উড়ওয়ার গল্প

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ১০ মে, ২০১৪, ০৬:৪৬:৩৪ সন্ধ্যা

হুদায়বিয়া সন্ধির পূর্বে রাসুলুল্লাহ (স) কোরায়েশদের বুঝাতে চাচ্ছিলেন যে তারা (মুসলমানরা) যুদ্ধের জন্য আসেননি, শুধুমাত্র উমরাহ করার জন্যই এসেছিলেন।

আত-তাকিফ গোত্রের উড়ওয়া ইবনে মাসুদ কোরায়েশদের অনুরোধ করল তাকে যেন কোরায়েশদের পক্ষ হয়ে রাসুলুল্লাহ (স) এর সাথে মধ্যস্থতা করার সুযোগ দেয়া হয়।

ইমাম বুখারীর বর্ণনানুযায়ী উড়ওয়া ইবনে মাসুদ কোরায়েশদের বলল, “ হে লোকেরা, তোমরা কি আমার পিতা নও?” তারা বলল, ‘হা’। সে বলল, “আর আমি কি সন্তান নই?” তারা বলল, ‘হা’। উড়ওয়ার মা কোরায়েশ গোত্রের ছিল। উড়ওয়া এখানে তার কোরায়েশদের সাথে গভীর বন্ধনের কথাই জানাচ্ছিল।

সে বলল, “তোমাদের কি কোন কারণ আছে কোন (দোষের) ব্যাপারে আমাকে অভিযুক্ত করার?”

তারা বলল, ‘না’।

সে বলল, “আমি কি উকায মেলার মিছিলের (আত-তায়েফের উত্তরে একটি প্রসিদ্ধ বাজার যেখানে এ মেলা বছরে একবার বসত) নেতৃত্ব দিতাম না? এরপর যখন তারা (আমার গোত্র) আমার নেতৃত্বে মিছিলে যোগদান করল না, আমি কি আমার পরিবার পরিজন এবং আমার অনুসারী দলবল নিয়ে তোমাদের সাথে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে এখানে আসি নাই?”

তারা সকলে জানাল, “হা”।

তার অবস্থান পরিষ্কার করার পর সে রাসুলুল্লাহ (স) এর সাথে কথা বলার আগ্রহ জানাল।

উড়ওয়া মুসলমানদের ক্যাম্প এ গেল। রাসুলুল্লাহ (স) কে বলল, ‘হে মুহাম্মদ, ধর যে তুমি তোমার লোকদের জীবনপ্রনালী (ধর্ম, জীবনধারা) পরিবর্তন করতে চাও, কিন্তু তুমি কি তোমার পূর্বে আরবদের মাঝে এমন কোন মানুষকে দেখেছ যে কিনা তার মানুষদের ধ্বংস করতে তোমার মত পারঙ্গম? কিন্তু যদি বিপরীত কোন ফলাফল হয় (অর্থাৎ কোরায়েশরা তোমাকে পরাজিত করে), তবে আল্লাহর শপথ, আমি তোমাদের মাঝে আর কোন মানুষ দেখি না কেবলমাত্র বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন গোত্রের মানুষদের একটি জামায়াত ছাড়া (অর্থাৎ মুসলমানদের দল)। যারা সে সময় তোমাকে একাকী রেখে পলায়ন ছাড়া আর কিছুই করতে পারবেনা।”

উড়ওয়া বুঝাচ্ছিল যে, কোন একটি গোত্রের লোকজনই কেবল একসাথে শেষ পর্যন্ত

একতাবদ্ধ থাকতে পারে, যেহেতু তাদের একজনের আরেকজনের সাথে সম্পর্ক মজবুত থাকে জাতীয়তা তথা গোত্রীয় কারণেই। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (স) এর সাহাবীরা যেহেতু বিভিন্ন গোত্র থেকে এসেছে, তার মতে তাদের সম্পর্ক দীর্ঘ দিন পর্যন্ত মজবুত থাকতে পারবে না। উড়ওয়ার ধারনা ছিল যে মুসলমানেরা যখন ই কোরায়েশদের শক্তিমত্তা দেখবে, তখন ই পালাবে।

আসলে উড়ওয়ার মুসলমানদের বিশ্বাসের শক্তিমত্তা সম্পর্কে কোন ধারনাই ছিলনা। সে এটা বুঝতে পারত না যে, ঈমানের বন্ধন বা ঐক্য, গোত্র তথা জাতীয়তার ঐক্য থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়ে থাকে।

উড়ওয়ার বাজে মন্তব্যের পর আবু বকর (রা) তাৎক্ষনিক ভাবে উড়য়াকে থামিয়ে দেয় এই বলে যে, “ আল-লাতের (উড়য়া যে মূর্তি পূজা করত) যৌনাঙ্গ খাও” (Suck on the Bazr (the clitoris) of Al-Laat)। আমরা কি তার (রাসুলুল্লাহ (স)) থেকে পালাব তাকে একা রেখে? ইনশাল্লাহ এমনটি কখন ই হবেনা।”

এখানে আমরা দেখি কেউ যদি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জঘন্য বা আপত্তিকর মন্তব্য করে তার বিরুদ্ধে বাজে মন্তব্য ব্যবহারের অনুমতি রয়েছে।

উড়ওয়া মন্তব্যকারীর উদ্দেশে পাশের লোকদের বলল, ‘এ কে?’

লোকেরা বললেন, “সে হল আবু বকর”।

উড়ওয়া বলল, দুর! তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ, যদি অতীতে তুমি (আবু বকর) আমার প্রতি কোন অনুগ্রহ না করতে ( জাহেলিয়াতের সময়ে আবু বকর (রা) একবার উড়ওয়াকে একটি ঋণ পরিশোধে সাহায্য করেছিল) যা আমি পরিশোধ করিনি, তবে আমি অবশ্যই তোমার কথার উত্তর দিতাম (যে অপমান তুমি আমায় করেছ)।

মূলত উড়ওয়া যখন সাহাবাদের পালিয়ে যাওয়া সম্পর্কে বলছিল, তার উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে অনৈক্য বা বিভেদ তৈরি করা। সে মূলত নেতৃত্ব এবং মুসলমান সৈন্যদের মাঝে দূরত্ব তৈরিতে যুক্তি তৈরি করছিল। সে কোরায়েশদের শক্তিমত্তা তুলে ধরছিল আর বলছিল, মুসলমানেরা পরাজিত হলে পালাবে যেহেতু ভিন্ন ভিন্ন গোত্র হওয়ার সুবাদে তারা নিজেদের এবং নেতৃত্বের প্রতি বিশ্বস্ত নয়। দৃঢ় চিত্ত হয়ে উড়য়া মুসলমানদের বুঝাতে চেষ্টা করছিল যে কোরায়েশদের সাথে সংঘাতে জড়ানো মুসলমানদের জন্য ঠিক হবে না। যদি ও সে শীঘ্রই বুঝল যে, তার প্রচেষ্টা নিষ্ফল হয়েছে, কারণ তার সাহাবাদের ঈমানের দৃঢ়তার কাছে তার কথার কোন মূল্যই নেই।

শুধু আবু বকর (রা) ই তির্যক ভাবে মন্তব্য করেছেন তা নয়, উড়ওয়ার আরেকজন অতি কাছের মানুষ ও এমন আচরণ দেখিয়েছেন তাতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ইসলাম একজন মানুষকে যে কিভাবে পরিপূর্ণ ভাবে পরিবর্তন করে দিতে পারে। সে মানুষটি ছিলেন আল-মুগীরাহ ইবনে শবাহ (রা)। তিনি ছিলেন উড়ওয়া ইবনে মাসুদ এর সরাসরি ভাতিজা। তার ভাইয়ের ছেলে। আল মুগীরাহ হুদায়বিয়ার সন্ধির নিকট-পূর্বেই ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পূর্বে তিনি ছিলেন একজন হত্যাকারী, মাতাল এবং রাজপথের ডাকাত। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পরপরই তিনি একজন ভিন্ন মানুষ হয়ে গেলেন। আল্লাহতায়ালার অশেষ রহমতে হেদায়াত প্রাপ্ত হয়ে তিনি বিশ্বাসীদের কাতারে চলে এলেন।

রাসুলুল্লাহ (স) মুগীরাহ (রা) কে তার চাচা উড়য়া এবং রাসুলুল্লাহ (স) এর সাথে কথোপকথনের সময়ে দেহরক্ষী হিসেবে রেখেছিলেন। প্রাক-ইস্লামিক যুগে মধ্যস্ততার সময়ে প্রতিপক্ষ একজন আরেকজনের মুখের দাড়ি ধরে কথা বলতে পারতেন। সে অনুযায়ী উড়ওয়া বিভিন্ন শর্ত আলোচনার সময়ে এক পর্যায়ে রাসুলুল্লাহ (স) এর পবিত্র দাড়ি মোবারক ধরেছিলেন। এ কাজটি আল মুগীরাহ (রা) কে ক্রোধান্নিত করেছিল। আল মুগীরাহ (রা) মাথায় একটি শিরস্ত্রাণ পড়েছিলেন। আর একটি তরবারি হাতে উন্মুক্ত রেখেছিলেন। রাসুলুল্লাহ (স) এর একেবারে সাথে ঘেঁষে দাঁড়িয়েছিলেন। ঠিক যে মুহূর্তে উড়য়া মহানবী (স) এর দাড়ি মোবারক ধরেছিলেন, মুগীরাহ (রা) তরবারির হাতল দিয়ে উড়ওয়ার হাতে খোঁচা দিয়ে বললেন, “ তোমার হাত সরিয়ে নাও রাসুলুল্লাহ (স) এর দাড়ি মোবারক থেকে অতি দ্রুত, এই হাত তার মালিকের কাছে ফিরে আসার আগেই (অর্থাৎ তোমার হাত কর্তনের আগেই)।”

উড়ওয়া এবং তার ভাতিজা আল মুগীরাহ (রা) এর মধ্যকার কর্ম কাণ্ড দেখে রাসুলুল্লাহ (সা) হেসে দিলেন। পুরো ঘটনার মুল কারন ছিল যে, আল মুগীরাহ (রা) তার আপাদ মস্তক পুরো শরীর বর্মাচ্ছাদিত রেখেছিলেন। এমনকি মুখও ঢেকে রেখেছিলেন যাতে তার চাচা তাকে না চিনতে পারে।

রাসুলুল্লাহ (স) এর দেহরক্ষীর এহেন আচরণে উড়য়া আশ্চর্য হয়ে বলল, “আমি কি তোমার সঙ্গীদের মধ্যকার এই রক্ষীর পরিচয় জানতে পারি?” রাসুলুল্লাহ (স) বললেন, “এ হল তোমার ভাতিজা - আল মুগীরাহ ইবনে শবাহ।”

বিস্মিত হয়ে ভাতিজার দিকে ঘুরে বললেন, “তুমি এটা বলতে পারলে হে অস্পৃশ্য।” তুমি থাকিফ গোত্রে ঘৃণা-বিদ্বেষের বীজ বপন করেছিলে যা পৃথিবীর শেষ দিন পর্যন্ত বিদ্যমান থাকত। আল্লাহর শপথ, এই গতকালই কেবল তোমার বিশ্বাসঘাতকতার মূল্য শোধ করেছিলাম আমি নিজে তোমার হয়ে।”

উড়ওয়া এখানে আল মুগীরাহ (রা) এর ইসলাম গ্রহণের পূর্বে সঙ্ঘটিত একটি ভয়ঙ্কর কাজের উল্লেখ করছিল। ঘটনাটি ছিলঃ আল মুগীরাহ (রা) কিছুদিন আগে তার নিজ গোত্রেই ডাকাতি চালিয়েছিল এবং সগোত্রীয় ১৩ জনকে হত্যা করেছিল। ফলশ্রুতিতে থাকিফ গোত্রের উপগোত্রের মাঝে একটি যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। উড়ওয়া সে সময় বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতি সামাল দেয়। সে ভাতিজার পক্ষে রক্তমূল্য পরিশোধের মাধ্যমে ঝামেলা মিটমাটে পুরো গোত্রকে রাজি করায়। আর ঠিক সে সময়েই আল মুগীরাহ পালিয়ে মদিনায় চলে যান এবং ইসলাম গ্রহণ করেন।

উড়ওয়া হতাশ হয়ে কোরায়েশদের কাছে ফিরে আসে। যে আশা নিয়ে সে মহানবী (স) এর কাছে গিয়েছিল তার পুরো বিপরীত মানসিক অবস্থায় সে ফিরে আসে কোরায়েশদের কাছে। সে কোরায়েশদের বলল, “হে লোকেরা। আমি আমার জীবনে বিভিন্ন রাজার দরবারে গিয়েছি। (পারস্যের) কিসরা, (রোমের) হারাকল, আন-নাজ্জাশী সবার দরবারে গিয়েছি। কিন্তু আল্লাহর শপথ, আমি মুহাম্মদের মত এমন রাজা দেখিনি যে তার সঙ্গীসাথীদের কাছে যে পরিমাণ সন্মানিত আর প্রিয়। আল্লাহর শপথ, (তারা মুহাম্মদকে এত বেশি সন্মান করে যে) তারা মুহাম্মদের দিকে এক মুহূর্তের ও বেশি চোখ তুলে তাকাণ না। তার সামনে কণ্ঠস্বর উঁচু করেনা। তিনি (মুহাম্মদ) কেবল কোন বিষয়ে উপদেশ দেন আর সাথে সাথে তা সঙ্ঘটিত হয় তার সঙ্গীদের দ্বারা। কোন সময় তিনি থুথু ফেললে বা কাশি দিলে, তার কোন না কোন সঙ্গী তা হাতে নিয়ে শরীরে মেখে ফেলে। আর যখন ই তিনি ওজু করেন, তার সঙ্গীরা তাকে ঘিরে রাখেন এবং প্রত্যেকে তার ব্যবহৃত ওজুর পানি সংগ্রহে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে কোন অপার্থিব লাভের আশায়। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়েছি তাদের চরিত্র আর উদ্দেশ্য বুঝার জন্য। আমি যা নিজ চোখে দেখেছি তার আলোকে আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি তোমরা যদি তাদের বিরুদ্ধে তরবারি সহকারে যুদ্ধ কর, তবে তারা তাদের সবকিছু উৎসর্গ করে দিবে মুহাম্মদের জন্য। তাকে রক্ষার্থে। কারণ তারা এমন ই দল যারা নিজের জীবনের বিন্দুমাত্র পরোয়া করেনা তাদের নেতার জীবন রক্ষার্থে। অতএব, (হে কোরায়েশরা), তাদের সাথে দৃঢ় সমঝোতা করে ফেল আর কোন দুর্বল সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে ভয় কর। হে লোকেরা, একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদের সাথে চুক্তি কর। আমি তোমাদের যে উপদেশ দেই তা গ্রহণ কর, কারণ আমি অবশ্যই তোমাদের প্রতি আন্তরিক। যদিও আমি ভয় করি যে, তোমরা কখন ই তাদের উপর বিজয়ী হতে পারবে না। ধরে নাও যে, সে (মুহাম্মদ) কাবা ঘরে এসেছে তওয়াফের জন্যই তথা ওই ঘরকে সন্মানিত করার জন্যই। সে (মুহাম্মদ) বলেছে যে তার সাথে পশু রয়েছে আল্লাহর নামে উৎসর্গের জন্যই।”

কিন্তু উড়ওয়ার কথা পরিত্যাগ করে কোরায়েশরা বলল, হে আবু রাফুর (উড়ওয়া), তুমি ছাড়া অন্য কেউ এসব কথা বললে আমরা অবশ্যই তার কথায় ভুল বের করতাম। কিন্তু না; আমরা তাদের (মুসলমানদের) এ বছর এ ঘরের তাওয়াফ থেকে বিরত রাখব, যদিও তারা আগামী বছর আসতে পারবে।”

==========

তথ্যসূত্র

[i] The Noble Life of the Prophet, Dr Ali Muhammad As-Sallaabee, Vol-3 pp. 1501 - 1506

বিষয়: বিবিধ

১২১৭ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

219958
১০ মে ২০১৪ রাত ০৮:৩৩
চোথাবাজ লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
219963
১০ মে ২০১৪ রাত ০৮:৩৯
দুষ্টু পোলা লিখেছেন : ভালো লাগলো অনেক ধন্যবাদ
220082
১১ মে ২০১৪ সকাল ০৮:১১
ইবনে হাসেম লিখেছেন : ইসলামের মহান শিক্ষার মাঝের হীরের টুকরোগুলোর এক ঝলক এই ঘটনার মাঝে দেখতে পেলাম। যা এতোদিন জানা ছিল না। এটা কি আমারই ব্যর্থতা? মহানবীর জীবনী বই তো বেশ কয়েকটাই পাঠ করেছি, সর্বশেষ আর রাহীকূল মাখতুম। অবশ্য এ বইটি সম্পূর্ণ করতে পারিনি।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File