সত্য ঘটনা অবলম্বনে (১১) : বিবেকের দায়বদ্ধতা
লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ১০ নভেম্বর, ২০১৩, ০৮:১৫:০২ রাত
'অত্যাচারীর সব চেয়ে বড় পরিচয় সে ভীতু।
সে যে পরিমান অহংকারী তার চেয়ে ও বেশি পরিমান আতঙ্কগ্রস্ত।'
পুলিশ মহা আতঙ্কে ভুগছে।
লোহাগাড়ার থানা ঘেরাও করে রেখেছে জনতা।
আমি তাদের একজন।
এ থানা থেকে রাত পরলেই শুরু হয় আর্ত চিত্কার।
কান্না -- চলে ভয়াবহ নির্যাতন।
আমি কে?
আমি কি পিলখানায় শহীদ এক কর্নেলের বড় সন্তান?
আমি কি মুজাহিদের ভাই? যার লাশের উপর দাড়িয়ে লাঠি বৈগা হাতে স্বাধীনতার চেতনা-ফেরিওয়ালারা নৃত্যন কুর্দন করেছিল?
আমি কি শেয়ার বাজারের স্বর্ব সান্ত এক পিতা?
আমি কি গুম হয়ে যাওয়া শিবিরের এক ছাত্রের আপন ভাই? মা যেন জীবন্ত লাশ হয়ে গিয়েছে সেই গুম হয়ে যাওয়ার পর দিন থেকেই?
আমার মনের ভিতর কেমন লাগে যখন অগণিত বেওয়ারিশ লাশের উপর দাড়িয়ে সরকারের বিজয়ের হাসি দেখি?
আমার মনের ভিতরে কেমন লাগে যখন বিশ্বাস ঘাতক আর লেনদেনের সখাদের চাপে বিরোধী দলের 'ক্ষমা-দানের' প্যাচাল দেখি?
আমার মনের ভেতর কেমন লাগে যখন ভয়ঙ্কর হায়নার অত্যাচারের পর ও স্বার্থপর মানুষের নির্লিপ্ত গতানুগতিক রোজনামচা দেখি?
আমার বা হাত কেটে গেছে।
বৃষ্টির মত ছুটে আসা রবার বুলেট সেখানে বিদ্ধ।
ছোট ভাই পিছনে ইট ভাংছে আর টুকরো দিচ্ছে।
গুলতি ছিড়ে গেছে।
অতিরিক্ত রাখা দরকার ছিল।
জনতা জেগে উঠেছে। ব্লকের ইলেকট্রিসিটি বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। চাদের আলোয় পৃথিবীতে একদল নিপীড়িত মানবাত্মা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। জোত্স্নায় কি পৃথিবী সিক্ত হচ্ছে না? মোহময় আলোর জলধারায় কি থানা, পুলিশ, পুলিশের বন্দুক, বিদ্রোহী, বিদ্রোহীর ইট -পাথর ভিজে যাচ্ছে না?
হে কবি, রাখ তোমার আবেগ!
মানুষ যখন ভয়ঙ্কর অত্যাচারিত - শোষনের দাবানলে পুন;পুন; ক্ষতিগ্রস্ত - তুমি এসেছ প্রকৃতি প্রেম নিয়ে!
হে সুশীল - হে পত্রিকার মানবপ্রেমিক - মিডিয়ার সমাজ সেবী - প্রথম আলোর সাদা মানুষের দল,
তোমার কোন ভাই কি পিলখানায় জীবন্ত কবর গ্রস্ত হয় নি?
শেয়ার ধসের পর তোমার কোন সন্তান কি অপলক তোমার শক্ত চোখে তাকিয়ে থাকে নি?
তোমার কোন ভাইকে কি থানা হেফাজতে ওসি সহজে চোখ গেলে দেয় নি?
তোমার পিতাকে কি শাপলা চত্বর থেকে নিরুদ্দেশ হতে দেখনি?
যদি না দেখ তো - তোমাদের আমি থোরাই কেয়ার করি!
আমি আমার বিবেকের দায়ে এজন্যই ছুটে এসেছি।
হাতে ইট নিয়ে শোষকের বিরুদ্ধে দাড়িয়েছি।
বহমান জীবনে ৫২, ৬৯, ৭১, ৯০ এসেছিল -- অতপর ২০১৩ উপস্থিত ।
সে সময় ও আমার মত কোন অত্যাচারিতের সহযোগী ছিল -- পাশে দাড়ানোর মানুষ ছিল - বজ্র কন্ঠে রাজপথ কাপানোর দায়বদ্ধতা ছিল। সে সময় তোমাদের (সুশীল, মিডিয়া আর পত্রিকার সাদা মানুষ) মতও শাসকের সহযোগী ছিল।
কিন্তু বিবেকের দায়বদ্ধতা তখন ও থেমে থাকেনি -- আজ ও থামবে না।
ভাবতে ভাবতে ই শুনতে পেলাম সাইরেন। বিজিবির কয়েকটা গাড়ি কি চলে এসেছে?
হে বর্ডারের পাহারাদার, তোমাদের অরক্ষিত সীমানা দিয়ে ভারত অবলীলায় ঢুকে বাংলাদেশ নামক মানুষকে হত্যা করে গাছে ঝুলিয়ে রাখে।
হে নির্লজ্জ শাসকের তাবেদার রা, সেদিন তো বর্ডার আর ও অরক্ষিত রেখেছিলে যেদিন সারা দেশ চেটে লুটে পুটে ভারত নিয়ে যাচ্ছিল - মেজর জলিল ছাড়া একজন ও প্রতিবাদী ছিল না - ডাকাত ভারতকে থামানোর মত সাহস তাবেদার সরকারের ছিল না -- তোমাদের ও ছিল না!
হে কাপুরুষ! আজ এসেছ বর্ডার অরক্ষিত করে নিরস্ত্র দেশবাসীর উপর গুলি ব্যবহার করতে?
প্রকৃতির ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য আর বিবেকের কষাঘাত একত্রে কি আমাকে জাদুগ্রস্ত করেছে ?
উদাসী করে ফেলেছে?
কিন্তু উদাস হলে তো চলবে না। যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে।
পাশের সহযোগিরা বার বলছে চলে আসতে।
তাদের কথা কি আমি শুনতে পারছি না?
আমি কি বধির হয়ে যাচ্ছে?
তীব্র মনের যন্ত্রনায় কি বাস্তবতা অপ্রয়োজনিয় মনে হচ্ছে?
আমার কি মনে হচ্ছে?
এই বিজিবির লোকেরা আমায় কি করবে?
আমি কি নিদারুন সাহসী হয়ে গেছি?
আমি কি বন্দুকের গুলি থেকে নির্ভয় হয়ে গেছি পুরোপুরি?
আমি কি মরণজয়ী?
আমার কি বেদনা বলে কিছু নেই?
আমি কি পাশের বন্ধুর উপর এলিয়ে পড়লাম?
---------------------------------------------------------
গোয়ালিয়র কারাগারে বন্দী মুজাদ্দিদ আহমদ সাহেব।
সময়কাল ১৬০৬ সালের কোন সময়।
আকবরের মৃত্যুর পর জাহাঙ্গীর সম্রাট হয়ে প্রতাপে রাজত্ব চালাচ্ছে।
আকবরের তীব্র ইসলাম বিরোধী আচরণ আর নিজ-প্রবর্তিত দীনে এলাহী নামক ধর্মের বিরুদ্ধে একজন কামেল মানুষের একক সংগ্রাম।
সারা ভারতের রাজা, প্রতাপশালী আকবরের দম্ভ আর এক রোখা আচরণের কি ফলাফল হল?
মৃত্যুর মুহুর্তে মাত্র ১৮ জন শিষ্য -- মৃত্যুর পূর্বে ই নতুন ধর্মের বিকল অবস্থা!
আর একজন প্রতিবাদী সমর্থনহীন কামেল মুজাদ্দিদ আল ফিসানি? হাজার হাজার শিষ্য তৈরী হল!
তারাই আজ দেশ ব্যপী জেগে উঠেছে।
মদ্যপ জাহাঙ্গীর মুজাদ্দিদ আহমদ কে কারাগারে পাঠালো শুধুমাত্র ওই লোকের কারণে হাজার হাজার ইসলামপ্রেমী সমর্থক তৈরির কারণেই! যারা ইসলামকে সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠিত করতে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিতে প্রস্তুত। যারা সমাজের কোথা ও ইসলাম-বিদ্বেষী আচরণ সয্য করে না।
সারা ভারতের মানুষ জেগে উঠেছে।
বন্দী মুজাদ্দিদ আহমদ সাহেব কে মুক্ত করবে ই জনতা!
এরই মধ্যে মহব্বত খান বিদ্রোহ করলেন।
সে যে আহমাদ সাহেবের একনিষ্ঠ ভক্ত।
গোয়ালিয়র কারাগারের বাইরে সমবেত প্রতিবাদী লোকদের মাঝে আমি একজন।
পাথর ছুরছি।
সত্যের মুক্তি চাই।
জনতা বজ্রকন্ঠে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
রাজ-আদেশ আসেনি -- তাই সৈন্যরা কিছু করছে না। শুধু প্রতিরোধ-বেষ্টনী গড়ে তুলেছে কারাগারের চারপাশে।
কারাগারে বন্দী প্রানের নেতা মুজাদ্দিদ আল ফিসানি।
তাকে মুক্ত করবই।
শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলে ই কারাগারের শেকল ভেঙ্গে তাকে বের করবই।
এই আত্ম প্রত্যয় আমাদের সবার!
----------------
আমি ভাবি কি জাদু ওই দরিদ্র আলেমের?
রাজা যা পারেনি, এক ইসলামের আদর্শ দিয়ে ই ভারতবাসীর হৃদয় জয় করে নিল?
আমি ভাবি মানবাত্মাকে জয় করাই কি সবচেয়ে বড় অর্জন নয়?
সবচেয়ে বড় সফলতা নয়?
'আশ্ফ্গাহ, আপনি দরবেশকে রাজসভায় ডাকুন।'
মাননীয় সম্রাট, আরেকবার ভাবুন। সে যে আপনার ক্ষমতা ও ছিনিয়ে নিতে পারে?
'চুপ করুন । সম্রাট জাহাঙ্গীরের ফরমান জারি করুন। সসম্মানে আল ফিসানি সাহেবকে রাজ সভায় আমন্ত্রণ জানান।'
** **
শ্বেতশুভ্র পবিত্র একজন মানুষ যেন রাজ সভা আলোকিত করলেন।
তিনি সবার মাঝে দাড়িয়ে।
ভয়্শুন্ন।
চিন্তাহীন।
বললেন, আমার কয়েকটি দাবি আছে।
আমি বললাম, 'বলুন জনাব'।
'দরবার হতে ইসলাম বিরোধী সিজদা ও কুর্নিশ প্রথা তুলে দিতে হবে।
ধংস করে দেয়া (আকবরের সময়) মসজিদ পুন: প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
যুদ্ধ্করের প্রবর্তন করতে হবে।
আপনাকে ( সম্রাট জাহাঙ্গীর) ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী চলতে হবে এবং রাজ্য ও ইসলামের আইনমত চলবে।
বিচার আগের মতই কাজী বা মুফতি, মৌলভীরা চালাবেন।'
আমি কি মনের মাঝে এক পরিবর্তনের শব্দ শুনছি?
আমি কি অন্ধকারে ডুবে ছিলাম?
আমার মনের ভেতর একজন কি আমাকে সকল অহংকার পরিত্যগ করে সত্যের পতাকাবাহী হতে বলছে?
কে বলছে?
হে স্রষ্টা, আমি কি তোমাকে এতদিন ভুলে ছিলাম?
কিভাবে?
কেন?
এত করুনার আধারের দয়াকে কিভাবে অগ্রাহ্য করছিলাম?
আমি কি নতুন সকাল দেখছি?
আমি কি শান্ত ভোরের অসম্ভব স্নিগ্ধতা অনুভব করছি?
'হে মহামানব, আমাকে আপনার শিষ্য করে নিন। আমি পন করেছি মদ্যপান পরিত্যগ করব। নামাজ কখন ও পরিত্যগ করব না।
আপনি কি আমার পরামর্শ দাতা হসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন? আমি তাহলে চির কৃতার্থ হতাম!'
----------------
৭১ এর মুক্তিযোদ্ধা একজন জামায়াতের জেলার দায়িত্বে থাকার কারণে ২০১৩ এ রাজাকার হিসেবে পরিচিত।
কি সেলুকাস!
আজ আমাদের থানা ঘেরাও য়ের এটি একটি কারণ।
তাকে নিদারুন অত্যাচার করেছে জল্লাদ ওসি এসপি মিলে।
এক হাত ভেঙ্গে ই ফেলেছে জল্লাদরা!
**
তলপেটে ই গুলি লেগেছিল আমার।
আমাকে নিয়ে এসেছে একটা ছোট ঔষধের চেম্বারে।
হাসপাতালে বলে পুলিশ বসে আছে।
নিয়ে গেলে সোজা গ্রেফতার।
চিকিত্সা ছাড়া জেল হাজতে রাখবে সারা রাত !
রক্তক্ষরণে মারা গেলে তাদের কিছু যায় আসে না!
অবশ্য মনুষত্ব হীন দের কোন কিছু তে ই কিছু যায় আসে না!
অবশ অবশ লাগছে।
স্বপ্নময় লাগছে।
একটি মুক্ত আকাশের স্বপ্ন দেখছি।
নীল আকাশ।
সেই আকাশে ঘুরি উড়াচ্ছি।
আমি কি আমার অনাগত সন্তানদের নিয়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছি?
স্বাধীন দেশের আনন্দে কি চারপাশ উদ্বেলিত?
প্রানভরে আমি শ্বাস নেই!
-----------------
ইসলামের স্নিগ্ধ আলোকে নব শিশুর মত নির্মল জীবন শুরু করলেন মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর। পঞ্চাশ বছর দীর্ঘ ছিল তার এ নব জীবন। একটি কুপের মত গর্ত করে সেটা সোনা রুপার টাকা দিয়ে ভর্তি করে তা থেকে দিন, দু:স্থ, অনাথ, বিধবা হিন্দু- মুসলমানদের দান করতেন এ মহিয়ান রাজা।
মাওলানা আহমাদ সরহিন্দের প্রভাবে পরিবর্তিত রাজা জাহাঙ্গীর প্রতাপশালী ইসলাম-বিদ্বেষী আকবরের বিপরীত মেরুর একজন হিসেবে ই ছিলেন আজীবন। তার বংশধর শাহজাহান এবং পরবর্তিতে আওরঙ্গজেব একাই একজন দরবেশ ও শাসক হিসেবে ই ভারতবর্ষকে ধন্য করেছিলেন সুদীর্ঘ ৫১ বছর।
=====
সূত্র: [১] গোলাম আহমদ মোর্তাজা, "চেপে রাখা ইতিহাস" (ভারত সরকার কতৃক বাজেয়াপ্ত)
[২] শ্রী শর্মা, "মোঘল গভর্নমেন্ট"
[৩] এইচ আর চৌধুরী, "পাক ভারতের ইতিহাস"
বিষয়: বিবিধ
১৪৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন