নেতৃত্বের শ্রেষ্ঠ গুণ
লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ২০ এপ্রিল, ২০১৪, ০৯:৩৯:৫০ রাত
মাত্র একটি গুন আলোচিত হবে যা রাসুলুল্লাহ (স) সবচেয়ে কঠিনতম মুহূর্তে তার সঙ্গী-সাথীদের উপর প্রয়োগ করেছিলেন। এ গুনটি এমন ই ব্যাপক যে, মুসলিমরা (নেতার অবস্থানে) সকল সময় এবং অঞ্চলে যেকোন পরিস্থিতিতে তা ব্যবহার করতে পারেন নেতৃত্বের প্রয়োগিক অবস্থান থেকে।
গুণটি আল্লাহ প্রদত্ত একটি উপদেশ তথা নির্দেশ। বিশ্বনেতা রাসুলুল্লাহ (স) কে উদ্দেশ্য করে।
কোন পরিস্থিতিতে আল্লাহ মুসলিমদের নেতা রাসুলুল্লাহ (স) কে এই গুণটি শিক্ষা দেন তা আগে আলোচিত হবে।
প্রেক্ষাপটটি ছিল ওহুদের যুদ্ধ।
ওহুদের পাহাড় মুখোমুখি ছিল আইনাইনের পাহাড়। এটি মূলত একটি উঁচু টিলাবিশেষ- পাহাড় নয়। যুদ্ধের ময়দানে এসেই প্রখর দূরদৃষ্টি ও সূক্ষ্ম বুদ্ধিপ্রদিপ্ত মহানবী মুস্তাফা (স) পুরো অঞ্চল পর্যবেক্ষণ করে আইনাইনের পাহাড় কে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্পট হিসেবে নির্ণয় করেন। পঞ্চাশ জণের সুদক্ষ তীরন্দাজ মুজাহিদের একটি দলকে এই পাহাড়ের চুড়ায় নিয়োজিত করেন আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা) কে তাদের নেতা হিসেবে নিয়োগ দিয়ে। তিনি তাদেরকে স্পষ্ট নির্দেশ দেন - যুদ্ধক্ষেত্রে যাই ই ঘটুক না কেন - মুসলিমরা জিতুক বা হারুক - কোন অবস্থাতেই এই পাহাড়ের অবস্থান ছাড়া যাবে না।
তিনি বলেন, “এমনকি তোমরা যদি দেখ যে পাখি এসে আমাদের মৃতদেহ ভক্ষণ করছে - তোমাদের অবস্থান অবশ্যই পরিত্যাগ করবেনা যতক্ষণ না আমি কোন বার্তা পাঠাই।”
তিনি আর ও বলেন, “তাদের ঘোড়-সওয়ারিদের উপর অনবরত তীর ছুড়বে যাতে করে আমাদের পেছন দিকে থেকে শত্রুরা আমাদের উপর আক্রমণ করতে না পারে। এবং তোমাদের অবস্থানে তোমরা দৃঢ় থাকবে আমরা জিতি বা হারি দুই পর্যায়েই।”
কিন্তু যুদ্ধ শুরুর প্রথম পর্যায়েই যখন মুসলমানদের জয় হল তখন পরাজিত শত্রুদের পরিত্যক্ত সম্পত্তি দখলে মুসলিমরা এগিয়ে গেলে আইনাইন পাহাড় চুড়োয় অবস্থিত মুসলিম সৈন্যদের মাঝে ও এক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হল। মহানবী (স) এর কঠিন নির্দেশ উপেক্ষা করে ৩৫ জনের মত নেমে আসেন পাহাড় থেকে। দূর থেকে পর্যবেক্ষণরত খালিদ বিন ওয়ালিদ এই সুযোগেই ছিল। তার নেতৃত্বে কাফেররা ওই পাহাড় দখল করে নিল। এরপর মুসলমানদের চারিদিক থেকে ঘেরা ও করে আক্রমণ চালাল।
নেতার আদেশ না মানার এক ভুলে ৭০ জনের মত সাহাবা শাহাদাত বরন করলেন। নবিজী (স) এর চাচা হামজা (রা) শহীদ হলেন।
মাত্র কয়েক জনের ভুলে মহানবী (স) মারাত্মকভাবে আহত হলেন। মুখ মোবারক রক্তে ভরে উঠল।
কিন্তু তার পর ও ভুল করা সাহাবা দের সাথে বিশ্বনেতা মুহাম্মাদ (স) কি ব্যবহার করেছিলেন?
তারাতো নিজেরা ই জানেন যে তাদের ভুলের মাশুল হিসেবে ৭০ জন সাথী শহীদ হয়েছেন। মহানবী (স) স্বয়ং মারাত্মকভাবে জখম হয়েছেন। তাই তারা একই সাথে নিশ্চয়ই মারাত্মক অনুশোচনায়ও ছিলেন!
আর তখন ই আল্লাহ নাজিল করলেন নিম্নের আয়াতখানা। যা শুধুমাত্র নেতৃত্বের গুণ ই নয় - বরং সবচেয়ে কঠিন পরিস্থিতিতে অধস্তনদের সাথে আচরণের স্রস্টা বর্ণিত রূপরেখা।
( হে নবী!) “ এটা আল্লাহর বড়ই অনুগ্রহ যে, তোমার ব্যবহার তাদের প্রতি বড়ই কোমল৷ নয়তো যদি তুমি রুক্ষ স্বভাবের বা কঠোর চিত্ত হতে, তাহলে তারা সবাই তোমার চার পাশ থেকে সরে যেতো “৷ (ইমরানঃ ১৫৯ - প্রথম অংশ )
চিন্তা করুনঃ কোন পরিস্থিতিতে কি রকম আদেশ সম্বলিত আয়াত নাজিল হচ্ছে!
সাহাবারা ইসলামের সুশীতল পরশে এসেছিলেন ইসলামের আচরণ, আকর্ষণ তথা গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়েই। অথচ এই একটি গুণ তথা "রুক্ষ স্বভাবের বা কঠোর চিত্ত” তাদের তথা সকল কাল ও অঞ্চলের মুসলিম দের মাঝের সবচেয়ে উত্তম মানের মানুষদেরকেও ইসলাম থেকে চির-দুরে সরিয়ে নিবে - এটা আল্লাহর সতর্ক বানী রাসুলুল্লাহ (স) এর বরাবর।
যদি তাই ই হয়, তবে আমাদের কি রকম আচরণ করা উচিত অধস্তনদের প্রতি?
আর ইমরানঃ ১৫৯ আয়াতের দ্বিতীয় অংশে এর পর পর ই তিনটি নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
অধস্তন দের সাথে (শত ভুল করার পর ও ) কিভাবে নেতার আচরণ করতে হবে সে বিষয়ে।
আল্লাহ বলছেন
“ (১) তাদের ক্রটি ক্ষমা করে দাও৷”
অনেক সময় হতে পারে মৌখিকভাবে অপরাধী ইসলামী আন্দোলনের সাথীদের হয়ত ক্ষমা করে দিলাম - কিন্তু মন থেকে হয়ত ক্ষমা না ও করতে পারি। তাই এর পর পরই আল্লাহতায়ালা নির্দেশ দিচ্ছেনঃ
"(২) তাদের জন্য মাগফিরাতে দোয়া করো|”
লক্ষ্য করুনঃ আপনি নেতা হসেবে তখন ই তাদের জন্য মন থেকে নিভৃতে দোয়া করতে পারবেন যখন আসলেই মন থেকে তাদের ক্ষমা করতে পারবেন। সুবহানাল্লাহ!
এখানেই শেষ নয়। অপরাধী অধস্তনরা হয়ত অনুশোচনা গ্রস্ত থাকবে এর পর ও । তাই নেতার উচিত তাদেরকে শলা পরামর্শে অন্তর্ভুক্ত করা তাদের মাঝের সম্পর্ক স্বাভাবিক ও মজবুতির জন্যই। সর্বোপরি পরামর্শের জন্য তাদের কাছে টেনে নিলে তারা গুরুত্ব বোধ করবে। তাদের মনের কোনে লুক্কায়িত সকল অপরাধ- বোধকে ঝেড়ে ফেলে ভুলে যেতে সাহায্য করবে ইসলামী আন্দোলনে। অতীত ভুলে জীবনে সামনের দিকে তাদের এগুতে সাহায্য করবে। তাই আল্লাহ তায়ালা তৃতীয় স্তরে বলেছেনঃ
“ (৩) দীনের ব্যাপারে বিভিন্ন পরামর্শে তাদেরকে অন্তরভুক্ত করো৷”
ইসলামী আন্দোলনের নেতার এই গুণটি সবচেয়ে কঠিন অবস্থায় (যেমন ওহুদের প্রেক্ষাপট) যদি সবচেয়ে উত্তমভাবে প্রযোজ্য হয় তবে তা অবশ্যই যে কোন পরিস্থিতিতে সুন্দর ভাবেই প্রযোজ্য হবে।
এ গুণটি যুদ্ধ ছাড়া ও জীবনের সকল পর্যায়ে প্রযোজ্য।
যেমন, একজন পিতা সন্তানের কোন ভুলকে যদি উপরোক্ত তিনটি পয়েন্টে মূল্যায়ন করে সে অনুযায়ী আচরণ করেন তবে অবশ্যই সবচেয়ে ভাল ফলাফল আশা করা সম্ভব। একই ভাবে সকল পরিস্থিতিতে একজন নেতা তার অধস্তনদের উপর এ তিন ধাপে তার আচরণ করতে পারেন!
(নোটসঃ Mercy mission 2014 conference এর একটি আলোচনা অবলম্বনে লেখা)
বিষয়: বিবিধ
১৫৯৩ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
যাজাকাল্লাহু খাইরান।
ইসলাম প্রতিষ্ঠাব্যতীত অন্য কোন কিছু প্রতিষ্ঠায় বিভোর জনগোষ্ঠী ইসলামের জন্য অনেক ত্যাগ করলেও চারিত্রিক বিকাশে সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে না পারলে স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়।
ওহুদের সে ময়দানে অসংখ্যবার গিয়েছি। জাহেলিয়াত পুর্ব নেতাগুলো ইসলাম কবুল করে দুনিয়া ত্যাগের সর্বশ্রেষ্ট যে নমুনা পেশ করেছে তা আজ কিতাবে বন্দী। অনেকের বাস্তব চরিত্রের সাথে হযরত ওমর ও ভৃত্যুর ঘটনা মিলিয়ে দেখে হতাশ হই।
ধন্যবাদ। আজ এসব রক্তাক্ত ইতিহাসে থেকে শিক্ষা নেয়া বড় প্র্য়োজন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন