সত্য ঘটনা অবলম্বনে (১৯): উপমহাদেশের শহীদ-নামা (১) - সাইয়েদ আহমেদ, তিতুমীর ও আব্দুল কাদের মোল্লা
লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ১৪ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৬:২৪:৩২ সন্ধ্যা
:: এক ::
১৮২২ সাল।
হজ্জের মৌসুম। তাওয়াফ শেষে আমি একটু বসে আছি। মহান করুনাময়ের স্মরণ করছি। হে আল্লাহ, আমার দেশের মানুষদের রক্ষা করুন। শিরক আর বিদায়াতের অন্ধকার থেকে তাদের হেদায়াত করুন। আপনার সৈন্যদের শক্তি দিন। ধর্ম রক্ষার আন্দোলনে তাদের বলিয়ান করে দিন। সেই সাথে ইংরেজ বেনিয়াদের বিরুদ্ধে তীব্র সংগ্রামে আমাদের সাহায্য করুন।'
'আসসালামু আলাইকুম হুজুর।' কে ডাকল আমায়?
'ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আপনার পরিচয়?'
আমি মীর নিসার আলী (তিতুমীর)। আমি বাংলার চাদপুর থেকে এসেছি। আমার বড়ই সৌভাগ্য আমি যে মক্কায় হুজুর সাইয়েদ আহমেদ বেরলভির সাথে মিলিত হতে পারব।'
**
দুই সংগ্রামী যুগ্জয়ী পুরুষ পবিত্র ভূমিতে কথা বলছেন।
দুজনের একটি ই উদ্দেশ্য। ইংরেজদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং মানুষের মুক্তি। একজনের খায়েশ সীমান্ত প্রদেশে ইসলামী হুকুমাত প্রতিষ্ঠা। আরেকজন মীর নিসার আলীর (তিতুমীর) স্বপ্ন হিন্দুদের সাথে সু-সম্পর্কের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধভাবে বেনিয়া ইংরেজদের বিরুদ্ধে বাংলার বুকে তীব্র সংগ্রাম গড়ে তোলা।
দুই শহীদ কথা বলছেন। যারা এই উপমহাদেশে ইসলামী আন্দোলনের দুই পুরোধা। মহান করুনাময় তাদের জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন।
**
মীর নিসার আলী (তিতুমীর): 'আমাকে আপনার শিষ্য করে নিন হুজুর।'
সাইয়েদ আহমেদ বেরলভি: 'আমি তো সামান্য লোক। তবে আমি বুঝি আমাদের অনেক কাজ করতে হবে। দেশের মানুষকে বাচাতে হবে। ধর্মীয় অন্ধকার আর ইংরেজদের শোষণ থেকে।'
মীর নিসার আলী (তিতুমীর): বাংলায় ইংরেজ দের পাশাপাশি হিন্দু রাজারা ও দালালরা অতি উত্সাহী হয়ে আমাদের অত্যাচার করছে। ইংরেজরা পিছন থেকে পুতুল নাচাচ্ছে। তাদের পুতুলেরা একটার পর একটা বাধা তৈরী করছে। আমাদের অতিরিক্ত টাক্স ধার্য করেছে। আমার দলের সংগ্রামী লোকদের তো একেবারে বয়কটের ঘোষণা দিয়েছে।আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছি হিন্দু - মুসলিমের ভেদাভেদ ভেঙ্গে ফেলে এক হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে দাড়াতে। ওই উদ্দেশে আমি হিন্দু রাজাদের সব অন্যায় মুখ বুঝে সহ্য করছি।'
সাইয়েদ আহমেদ বেরলভি: আল্লাহ আপনার উদ্দেশ্য সফল করুন। আপনাকে দুই জগতের বিজয়ী করুন।
**
এরও আগে ১৮ শতকের অন্যতম আলেম ও সাধক শাহ ওয়ালিউল্লাহ (র) ভারতের বুকে ইসলামী আন্দোলনের বীজ বপন করেন। ইংরেজ তাড়ানো ছিল টার্গেট। তার অন্যতম ছাত্র ও সংগঠক সাইয়েদ আহমদ বেরেলী (রা) সেই টার্গেট পুরনে ঝাপিয়ে পড়েন অসাধারণ কর্ম দক্ষতায়।
জীবনের শুরুতে যোগ দেন এক সামন্ত প্রভুর সৈন্য বাহিনীতে। উদ্দেশ্য যুদ্ধে পারদর্শিতা অর্জন। জিন্তু সেই সামন্তপ্রভু ইংরেজদের দালালি শুরু করলে তিনি চলে আসেন ঘৃনা ভরে।
এরপর সময় যায়। অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ জেগে উঠে ভারতে।
৬ই মে, ১৮৩১ সাল।
বালাকোট প্রান্তর।
এটাকে কি যুদ্ধ বলা যাবে?
একদিকে আমার ৯০০ ভগ্ন হৃদয়ের দুস্থ, ক্লান্ত সৈন্য। রসদ পাইনি কোথাও। সাহায্য পাইনি কোথাও। মুসলমানেরাই আমাদের 'ওহাবী' বলে গালি দিয়ে না বুঝে দুরে সরিয়ে দিয়েছে। দালাল হিন্দু রাজাদের কথা বাদ ই দিলাম। অন্যদিকে ইংরেজদের ২০০০০ আধুনিক সমর্রাস্ত্রে সজ্জিত সৈন্য।
'ভাইসব, আপনারা জীবন ও মরণ আল্লাহর জন্য সমর্পণ করেছেন বিধায় আজ এখানে এসেছেন। সামান্য সহায় থাকার পর ও কেবল ঈমানের দাবিতে ই জেহাদের ডাকে ময়দানে এসেছেন।
প্রিয় ভাইসব, শত্রুপক্ষ পাহাড় থেকে নিচে না নামা পর্যন্ত বা আক্রমন শুরু না করা পর্যন্ত আপনারা অস্ত্র ধরবেন না।'
সাইয়েদ চেরাগ আলী মুজাহিদদের জন্য রান্না করছিলেন। আর শত্রুদের দিকে লক্ষ্য রাখছিলেন।
হটাত তার কি হল?
সে চিত্কার করছে কেন?
সে কি পাগল হয়ে গেল?
সে কেন বলছে?: ' ভাইসব, আকাশ থেকে লাল পোশাক পরে ফেরেশতারা নেমে আসছে। আপনারা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ুন।'
এ বলে কার ও সাথে কোন পরামর্শ না করে সে অস্ত্র তুলে নিল কেন?
সে দৌড়ে শত্রুর দিকে এগুচ্ছে কেন?
শত্রুরা কি গুলি শুরু করল? সে কি লুটিয়ে পড়ল?
বালাকোটের প্রথম শহীদ হলেন সাইয়েদ চেরাগ আলী।
আমি কি এখন যুদ্ধের পূর্ণ নির্দেশ দিব না? আমার কি আর অন্য কোন উপায় আছে?
'ভাইসব শত্রুর উপর আল্লাহর নামে ঝাপিয়ে পড়ুন। আল্লাহু আকবার।'
যুদ্ধ শুরু হল। অসম যুদ্ধ। মুজাহিদরা লুটিয়ে পড়ছে। আহারে, আমি আর কি করতে পারতাম? এ ছাড়া আর কি করার ছিল? আল্লাহর জমিনে আল্লাহর হুকুমাত প্রতিষ্ঠায় যে জীবন পন করেছি। তার প্রমান দিতে হবে যে।
'হে পরম দয়ালু, আমাদের ক্ষমা করুন।'
আমি কি অবশ হয়ে যাচ্ছি?
এত শান্তি লাগছে কেন?
আমি কি লাল পোশাকের ফেরেশতা দেখছি আমার চার পাশে।
আল্লাহু আকবার।
হে পরম বন্ধু। তুমি ছাড়া আর কোন প্রভু নাই। মুহাম্মদ (স) তোমার প্রেরিত রাসুল।
**
ঐতিহাসিক লাহিড়ি বলছেন, "এ ছিল মৃত্যু অভিসারীদের বাহ্নিবন্যার মুক্তিস্নান। দুর্দম বেগে তারা ঝাপিয়ে পড়লেন 'জীবন মৃত্যু মিশেছে যেথায় মত্ত ফেনিল স্রোত'। শাহাদাত বরণ করলেন সঙ্গী সহ সৈয়েদ আহমাদ বেরেলভী ও শাহ ইসমাইল।" (সূত্র: ওহাবী আন্দোলন: পৃ-১৯৫)
১৮৩১ সালে সৈয়েদ আহমাদ বেরেলভী শহীদ হলেও তার সংগঠন ও আন্দোলন কিন্তু শেষ হয়নি। বরং সিপাহী বিদ্রোহ এবং ১৯৪৭ সালের পূর্ব পর্যন্ত যারা ইংরেজদের সাথে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন তার প্রতিটি আন্দোলন আহমাদ সাহেবের বপনকৃত বীজের সফল বৃক্ষ বলা যায়। (সূত্র: চেপে রাখা ইতিহাস; গোলাম মোর্তাজা- পৃ: ১৭৯)
রতন লাহিড়ি তার 'ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সত্যিকারের ইতিহাস' গ্রন্থে লিখেছেন, 'যার জীবন স্মৃতি প্রেরণা যুগিয়েছিল যুগে যুগে এ দেশের মহাবিপ্ল্বিদের। যার জীবনাদর্শ, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আওতার বাইরে থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আক্রমন করা, স্বাধীন সরকার গঠন করা, আবার সে সাথে সাথে দেশের মধ্যে থেকে ও সাম্রাজ্যবাদকে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করা, ইত্যাদি পথ দেখিয়েছিল পরবর্তীকালের মহেন্দ্রপ্রতাপ, বর্কতুল্লা, এমন এন, রায় রাসবিহারী এমনকি নেতাজিকেও। কে এ মহাবিপ্লবী, যার আদর্শে উদ্বোধিত হয়ে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ দিয়েছিল ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রহে - শত হাজার মানুষ বরণ করেছিল দ্বীপান্তর, সশ্রম কারাদন্ড, কঠোর যন্ত্রনায় মৃত্যু। কে ইনি? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আর তার দালালদের লেখা ইতিহাসে এর নামোল্লেখ থাকলে ও এর সম্বন্ধে বিশেষ কিছু লেখাথাকা স্বাভাবিক ও নয়। আর আজ ও স্কুল-কলেজে যে ইতিহাস পড়ান হয়, সে সব এ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রাচীন গলিত বিকৃত ইতিহাসের আধুনিক সংস্করণ মাত্র। তাই কি করে জানবে এ মহাপুরুষের নাম? এ মহান মহাবিপ্লবী মহাবিদ্রহির নাম হজরত মাওলানা সাইয়েদ আহমদ বেরলভী।" (পৃ: ৭-৯)
:: দুই::
মীর নিসার আলীর আন্দোলনের ক্ষেত্র ছিল অবিভক্ত বাংলায়। তিনি ছিলেন কোরানের হাফেজ। ছোটবেলা থেকে ই মানুষকে কোরআনের দাওয়াত দিতেন। যৌবনে তার প্রচেস্টা চলে প্রথমত: মুসলমানদের অধার্মিক জীবন ও আচরণ থেকে পুনরুদ্ধারে। দ্বিতীয়ত, হিন্দু রাজাদের অত্যাচার থেকে মুসলিম-হিন্দু সবাইকে বাচাতে। তৃতীয়ত, সমগ্র ভারত থেকে ইংরেজদের তাড়াতে।
মীর নিসার আলী (তিতুমীর) ছিলেন একজন অনলবর্ষী বক্তা। এছাড়া শিষ্যদের সশস্ত্র ট্রেনিং নিজেই দিতেন। হিন্দু মুসলিম সবার দুখেই তিনি ছিলেন নিবেদিত প্রাণ।
ইংরেজদের দালাল হিন্দু জমিদারেরা মীর নিসার আলী র দলবলের বিরুদ্ধে নিন্মোক্ত আদেশ জারি করল:
(১) যারা মীর নিসার আলীর দলবলে যুক্ত হয়ে দাড়ি রাখবে এবং গোফ ছাটবে, তারা প্রতি দাড়ির উপর আড়াই টাকা এবং প্রতি গোফের উপর্পাচ সিকা খাজনা দিবে।
(২) মসজিদ তৈরী করলে প্রতি কাচা মসজিদে ৫০০ টাকা এবং পাকা মসজিদে ১০০০ টাকা নজরানা দিতে হবে।
(৩) সন্তানের নাম ওহাবী মতে (!) আরবিতে রাখলে ৫০ টাকা জরিমানা দিতে হবে।
(৪) গো-হত্যা করলে হত্যাকারীর দান হাত কেটে দিতে হবে।
(৫) যে ব্যক্তি সংগ্রামী নিসার আলীকে তার বাড়িতে আশ্রয় দিবে, তাকে ভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হবে।
মীর নিসার আলীর যে প্রস্তুতি ছিল তাতে তিনি আক্রমন করতে পারতেন। কিন্তু তার উদ্দেশ্য ছিল হিন্দু-মুসলমানে লড়াই নয়। বরং লড়াই হবে যৌথভাবে হিন্দু ও মুসলমান মিলে ইংরেজদের সাথে।
ঠান্ডা মাথায় তিনি জমিদারকে চিঠি লিখলেন:
"জনাব বাবু কৃষ্ণদেব রায়, আমি আপনার প্রজা না হলেও আপনার স্বদেশবাসী। আমি জানতে পারলাম যে, আপনি আমার প্রতি অসন্তুস্ট হয়েছেন। আমাকে 'ওহাবী' বলে গালি দিচ্ছেন। আমি আপনার কোন ক্ষতি করি নাই। যদি কেউ আমার বিরুদ্ধে আপনার নিকট কিছু বলে আপনাকে উত্তেজিত করে থাকে তবে আপনার উচিত ছিল সত্য অনুসন্ধান করে হুকুম জারি করা। আমি দ্বীন ইসলাম প্রচার করছি। এতে আপনার অসন্তোষের কি কারণ থাকতে পারে? যার ধর্ম সেই বুঝে। আপনি ইসলাম ধর্মের উপর হস্তক্ষেপ করবেন না। ওহাবী ধর্ম বলে কোন ধর্ম নাই। আল্লাহর মন:পুত ধর্ম ই হল ইসলাম। ইসলামের অর্থ হচ্ছে শান্তি। ইসলামী ধরনের নাম রাখা, দাড়ি রাখা, গোফ ছাটা, ঈদুল আজহার কোরবানি করা ও আকিকাতে কোরবানি করা মুসলমানদের উপর আল্লাহর ও রাসুলের আদেশ। মসজিদ প্রস্তুত করে আল্লাহর উপাসনা করা ও আল্লাহর হুকুম। আপনি ইসলাম ধর্মের আদেশ, নিষেধ এর উপর হস্তক্ষেপ করবেন না। আমি আশা করি আপনি আপনার হুকুম প্রত্যাহার করবেন।"
(সূত্র: অমলেন্দু দে, শহীদ তিতুমীর: পৃ-৫০-৫১)
এই চিঠি দিয়ে তিতুমীর তার শিষ্য আমিনুল্লাহ্কে পাঠালেন পুড়ার জমিদারবাড়ি। কৃষ্ণ দেব চিঠি পরেই আমিনুল্লাহ্কে অন্যায়ভাবে আটক করে, সীমাহীন প্রহার করে অবশেষে হত্যা করে। এ সংবাদ তিতুমীরের কাছে পৌছলে অশ্রু-সংবরণ করতে পারলেন না। বললেন, 'আমার আজাদী আন্দোলনের প্রথম শহীদ আমিনুল্লাহ্'।
অন্যদিকে ইংরেজদের চক্রান্তে বড় বড় হিন্দু জমিদারদের একসাথে মিটিং হয় কলকাতায়। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে, ইংরেজ পাদ্রী, নীলকর, সমস্ত জমিদার কৃষ্ণ দেবকে সব রকম সহায়তা করবে। কিভাবে তিতুমিরকে জড়িয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা তৈরী করা যায় সে ভয়ঙ্কর পদক্ষেপ নিতে হবে!
সেই উদ্দেশে মুসলমানদের থেকে কর আদায়ে অত্যাচার শুরু হল। মুসলমানদের অনেকে ই জরিমানা দিল, গ্রাম ত্যগ করল। তিতুমীর কিন্তু তবুও হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যই সন্ধান করছিলেন। তিনি মোটেই চাচ্ছিলেন না যে লড়াই হিন্দু মুসলমানে হোক; বরং চাচ্ছিলেন মুসলমান - ইংরেজ যেন যুদ্ধ হয় এবং হিন্দু জনসাধারণ এতে অন্তত নিরপেক্ষ থাকুক।
সর্ফরাজ্পুরে কৃষ্ণদেবের জরিমানা সংগ্রহ শুরু হলে তিতুমীরের লোকেরা বাধা হিল। কিন্তু বাধা অগ্রাহ্য করে লাঠিওয়ালারা মসজিদ এবং গ্রামে আগুন দেয়া শুরু করল।
এর পর ও তিতুমীর ধৈর্য ধরেন এবং কোর্টে মামলা করেন।
বারাসাত কোর্টে এত বড় নরহত্যা, মসজিদ পুড়ানো এবং গ্রামকে শ্মশানে পরিনত করার মামলা খারিজ (বাতিল) হয়ে যায়!
এরপর কলকাতায় এই মামলা দায়ের করলে সেখানে ও তা খারিজ হয়ে যায়।
তিতুমীর বুঝলেন, 'সুবিচার চাইলে এদের কাছে অবিচার ই প্রাপ্য'।
**
অবশেষে নারিকেলবারিয়ায় তৈরী করলেন বাশের কেল্লা। তিতুমীরের বাশের কেল্লা। আহারে, কত বেদনার ক্ষত আর অত্যাচারের নিরিখে ই না তৈরী এই কেল্লা।
সত্যের কেল্লা।
সাহসের কেল্লা।
শোষিতের কেল্লা।
নারায়ে তাকবির আল্লাহু আকবার বলে সকলে পন করলেন আজাদী আন্দোলনে শাহাদাতের। তিতুমীর আদেশ দিলেন কৃষ্ণদেব বাবুর গ্রাম পুড়া আক্রমনের। আমিনুল্লাহের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার বাসনা। জমিদারের সেনাবাহিনী, নীলকরের কর্মচারী, পাদ্রীদের দলবল সহ সবাই ব্যর্থ হলেন এসের রুখতে। সেনাপতি মাসুমের দক্ষতায় সবাই মুগ্ধ। ইংরেজরাও স্তম্ভিত।
**
এরপর তিতুমীর ঘোষনা দিলেন, "আজ থেকে ইংরেজদের সাথে সর্বত অসহযোগ করতে হবে।" একদল ইংরেজ সৈন্য মাসুমের সৈন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে আসে। কিন্তু ইংরেজরা এতে পরাজিত হয় এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করে।
এরপর ইংরেজরা সুদক্ষ সেনাপতির অধীনে একদল সৈন্য আর উচ্চ শ্রেনীর কামান পাঠায়। উদ্দেশ্য বাশের কেল্লার পতন।
তিতুমীর মুজাহিদদের বললেন, 'আমাদের কামান নেই। হয়ত মৃত্যু হতে পারে। যাদের ইচ্ছা যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে চলে যেতে পারেন।'
একজনকেও পাওয়া গেল না যে চলে যেতে ইচ্ছুক। এরা যে মৃত্যু জয়ী মুজাহিদ। শোষিত দেশবাসীর কান্নায় এরা প্রতিবাদী, প্রতিরোধী। স্রষ্টার কাছে সপেছে জীবন।
**
যুদ্ধ শুরু হল।
আমি বাশের কেল্লায় আছি।
আমার সৈন্যরা ঝাপিয়ে পড়ল ইংরেজদের উপর।
কিন্তু কামান গর্জে উঠল।
আমাদের সৈন্যরা কি পড়ে যাচ্ছে। হে আল্লাহ আমাদের সহায় হও।
মাসুম কি কামান পরিচালককে হত্যার জন্য মরিয়া হয়ে পড়েছে?
কিন্তু মাসুম কি ব্যর্থ হল? সে কি গ্রেফতার হল?
আমি কি বাকি দলবল নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ব না? অস্তাচলে কি স্বাধীনতার লাল সূর্য? আহারে।
হে করুনার আধার আমাদের ক্ষমা করে দাও।
**
কামান গর্জে উঠল।
তিতুমীরের বাশের কেল্লা ধ্বংস হল। দেশের মাটিতে রাঙ্গা রক্ত ঢেলে দিলেন শহীদ তিতুমীর ও তার মুজাহিদ সঙ্গীরা।
অবিভক্ত বাংলার বিপ্লবী বীরেরা সেদিন শহীদ হলেন বেনিয়া ইংরাজ, দেশীয় দালাল ও পাদ্রীদের প্রত্যক্ষ আক্রমনে।
**
সেনাপতি মাসুমকে ফাসি দেয়া হল। অন্যান্য সৈন্যদের বিচারের নামে জাহাজ ভর্তি করে ভারত থেকে দুরে পাঠিয়ে দিল যাবজ্জীবন কারাদন্ডে। আহতদের হাসপাতালে নেয়ার নাম করে নদীতে নিক্ষেপ করে হত্যা করা হল।
**
কবি বলেন,
"শাহ জালালের পুন্যভূমি শাহ মাখ্দুমের বাংলাদেশ
আমাদের অহংকারের গরবের বাংলাদেশ
এখানে শহীদ তিতু বাসের কেল্লা গড়ে
ঈমানী অস্ত্র দিয়ে খোদার পথে লড়ে
জান দিব তো মান দিব না, মুক্ত স্বাধীন রাখব দেশ
আমাদের অহংকারের গরবের বাংলাদেশ।"
:: তিন ::
তিনি ফাসির মঞ্চের দিকে হাসি মুখে যাচ্ছেন। একজন নিরপরাধ মানুষকে সরকার হত্যা করছে। ২০১৩ সালের ঢাকা জেলখানা।
মানুষটিকে বাচানোর জন্য সারা দেশ জ্বলছে।
মানুষটি তার জবানবন্দিতে বলেছিলেন,
"আমাদের প্রাকটিক্যাল পরীক্ষার তারিখ পড়েছিল সম্ভবত ১২/১৩ মার্চ, ১৯৭১। কিন্তু ঐতিহাসিক ৭ মার্চে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক চুড়ান্ত অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়ার কারণে উল্লেখিত তারিখের পরীক্ষা স্থগিত হয়ে যায়। তখন আমরা জিজ্ঞেস করি যে পরীক্ষা কবে হবে। তখন তিনি বলেন দেশের যে পরিস্থিতি তাকে পরীক্ষা নেয়া সম্ভব নয়। আরো বললেন, তোমরা হলে থাক আমি তোমাদের অচিরেই আমার সিদ্ধান্ত জানাব। আমরা যারা হলে ছিলাম তারা বিভাগীয় চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্ত দেওয়ার পূর্বে আমরা নিজেরাই আবারো তার সঙ্গে দেখা করি। এই পরিস্থিতিতে তিনি আমাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ঢাকায় যাদের থাকার ব্যবস্থা আছে তাদেরকে নিজ নিজ বাসায় চলে যাবার পরামর্শ দিলেন। আর যাদের ঢাকায় বাড়িঘর নেই তাদেরকে তাদের গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে বললেন। যাবার আগে ডিপার্টমেন্টের অফিসে প্রত্যেকের ডাক এবং টেলিগ্রাম ঠিকানা দিয়ে যাবার জন্য নির্দেশ দিলেন।
এরপর ১১/১২ মার্চ, ১৯৭১ আমি আমার নিজ গ্রামের বাড়ি আমিরাবদ চলে যাই। সেখানে যাবার পর প্রতিদিনই বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজে পড়–য়া ছাত্ররা যারা বাড়িতে চলে এসেছে তারা এবং স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক এবং বিভিন্ন কলেজের শিক্ষকগণ আমরা একত্রে আমিরাবাদ হাইস্কুলের মাঠে বসতাম এবং রেডিওতে প্রচারিত প্রতিদিনের খবরাখবর শুনতাম। ইতিমধ্যে আমাদের সাথে অবসরপ্রাপ্ত জেসিও আমাদের সাথে যোগাযোগ করেন। এভাবে এক সপ্তাহ বা তার কিছু সময় বেশি পার হয়ে যায়।
২৩ মার্চ, ১৯৭১ আমাদের এলাকায় তখনও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাটি যায়নি। অধিকাংশ বাড়ি ঘরে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। শুধু থানা হেড কোয়ার্টারে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ওই দিন আমরা ১২ টার সময় জেসিও সম্ভবত উনার নাম ছিল মফিজুর রহমানের ডাকে আমরা বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজ পড়–য়া ছাত্র এবং স্কুলের উচ্চ শ্রেণীর কয়েকজন ছাত্র একত্রিত হই। মফিজুর রহমান সাহেব আমাদেরকে বললেন, তিনি বিকাল থেকেই আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং দেবেন এবং সেই লক্ষ্যে তিনি কিছু কাঠের তৈরি ডামি রাইফেল জোগাড় করেছেন। তিনি আরো বললেন, রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। তাই আমাদেরকে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। আমরা ওইদিন বিকালে তার পরামর্শ মতো ৩০/৪০ জন একত্রিত হই। তিনি প্রাথমিক পরীক্ষা নেয়ার পর ২/১ জন বাদে প্রায় সবাই প্রশিক্ষণ নেবার জন্য মনোনীত করেন এবং ঐদিন থেকেই আমরা পিটি, প্যারেড শুরু করি। তিনি প্রথম তিন দিন আমাদেরকে ডামি রাইফেল দেন নাই। পরে ২০/২১টি ডামি রাইফেল আমাদেরকে দেন এবং এই রাইফেলগুলো দিয়েই আমরা প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে থাকি।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ৩০ এপ্রিল বা ১ মে তারিখে ফরিদপুরে পৌঁছার দিন পর্যন্ত আমরা ট্রেনিং চালিয়ে যাই। ফরিদপুরে সেনাবাহিনী পৌছার পর কয়েক দিন আমাদের ট্রেনিং বন্ধ থাকে। এর কয়েক দিন পর আবার ট্রেনিং চালু হয়। যেদিন পাক সেনারা ফরিদপুর থেকে বরিশালের দিকে যায় সেদিন আমরা আমাদের স্কুল থেকে কামানের গোলার শব্দ শুনতে পাই। কামানের গোলার শব্দ শোনার পর আমরা মাঠ থেকে স্কুল ঘরের ভিতরে ঢুকে যাই। এরই মধ্যে একদিন কয়েকটি যুদ্ধবিমান আমাদের মাথার উপর দিয়ে খুব নিচু দিয়ে উড়ে যায় ফলে সবাই সাংঘাতিকভাবে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যায় এবং আমাদের ওস্তাদ ট্রেনিং বন্ধ করে দেয়। এই সময়ে পাকিস্তান রেডিও থেকে অবসরপ্রাপ্ত অথবা এলপিআর-এ থাকা বা ছুটিতে থাকা সকল সামরিক কর্মকর্তা ও সিপাহীকে কাজে যোগদান করার জন্য নিকটবর্তী থানা অথবা সেনা ছাউনিতে যোগদানের আহবান জানান হয়।
গ্রামে অবস্থান কালিন সময় আমি মৌলভি মোঃ ইসহাক ওরফে ধলা মিয়া পীর সাহেবের দুই মেয়েকে পড়াতাম। তাঁর এক জামাতা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল। পীর সাহেবের সব ছেলেরাই স্বাধীন বাংলার সমর্থক ছিল। পীর সাহেব আমাকে কিছু টাকা দেন তাঁর বাজারের ঘরটি ব্যবসা বানিজ্যের জন্য চালু করতে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চুড়ান্ত বিজয়ের পর আমি লেখাপড়ার জন্য ঢাকা আসার চেষ্টা করতে থাকি। জবানবন্দীতে উল্লেখিত ব্যক্তি ব্যক্তিদের সাথে ঢাকায় যাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ করি যাতে আমার লেখাপড়ার কোনো ক্ষতি না হয়। তারা তিনজনই আমাকে একযোগে পরামর্শ দেন, এখন ঢাকায় যাওয়া ঠিক হবে না। কারণ হিসেবে তারা বলেন তোমার ভূমিকা সম্পর্কে ঢাকায় কারো জানা নাই। সেখানে গেলে বর্তমান অবস্থায় যেকোনো ধরনের বিপদ হতে পারে। আমরা তোমার ভুমিকা সম্পর্কে জানি তাই তুমি বাড়িতে থাকো। আমরা খোঁজ খবর নেই, তারপর সবকিছু জানাশোনার পর এবং বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে এলে ছড়ানোর ছিটানো অস্ত্রপাতি সরকারের হাতে জমা হলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে, জান-মালের নিরাপত্তা বিধান হবে, তখন আমরাই তোমাকে ঢাকায় পৌঁছানোর ব্যবস্থা করব।
এরপর তাদের পরামর্শ মোতাবেক আমি বাড়িতে এবং উপরে উল্লেখিত পীর সাহেবের বাড়িতে অবস্থান করতে থাকি এবং চৌদ্দরশি বাজারে ব্যবসা করতে থাকি। তখন মাঝে মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলে ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা হাসান, মাকসুদ, আবদুল হাই প্রমুখের কাছ থেকে আমি চিঠি পেতে থাকি, তারা লেখে যে তোমার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নাই তুমি তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে এসো। এই চিঠিপত্র সম্পর্কে আমি সদরপুর থানার উল্লেখিত তিন ব্যক্তিকে জানাই। তারা বললেন, একটু দেখেশুনে যাওয়াই ভালো, এই চিঠি যে তারাই লিখেছেন তার কী প্রমাণ আছে।
১৯৭২ সালের সম্ভবত নভেম্বর-ডিসেম্বরে সদরপুর থানা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি শাহজাহান তালুকদার নিজেই আমাকে ঢাকায় নিয়ে আসেন এবং আমাকে শহীদুল্লাহ হলের গেটে নামিয়ে দেন। আমি আসার পর ছাত্রলীগের বর্ণিত নেতৃবৃন্দ আমার ভর্তির এবং হলে থাকার ব্যাপারে সহযোগিতা করেছেন। কারণ তারা আমার কাসমেট ছিলেন এবং আমি তাদেরকে লেখাপড়ার ব্যাপারে সহযোগিতা করতাম এবং তাদের সঙ্গে আমার আন্তরিকতাও ছিল।"
উপরোক্ত জবানবন্দিতে অনেক তথ্য, মানুষের সংযোগ, সময়কালের অবস্থিতি, যুক্তি রয়েছে। সাধারণ ভাবে বিচারকের দায়িত্ব থাকবে তা যাচাই বাছাই করা। তা না করে তাকে প্রথম কিস্তিতে যাবজ্জীবন এবং পরের কিস্তিতে ফাসির হুকুম দিল! সেলুকাস।
পরবর্তীকালে এই মানুষটি আবার আরেকজনকে দিয়েছিলেন এক চিরকুট:
"প্রিয় রনি,
যদি কখনও সময় পাও এবং তোমার ইচ্ছা হয় তবে আমার ফাঁসির পর একবার হলেও বলো বা লিখো- কাদের মোল্লা আর কসাই কাদের এক ব্যক্তি নয়। আমার আত্মা কিয়ামত পর্যন্ত কাঁদবে আর কসাই কাদের তখন কিয়ামত পর্যন্ত অট্টহাসি দিবে। - কাদের মোল্লা"
**
তিনি নামাজ পড়লেন। কোরআন তেলাওয়াত করলেন।
সর্বশক্তিমানের নাম নিচ্ছেন আর ফাসির মঞ্চে এগিয়ে যাচ্ছেন। আহারে কি শীঘ্রই না দেখা হবে পরম করুনাময়ের সাথে।
মুমিনের জন্য এর চেয়ে আনন্দ আর কিসে হতে পারে?
"প্রকৃত ব্যাপার এই যে, আল্লাহ মুমিনদের থেকে তাদের প্রাণ ও ধন-সম্পদ জান্নাতের বিনিময়ে কিনে নিয়েছেন।
তারা আল্লাহর পথে লড়াই করে এবং মারে ও মরে৷ তাদের প্রতি তাওরাত ,ইনজীল ও কুরআনে(জান্নাতের ওয়াদা) আল্লাহর জিম্মায় একটি পাকাপোক্ত ওয়াদা বিশেষ৷ আর আল্লাহর চাইতে বেশী নিজের ওয়াদা পূরণকারী আর কে আছে? কাজেই তোমরা আল্লাহর সাথে যে কেনা-বেচা করছো সে জন্য আনন্দ করো৷ এটিই সবচেয়ে বড় সাফল্য৷" (সুরা তওবা: ১১১)
তিনি স্বাভাবিকভাবে আনন্দিত মুখে ফাসির মঞ্চে এগিয়ে যাচ্ছেন। এখন তো তিনি হাসবেন ই।
"হে পরম বন্ধু। তুমি আমায় ক্ষমা কর। বাংলাদেশের ইসলামী আন্দোলনকে বিজয়ী করে দাও।"
**
"বিজয় কেতন দেখছি বাংলার মাটিতে।
ইসলামের বিজয়।
আল্লাহ তার প্রিয় বান্দাহদের
শহীদ হিসেবে করে নেন গ্রহণ।
শহীদের রক্ত কথা বলছে।
হে পতাকাবাহী। তুমি কি তা শুনতে পাও না?
সে তো তোমার পাশেই রয়েছে।
তোমার হাসি তাকে হাসায়।
তোমার কান্না তাকে কাদায়।
শাহাদাতের আরদ্ধ সাধনায় বলিয়ান এ কাফেলার অগ্রযাত্রা
কে থামায়?"
বিষয়: বিবিধ
২৬৭১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন