"জয় এবং পরাজয়ের সূত্র" মুলঃ ডঃ আলী মুহাম্মদ আস-সালাবী অনুবাদঃ মঞ্জুর আশরাফ
লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ১৪ এপ্রিল, ২০১৪, ১০:৩৮:০৭ সকাল
বদর এবং ওহুদ যুদ্ধ - উভয়ই সকল কাল ও অঞ্চলে মুসলিমদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রদান করে। বদর যুদ্ধ সুরা আনফালে এবং ওহুদের যুদ্ধ সুরা ইমরানে সবিস্তারে বর্ণিত হয়েছে। আল্লাহর বানী সঠিকভাবে বুঝার জন্য, জীবন এবং মৃত্যু সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিকোণ আনায়নের জন্য, জয় এবং পরাজয়ের সূত্র উপলব্ধির জন্য, জয় এবং পরাজয়ের মূল্যবোধ বিচারের জন্য, ঈমান এবং মুনাফেকীর পরিষ্কার পার্থক্য বুঝার জন্য - ওই দুই যুদ্ধে যেসব ঘটনা সংঘটিত হয় তাতে ঈমানদারদের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিহিত রয়েছে। যেহেতু ওই দুই সুরায় জয় এবং পরাজয়ের কার্যকারণ বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে, নিম্নে মুল বিষয়গুলোকে উল্লেখ করা হল কেবল যা সকল সময় ও অঞ্চলে আল্লাহর পথে প্রাণান্ত প্রচেষ্টারত মুসলিমদের জন্য এক নির্দেশনা-স্বরূপঃ
(১) বিজয়, শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সবসময়ই পুরোপুরি আল্লাহতায়ালার হাতে। কোন মানুষ, কোন সৃষ্টির পক্ষে বিজয় অর্জন করা অসম্ভব আল্লাহতায়ালার অনুমতি ব্যতিরেকে। প্রত্যেক জীবের জীবিকার (রিযক) সংস্থান, জীবন-মরণ এর ভাগ্য নির্ধারণ এবং সংঘটন মহাশক্তিমান আল্লাহতায়ালা অসীম জ্ঞান ও শক্তিমত্তা অনুসারে নিষ্পন্ন করে থাকেনঃ
“একথা আল্লাহ তোমাদের শুধুমাত্র এ জন্য জানিয়ে দিলেন যাতে তোমরা সুখবর পাও এবং তোমাদের হৃদয় নিশ্চিন্ততা অনুভব করে৷ নয়তো সাহায্য যখনই আসে আল্লাহর পক্ষ থেকেই আসে৷ অবশ্যই আল্লাহ মহাপরাক্রমশীল ও মহাজ্ঞানী৷”
(আনফালঃ ১০)
(২) আল্লাহতায়ালা যখন কোন জনপদের জন্য বিজয় নির্ধারণ করেন, তখন সৃষ্টি জগতের সকল শক্তি মিলেও ওই বিজয়কে থামাতে সক্ষম হয়না। পক্ষান্তরে আল্লাহতায়ালা যখন কোন জনপদের জন্য পরাজয় লিখে দেন, কোন সম্মিলিত (সামরিক) শক্তি ও তা থামাতে ব্যর্থ হয়ঃ
"আল্লাহ যদি তোমাদের সাহায্য করেন তাহলে কোন শক্তি তোমাদের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে পারবে না৷ আর যদি তিনি তোমাদের পরিত্যাগ করেন, তাহলে এরপর কে আছেন তোমাদের সাহায্য করার মতো ? কাজেই সাচ্চা মুমিনদের আল্লাহর ওপরই ভরসা করা উচিত ৷ “
(ইমরান ১৬০)
(৩) হ্যাঁ, আমরা এটা অবশ্যই বিশ্বাস করব যে, বিজয় একমাত্র আল্লাহতায়ালার নির্দেশেই সংঘটিত হয়। একইসাথে এ কথাও বুঝতে হবে যে, আল্লাহতায়াল কোন কারন ছাড়াই কাউকে বিজয়ী করেননা। বরং এর পেছনে স্রস্টার প্রজ্ঞা জড়িত। অতএব, একটি পদ্ধতি এবংএর অন্তর্গত কিছু সূত্র রয়েছে যা যেকোনো বিজয়ের কার্যকারণ রূপে ক্রিয়াশীল।
এর একটি সূত্র হলঃ মুসলিমরা অবশ্যই কাজ করবে এবং আল্লাহর পথে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাবে - যার অর্থই হচ্ছে ইসলাম - যদি তারা ‘বিজয়' অর্জনের মাধ্যমে পুরস্কৃত হতে চায়ঃ
"হে ঈমান গ্রহণকারীগণ, তোমরা আল্লাহকে সাহায্য করো তাহলে আল্লাহও তোমাদেরকে সাহায্য করবেন এবং তোমাদের পা সুদৃঢ় করে দিবেন৷” (মুহম্মদ ৭)
আল্লাহতায়ালার নিকট হতে বিজয় আসে - এর অর্থ এই নয় যে, আমরা বিজয় অর্জনের জন্য কিছুই করব না। অন্যদিকে আল্লাহতায়ালা তখনই আমাদের বিজয়ী করবেন যখন আমরা তাকে পুরোপুরিভাবে মানব, তার জীবন-বিধান সঠিক পন্থায় আঁকড়ে ধরব, এবং তার পথে প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চালাব।
(৪) আরেকটি মৌলিক সূত্র হলঃ বিজয় তখন ই আসবে যখন আমরা (মুসলিমরা) ঐক্যবদ্ধ থাকব/হব। বিজয় তাদের উপর আসবে না যারা ঐক্যবদ্ধ নয়, যারা পারস্পরিক দ্বন্দ্বে সবসময়ই জড়িতঃ
"আর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করো না, তাহলে তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেবে এবং তোমাদের প্রতিপত্তির দিন শেষ হয়ে যাবে৷ সবরের পথ অবলম্বন করো, অবশ্যি আল্লাহ সবরকারীদের সাথে রয়েছেন৷ “
(আনফালঃ ৪৬)
(৫) আরেকটি সূত্র হলঃ বিজয় অর্জনের জন্য মুসলিমরা অবশ্যই আল্লাহর আদেশ- নিষেধের প্রতি অনুগত হবে, রাসুলুল্লাহ (স) এর প্রতিও আনুগত্যশীল হবে। পক্ষান্তরে, আল্লাহ এবং তার রাসুলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করা অবশ্যই পরাজয় এবং ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়ঃ
"আর আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য করো এবং নিজেদের মধ্যে বিবাদ করো না, তাহলে তোমাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দেবে এবং তোমাদের প্রতিপত্তির দিন শেষ হয়ে যাবে৷ সবরের পথ অবলম্বন করো, অবশ্যি আল্লাহ সবরকারীদের সাথে রয়েছেন৷ “
(আনফালঃ ৪৬)
(৬) পরকালের পরিবর্তে এ পৃথিবীর প্রতি মোহ-ভালবাসা যখন মুসলমানদের হৃদয়-গভীরে প্রবেশ করে এবং তার প্রত্যেক কাজকে নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে, তখন মুসলমানেরা আল্লাহতায়ালার সাহায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হনঃ
"আল্লাহ তোমাদের কাছে ( সাহায্য ও সমর্থনদানের ) যে ওয়াদা করেছিলেন, তা পূর্ণ করেছেন৷ শুরুতে তাঁর হুকুমে তোমরাই তাদেরকে হত্যা করেছিলে৷ কিন্তু যখন তোমরা দুর্বলতা দেখালে এবং নিজেদের কাজে পারস্পারিক মতবিরোধে লিপ্ত হলে আর যখনই আল্লাহ তোমাদের সেই জিনিস দেখালেন যার ভালোবাসায় তোমরা বাঁধা ছিলে ( অর্থাৎ গনীমাতের মাল), তোমরা নিজেদের নেতার হুকুম অমান্য করে বসলে, কারণ তোমাদের কিছু লোক ছিল দুনিয়ার প্রত্যাশী আর কিছু লোকের কাম্য ছিল আখেরাত, তখনই আল্লাহ কাফরদের মোকাবিলায় তোমাদেরকে পিছিয়ে দিলেন, তোমাদেরকে পরীক্ষা করার জন্য৷ তবে যথার্থই আল্লাহ এরপরও তোমাদের মাফ করে দিয়েছেন ৷ কারণ মুমিনদের প্রতি আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহের দৃষ্টি রাখেন৷”
(ইমরান ১৫২)
(৭) শত্রুর থেকে সংখ্যায় কম হওয়া, কিংবা অস্ত্র-রসদের দিক থেকে পিছিয়ে থাকা - আমি আবারো গুরুত্ব সহ উল্লেখ করছি - যে পরাজয়ের কোন কারণই নয়ঃ
“এবং আল্লাহ তায়ালা তোমাদের বদরে বিজয়ী করেছেন যখন তোমরা অনেক দুর্বল ছিলে৷ কাজেই আল্লাহকেই ভয় কর, আশা করা যায় এবার তোমরা শোকর গুজার হবে ৷”
(ইমরানঃ ১২৩)
(৮) যদিও অস্ত্র-রসদে পিছিয়ে থাকা পরাজয়ের কোন কারণই নয়, তথাপি মুসলিমদের ঐশী নির্দেশের সঠিক বুঝের সাথে সাথে, সদা-প্রস্তুত এবং উত্তমরূপে অস্ত্র-রসদে সজ্জিত সেনাবাহিনী তৈরি রাখা একান্ত কর্তব্যঃ
"আর তোমরা নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী সর্বাধিক পরিমাণ শক্তি ও সদাপ্রস্তুত ঘোড়া তাদের মোকাবিলার জন্য যোগাড় করে রাখো৷ এর মাধ্যমে তোমরা ভীতসন্ত্রস্ত করবে আল্লাহর শত্রুকে , নিজের শত্রুকে এবং অন্য এমন সব শত্রুকে যাদেরকে তোমরা চিন না৷ কিন্তু আল্লাহ চেনেন৷ আল্লাহর পথে তোমরা যা কিছু খরচ করবে তার পূর্ণ প্রতিদান তোমাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হবে, এবং তোমাদের প্রতি কখনো জুলুম করা হবে না। “
(আনফালঃ ৬০)
(৯) “যুদ্ধক্ষেত্রে দৃঢ়চেতা থাকা” এবং সে সময় “ধৈর্যের সাথে সকল দুঃখ-কষ্টকে মোকাবেলা করা” এমন দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা সফলতা এবং বিজয়ের দিকে ধাবিত করেঃ
"হে ঈমানদারগণ! যখন কোন দলের সাথে তোমাদের মোকাবিলা হয়, তোমরা দৃঢ়পদ থাকো এবং আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো বেশী বেশী করে৷ আশা করা যায়, এতে তোমরা সাফল্য অর্জন করবে৷ “
(আনফালঃ ৪৫)
অন্যত্র আল্লাহতায়ালা বলেনঃ
"হে ঈমানদারগণ! যখন তোমরা একটি সেনাবাহিনীর আকারে কাফেরদের মুখোমুখি হও তখন তাদের মোকাবিলায় পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো না৷"
(আনফালঃ ১৫)
(১০) যুদ্ধক্ষেত্রে “দৃঢ়চেতা থাকা” এবং “ধৈর্যের সাথে শত্রু মোকাবেলা করা” এই দুটি গুন অর্জনের জন্য একমাত্র যে বিষয়টি মুসলিমদের সাহায্য করতে পারে তা হলঃ “আল্লাহতায়ালার প্রতি একান্ত স্মরণ বা জিকির”। আর কিছু নয়। এ জীবনের সকল বিষয় থেকে শুরু করে যুদ্ধক্ষেত্র পর্যন্ত, একজন মুসলিম নিবিড় ভাবে একমাত্র মহা শক্তিধর অভিভাবক আল্লাহতায়ালারই সাহায্য কামনা করবে, তার উপর ই পূর্ণ আস্থা রাখবে বিজয়ের ব্যাপারে - সৈন্য সংখ্যা বা অস্ত্রের উপর নয়। সে অবশ্যই মানুষের দুর্বলতাকে খেয়াল রাখবে (বা বুঝার চেষ্টা করবে) এবং পূর্ণ আস্থার সাথে এ বিশ্বাস রাখবে যে, "আল্লাহতায়ালা ব্যতীত কোন শক্তি বা সহায় নেই”। যখন পুরো মুসলিমদের দলটি এই একই বিশ্বাসে বলীয়ান হবে, কেবল তখনই আল্লাহর সাহায্য অতি শীঘ্র তাদের উপর আসবেঃ
"হে ঈমানদারগণ! যখন কোন দলের সাথে তোমাদের মোকাবিলা হয়, তোমরা দৃঢ়পদ থাকো এবং আল্লাহকে স্মরণ করতে থাকো বেশী বেশী করে৷ আশা করা যায়, এতে তোমরা সাফল্য অর্জন করবে৷ “
(আনফালঃ ৪৫)
বিষয়: বিবিধ
১১৩৪ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন