ঈমানদারদের পরীক্ষা এবং কঠিন দুর্দশা (এর গুরুত্ব এবং উপকারিতা) (অনুবাদ-গ্রন্থ; মূল: আল-ইমাম আল-ইয বিন আব্দিস-সালাম (৫৭৭-৬৬০ হিজরী)
লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ০৫:৪৮:৪৬ বিকাল
"ঈমানদারদের পরীক্ষা এবং কঠিন দুর্দশা (এর গুরুত্ব এবং উপকারিতা)"
মূল: আল-ইমাম আল-ইয বিন আব্দিস-সালাম (৫৭৭-৬৬০ হিজরী)
অনুবাদ: ড: মঞ্জুর আশরাফ
----------
পরম করুনাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি। প্রশংসা ও শান্তি মুহাম্মদ (দ), তার পরিবার এবং তার সঙ্গীদের প্রতি।
ঈমানদারদের যেকোনো দুর্দশায়, পরীক্ষায়, দুর্ভাগ্যে এবং দুর্যোগে অনেকগুলো উপকারিতা নিহিত। এই উপকারিতাগুলো মানুষদের ঈমানের তারতম্য অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন রকম হয়। নিচে তা বর্ণিত হলো:
১) প্রকৃত ঈমানদাররা এসব কঠিন পরীক্ষা ও দুর্দশার মাঝে আল্লাহর প্রভুত্ব, সার্বভৌমত্ব এবং সর্বব্যপী ক্ষমতা বুঝতে পারেন।
২) এর মধ্য দিয়ে ঈমানদারদের প্রকৃত বিনয়ী হওয়ার এবং আল্লাহর দাস রূপে প্রমান করার সুযোগ আসে। আল্লাহ বলেন:
"এবং যখনই কোন বিপদ আসে (তারা) বলেঃ “আমরা আল্লাহর জন্য এবং আল্লাহর দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে" (২:১৫৬)
ঈমানদাররা স্বাক্ষ্য দেয় যে তারা আল্লাহর অধীনে অতি সাধারণ দাস্ মাত্রই। এবং মহান রবের কাছেই বিচারের জন্য ফিরে যেতে হবে। আল্লাহরই অনুমোদন আর নিয়ন্ত্রনের অধীন তাদের প্রতিটি মুহূর্ত।তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে যে স্রষ্টার থেকে তারা কোথাও পালিয়ে যেতে পারবে না এবং কোথাও মুক্তিও পাওয়া যাবেনা।
৩) পরীক্ষার মাধ্যমে ঈমানদারদের আল্লাহর প্রতি আন্তরিকতা প্রকাশের সুযোগ ঘটে। তারা বিশ্বাস করে যে একমাত্র আল্লাহই বিপদ-মুসিবত থেকে উদ্ধার করতে পারেন - পৃথিবীর আর কোনো শক্তি নয়।
"যদি আল্লাহ তোমার কোন ধরনের ক্ষতি করেন তাহলে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই যে তোমাকে ঐ ক্ষতি থেকে বাঁচাতে পারে৷ " (৬:১৭)
"... যখন তারা নৌযানে আরোহণ করে তখন নিজেদের দ্বীনকে একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত করে নিয়ে তার কাছে প্রার্থনা করে ... (২৯:৬৫)
৪) এ সময়ে ঈমানদারদের আল্লাহর কাছে অনুশোচনাগ্রস্ত হওয়ার সুযোগ ঘটে; অন্তরকে একমাত্র তারই দিকে রুজু করার সুযোগ এসে যায় :
" মানুষের ওপর যখন কোন বিপদ আসে, তখন সে তার রবের দিকে ফিরে যায় এবং তাঁকে ডাকে ... " (৩৯:৮)
৫) ঈমানদারদের আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করার এবং আকুতি পেশ করার সুযোগ এসে যায়:
"এ মানুষকেই যখন সামান্য মুসিবত পেয়ে বসে তখন সে আমাকে ডাকে .... " (৩৯:৪৯)
"যখন সাগরে তোমাদের ওপর বিপদ আসে তখন সেই একজন ছাড়া আর যাকে তোমরা ডাকো সবাই অন্তর্হিত হয়ে যায় ..." (১৭:৬৭)
