সত্য ঘটনা অবলম্বনে (৯) : শিল্পী

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ০৪ নভেম্বর, ২০১৩, ০৫:১৯:১০ বিকাল

"এসো গাই আল্লাহ নামের গান

এস গাই গানের সেরা গান।

তনু মনে তুলবো তুমুল তুর্য তাল ও তান।"

আমি একজন শিল্পী। ইসলামী গানের শিল্পী। প্রেরণা আকি ইসলাম-দরদী মানুষের মনে।

লিড দেয়ার পর পর ই সহকারী শিল্পীরা একসাথে গেয়ে উঠল একই গানের কলি।

সামনে অন্ধকার। একটা তীব্র আলো চোখে লাগল। এখন রঙ পরিবর্তন হচ্ছে। রং বেরঙের আলোর ঝলকানি স্টেজ ময় ছড়িয়ে পরছে।

গানের কলি পরিবর্তনের সাথে সাথে আলোর পরিবর্তন।

পাশ দিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কেউ ইন্সট্রাকশন দিচ্ছেন।

একমুখী আলোয় স্টেজ থেকে দর্শক দেখা যাচ্ছে না। সংগীত প্রানভরে নি:শব্দে উপভোগ করছে হাজার হাজার মানুষ।

ঢাকায় ইসলামী গানের আসর বা উত্সব কোথায় হয়? অস্লিলতায় যেখানে সারা দেশ ছেয়ে। তার উপর সরকারের ইসলাম-ভীতি রোগ। সব জায়গায় জামায়াত -শিবিরের গন্ধ খুঁজে পায় সুচিবায়ু সরকার।

তাই গন্ধ দূর করতে সরকারের দিবারাত্র লম্ফ ঝম্ফ। সেই লম্ফ ঝম্ফে জনগনের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা!

কোরআনের কোন তাফসির, আলোচনা, সংগীত এর সন্ধান পেলেই পুলিশ চলে আসে - মানুষ ধরে ধরে গাড়িতে তোলে!

গান গেয়ে যাচ্ছে সাথীরা:

"নবী মোর পরশ মনি,

নবী মোর সোনার খনি,

নবী নাম জপে যে জন

সেই তো দোজাহানের ধনী।"

এমন সরকারিয় তান্ডব সমন্বিত কার্টুন ময় পরিবেশে কিছু মানুষ ইসলাম কে ভালবেসে -- আল্লাহ রাসুল কে ভালবেসে ইসলামী সংস্কৃতি কে তুলে ধরতে আপ্রাণ চেস্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

গান ও চলছে এক টানা। একটা শেষ হতে ই আরেকটা শুরু। দুই/তিনটা শেষ হলে বিরতি।

শুরু হল প্রয়াত কবি মতিউর রহমান মল্লিকের আরেকটি গান:

"দু:খি দের প্রিয়জন তুমি গরিবের সহায়

হেরার আলো জ্বালাও তুমি আধার দুনিয়ায়"

আবেগ তৈরী হয়ে গিয়েছে সর্বত্র। এর পর ই শুরু করলাম:

'মুসলিম আমি সংগ্রামী আমি

আমি চির রনবীর

আল্লাহকে ছাড়া কাউকে মানিনা

নারায়ে তাকবির"

.....

মুসলিম জাগে কারবালা শেষে

কঠিন শপথ করে

লাখ শহীদের কলিজার দামে

নতুন পৃথিবী গড়ে"

.....

মানি না বিধান কোন মানুষের

আমরাই ভাংবো বাতিলের প্রাসাদ আর

ধিকৃত পথ যত বাতিলের

এরই পথে আমাদের সংগ্রাম সাধনা

প্রানবাজি এই পথে রেখেছি"

কান্নার রোল শুরু হয়ে গিয়েছে। থেমে যাওয়া যাবে না। আবেগে আটকানো যাবে না। সুর ভেঙ্গে ফেলা যাবে না। বড় কঠিন এই সাধনা। বড় কঠোর এই মনের বিপরীতের মনন।

** **

রাতের ঢাকা শহর। প্রিয় শহর। অন্ধকারের শহরে মানুষের দু:খ যেন কোন আলো ফুটতেই দিচ্ছে না।

সরকারিয় বিদ্যুত আমদানির আলো , কুইক রেন্টালের আলো , মন্ত্রীদের ৩২ পাটি দাতের আলো -- সব ধরনের আলো যেন স্তিমিত করে দিয়েছে জনগনের কান্না। এক শ্রেনীর দুর্নীতিবাজ জনগনের আনন্দ আজ বিকট অট্টহাসিতে পরিনত হয়েছে।

পাশাপাশি চলা --

দু:খ্ভরা জীবন।

(চুরির) টাকার জীবন।

৪২ বছরের স্বাধীন জীবন।

নিরাপত্তাহীন জীবন।

স্বাধীন দেশের পরাধীন জীবন।

মীরজাফর ঘষেটি বেগমদের জীবন।

বাশের লাঠি হাতে শীর্ণ তিতুমীরের জীবন।

সচিবালয়ে পতাকা লাগিয়ে জন্তু জানোয়ারের জীবন।

ঝাড়ু হাতে মিছিলরত কোলের শিশু হাতে করিমনের জীবন।

মানুষরুপি কুকুরের জীবন।

কুকুর-রূপি কুকুরের জীবন।

আমি রিক্সায় বাড়ি ফিরছি। সমান্তরালে গাড়ি চলছে - বাস চলছে - ট্রাক চলছে - মানুষ চলছে। হটাত মনে পড়ল এক মিছিলের কথা:

রমজানকে স্বাগত জানিয়ে শিবিরের মিছিল।

নানা রং জড়িয়ে রয়েছে মিছিলকে যেন রমজানের রং। রমজান মাসের ভালবাসায় সিক্ত হলে কি সে রং দেখা যায়?

ট্রাকে আমরা গান ধরেছি:

'এ যে মাহে রমজান রহমতের দরিয়া

এ দরিয়ায় কাটলে সাতার গুনাহ যাবে ঝরিয়া'

ক্ষমা পাবার এমন সুযোগ হারিস নে তুই ভুলে।

আজ আছিস কাল থাকবি না হয় যেতে হবে ওই কুলে।

ধরার হাতে আলোর খেলা

ফুল ফসলের বসলো মেলা গাফেল বেহুশ ঘুমাস্নে আর

কর সাধনা মরিয়া'

'রমজান সে তো খোদার তরে

পুরস্কার ও অকাতরে

দেবেন রহমান।

যাকাত যেমন সব জিনিসের রোজা তেমন যাকাত দেহের

রাসুলের ফরমান'

গুন গুন গাচ্ছি রমজানের গান।

চমত্কার একটা ফাংশন আজ হল আলহামদুলিল্লাহ।

এজন্য মন ও অসম্ভব ভাল।

রিক্সাচালক একবার ঘুরে হাসল। সত্যিকার গাতকের গান যে - তাকাতে তো হবেই!

বাসার গলিতে ঢুকে পরলাম। আর তখন ই কয়েকজন ঘেরাও করে ফেলল।

সাদা পোশাকের পুলিশ।

'আপনাকে যেতে হবে'

'ওয়ারেন্ট আছে? বাসায় বলে আসি।'

'না সম্ভব নয় - জোর করে ই সাদা মাইক্র-বাসে উঠালো।

আরেকজন হাত বেধে ফেল। চোখ ও বেধে ফেল। অন্ধকার হয়ে গেল সব।

'প্লিজ, অন্যায় করবেন না'

মুখ ও বেধে দিল এক কাপর দিয়ে'

সাথে সাথে পিছন দিক থেকে প্রচন্ড আঘাত পেলাম।

আর মনে নেই।

......

রাস্তার এক স্টেজ।

মাইকের সামনে দাড়িয়ে আমি।

আমার গান গেতে হবে।

দর্শকের চেয়ার শুন্য।

হটাত একজন এলো।

আমার নাম আবির। আমার বাড়ি সাতখিরার মনমহুরি গ্রাম। আমি আপনার গানের দারুন ভক্ত।

আমাকে একটি গান শোনাবেন?

'ঠিক আছে'।

গান গাওয়া শুরু করতে চেষ্টা করছি। পারছি না।

প্রবল চেষ্টা করছি।

কিন্তু পারছি না।

হটাত মনে হল ভিজে যাচ্ছি।

ভিজে যাচ্ছি কেন?

.......

জ্ঞান ফিরে আসলে দেখলাম আমি একটিও চেয়ারে পিছন দিক থেকে হাত বাধা অবস্থায় বসা। হাই পাওয়ারের লাইট আমার চোখ বরাবর ফোকাস করা। তাকানো অসম্ভব।

সারা শরীর কি ভেজা?

পানিতে?

রক্তে?

সারা শরীরে ব্যথা কেন?

কতক্ষণ নির্যাতন করেছে?

'মি: মেহেদী, ডোন্ট গো ফারদার উইথ দিস কিড। ইউ হাভেন্ট স্টার্টড ইনভেস্টিগেশন ইয়েট'

'সার, টর্চার উইল মেক হিম ফ্রাইটেন্ড - ইয়ে লাড়কা সাব বাতা দেগা'

'বাট লাস্ট টাইম ইউ কিল্ড বিফোর ইন্টারগেসন'।

'উইল নট হাপ্পেন এগেইন স্যার'.

মি: মেহেদী, আই আম গোয়িং তো DGFI অফিস নাউ।

'স্যার প্লিস, কিপ ইন মাইন্ড এবাউট মাই প্রমোশন'।

***

'দেলোয়ার কই জানস?'

কোন দেলোয়ার?'

'শিবিরের সভাপতি।'

প্লাস দিয়ে একটা আঙ্গুলে কি চাপ দিল?

ব্যথায় সব অন্ধকার হয়ে গেল। চিত্কার দিলাম: 'আল্লাহু আকবার'।

আবার কি অচেতন?

আমি কি আবার স্টেজে?

আবির বলছেন, 'কি ভাই গান ধরুন'.

আমি শুরু করলাম:

'এলো কে কাবার ধারে আধারে চিড়ে চিনিস নাকি রে

ওকে ও মা আমিনার কোল জুড়ে চাদ জানিস নাকিরে।

মুতালিব আজকে কেন বেহুশ হেন বক্ষে খুশির বান

বেদনার সুপ্ত ক্ষতে হাত বুলাতে কার এ আগমন

সাহারার হৃদয় ভরা ঝরনা ধারা বইলো নাকি রে'

আমি আর গাইতে পারছি না -- কান্নায় থেমে গেলাম। আবির ও কি কাদছে?

আরেকটা আঙ্গুলে কি প্লাস দিয়ে চাপ দিল?

পরলোক গত মার চেহারা তখন ই ভেসে উঠল। অনেক আগের কথা। আমি ছোট। মা আমার ওই আগুলে কি পট্টি বেধে দিচ্ছে? ওই আঙ্গুলটা কেটে গিয়েছিল যে। মা কি পট্টি বাধা আঙ্গুলে চুমু খেলেন?

মা কি আমায় আদর করছেন? আমি কি মার গন্ধ পাচ্ছি? আহারে। তোমার জন্য কিছু ই করতে পারিনি মা!

সম্বিত ফিরে পেলাম। দুটো তার দুই হাতে নিয়ে এডিসি মেহেদী। তারের আগায় কি লোহার শলাকা? কি করবে? আমার হাটুর কাছে এগিয়ে যাচ্ছে কেন? চিত্কার করার মত কোন শক্তি কি অবশিস্ট নেই? মাহমুদুর রহমানের দু'পায়ে ও কি ওই দুই শলাকা ঢুকিয়েছিল? তার পর অনবরত ইলেকট্রিক প্রবাহ!

আর কিছু মনে নেই!

আমি কি আবার স্টেজে? আবির বলছে - 'আরেকটা গান শোনান'।

আমি ধরলাম:

"আমি ও সেই সে নবীর দীপ্ত রবির আশিক দিওয়ানা

রাহে তার যা কিছু সব বেলা-হিসাব দেব ই নজরানা

জিহাদের ময়দানে তাই যাই চলে যাই স্বপ্ন আকি রে"

********************************

সাতক্ষিরার মন মহুরী গ্রামে গাছের তলে বসা বাহুতে গুলিবিদ্ধ আবির ভাবছে -- একটা গান শুনতে পারলে দারুন লাগত।

রাহাত ভাইয়ের গান যদি শুনতে পারতাম?

হায় আল্লাহ তাকে নিরাপদে রাখ!

তার সুললিত কন্ঠ অনেক মর্দে মুজাহিদকে উজ্জীবিত রাখবে।

তাকে সুরক্ষিত রেখো।

বিষয়: বিবিধ

১৪১৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File