একজন একাকী মানুষের গল্প

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ১৮ মে, ২০১৪, ০৮:০২:৩২ সকাল

মুসলিম দল রাসুলুল্লাহ (স) এর নেতৃত্বে ৯ম হিজরিতে প্রায় ৩০ হাজার মুজাহিদ সহ তাবুক যুদ্ধের যাত্রা শুরু করেন। মদিনা থেকে প্রায় ৭৭৮ মাইল দুরে তাবুক অবস্থিত। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরম এবং রুক্ষ্ম আবহাওয়ার মাঝে এই বিশাল সংখ্যক অভিযাত্রী দল রওয়ানা শুরু করেন। বাস্তবিক কারণেই রাসুলুল্লাহ (স) এর পক্ষে সম্ভবপর ছিল না যারা এই যাত্রায় (অন্যদের তুলনায় অত দ্রুত না হওয়ার দরুন) পেছনে পড়ে ছিল তাদের সম্পর্কে সার্বক্ষণিক খেয়াল রাখার। অনেক মুজাহিদ পেছনে পড়ে রইলেন। অগ্রসরমান দলের অনেকেরই মনে হতে পারে কোন উদ্দেশ্যে হয়ত কেউ কেউ পেছনে পড়ে ছিলেন। কিন্তু ওই সাহাবারা তাদের সম্পর্কে কোন খারাপ ধারনাকেই মনে প্রশ্রয় দেননি। যখনই তাদের কারো নাম মহানবী (স) এর সামনে উল্লেখ করা হত, তিনি (স) বলতেন, “তার সম্পর্কে কথা বলা বন্ধ কর। যদি তার মাঝে কোন ভাল থাকে তবে আল্লাহ তায়ালা তাকে অবশ্যই তোমাদের সাথে একত্রিত করবেন, আর তা না হলে আল্লাহ তায়ালা তার বিপদ থেকে তোমাদের রক্ষা করবেন”।

এমন ই একজন সাহাবী যিনি পেছনে পড়ে রইলেন তিনি হলেন আবু যার আল গিফারী (রা)। তিনি পেছনে পড়ে থাকতে চাননি, বরং তিনি রাসুলুল্লাহ (স) এর সেনাদলের সাথে একসাথেই থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার উটটি দুর্বল ছিল এবং বেশ আস্তে আস্তে চলছিল। সময়ের সাথে সাথে আবু যার (রা) আরও পেছনে পড়ে রইলেন যতক্ষণ না মুসলিম সেনাবাহিনীর দৃষ্টির সম্পূর্ণ অগোচরে আবু যার (রা) রয়ে গেলেন। তিনি একাকী পড়ে রইলেন। এ অবস্থায় তার কয়েকটি বিকল্প রয়েছে- (১) তিনি মদীনা ফিরে যেতে পারেন; (২) তার উট যেভাবে চলছিল সে গতিতেই তার যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারেন; (৩) সবচেয়ে কঠিন এবং অবাস্তব বিকল্পটি হল তিনি তার উটকে ত্যাগ করবেন এবং মাল সামাল নিয়ে হেঁটে যাত্রা করবেন যতক্ষণ না মুসলিম সেনাদলের কাছে পৌছতে পারেন।

যতই অবাস্তব হোক না কেন, রাসুলুল্লাহ (স) এর সাহাবী আবু যার আল গিফারী (রা) এই শেষ (৩ নম্বর) বিকল্পকেই গ্রহণ করেন!

ইতিমধ্যে মুসলিম সেনাদল সম্মুখ দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। যখন ই কেউ রাসুলুল্লাহ (স) এর সামনে নিখোঁজ আবু যার আল গিফারী (রা) এর নাম উল্লেখ করতেন, তিনি (স) বলতেন, “তার সম্পর্কে কথা বলা বন্ধ কর। যদি তার মাঝে কোন ভাল থেকে থাকে তবে আল্লাহ তায়ালা তাকে অবশ্যই তোমাদের সাথে একত্রিত করবেন, আর তা না হলে আল্লাহ তায়ালা তার বিপদ থেকে তোমাদের রক্ষা করবেন”।

পরে রাসুলুল্লাহ (স) এবং তার সেনাদল ক্যাম্প স্থাপন করলেন। কেউ দুর থেকে দেখলেন একটি ক্ষুদ্র ছায়া। ছায়াটি ধীরে ধীরে বাড়ছে যতক্ষণ না নিশ্চিত হওয়া গেল দুর থেকে কোন একজন মানুষ হেতে হেতে মুসলিম ক্যাম্প এর দিকে আসছেন। ওই সাহাবী দৌড়ে দিয়ে রাসুলুল্লাহ (স) কে জানালেন, “হে আল্লাহর রাসুল (স), একজন মানুষ হেঁটে হেঁটে এদিকে আসছেন”। রাসুলুল্লাহ (স) বললেন, “যেন আবু যার হয়!”

যখন দুর থেকে ওই মানুষটিকে স্পষ্টত ই চেনা গেল, তখন কেউ কেউ বলে উঠলেন, “আল্লাহর শপথ, হে রাসুলুল্লাহ (স), তিনি নিশ্চিতই আবু যার”। রাসুলুল্লাহ (স) তখন বললেন, “আল্লাহ তায়ালা আবু যারের উপর দয়া বর্ষণ করুন। সে একা হাটে, সে একা মৃত্যুবরন করবে, আবার সে একাই পুনরুত্থিত হবে।”

এই দোয়াটি মূলত একটি ভবিষ্যৎবানী ছিল যা খলীফা ওসমান (রা) এর সময়ে পুরণ হয়। উসমান (রা) এর খেলাফতের সময়ে মুসলিম রাজ্য অর্থ, বিভব, প্রাচুর্য অতীতের তুলনায় অনেক বেশি উপভোগ করছিল। অবারিত সম্পদ ছিল। বাহিরের রাজ্য থেকে অগণিত মানুষ ইসলামে প্রবেশ করছিল। কিন্তু সব সময়েই আবু যার আল গিফারী (রা) অতীতের সেই সরল জীবনের আকাঙ্ক্ষী ছিলেন যখন মুসলিমরা সাধারণ জীবনযাপন করতেন আর ইসলামের জন্য উৎসর্গে (অর্থ, সময়, শক্তি দিয়ে) বেশি নিবেদিত ছিলেন। সংক্ষেপে তিনি মোহমুক্ত ছিলেন সকল প্রকার পার্থিব প্রাচুর্য থেকে যা বিভিন্ন অঞ্চল জয়ের মাধ্যমে এসেছিল।

সরল জীবনের সন্ধানে আবু যার আল গিফারী (রা) তার পরিবার নিয়ে দুরে চলে গিয়েছিলেন এবং মরুভূমির একটি অনাবাদী অঞ্চলে (আর-রাব্দাহ) বসতি স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তিনি একটি কঠোর, সাদাসিধা জীবন যাপন করতেন। জীবনের শেষ সময় আল্লাহতায়ালার ইবাদতে পুরোপুরি উৎসর্গ করে দেন। যখন আবু যার (রা) অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুর সন্নিকটে উপস্থিত হন, তিনি তার স্ত্রী এবং ভৃত্যকে

এই নির্দেশ দেন যে, “আমি যখন মারা যাব, আমাকে ধৌত করবে, কাপড়ে আচ্ছাদিত করবে এবং আমাকে বহন করে রাস্তার ধারে নিয়ে যাবে যেখানে আমাকে দাফন করবে।” এরপর যখন প্রথম কোন অভিযাত্রী দল তাদের (আবু যার (রা) এর লাশবাহী পরিজনদের) দেখল, তারা যাত্রীদের জানাল যে, “এ আবু যার”। অভিযাত্রী দল কুফার একদল লোকের সমষ্টি ছিল। তাদের মাঝে প্রসিদ্ধ সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা)ও ছিলেন। তিনি (রা) বললেন, “ এ কি হচ্ছে?” দলের একজন জানাল, “এ হল আবু যার আল গিফারী (রা)এর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া”।

শুনেই আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা) অঝোরে কাঁদতে শুরু করলেন। বললেন, “রাসুলুল্লাহ (স) সত্যিই বলেছিলেনঃ “আল্লাহ তায়ালা আবু যারের উপর দয়া বর্ষণ করুন। সে একা হাটে, সে একা মৃত্যুবরন করবে, আবার সে একাই পুনরুত্থিত হবে।”

আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা) কাফেলা থেকে নামলেন। ব্যক্তিগত ভাবে লাশ দাফন এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিলেন।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ঃ

(১) আবু যার আল গিফারী (রা) এর একনিষ্ঠতা, যা তাকে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ পারি দিয়ে তাবুক যুদ্ধের মুসলিম দলের সাথে মিলিত করেছিল। যাতে তিনি রাসুলুল্লাহ (স) এর দলের সাথে জিহাদে অংশ নিতে পারেন।

(২) রাসুলুল্লাহ (স) এর সত্যবাদিতা। তিনি (স) আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে একটি মিরাকল ছিলেন। যিনি (স) আবু যার আল গিফারী (রা) এর মৃত্যুর অবস্থা সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন এবং তা সত্য হয়েছিল।

(৩)আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা) এর জ্ঞান এবং স্মরণশক্তি। অনেক বছর পর ও যিনি রাসুলুল্লাহ (স) এর আবু যার (রা) মৃত্যু সম্পর্কে উক্তি হুবহু মনে রেখেছিলেন।

উৎস

(১) The Noble Life of the Prophet, Dr Ali Muhammad As-Sallaabee, Vol-3 pp. 1833 – 1836

বিষয়: বিবিধ

১১৫৯ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

222887
১৮ মে ২০১৪ সকাল ০৮:৩৪
মু. মিজানুর রহমান মিজান (এম. আর. এম.) লিখেছেন : ইসলামীক পোষ্ট।

পড়ে খুব ভালো লাগলো।
222889
১৮ মে ২০১৪ সকাল ০৯:১০
মদীনার আলো লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File