"তাদেরকে বিপদ ও কষ্টের মুখে নিক্ষেপ করেছি, যাতে তারা বিনীতভাবে আমার সামনে মাথা নত করে .... (৬:৪১)
"এদেরকে জিজ্ঞেস করো, জল-স্থলের গভীর অন্ধকারে কে তোমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করে ? কার কাছে তোমরা কাতর কণ্ঠে ও চুপে চুপে প্রার্থনা করো? কার কাছে বলে থাকো, এ বিপদ থেকে আমাদের উদ্ধার করলে আমরা অবশ্যি তোমার শোকরগুজারী করবো ? বলো, আল্লাহ তোমাদের এ থেকে এবং প্রতিটি দুঃখ –কষ্ট থেকে মুক্তি দেন৷ এরপরও তোমরা অন্যদেরকে তাঁর সাথে শরীক করো৷" (৬:৬৩-৬৪)
৬) বিপদে ঈমানদারদের ধৈর্যশীল হওয়ার সুযোগ এসে যায়:
"... যথার্থই ইবরাহীম কোমল হৃদয়, আল্লাহভীরু ও ধৈর্যশীল ছিল৷" (৯:১১৪)
"... আমি তাকে একটি ধৈর্যশীল পুত্রের (ইবরাহীম) সুসংবাদ দিলাম৷" (৩৭:১০১)
মহানবী (দ) বলেন (আসাজ আব্দুল কায়েস (রা) কে ) " আল্লাহ তোমার চরিত্রের দুটি দিক ভালবাসেন - ধৈর্যশীলতা এবং সুচিন্তিত কাজ।
ধৈর্যশীলতার মানদন্ড পরিবর্তিত হয় বিপর্যয়ের পরিমান অনুসারে। চরম বিপর্যয়ের সময়ে ধৈর্যশীলতার মূর্ত প্রতিক হওয়াই এ চরিত্রের সর্বতকৃস্ট বহিপ্রকাশ।
৭) যেসকল মানুষ ঈমানদারদের বিপদ/দুর্যোগের জন্য দায়ী তাদের ক্ষমা করে দেয়া:
".... যারা ক্রোধ দমন করে ও অন্যের দোষ –ক্রটি মাফ করে দেয়৷ এ ধরনের সৎলোকদের আল্লাহ অত্যন্ত ভালোবাসেন৷" (৩:১৩৪)
"... যে মাফ করে দেয় এবং সংশোধন করে তাকে পুরস্কৃত করা আল্লাহর দায়িত্ব ... " (৪২:৪০)
চরম বিপর্যয়ের জন্য দায়ী অত্যাচারীকে ক্ষমা করে দেয়া ঈমানদারদের পরম ধৈর্যশীলতার আরেকটি প্রতীক।
৮) বিপর্যয় তথা শাসকের অত্যাচারের সময়ে ধৈর্যশীল এবং দৃরচেতাসম্পন্ন হওয়া। এই গুনটি ঈমানদারদের প্রতি আল্লাহর ভালবাসা এবং পুরস্কার বাড়িয়ে দেয়:
" ... আল্লাহর পথে তাদের ওপর যেসব বিপদ এসেছে তাতে তারা মনমরা ও হতাশ হয়নি, তারা দুর্বলতা দেখায়নি এবং তারা বাতিলের সামনে মাথা নত করে দেয়নি৷এ ধরনের সবরকারীদেরকে আল্লাহ ভালবাসেন ৷" (৩:১৪৬)
" ধৈর্যশীল এবং দৃরচেতাসম্পন্নরা আল্লাহর থেকে পূর্ণ মাত্রায় পুরস্কৃত হবে কোনো হিসাব ছাড়াই" (৩৯:১০)
মহানবী (দ) বলেন: "কাউকেই ধৈর্যশীল দের মত মহাপুরস্কার দেয়া হবে না।" (বুখারী:১৪২৯, মুসলিম: ১০৫৩)
৯) চরম বিপর্যয়ের সময়ে (তথা পরীক্ষার সময়ে ঈমানদারদের সহজ-আচরন করা! কারণ এর মাঝে অনেক উপকারিতা নিহিত বলেই:
মহানবী (দ) বলেন: "যার মুঠোয় আমার জীবন তার শপথ, তারা (ঈমানদাররা) বিপর্যয়ের সময়ে অবশ্যই আনন্দিত হয় যেমন তুমি স্বাভাবিক অবস্থায় আনন্দিত হও।" (ইবনে মাজা: ৪০২৪, আল হাকিম: ১১৯)
ঈমানদাররা বিপর্যয়ের সময় আনন্দিত হয় কারণ তারা জানে যে এই সামান্য বিপর্যয়ের সাথে এর উপকারিতার (তথা মহান রবের কাছ থেকে মহা-পুরস্কারের) কোনো তুলনাই হয় না। এই অবস্থাটিকে এভাবে চিত্রায়িত করা যায় যেমন কেউ সামান্য ঔষধ সেবন করল এবং অনেকগুলো কঠিন রোগ থেকে মুক্ত হয়ে গেল!
১০) ঈমানদারদের উপর যেকোনো পরীক্ষা তথা বিপর্যয় গুনাহ-মুক্তির উপায়:
"তোমাদের ওপর যে মুসিবতই এসেছে তা তোমাদের কৃতকর্মের কারনে এসেছে৷ বহু সংখ্যক অপরাধকে তো আল্লাহ ক্ষমা করে দিয়ে থাকেন।" (৪২:৩০)
মহানবী (দ) বলেন: " ঈমানদাররা এমন কোনো পরীক্ষায় পতিত হয় না এমনকি তা ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়া অথবা কাটা-বিদ্ধ হয়ে কস্ট পাওয়া - সবই তার গুনাহ-মুক্তির কারন হয়।" (বুখারী: ৫৬৪২, মুসলিম: ২৫৭৩)
১১) ঈমানদার যারা বিপর্যয়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছেন তাদের প্রতি সহানভুতি পোষণ এবং সাহায্যে এগিয়ে আসা:
হজরত ঈসা (আ) বলতেন, " লোকেরা হয় ভাল সময় কাটাচ্ছে অথবা বিপদে সময় কাটাচ্ছে। তাই যারা বিপদগ্রস্ত তাদের প্রতি সহানুভুতিসম্পন্ন হও এবং আল্লাহর প্রশংসা কর তোমার ভাল অবস্থার জন্য'" (মালিক: ২/৯৮৬)
১২) 'ভাল' থাকার রহমতের বুঝ আসা। কারণ ভাল অবস্থার বুঝ মানুষের তখন ই প্রকৃত আসে যখন মন্দ সময় আসে।
১৩) আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এই পরীক্ষাগুলোর মাধ্যমে পরকালের পুরস্কারের ব্যবস্থা করছেন এই প্রত্যয় ঈমানদারদের আসে।
১৪) অনেক লুক্কায়িত উপকারিতা ঈমানদারদের পরীক্ষা এবং দুর্যোগের মাঝে আসে - ঈমানদারদের এ বোধদয় ঘটে:
" ... হতে পারে একটা জিনিস তোমরা পছন্দ করো না কিন্তু আল্লাহ তার মধ্যে অনেক কল্যাণ রেখেছেন।" (৪:১৯)
" ... হতে পারে কোন জিনিস তোমরা পছন্দ করো অথচ তা তোমাদের জন্য খারাপ ৷" (২:২১৬)
" যারা এ মিথ্যা অপবাদ তৈরী করে এনেছে তারা তোমাদেরই ভিতরের একটি অংশ। এ ঘটনাকে নিজেদের পক্ষে খারাপ মনে করো না বরং এও তোমাদের জন্য ভালই .... " (২৪:১১)
যখন স্বৈরাচারী শাসক ইব্রাহিম (আ) থেকে সারাহ (রা) কে জোর-জবর্দস্তির মাঝে গ্রেফতার করেছিল, এর একটি অব্যক্ত উপকারিতা ছিল। ইব্রাহিম (আ) পরবর্তিতে হাজর (আ) কে ভৃত্য হিসেবে পেয়েছিলেন যিনি ইসমাইল (আ) কে জন্ম দিয়েছিলেন এবং গড়ে তুলেছিলেন 'নবুয়তের চিহ্নরেখা'।
লক্ষ্য করুন, পরীক্ষাটির লুক্কায়িত উপকারিতা পার্থিব জীবনেই কত ব্যপক ছিল।
১৫) পরীক্ষা, বিপর্যয় এবং কঠিন অবস্থা ঈমানদারদের খারাপি, অসার দম্ভ, হামবড়াই, অহংকার, বাহ্যাড়ম্বর প্রদর্শন এবং জুলুম করা থেকে বিরত রাখে।
রাজা নিম্রদ (বা নমরুদ) যদি গরিব এবং দু:স্থ হত, অথবা অন্ধ ও বধির হত, সে কখন ই ইব্রাহিমের (আ) সাথে 'আল্লাহকে' নিয়ে তর্ক করত না। কিন্তু ক্ষমতার সার্বভৌমত্বের বড়াই তাকে ধ্বংসের মাঝে পতিত করে:
"... তর্ক করেছিল এই কথা নিয়ে যে, ইবরাহীমের রব কে ? এবং তর্ক এ জন্য করেছিল যে, আল্লাহ তাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছিলেন ৷ ... " (২:২৫৮)
ফেরাউন ও যদি একই রকম পার্থিব অবস্থায় (ক্ষমতার পরীক্ষায়) না পরত তাহলে কখন ই বলত না:
"আমি তোমাদের সবচেয়ে বড় রব " (৭৯:২৪)
আল্লাহ বলেন:
"... আল্লাহ ও তাঁর রসূল নিজ অনুগ্রহে তাদেরকে অভাবমুক্ত করে দিয়েছেন বলেই তাদের এত ক্রোধ ও আক্রোশ ! .. (৯:৭৪)
"কখনই নয় , মানুষ সীমালংঘন করে৷ কারণ সে নিজেকে দেখে অভাবমুক্ত৷" (৯৬:৬-৭)
" আল্লাহ যদি তাঁর সব বান্দাদেরকে অঢেল রিযিক দান করতেন তাহলে তারা পৃথিবীতে বিদ্রোহের তুফান সৃষ্টি করতো৷ ... (৪২:২৭)
"... জালেমরা তো এমনি সব সুখৈশ্বর্যের পেছনে দৌঁড়াতে থেকেছে, যার সরঞ্জাম তাদেরকে প্রচুর পরিমাণে দেয়া হয়েছিল .. (১১:১১৬)
"... তাহলে আমি তাদের প্রচুর বৃষ্টি বর্ষণের মধ্যে সমৃদ্ধ করতাম; যাতে এ নিয়ামতের মাধ্যমে তাদের পরীক্ষা করতে পারি৷ .. (৭২:১৬-১৭)
"কখন এমনটি ঘটেনি যে, আমি কোন জনপদে কোন সতর্ককারী পাঠিয়েছি এবং সেই জনপদের সমৃদ্ধিশালী লোকেরা একথা বলেনি যে, তোমরা যে বক্তব্য নিয়ে এসেছ আমরা তা মানি না।" (৩৪:৩৪)
অনেক প্রাচুর্য এবং নেয়ামতে মত্ত থেকে যুগে যুগে অত্যাচারী শাসক ঈমানদারদের নির্যাতন চালিয়েছে। অন্যদিকে ঈমানের পরীক্ষায় সবচেয়ে বেশি অংশ নিতে হয়েছিল নবী-রাসুলদের, অতপর তাদের সঙ্গী-সাথী ঈমানদারদের, এবং অতপর যারা তাদের নিকটবর্তী তাদের। ঈমানদারদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল 'পাগল', 'জাদুকর', 'জোতিষী ', ইত্যাদি হিসেবে - তাদের গালিগালাজ করা হয়েছিল, অপমান করা হয়েছিল। এটি সকল কাল ও অঞ্চলে প্রযোজ্য। তবুও ..
