পার্থিব সম্পদ এবং আনসার

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ১৫ মে, ২০১৪, ০৫:৪৭:৪৮ বিকাল

হুনায়িনের যুদ্ধের (৮ম হিজরি) পর রাসুলুল্লাহ (স) স্থির করলেন এবং সম্ভবত প্রয়োজনীয়ই মনে করলেন যে নও-মুসলিমদের যুদ্ধ লব্ধ সামগ্রীর একটি বড় অংশ দেয়ার। এর ফলে তারা হয়ত ইসলামের পথে ভালভাবে আকৃষ্ট হবে আর দৃঢ় অবিচল থাকতে পারবে। রাসুলুল্লাহ (স) কোরায়েশ, গাতফান আর তামিম গোত্রের নও-মুসলিম নেতাদের

যুদ্ধ-লব্ধ সামগ্রীর একটি বিরাট অংশ দেন - প্রত্যেকে ভাগে ১০০ করে উট পান। যেমনঃ আবু সুফিয়ান ইবনে হারব, সুহায়েল ইবনে আমর, হাকিম ইবনে হিজাম, সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া, উয়াইনাহ ইবনে হিস্ন আল-ফিজারি, আল-আক্রা ইবনে হাবিস, মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান, ইয়াজিদ ইবনে আবু সুফিয়ান এবং কায়েস ইবনে আদি। শুরুতেই তাদের এত বিরাট পরিমাণ গনিমতের সম্পত্তি দেয়ার উদ্দেশ্য তাদের হৃদয় কে আলোড়িত করা - ইসলামের প্রচার ও জিহাদে উদ্বুদ্ধ করা। এই আশায় যে তাদের দুনিয়ার প্রতি ভালবাসা আখেরাতের ভালবাসায় পরিবর্তিত হবে। আনাস ইবনে মালিক (রা) বলেন, “নিশ্চয়ই, যদি এমন ও হয় যে দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলে একজন মানুষ ইসলামে পরিপূর্ণভাবে প্রবেশে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়, এতে করে যখনই সে প্রকৃতই ইসলামে পূর্ণভাবে দাখিল হওয়া শুরু করে তখন ই তার কাছে এই পৃথিবী এবং এর যত রকম উপকরণ আছে তার থেকে ও ইসলাম বেশি প্রিয় হয়ে যায়” (মুসলিমঃ ২৩১২)।

প্রত্যেকেই এই সম্পদের বণ্টনে খুশি ছিলেন না। বিশেষ করে, আনসারদের অনেকে হয়ত দুঃখিত হয়েছিলেন এই ভেবে যে সম্পত্তি বণ্টনে কেন তাদের পুরোপুরি উপেক্ষা করা হল! সাদ ইবনে উবাদা রাসুলুল্লাহ (স) এর কাছে এসে বিষয়টি উল্লেখ করেনঃ “হে আল্লাহর রাসুল (স), মদিনার আনসারেরা নিশ্চয়ই কষ্ট পেয়েছে কেন তাদের আপনি পুরোপুরি উপেক্ষা করলেন? আপনি আপনার লোকদের (কোরায়েশ) মাঝে আর আরবের বিভিন্ন গোত্রের মাঝে যুদ্ধলব্দ সম্পত্তি বণ্টন করলেন আর আনসারদের কিছুই দিলেন না?”

রাসুলুল্লাহ (স) বললেন, “এ ব্যাপারে তোমার মনের অনুভূতি কি?”

“হে রাসুলুল্লাহ! আমি আমার লোকদের (আনসারদের) একজন ভিন্ন আর কেউ নই (অর্থাৎ তাদের মতই চিন্তা করছি)”।

“তাহলে তোমার লোকদের এখানে জড় কর।”

মুহাজিরদের কেউ কেউ ও এলেন ওই সমাবেশে। আবার (মুহাজিরদের) অনেককে আসতে বাধা দেয়া হল। সবাই (আনসাররা) এলে সাদ (রা) রাসুলুল্লাহ (স) কে বিষয়টি জানালেন।

রাসুলুল্লাহ (স) তাদের সামনে এলেন। প্রথমে মহান আল্লাহ পাকের প্রশংসা স্তুতি পেশ করলেন। তারপর শুরু করলেনঃ “হে আনসারের লোকেরা! আমাকে বলা হয়েছে যে একটি রাগের অনুভূতি তোমাদের অন্তঃস্থল ছেয়ে রেখেছে। আমি (মদীনায়) আসার পূর্বে তোমরা কি ভুল পথে ছিলে না? অতঃপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের হেদায়েত দিলেন। তোমরা কি দরিদ্র ছিলেনা? অতঃপর আল্লাহ তোমাদের সম্পদশালী করলেন আমার মাধ্যমে। তোমরা কি একে অপরের শত্রু ছিলে না? অতঃপর আল্লাহ তায়ালা তোমাদের হৃদয় পরস্পর জুড়ে দিলেন”।

সকলে (আনসারেরা) বললেন, “আল্লাহ এবং তার রাসুল সবচেয়ে উত্তম, দয়ালু এবং দানশীল”।

রাসুলুল্লাহ (স) বললেন, “তোমরা কি আমাকে উত্তর দিবে না? হে আনসার লোকেরা?”

“হে রাসুলুল্লাহ (স) আমরা কি উত্তর দিব? যখন সহায়, রহমত আর বরকত (যা আমরা পেয়েছি সর্বতভাবে) সবকিছু আল্লাহ এবং তার রাসুলের জন্যই।”

রাসুলুল্লাহ (স) বললেন, “আল্লাহর শপথ। যদি চাইতে, তোমরা বলতে পারতে সে কথা যা অবশ্যই সত্যি এবং যদি তোমরা বিশ্বাস করতেঃ ‘আপনি (রাসুলুল্লাহ (স)) আমাদের কাছে এসেছিলেন যখন আমরা অবিশ্বাসী ছিলাম। অতঃপর আমরা বিশ্বাস করেছিলাম। আমরা অসহায় ছিলাম। আপনি আমাদের সাহায্য করলেন। আপনাকে (মক্কা থেকে) তাড়িয়ে দিল আর আমরা আপনাকে গ্রহণ করে নিয়ে আরাম দিলাম’। হে আনসার লোকেরা, তোমরা রাগান্বিত হচ্ছ পৃথিবীর সামান্য প্রাপ্তির আশায়। অথচ পৃথিবীর এ তুচ্ছ সম্পদ আমি ওই লোকদের দিয়েছি তাদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করে পূর্ণভাবে দাখিল করে নেয়ার প্রয়োজনেই। অপরদিকে তোমাদের ইসলামের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে (তোমাদের প্রতি আমার আস্থা আর বিশ্বাস পূর্ণ মাত্রায়ই রয়েছে। অর্থাৎ তোমাদের আকৃষ্ট করার প্রয়োজন নেই)।

হে আনসার লোকেরা, তোমরা কি এ ভেবে খুশী নও যে, লোকেরা উট, ভেড়া ইত্যাদি নিয়ে ফিরে যাচ্ছে আর তোমরা তোমাদের ঘরে ফিরে যাচ্ছে স্বয়ং আল্লাহর রাসুল (স) কে সাথে নিয়ে। তার শপথ, যার হাতে মুহাম্মদের প্রাণ, তোমরা যা নিয়ে ফিরে যাচ্ছ তা অন্যরা যা নিয়ে (পার্থিব উপকরণ) ফিরে যাচ্ছে তার থেকে অনেক বেশি উত্তম। হিজরত (মক্কা থেকে মদীনায় গমন) যদি না হয়ে থাকত, তবে আমি অবশ্যই একজন আনসার হতে ইচ্ছে পোষণ করতাম। যদি লোকেরা কোন এক পাহাড়ি পথ বা উপত্যকা দিয়ে যাত্রা করত, আর আনসারেরা যদি অন্য আরেক পাহাড়ি পথ বা উপত্যকা দিয়ে যাত্রা করত, তবে আমি অবশ্যই আনসারদের পথ দিয়ে যাত্রা করতাম। (আমার জন্য) আনসারেরা হল অন্তঃস্থল। আর বাকি মানুষেরা হল বাহরের জামা স্বরূপ। হে আল্লাহ, আনসারদের উপর দয়া বর্ষণ করুন , তাদের বংশ ধরদের প্রতি ও দয়া বর্ষণ করুন, তাদের ও বংশ ধরদের প্রতি দয়া বর্ষণ করুন।”

রাসুলুল্লাহ (স) এর এ হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতার সময়ে প্রত্যেকেই কাঁদছিলেন। কাঁদতে কাঁদতে প্রত্যেকেই তাদের শ্মশ্রু পর্যন্ত ভিজিয়ে ফেলেছিলেন। আর তারা সমস্বরে চিৎকার করে বলছিলেন, “আমরা খুশী আর রাজি হে আল্লাহর রাসুল (স); আপনি যা বণ্টন করেছেন আমরা তার প্রতি খুশী আর রাজি”।

মুসলিম শরীফের এক বর্ণনানুযায়ী (১০৬১), রাসুলুল্লাহ (স) এর সাথে যোগ করেছিলেন, “নিশ্চয়ই আমার পরে (আমার মৃত্যুর পরে) তোমরা (অন্য লোকদের) স্বার্থপরতার বিপদে পতিত হবে। অতএব তখন ধৈর্য ধারণ করবে যতক্ষণ না তোমরা আমার সাথে ‘হাউদে’ (যে জলাধার থেকে পুনরুত্থান দিবসে ঈমানদারেরা পান করবেন) মিলিত হবে”।

------------

উৎস

(১) The Noble Life of the Prophet, Dr Ali Muhammad As-Sallaabee, Vol-3 pp. 1767 - 1769

বিষয়: বিবিধ

১০৪৯ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

221909
১৫ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:০৩
অনেক পথ বাকি লিখেছেন :
সুন্দর হয়েছে অনেক ধন্যবাদ ।
221930
১৫ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:২০
আঁধার কালো লিখেছেন : অনেক সুন্দর হয়েছে ... চালিয়ে যান।
221964
১৫ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:১৩
ছিঁচকে চোর লিখেছেন : হুম রাসুলে পাক (স.) ঠিকি করেছেন। এটা হলো কৌশল। মাঝে মাঝে অন্যদের আকৃষ্ট করতে এমন করতে হয়।
221978
১৫ মে ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৩৭
ফেরারী মন লিখেছেন : ইসলামের প্রচার ও প্রসাবে তার মত জ্ঞানী আর কে আছে। হে রাসুল তুমিই আমাদের নেতা।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File