তিধর ও সার্বভৌমত্বের অধিকারী, তারই আদেশ-নিষেধ উপস্থাপন করেছেন যুক্তি ও প্রমান সহকারে।

এছাড়াও, 'আয়াহ' শব্দের প্রয়োগ এটাই বুঝায় যে, আল্লাহ প্রদত্ত ধর্ম বলপ্রয়োগ এবং জোড়-জবরদস্তির উপর ভিত্তি করে রচিত নয়; বরং মনস্তাত্বিক যুক্তি ও পরিস্কার প্রমানের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত যার প্রতিটি অংশ যুক্তি ও সত্যের অকাট্য প্রমান পেশ করে।

আসমানী গ্রন্থ শিক্ষা দেয়া শুধুমাত্র তেলাওয়াত করার থেকে পুরোপুরি ভিন্ন অর্থ ধারণ করে।

এ আয়াতে 'তেলাওয়াত করা' দিয়ে বুঝায় যে, নবী (স) মানুষদের জানাচ্ছেন, তার (স) উপর আল্লাহ রাব্বুল আলামিন রেসালতের দায়িত্ব দিয়েছেন এবং আসমানী গ্রন্থ নাজিল করেছেন।

অন্যদিকে 'শিক্ষা দেয়া' বলতে নাজিলকৃত ঐশী বাণীকে মানুষের সামনে বিশ্লেষন ও বাখ্যা করা এবং এর শিক্ষা ও তাত্পর্যকে উপস্থাপন করাকে বুঝায়। এক্ষেত্রে যদি কোন প্রশ্ন থেকে থাকে, 'শিক্ষা দেয়া' বলতে ওই প্রশ্নগুলোর উপস্থাপন ও তার উত্তর পেশ করাও বুঝায়। এছাড়াও, 'আসমানী গ্রন্থের শিক্ষা দেয়া' বলতে একদল মানুষকে প্রশিক্ষিত করাকেও বুঝায় - যাদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে শিক্ষাদান, (তাদের ব্যবহারিক জীবনের) প্রশ্ন/সমস্যাবলী দেয়া, এর উত্তর অনুধাবন করার চেষ্টা জাগ্রত করানো, এ উদ্দেশেই কেবল যাতে তারা (শিক্ষানবীশরা) পূর্নাঙ্গভাবে আল্লাহ প্রদত্ত কিতাব চিন্তা করার, অনুধাবন করার এবং বিশ্লেষন করার যোগ্যতা অর্জন করেন।

উপরোক্ত সব কিছুই শিক্ষা দেয়া ও ট্রেনিং এর অপরিহার্য অংশ। যারাই রাসুলুল্লাহ (স) এর জীবনী অধ্যয়ন করেছেন তারাই অবগত হবেন যে, তিনি (স) তার সাহাবাদের শিক্ষা দিতে উপরোক্ত সব গুলো বিষয়ই প্রয়োগ করেছিলেন।

খ) 'হিকমাহ' বা প্রজ্ঞা (wisdom) শব্দের বিশ্লেষন:

হিকমাহ' (wisdom) বা প্রজ্ঞা শব্দের বিশ্লেষন করতে গিয়ে উস্তাদ ফারাহী তার মুফ্রাদাতুল কুরআনে উল্লেখ করেছেন:

"হিকমাহ' (wisdom) বা প্রজ্ঞা এমন একটি মৌলিক মানসিক শক্তি বা দক্ষতা যার মাধ্যমে একজন মানুষ সত্যানুসারে কার্যাবলী বিচার (judge) করতে পারেন। দাউদ (অ) সম্পর্কে পবিত্র কোরানে উল্লিখিত হয়েছে: 'তাকে দান করছিলাম হিকমত এবং যোগ্যতা দিয়েছিলাম ফায়সালা করার ক্ষমতা৷ (সাদ: ২০)'। 'ফায়সালা করার ক্ষমতা' এক্ষেত্রে হেকমাহ (wisdom) এর ফলস্বরূপ (ফলশ্রুতি)। যেহেতু, সত্যানুসারে কার্যাবলী বিচার (judge) করার মৌলিক মানসিক শক্তি বা দক্ষতা হল হেকমাহ (wisdom) এর ফলাফলস্বরূপ, এটি (হিকমাহ বা প্রজ্ঞা হল) নীতি-নৈতিকতার পরিশুদ্ধতার ও ফলশ্রুতি। এজন্যই আরবেরা 'হিকমাহ' শব্দটি ব্যক্তি বিশেষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করত তার বিচারিক ক্ষমতা পরিপক্কতা ও নীতিনৈতিকতার উচ্চ শালীন অবস্থা বুঝানোর জন্য। এজন্যই একজন জ্ঞানী এবং ভদ্র ব্যক্তিকে প্রজ্ঞাবান বলা হয় যার মাধ্যমে বুঝায় যে তার অন্তর ও মানসিকতা প্রজ্ঞাসম্পন্ন।

'কিতাব বা বই' এর সাথে 'প্রজ্ঞা' ব্যবহার পরিস্কারভাবে বুঝায় যে, প্রজ্ঞার শিক্ষা দেয়া কিতাব শিক্ষার থেকে আর ও ব্যপক কিছু - এমনকি প্রজ্ঞা যদি উক্ত 'বই' এর উপর ভিত্তি করেও বুঝায়। অতএব, প্রজ্ঞা বলতে এ আয়াতে হাদিস বা রাসুলুল্লাহ (স) এর সুন্নাহকে বুঝানোর যুক্তি অনেক বেশি প্রনিধানযোগ্য। 'প্রজ্ঞা' বলতে জ্ঞানগর্ভ কথা এবং একই সাথে জ্ঞান্গর্ভ কথা বলার দক্ষতাকেও বুঝায়। 'প্রজ্ঞা শিক্ষা দান' বলতে লোকদেরকে জ্ঞানগর্ভ তথ্য জানানো এবং তাদের মনের মাঝে প্রজ্ঞার বৈশিস্ট জাগ্রত ও তৈরী করানোর প্রচেষ্টাকেই বুঝায়।

সূত্র/অনুবাদ: Pondering Over The Quraan, Vol 1, Amin Ahsan Islahi, পঃ ৩৫৪-৫

বিষয়: বিবিধ

১১২৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File