পৃথিবী (৪)ঃ লক্ষ্য

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৬:২৭:৩৭ সন্ধ্যা

বৃষ্টির রাতে শফিকের এই ভাবনা জাগে।

কফি হাতে বারান্দায় পায়চারী করে সে ভাবছে:

আমার জীবনের লক্ষ্য কি?

জ্ঞান অর্জন ও ইসলামের জন্য প্রকৃত কাজের জন্য প্রতিজ্ঞা করা ও সচেষ্ট হওয়া

নাকি পৃথিবী (সম্পদ আর ক্ষমতা) অর্জন করা?

"কেয়ামতের পূর্বে অনেক আলামতের একটি হল জ্ঞান তুলে নেয়া হবে, অজ্ঞতা ছড়িয়ে পড়বে ... " (ইবনে মাজাহ)

কেয়ামতের আরেক আলামত যা এই উম্মতের মাঝে ছড়িয়ে পড়বে তা হল

" ... আল্লাহ মুসলমানদের হৃদয়-মাঝে 'ওয়াহান' প্রবেশ করাবেন। সাহাবারা বললেন, 'ওয়াহান' কি? রাসুলুল্লাহ (স) বললেন, "এই পৃথিবীর (চাকচিক্যের) প্রতি প্রবল ভালবাসা এবঙ মৃত্যুকে ভয় করা।" (আহমাদ, আবু দাউদ)

দুনিয়ার (সম্পদ, ক্ষমতা, প্রতিপত্তি, ইত্যাদি) প্রতি প্রবল ভালবাসা সকল শ্রেণীর মুসলমানদের এমনকি অগণিত ইসলামী নেতৃবৃন্দ, ইসলামী সংগঠনের মানুষের মাঝে ঢুকে পড়েছে!

আল্লাহ তায়ালা বলেন:

" মানুষের জন্য নারী, সন্তান, সোনারুপার স্তূপ, সেরা ঘোড়া, গবাদী পশু ও কৃষি ক্ষেতের প্রতি আসক্তিকে বড়ই সুসজ্জিত ও সুশোভিত করা হয়েছে৷ কিন্তু এগুলো দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনের সামগ্রী মাত্র৷ প্রকৃতপক্ষে উত্তম আবাস তো রয়েছে আল্লাহর কাছে৷ " (ইমরান: ১৪)

এবং আল্লাহতায়ালা আরও বলেন:

"... এ দুনিয়ার জীবন যেন তোমাদের প্রতারিত না করে এবং প্রতারক যেন তোমাকে আল্লাহর ব্যাপারে প্রতারিত করতে সক্ষম না হয়৷" (লুকমান: ৩৩)

কেয়ামতের আরেক আলামত হলঃ "জ্ঞান অর্জন করবে শুধুমাত্র পার্থিব স্বার্থে; আল্লাহর (পথে কাজের) উদ্দেশে নয়" (তিরমিজি)

আমি কি করছি?

আমি কোন জিনিষকে প্রায়োরিটি দিচ্ছি?

আমি চাকুরী করছি - এর পেছনে পারলৌকিক কোন উদ্দেশ্য আছে কি?

আমি কি এমন কোন চাকুরি করছি যাতে পারলৌকিক কোন লাভের উপায় নাই? পারলৌকিক লাভ সাধনের জন্য নিজ যোগ্যতা বৃদ্ধিতে তা মোটেও সহায়ক নয়?

চাকুরী যেখানে জীবনের আচরণ পরিবর্তনে ব্যপক ভুমিকা রাখে - সেই পরিবর্তিত আচরণ কি আমার পারলৌকিক উত্কর্ষতার পক্ষে নাকি বিপক্ষে? তা আদৌ চিন্তা করেছি কিনা কখনও ? নাকি টাকার সন্ধানে পরকালকে এক্ষেত্রে লক্ষ্যই করিনি?

কিছু টাকার জন্য এমন কাজ করছি যাতে ইসলামের পড়াশোনার সুযোগ কম থাকে - ইসলামী কাজের সুযোগ কমে যায় - আচরণে কাঠিন্য আসে - কোমল আচরণ দূর হয়ে যায় - অহংকার তৈরী হয় - অথচ মানুষ, নিজের ইসলামের লেবাসী আপনজন টাকার গন্ধে হুজুর হুজুর করা শুরু করে দেয় - তাতে ইসলামের কি উপকারটা হয়? সে শ্রম, যোগ্যতা কি কোন কাজে আসে?

অথচ সে লোক যদি সে কাজ পরিত্য্গে সংকল্প নেয়- তাতে সমাজ আজব বনে যায়! দূর দূর করা শুরু করে দেয়!

লোকেরা ভুলে যায় রিজিক যে পূর্ব নির্ধারিত - এমন লোকের দায়িত্ব স্রষ্টা ই নিজে নিয়ে নেন!

"যে ব্যক্তিই আল্লাহকে ভয় করে চলবে আল্লাহ তার জন্য কঠিন অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সৃষ্টি করে দেবেন এবং এমন পন্থায় তাকে রিযিক দেবেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না৷ যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট৷ আল্লাহ তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করে থাকেন৷ আল্লাহ প্রতিটি জিনিসের জন্য একটা মাত্রা ঠিক করে রেখেছেন৷" (সুরা আত-তালাক)

**

আমার জীবনের লক্ষ্য কি?

বিরাট কিছু হওয়া?

হয়ে কি হবে?

রিসার্চ হবে?

আমি যা করব তাতে কার উপকার হবে?

সে রিসার্চের ফলাফল কে পাবে? কি শক্তিশালী হবে?

কে শক্তিশালী হয়ে মুসলমানদের কচুকাটা করবে? কচুকাটা করে এসেছে সব সময়?

টাকা হবে!

টাকা হয়ে কি হবে?

ইসলামের কি লাভ হবে?

যে এখন ও খরচ করার সাহস রাখে না - সে অনেক টাকা হলে কিভাবে খরচ করার সাহস রাখবে? জগতে এমন কখন ও কি হয়েছে?

যদি নাই হল, তবে আমার কি হবে? যখন চোখ বন্ধ করব তখন?

"আমি তোমাদের যে রিযিক দিয়েছি তোমাদের কারো মৃত্যুর সময় আসার পূর্বেই তা থেকে খরচ করো৷ সে সময় সে বলবে : হে আমার রব, তুমি আমাকে আরো কিছুটা অবকাশ দিলে না কেন ? তাহলে আমি দান করতাম এবং নেককার লোকদের মধ্যে শামিল হয়ে যেতাম৷ অথচ যখন কারো কাজের অবকাশ পূর্ণ হয়ে যাওয়ার সময় এসে যায় তখন আল্লাহ তাকে আর কোন অবকাশ মোটেই দেন না৷" (সুরা মুনাফিকুন)

**

আমার জীবনের লক্ষ্য কি?

মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকা?

এটা কেমন লক্ষ্য?

এ লক্ষ্যের জীবিকা কেমন?

"সেই ব্যক্তির কথার চেয়ে আর কার কথা উত্তম হবে যে আল্লাহর দিকে ডাকলো, সৎ কাজ করলো এবং ঘোষণা করলো আমি মুসলমান ৷" (হা-মিম-আস সাজদাহ)

আমার চারপাশে অনেক ইসলামী সংগঠন একই রকম কাজ করে।

নিজে উদ্যোগী হয়েছি কিনা? নাকি passive হয়ে থেকেছি চিরকাল? অন্যে প্রোগ্রামের আয়োজন করল আর আমি তাতে বসে পড়লাম! এতটুকুই!

আমি কি আমার ২/৩ জন বন্ধু কে নিয়ে কখন ও ইসলামিক প্রোগ্রাম করেছি? নিজ উদ্যোগে? ইনফরমালি? গল্প করতে করতে? অথবা দাওয়াত দিয়ে?

আচ্ছা এমন করলে আসলেই কেমন হয় - অনেক গুলো প্রোগ্রামের জায়গা হয়ে যায়। Decentralized সিস্টেম। লুসলি কাপল্ড Decentralized সিস্টেম। adhoc নেটওয়ার্ক এর মত।

continuously growing - কোনটা ভেঙ্গে গেলে - সমস্যা নাই। এতে প্রচুর মানুষ কি ইসলামের কথা শুনতে পারবে না?

আমার এমন কোন লক্ষ্য আছে কি?

কমপক্ষে centralized সিস্টেম ধরনের ও কোন লক্ষ্য আছে কি?

আদৌ কোন লক্ষ্য আছে কি?

আমার কোন ইসলাম প্রিয় ভাইয়ের এমন কোন লক্ষ্য আছে কি?

সে লক্ষ্য দেখলে কি আমি হিংসা করি কি?

যদি হিংসা করি - তাহলে যে কিছু ই করল না আমি কি তার থেকে ও খারাপ হলাম না?

আমার কি করা উচিত?

সে ভাই এমন কোন লক্ষ্যে ঝাপিয়ে পড়ে, আমার কি তাকে বাহবা দেয়া উচিত না? তার প্রতি মন থেকে শ্রদ্ধা আসা উচিত না?

**

আমার লক্ষ্য কি হওয়া উচিত?

আমৃত্যু মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শিতা দেখানো? গায়িকার গানের পর যেভাবে তার উপর টাকা ছিটানো হয় - সেভাবে সমাজ আমার মুখস্থ বিদ্যার পারদর্শিতায় আমার উপর টাকা ছিটাবে?

নাকি সমাজের সমস্যাকে প্রাপ্ত সীমিত উপকরণ দিয়ে এক সুন্দর সমাধান দেয়ার পারদর্শিতা অর্জন? এটা কি লক্ষ্য হওয়া উচিত না?

"বইয়ের লেখা তাই সত্য

প্রশ্নে হই বিরক্ত

মুখস্থ যে লিখতে পার

সমাজ হবে তার ভক্ত"

আমি সমাজের পেছনে ছুটব নাকি সমাজ আমার পেছনে ছুটবে কেবল? বিধস্ত সমাজের কোন মূল্যমান ই কি আমার কাছে থাকবে না?

আমি কি এখন সে রকমই? সে রকম ই যদি আমার মানসিকতা হয় - তবে এতে কার কখন কবে কোথায় উপকার হয়েছে?

** ** ** **

সে এগুচ্ছে। ঠিক সাতটায় সময় দেয়া। টানেল দিয়ে মাসুদ এগুচ্ছে। দুই দিন ধরে না খাওয়া। গতরাত বৃষ্টির মত ইস্রাইলি বিমান বোমা ফেলেছিল। এখন শব্দ অনেক কমে এসেছে। পনের বিশ মিনিট পর পর শব্দ আসছে। অনেক দুরে। ৯৩ক পয়েন্টে পৌছে ডান দিকে মোড় নিয়ে দশ মিনিট এগুলে ই বের হওয়া যাবে।

দুটির একটি ঘটনা ঘটতে পারে। ইসরাইলি সৈন্যরা ঘিরে থাকবে বা পেছনে থাকবে। আর ভাগ্য ভাল হলে আমি পেছন দিক থেকে আক্রমন করতে পারব।

এগুচ্ছি। ৯৩ক পয়েন্টের আগে ই আমি জ্যাকেটটা পাব।

**

একি তুমি এখানে?

মাসুদের সামনে তার প্রিয়তমা স্ত্রী চলছে।

'তুমি কেমন আছ? বাচ্চারা কেমন আছে?'

"তোমার অনেক কস্ট হচ্ছে তাই না?"

মাসুদ তার স্ত্রীর মায়া-জড়ানো কন্ঠে চমকে উঠল।

অনেক আগে তার মা ও কি তাকে এমনটি বলেছিল?

মা তখন শুয়ে ছিলেন। ব্যথায় কাতর। একেবারে শেষের দিন। অনেক কষ্টে মা বলেছিলেন, " বাবা, তোমার অনেক কস্ট হচ্ছে তাই না?"

আমার কস্ট হবে কেন, মা! কস্ট তো হচ্ছে তোমার। সব ঠিক হয়ে যাবে।

আল্লাহ সব ঠিক করে দিবেন।

মা বলেছিলেন, " আমি আল্লাহর কাছে তোমাকে সপে দিয়েছি; আমার তো কোন চিন্তা নাই। মা কি তখন কষ্টে হেসেছিলেন?"

তখন ই সূর্য ডুবে গিয়েছিল। চারিদিক অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। জীবনটাও।

"এই নাও জ্যাকেট।" আমার প্রিয়তমা স্ত্রী ৯৩ ক পয়েন্ট থেকে জ্যাকেট তো আমাকে পরিয়ে দিল।

তুমি এখানে থাকবে। আমি বললাম। খবরদার এগুবে না।

আমি এগুলাম।

সামনে আলো দেখা যাচ্ছে।

ধোয়া মেশানো আলো।

পেছন ঘুরে দেখি - অন্ধকার। ওকে দেখিনা আর। না দেখলেই ভাল। আমি ওকে কস্ট দিতে পারব না।

রাইফেলটা শক্ত করে ধরলাম।

লক্ষ্য কি?

আমার লক্ষ্য কি?

আমার জীবনের লক্ষ্য কি?

এই মুহুর্ত ই কি আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় লক্ষ্য ছিল?

টানেল থেকে বের হলাম।

চারিদিকে কি লাশ আর লাশ দেখছি?

শিশুর লাশ! মহিলার লাশ? বৃদ্ধের লাশ?

বিচ্ছিন্ন দেহ!

দেখি - ছুড়ি দিয়ে এক বিকৃত সৈন্য একজন শহীদের লাশ বিকৃত করছে!

আমি ওই পশুর দিকে এগুচ্ছি!

গুলির শব্দ -- আমার পিঠে কি গেথে যাচ্ছে? আমি অব্যর্থ ট্রিগার চাপ দিলাম - বিকৃত নরপশু ও লুটিয়ে পড়ল।

অন্যান্য পশুরা ঘিরে ফেলেছে আমায়।

আমার জ্যাকেট -এ লুকানো শক্তিশালী বোমা। ওরা আর ও কাছে চলে এল। ট্রিগারে চাপ দিলাম।

**

"এই আমার হাত ধর!"

এত মোলায়েম সেই হাত। আহ!

অসম্ভব সুন্দরী আমার স্ত্রীর বিজয়ী হাসি।

অনন্তকাল সে হাসি দেখলে ও আমার ইচ্ছে ফুরাবে না!

বিষয়: বিবিধ

১১৫০ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

263040
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৪৮
মামুন লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ।
তবে আমার লক্ষ্য নির্ধারনের সময়সীমা মনে হয় পার হয়ে গেছে। এখন মনে হয় অনেক দেরী করে ফেলেছি.. আমি কি পারব নিজের মত না করে আল্লাহ পাকের ইচ্ছানুযায়ী নিজেকে গড়ে তুলতে?
আসলে যথাসময়ে নিজেকে গড়তে না পারলে, পরিণত বয়সে সম্ভব হয় না। আর সেই যথাসময়টি তো ছিল এক অসম প্রতিযোগিতায় ভরপুর.. ভালো ভাবে 'মুখস্ত বিদ্যা দ্বারা' যেনতেন ভাবে একটি 'ক্লাশ' পাওয়া.. বি সি এস দিয়ে লোভনীয় জবে ঢুকে যাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন যদি আপনার মত এই লেখাটি পড়তাম! কিন্তু সেই সময়ে হয়তো এখনকার মত প্রগলভ হতাম না।
ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর লেখাটির জন্য। অনেক ভালো লাগলো।
জাজাকাল্লাহু খাইর। Rose Good Luck
263041
০৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৫০
সুশীল লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
263097
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ রাত ১২:০০
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
263133
০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৪ সকাল ০৫:১৫
কাহাফ লিখেছেন : জীবনের উদ্দেশ্য সঠিক ভাবে উপলব্ধি করতে না পারাই বর্তমান অস্হিরতার মূল কারণ। মুসলিম সমাজ এলো-মেলো ভাবে ছুটছে। অনেক সুন্দর একটি লেখা-আত্মোপলব্ধিতে ভূমিকা রাখবে। জাযাকাল্লাহু খাইরান ভাই........

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File