পৃথিবী (২): আগন্তুক

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ১৫ আগস্ট, ২০১৪, ১০:২১:০৮ রাত

পৃথিবীর আগন্তুক কে? সে কেমন? আমি কি পৃথিবীর আগন্তুক?

শফিক ভাবছে এই নতুন দেশে। স্বদেশ ছেড়ে বহুদূরে পড়তে এসেছে সে। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। ঝির ঝির বৃষ্টি। তার বড় প্রিয় সময়। সে পড়ছে ইবন রজব আল- হানবালী রচিত ‘দা কম্পেন্দিয়াম অফ নলেজ এন্ড উইসডম’ বইয়ের একটি চ্যাপ্টার - ‘পৃথিবীতে এমনভাবে থাকবে যেন তুমি একজন আগন্তুক’।

**

ইবণে উমর (রা) বলেন, “রাসুলুল্লাহ (স) আমার কাঁধ ধরে বলেছিলেন “পৃথিবীতে এমনভাবে থাকবে যেন তুমি একজন আগন্তুক অথবা একটি পথ পাড়ি দেয়া একজনের ন্যায়”। ইবনে উমর (রা) বলতেন, “যখন তুমি সন্ধ্যায় উপনীত হবে, সকালের জন্য অপেক্ষা করবে না; আবার যখন সকালে উপনীত হবে সন্ধ্যার জন্য অপেক্ষা করবে না। ভাল স্বাস্থ্য- এর সুযোগ গ্রহণ কর অসুস্থতার সময় (কাটানোর জন্য) ; জীবণের সুযোগ গ্রহণ কর মৃত্যুর (পাথেয় হিসেবে)।

(বুখারীঃ ৬৪১৬)

সকল নবী-রাসুল এবং তাদের সঙ্গী-সাথীদের উপরোক্ত বিষয়ে একমত ছিল। ফেরাউনের মধ্যকার এক ব্যক্তির কথা পবিত্র কোরআনে এভাবেই বর্ণিত হয়েছেঃ

“হে কওম, দুনিয়ার এ জীবন তো কয়েক দিনের জন্য৷ একমাত্র আখেরাতই চিরদিনের অবস্থানস্থল৷” (মুমিনঃ ৩৯)

শেষ নবী রাসুলুল্লাহ (স) বলেন, “এই দুনিয়া দিয়ে আমি কি করব? (এ হাদিসে আরবি “মা লি ওয়া লিদ দুনিয়া” এর অর্থ আমার এ দুনিয়া নিয়ে কোন প্রাপ্তি নেই, দুনিয়ার ও আমাকে নিয়ে কোন প্রাপ্তি নেই) আমার সাথে দুনিয়ার তুলনা হল সেই অভিযাত্রীর মত যে একটি গাছের নীচে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল এবং তারপর আবার পথ চলা শুরু করল।” (আহমেদ ১ঃ৩৯১), তিরমিজিঃ ২৩৭৭)

ঈসা (আ) তার একজন সাথীকে বলেছিলেন, “(এ দুনিয়া) অতিক্রম কর, কিন্তু এতে বসবাস কর না।” তিনি (আ) বলতেন, “কে আছো এমন যে সমুদ্র-তরঙ্গের উপরে বাড়ি নির্মাণ করবে? এটাই হল এই পৃথিবী। অতএব এ (পৃথিবী) কে স্থায়ী বসবাসের জায়গা হিসেবে গ্রহণ করোনা।” (আহমাদ (রহ) ‘আজ-জুহদ’ (৯৩) এ উল্লেখ করেছেন)

আলী ইবনে আবি তালিব (রা) বলতেন, “পৃথিবী আমাদের থেকে দুরে চলে যাচ্ছে, আর আখেরাত আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। প্রত্যেকের ই সন্তান সন্ততি রয়েছে। অতএব আখেরাতের সন্তান হও। পৃথিবীর সন্তান হয়োনা। কারন আজ তোমার ‘কর্ম’ রয়েছে কিন্তু ‘হিসেব’ (জবাবদিহিতা) নেই। কিন্তু আগামীকাল তোমার ‘হিসেব’ নেয়া হবে কিন্তু কর্মের সুযোগ থাকবে না।”

উমর ইবনে আব্দুল আজিজ (রা) তার খুতবায় বলেছিলেন, “এ পৃথিবী তোমার স্থায়ী বসবাসের কোন জায়গা নয়। আল্লাহতায়ালা এর ধ্বংসের ফয়সালা করে ফেলেছেন এবং এর মানুষদের চলে যাওয়ারও ফয়সালা করে ফেলেছেন। (দুনিয়ার) কত শক্তিধর অধিবাসী কত দ্রুতই না নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, কত হিংসা-যোগ্য (সম্পদশালী) অধিবাসী কত দ্রুত ই না পৃথিবী ছেয়ে চলে যায়। অতএব বিদায়-যাত্রাকে উত্তম কর - আল্লাহ তোমাদের উপর দয়া বর্ষণ করুন - সেই উত্তম পাথেয়তে যা তুমি সেই যাত্রায় নিয়েছো। আর সে যাত্রায় সবচেয়ে উত্তম পাথেয় হল ‘তাকওয়া (আল্লাহ-ভীতি)’।

এ পৃথিবী যেহেতু বাসস্থানই নয় বা মুমিনের বাসস্থল নয়, মুমিনের অবস্থা নিচের দুটির একটি হবে। হয় সে বাহিরের কোন দেশে (অস্থায়ী ভাবে) থাকার মত থাকবে যার উদ্দেশ্য হবে পাথেয় সংগ্রহ করে স্থায়ী আবাসস্থলে (পরকালে) ফিরে যাওয়া। অথবা সে একজন সদা গতিশীল অভিযাত্রীর মত ই জীবন ধারণ করবে। দিন-রাত। ঘুরে ফিরবে যেখানে সে থাকবে। এভাবেই মহানবী (স) ইবনে উমর (রা) কে বুঝাচ্ছিলেন এ পৃথিবীতে এ দুয়ের যেকোনো এক অবস্থায় বসবাসের জন্য।

প্রথমত মুমিন এ ব্যাপারে দৃঢ় চিত্ত হবে যে, এ পৃথিবীতে সে একজন অপরিচিত বা আগন্তুক। যিনি নিজকে অন্য অপরিচিত দেশে থাকার মত অস্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে ভাববে। তার অন্তরে সেই অপরিচিত দেশের প্রতি কোন মায়া থাকবে না। বরং তার অন্তর পড়ে থাকবে তার স্থায়ী আবাসস্থল জান্নাতের প্রতি। যেখানে সে ফিরে যাবে। কারো যদি এমন মানসিকতাই থাকে তবে সে অন্য কোন বাসনাতেই মগ্ন হবেনা - বরং কিভাবে স্থায়ী আবাস পরকালের পাথেয় সংগ্রহে নিজকে ব্যতিব্যস্ত রাখা যায় সে চিন্তাতেই ব্যস্ত থাকবে। অতএব সে কখন ই পৃথিবীর মানুষের সাথে নশ্বর প্রাচুর্য নিয়ে প্রতিযোগিতা করবে না। তাতে (নশ্বর প্রাচুর্য) মুগ্ধ হবে না। কারণ সে নিজকে আগন্তুক হিসেবেই ধরে নিবে - শক্তি, প্রাচুর্য কিছু ই তার মনকে কাড়বে না। সে অধৈর্য হবে না - বরং (সে পরিস্থিতিতে) সবচেয়ে বিনম্রই থাকবে সবার মাঝে সবচেয়ে বেশি।

দ্বিতীয়ত মুমিন নিজকে সদা তৎপর সত্যের অভিযাত্রী হিসেবেই ভাববে। সে ভুলে ও নিজকে পৃথিবীর স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে মনে করবে না। সে যাত্রা করতে ই থাকবে - যতক্ষণ না সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। যে এমন অবস্থা সব সময় কামনা করবে সে অবশ্যই তার স্থায়ী আবাসস্থল (পরকালের) পাথেয় সংগ্রহে সর্বোচ্চ প্রয়াস চালাবে। যত বেশি উত্তম কাজ করে যাওয়া যায় সে চিন্তাতেই সদা নিমগ্ন থাকবে। সে কখনই পৃথিবীর সম্পদ বৃদ্ধিতে নিমগ্ন হবেনা। এজন্যই রাসুলুল্লাহ (স) তার সাহাবাদের পৃথিবীর অভিযাত্রায় (পরকালের) উপকরণ বা পাথেয় সংগ্রহেই কেবল উপদেশ দিয়েছিলেন।

ইবনুল কায়্যিম (রহ) বলেছিলেন, “জান্নাতের বাগানের বাসনায় অগ্রবর্তী হও। কারণ এটিই তোমাদের প্রথম বাসস্থল এবং এটিই হবে অনন্তকালের আবাসস্থল।

কিন্তু আমরা (ইসলামের) শত্রু কর্তৃক বন্দীর ন্যায়ই। তাই তুমি কি মনে কর শত্রুরা তোমাদের (পৃথিবীর নশ্বর) বাসস্থানে ফিরে যেতে দিবে এবং নিরাপদে থাকতে দিবে?

তবে তারা (শত্রুরা)এও বিশ্বাস করে যে, যখন আগন্তুক অনেক দূরে চলে যায় এবং তার আবাসস্থল অনেক দূরে থাকে, তখন সে (আগন্তুক) স্বভাবতই অস্থির হয়ে থাকে (তার স্থায়ী আসল বাসস্থানে ফিরে যাওয়ার জন্য)। আর আগন্তুকদের জন্য এর থেকে কঠিন নির্বাসন আর কি হতে পারে যখন শত্রুরা তাদের ই পরিবেষ্টিত করে ফেলে তাদের উপর দুঃশাসন চালাচ্ছে?"

**

আচ্ছা আগন্তুক কোথায় আছে?

শফিক ভাবছে, ফিলিস্তিনের মাটির নীচে লুকিয়ে থাকা অভুক্ত কাসসাম ব্রিগেডের সেই মানুষটির কথা যার এই নশ্বর পৃথিবীতে কেউ বেচে নেই।

সে ভাবছে আরব পেনিন্সুলার কোন এক পাহাড়ে তীব্র শীতের রাতে তীক্ষ্ণ চোখে শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করা সেই মুজাহিদের কথা। কোন প্লেনের শব্দ ই কি তাকে মনে করিয়ে দেয় সে কালো রাতের কথা - একটি বোমা চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছিল তার সকল প্রিয়জনদের।

বাংলাদেশের কোথাও কোলে শিশু নিয়ে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ক্রন্দনরত সেই বধূর কথা যার প্রিয়তম স্বামীকে একদল হায়না-পুলিশ নির্যাতন চালাচ্ছে অবিরত। তার স্বামীর অপরাধ সে ইসলামী আন্দোলন করে!

চোখ-বাধা নির্যাতিত সেই যুবক শুধু বলছে ‘আল্লাহ, আল্লাহ’ ।

শফিক ভাবছে, তার চোখের পানি বৃষ্টির পানিতে কি একাকার হয়ে যাচ্ছে?

**

সে ভাবছে, এই উন্নত দেশে মানুষ দেখি। তাদের সাথে মিশি। কথা বলি। কত গল্প হয়। বিভিন্ন রকম মানুষ দেখি। সবাই বিভিন্ন ধান্দায় ব্যতিব্যস্ত।

আহারে, তাদের মাঝে আমি সেই আগন্তুকেরে খুঁজে ফিরি। তার দেখা পাই না কেন?

বিষয়: বিবিধ

১৩২৯ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

254735
১৫ আগস্ট ২০১৪ রাত ১১:৫৮
শিশির ভেজা ভোর লিখেছেন : জাজাকাল্লা খায়র... অনেক ভালো লাগলো পড়ে। আরো বেশী বেশী লিখুন

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File