"... তাদের ওপর যে মিথ্যা আরোপ করা হয়েছে এবং যে কষ্ট দেয়া হয়েছে, তাতে তারা সবর করেছে ৷ ..." (৬:১৩৪)
আল্লাহ আমাদের বলছেন:
"তোমরা কি মনে করেছো, এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে? অথচ তোমাদের আগে যারা ঈমান এনেছিল তাদের ওপর যা কিছু নেমে এসেছিল এখনও তোমাদের ওপর সেসব নেমে আসেনি ৷ তাদের ওপর নেমে এসেছিল কষ্ট-ক্লেশ ও বিপদ-মুসিবত, তাদেরকে প্রকম্পিত করা হয়েছিল ৷ এমনকি সমকালীন রসূল এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা চীৎকার করে বলে উঠেছিল, অবশ্যিই আল্লাহর সাহায্য নিকটেই ৷" (২:২১৪)
"আর নিশ্চয়ই আমরা ভীতি, অনাহার, প্রাণ ও সম্পদের ক্ষতির মাধ্যমে এবং উপার্জন ও আমদানী হ্রাস করে তোমাদের পরীক্ষা করবো ৷ এ অবস্থায় যারা সবর করে তাদের উত্তম খবর শোনাও।" (২:১৫৫)
"তোমাদের অবশ্যি ধন ও প্রাণের পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে এবং তোমরা আহলি কিতাব ও মুশরিকদের থেকে অনেক কষ্টদায়ক কথা শুনবে৷ ... (৩:১৮৬)
সাহাবীরা ঘরবাড়ি, নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হয়েছিলেন। বাধ্য হয়েছিলেন সবকিছু পিছনে ফেলে যেতে। তাদের উপর ভয়ঙ্কর পরীক্ষার পর পরীক্ষা এসেছিল। তাদের শত্রুরা বহুগুনে সংখ্যায় বেড়েছিল। কখনো সাহাবীরা বিজিত হয়েছিলেন - কখনো হন পরাজিত। তাদের অনেকে ওহুদের বা অন্যান্য যুদ্ধে শহীদ হন। নবীজি (দ) নিজে মুখে আঘাতপ্রাপ্ত হন - তার একটি দন্ত-মোবারক ভেঙ্গে যায়। তার শিরস্ত্রাণ ভেঙ্গে মাথার একদিকে গভীর ক্ষত হয়ে যায়। তার শত্রুরা এতে আনন্দে আত্মহারা হয় - পক্ষান্তরে মুসলমানরা হতাশায় নিমজ্জিত হন। খন্দকের যুদ্ধে মুমিনদের অবস্থা হয় এরকম:
" মু’মিনদেরকে নিদারুণ পরীক্ষা করা হলো এবং ভীষণভাবে নাড়িয়ে দেয়া হলো৷" (৩৩:১১)
"যখন তারা (শত্রুরা) ওপর ও নিচে থেকে তোমাদের ওপর চড়াও হলো, যখন ভয়ে চোখ বিস্ফারিত হয়ে গিয়েছিল, প্রাণ হয়ে পড়েছিল ওষ্ঠাগত ... " (৩৩:১০)
মুমিনরা অনবরত 'ভয়', 'নিগ্রহ' এবং 'দারিদ্র্য' অবস্থার মধ্য দিয়ে বসবাস করছিলেন। ভয়াবহ ক্ষুধার যন্ত্রনায় তাদের পেটে পাথর বেধে রাখতে হয়েছিল। ঈমানদারদের নেতা নবীজি (দ) কখনো একদিনে দুই বেলায় পেট ভরে খেতে পারেননি (মুসলিম: ২৯৭০)।
উপরন্তু নবীজিকে বিভিন্ন ভাবে মনো-কস্ট দেয়া হয়েছিল - যেমন তার সবচেয়ে প্রিয় স্ত্রী (ঈমানদারদের মা) সম্পর্কে অপবাদ ছড়িয়ে দিয়ে। জীবনের শেষ প্রান্তে মুসায়লামা, তুলায়হা এবং আল-আনসি নামক ভন্ড -নবীরাও তাকে কস্ট দেয়। যখন তিনি মারা যান, তখন তার যুদ্ধের পোশাক এক ইহুদির কাছে ত্রিশ সা' পরিমান গমের বিনিময়ে বন্দক ছিল (বুখারী: ২৯১৬)।
নবীরা এবং ঈমানদারেরা সব সময় পরীক্ষা এবং নির্যাতন মোকাবেলা করেছিলেন । প্রত্যেকে তাদের ঈমানের স্তর অনুযায়ী পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলেন। তাদের কাউকে কাউকে করাত দিয়ে চিরে দুই টুকরা করা হয়েছিল কিন্তু তবুও তারা ঈমান-চুত হননি। মহানবী (দ) বলেন,
"ঈমানদারদের উদাহরণ হল একটি গাছের মত - প্রবল বাতাস তাকে সর্বদা একবার একদিকে বাক করে ফেলে আবার পরক্ষনেই অন্যদিকে। ঈমানদাররা এভাবে সবসময়েই পরীক্ষার মুখোমুখি হন।" (বুখারী: ৫৬৪৪, মুসলিম: ২৮০৯)
"ঈমানদারদের উদাহরণ একটি সতেজ গাছের কচি কান্ডের মতন; প্রবল বাতাস কখন ও তাকে বাকিয়ে ফেলে, কখনও ভেঙ্গে ফেলে, কখন ও প্রবল বাতাসেও তা দাড়িয়ে থাকে যতক্ষণ না শুস্ক ও মৃত হয়ে যায়।" (বুখারী: ৫৬৪৩, মুসলিম: ২৮১০)
পরীক্ষার কঠোরতা এবং দুর্যোগ বান্দাহদের আল্লাহর অভিমুখী করে দেয় - যিনি হলেন প্রবল পরাক্রান্ত এবং শক্তিশালী। পক্ষান্তরে ভাল অবস্থা এবং প্রাচুর্য বান্দাহকে আল্লাহ থেকে দুরে সরিয়ে নেয়।
"মানুষের অবস্থা হচ্ছে, যখন সে কোন কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়, তখন সে দাঁড়িয়ে ,বসে ও শায়িত অবস্থায় আমাকে ডাকে৷ কিন্তু যখন আমি তার বিপদ হটিয়ে দেই তখন সে এমনভাবে চলতে থাকে যেন সে কখনো নিজের কোন খারাপ সময়ে আমাকে ডাকেইনি ..." (১০:১২)
একারণেই ঈমানদাররা অসম্পূর্ণ ভাবেই আহার করেন, শালীন ও অমিতব্যয়ী কাপড় পরিধান করেন, ইত্যাদি - এক সহজ সরল জীবনযাপন করে থাকেন - যাতে করে সহজেই যেকোন সময়ে তারা আল্লাহ-অভিমুখী হতে পারেন এবং পূর্ণভাবে তার দিকে রুজু করতে পারেন।
১৬) ঈমানদাররা কঠিন দুরাবস্থার মাঝেও সন্তুস্ট এবং নিশ্চিত থাকেন। এ গুনটি তাদের আল্লাহর ভালবাসার দিকে ধাবিত করে। এর কারন হল: পূর্ণ-কর্মশীল এবং পাপী উভয়েই পরীক্ষার মুখোমখি। আল্লাহ প্রদত্ত এ পরীক্ষায় যে অসন্তুস্ট থাকে, সেই আল্লাহর অসন্তুষ্টির পাত্রে পরিনত হয় - এবং দুনিয়া এবং আখেরাত বরবাদ হয়ে যায়। পক্ষান্তরে যেকোনো অবস্থায় যিনি সর্বদা সন্তুস্ট এবং খুশি থাকেন, তার জন্য বরাদ্দ হয় আল্লাহর সন্তুষ্টি যা জান্নাত এবং তার মাঝের যেকোনো কিছুর তুলনায় মূল্যবান। আল্লাহ বলেন:
"এ মুমিন পুরুষ ও নারীকে আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তাদেরকে তিনি এমন বাগান দান করবেন যার নিম্নদেশে ঝরণাধারা প্রবাহমান হবে এবং তারা তার মধ্যে চিরকাল বাস করবে৷ এসব চির সবুজ বাগানে তাদের জন্য থাকবে বাসগৃহ এবং সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, তারা আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করবে৷ এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য৷ " (৯:৭২)
অর্থাৎ আল্লাহর সন্তুষ্টি জান্নাতের বাগানের থেকেও মূল্যবান।
ঈমানদারদের উপর পরীক্ষা এবং দুর্যোগের উপকারিতা এতক্ষণ সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম।
আমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং দুনিয়া এবং আখেরাতে কল্যান এবং বিজয় কামনা করি।
হে আল্লাহ, আমাদের এমন কাজ করার তৌফিক দিন যাতে আপনি আমাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাবেন।
দরুদ ও সালাম মানবতার মুক্তিদূত মুহাম্মদ (দ), তার পরিবার এবং সঙ্গী-সাথীদের প্রতি।
হে আল্লাহ, আপনি ই আমাদের জন্য যথেস্ট।
আমাদের সকল বিষয়ের কি উত্তম ফয়্সালাকারীই না আপনি !
বিষয়: বিবিধ
১৫৯৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন