সত্য ঘটনা অবলম্বনে (৪): ফিরে আসা
লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ২৩ অক্টোবর, ২০১৩, ০৩:৫২:০৮ দুপুর
জুলাই মাস।
৬৩৬ খ্রিস্টাব্দ।
কাদেসিয়া যুদ্ধ এর পূর্ব অবস্থা।
পারস্য বাহিনীর মুখোমুখি মুসলমানেরা।
সাদ (রা) এর সেনাপতিত্বে একটি ছোট দলের দায়িত্ব দিয়ে খলিফা আমাকে পাঠিয়েছেন।
রন-কৌশলে চৌকস, দীর্ঘ দেহী হওয়ায় আমি সে দলের সর্বাগ্রে দাড়িয়ে ।
যুদ্ধে আসার আগে খলিফার সাথে আমর বিন আস (রা) এর আমাকে নিয়ে একটি কথোপকথন ছিল এমন:
আমর বিন আস (রা):: যুদ্ধে তোলায়হা আল আজদী এর এত উচু পদে থাকা আমি পছন্দ করছিনা। তাছাড়া যে নিজকে এক সময়ে নবী হিসেবে দাবি করেছিল। যুদ্ধ করেছিল আবু বকর (রা) এর সৈন্যবাহিনীর সাথে!
খলিফা ওমর (রা):: যে যেই কাজে উত্তম তাকে সে কাজে নিয়োজিত করা উচিত। আপনি প্রজ্ঞাবান - তাই মদিনায় পরিকল্পনা প্রণয়নে আপনার সাহায্য অপরিহার্য। তোলায়হা যুদ্ধ-কৌশলে পারঙ্গম। তাই তাকে সেখানে দায়ত্ব দেয়া প্রয়োজন !
সীমানা যতদুর দেখা যায় ততদূর পারস্য সেনাদল। জাকজমকময়। সংগীত চলছে। প্রেরনাদায়ক চিত্কার।
তার অনেক ক্ষুদ্র পরিসরের মুসলিম বাহিনী দৃঢ়তায় দাড়িয়ে আছে আজ।
এ যে পারস্য পরাশক্তির বিরুদ্ধে মুসলিমদের অস্তিত্বের লড়াই।
আমি - তোলায়হা আল আজদী সারারাত কেদেছি -- এক প্রত্যয়ে -- শহীদ হওয়ার আকাঙ্খায়।
মনে পড়ে -- নিজে যখন সুদুর ইরাক থেকে ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় আসলাম। মহানবী (স) কে বললাম -- 'আমি ইসলাম গ্রহণ করে ইসলামের অনেক উপকার করলাম।' আমার জন্যই নাজিল হল সুরা হুজরাতের এই আয়াত। দেখলাম মহানবী (দ) এর মোবারক স্মিত হাসি!
" এসব লোক তোমাকে বুঝাতে চায় যে, তারা ইসলাম গ্রহণ করে তোমার উপকার করেছে৷ তাদের বলো, ইসলাম গ্রহণ করে আমার উপকার করেছো একথা মনে করো না৷ বরং যদি তোমরা নিজেদের ঈমানের দাবীতে সত্যবাদী হয়ে থাকো তাহলে আল্লাহ তা’আলাই তোমাদের উপকার করে চলেছেন৷ কারণ তিনি তোমাদেরকে ঈমানের পথ দেখিয়েছেন৷"
এত সন্মানিত হবার পর ও পরবর্তিতে আমি কিভাবে নিজকে একেবারে 'নবী' দাবি করলাম!
আমি কিভাবে সৈন্য যোগার করে মুসলিম দের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলাম?
কিভাবে সাহাবীদের যুদ্ধের ময়দানে হত্যা করলাম?
শেষ মুহুর্তে পরাজয়ের কাছাকাছি গিয়ে অবশ্য সিরিয়ার দিকে পালিয়ে প্রাণে বাচলাম!
আমার চোখের সামনে সব অতীত ভেসে উঠছে।
অতীতের প্রতিটি দিন যেন কুঠারের আঘাতের মত আমাকে ছিন্ন ভিন্ন করে দিচ্ছে!
আমার স্বাশ্প্রস্বাস বন্ধ করে দিচ্ছে!
কিভাবে আবার বোধদয় হল!
মহান আল্লাহ আমায় বোধদয় দিলেন।
ফিরে এলাম।
আবার স্বীকার করলাম - লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।
কেবল মুরতাদ ই নয় - একেবারে ভন্ড নবী র অবস্থান থেকে ইসলামের সুশীতল ছায়ায় ফিরে এলাম।
মনের অনেক রক্ত ক্ষরণ। তাও শেষ হয় না। হবার নয়।
একমাত্র কামনা যদি শহীদ হতাম আজ।
*****************************************
অক্টোবর মাস। ২৮ তারিখ।
২০০৬ খ্রিস্টাব্দ।
বাংলাদেশের বুকে ইসলামের শক্তি প্রদর্শনের নিমিত্তে এবং ইসলাম-বিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে আয়োজিত সমাবেশের পূর্ব দিকের অনেকের মাঝে একজন হিসেবে নিরাপত্তার দায়িত্বে আমি দাড়িয়ে ছিলাম।
খুব সাধারণ পরিবারে জন্ম।
বাবা সাধারণ দিনমজুর।
আমি ক্লাস এইট থেকে টিউশনি করে সংসারের অধিকাংশ ব্যয় নির্বাহ করি।
আরও চার ভাই-বোন।
মেধার জন্যই হয়ত বিশ্ব-সাহিত্য কেন্ধ আয়োজিত প্রতিযোগিতায় ভাল করার সুবাদে ছাত্র-মৈত্রী তথা কমিউনিস্ট পার্টির সুনজরে পড়ি।
অনেক সুবিধা দেয়া আর সুন্দর তত্বাবধানে আমি তাদের একজন হয়ে যাই কলেজে উঠার পর পর ই।
ধীরে ধীরে ইসলাম-বর্জিত মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠলাম - একসময়ে ইসলাম আর ইসলামী দলকে ঘৃনা করা শুরু করলাম।
কিছুটা বেশি দৈহিক শক্তি থাকায় তারা আদর্শের জন্য তথা ছাত্র মৈত্রীর প্রয়োজনে কেডার হওয়ার শপথ নিলাম ।
কলেজে ছাত্র থাকাকালে একদিন ফোনে বলল, "আজ হোস্টেলে গিয়ে কয়েকটা রাজাকারকে শায়েস্তা করা হবে।"
বিসয়টা প্রথমে তেমন গুরুতর ভাবিনি।
কিন্তু বিকেলে রুমে গিয়ে দেখি সবাই পিস্তল, চাপাতি নিয়ে প্রস্তুত।
রীতিমত শিউরে উঠলাম।
আমি রাজি হলাম না।
মন্ত্র্মুগ্গ্ধের মত ৭১ এর লোমহর্ষক বক্তব্য আমাকে উত্তেজিত করে দিল।
কলেজের ছাত্র তথা বহিরাগত হিসেবে আমার এসাইনমেন্ট দেয়া হল রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ে শিবির কচুকাটা করার দলের কর্মসূচিতে।
ছাত্রলীগ সর্বত সাহায্য করার কথা জানাল।
সরকারের পক্ষ থেকে পূর্ণ আশ্বাস পেলাম।
থানার ওসি, লিগ আর আমার দলের দুইজন সহ আগের রাতে পুরো পরিকল্পনা শেষ করলাম।
বিকেলে আক্রমন শুরু হল হলে।
হটাত উদ্দমী হলাম। রক্তের নেশা আমায় পেয়ে বসল।
আমি সুযোগ পেলে ই দূর থেকে গুলি চালাচ্ছি।
শিবির শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
আমি সজল্ দের একটা ছোট গ্রুপের সাথে দেয়াল টপকে হলের ভিতর ঢুকে পরি।
এদিকে কেউ ছিল না।
আমায় একটা ভয়ঙ্কর নেশা পেয়ে বসল।
একহাতে পিস্তল আর আরেক হাতে চাপতি নিলাম।
পিছন দিকের কমন রুম দিয়ে ঢুকে পরলাম।
কার ও ধারনা ছিল না -- এমনটি করা যাবে।
শিবিরের দুই জনকে পেলাম হটাত।
সাথে সাথে এক্গনকে দিলাম কোপ।
আরেকজনকে শুট করলাম।
লাইফের প্রথম শুট।
ঢুকে পরছি।
নির্দেশ অনুযায়ী বেশি পিস্তল ব্যবহার করা যাবে না।
হত্যার সংখা বেশি বাড়ানো যাবে না।
পুলিশের নির্দেশ।
স্বপ্নের মত লাগছে।
যেন গাছ কাটছি।
লাল রস ছিটিয়ে পরছে এদিক সেদিক।
নির্দেশ পেযে একটা রুমের দিকে যাচ্ছি।
দরজা ঠেলতেই সামনে একজন।
টুপি পড়া।
না বুঝার আগেই পেটে পোচ দিলাম।
তারপর চেহারায় তাকালাম।
হায় হায়।
সেই হাসান ভাই টা না?
ও আল্লা -- এ কি করলাম।
কেন আগে দেখলাম না?
রাজশাহীতে কলেজের প্রথম বর্ষ তে ভর্তির সময় বাসায় এসেছিল দাওআত দিতে - অনুষ্ঠানে নিয়ে গিয়েছিল - রাতের খাবার খেয়েছিলাম।
বাসায় পৌছে দিয়েছিল।
কয়েকবার পরে ও এসেছিল।
কি অমায়ক আচরণ। কি ভাল মানুষ। বাসার লোকদের খোজ খবর নেয়া!
অতিরঞ্জিত মনে হত!
পরে ভাল ও লাগত!
অবশ্য অন্যত্র চলে যাওয়ায় আমার সাথে আর যোগাযোগ হয়নি।
হাত থেকে চাপাটি পরে গেল।
সজল বলল বেরিয়ে যেতে।
চলে এলাম।
কিন্তু শেষের ঘটনাটি ছাড়া আর কিছুই মাথায় আটকে থাকল না।
কিছুতেই হাসান ভাইয়ের কথা ভুলতে পারছি না ...
কিছুতে ই না
সে কি মারা গেছে নাকি জীবিত আছে তাও -জানি না খবর নেই নি - বা খবর পাইনি।
---
সপ্তাহ যায়
মাস যায়
বছর যায়।
............................
সময়াবর্তে আজ আমি সেই শিবিরের দলে।
ইসলাম নিয়ে পড়াশুনা করার সুবাদে ই বলা যায়!
দায় ভার নিয়ে সারাদিন পরিশ্রম চলে।
আহারে অসহায় কোন তরুণ যদি একটু ও ইসলামের কথা শুনে সেই প্রত্যাশায়।
আমি মনে করে মহার করুনাময় আল্লাহর এ এক বড় অনুগ্রহ আমার প্রতি।
আজ ২৮ শে অক্টোবর আমি বক্তাদের ভাষন শুনছি -- 'আল্লাহর আইন চাই - সত লোকের শাসন চাই'
আহারে মানুষেরা যদি এর মর্যাদা বুঝত!
"আমি যদি এই কুরআনকে কোন পাহাড়ের ওপর নাযিল করতাম তাহলে তুমি দেখতে পেতে তা আল্লাহর ভয়ে ধসে পড়ছে এবং ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে৷ আমি মানুষের সামনে এসব উদাহরণ এ জন্য পেশ করি যাতে তারা (নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে) ভেবে দেখে৷" (সুরা হাশর)
আহারে অধিকাংশ লোক আসলে ই অবুঝ। মহা শক্তিধরের প্রতি ভয় শুন্য! পরকালের ভয় শুন্য!
একজন দায়ী হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টিতে আমাদের প্রয়াস -- আহারে আল্লাহ যদি এর বিনিময়ে অতীতের সব অপরাধ ক্ষমা করে দিত!
আমার ভাইদের ই তো হত্যা করেছি!
তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র চালিয়েছি অবলীলায়!
হটাত গুলির শব্দ শুরু হয়ে যায়।
আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ইকবাল গং দের নেতৃত্বে আমাদের দিক দিয়ে আক্রমন শুরু করে।
মঞ্চ থেকে নেতৃবৃন্দের অনুনয় তখন ও চলছে --
"কেউ তাদের আঘাত করবেন না!!
কেউ তাদের আঘাত করবেন না!!
আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন!
মৃত্যুর ফয়সালা জমিনে হয় না - আসমানে হয়!!
আল্লাহু আকবার!"
আমি আপ্রান চেষ্টা চালাচ্ছি --লোকদের সুসৃন্খল রাখতে!
পশ্চিম দিকে লোকদের পাঠাচ্ছি!
সব চিন্তা ভাইদের নিয়ে।
তাদের আক্রমন থেকে রক্ষার্থে।
পাঠাতে পাঠাতে কখন আমি এক প্রান্তে পরে গেলাম বুঝলাম না!
ওরা চলে এসেছে অনেক কাছে।
হাতে লাঠি বৈগা!
হটাত গুলির শব্দ।
পাঞ্জাবি মনে হল লাল হয়ে যাচ্ছে!
সব ঘোলা হয়ে আসছে!
আমার চারদিকে লাঠি বৈগা নিয়ে আমার উপর চড়াও।
কিন্তু আমি অনুভূতিহীন।
দেখলাম সব স্থির হয়ে গিয়েছে।
দেখলাম -- হাসান ভাই -- আহারে কি সুন্দর হাসি হাসছেন!
আমি ক্ষমা চাওয়ার অনুনয়ের আগেই তিনি বললেন --
ক্ষমা আল্লাহর কাছে চাইবে কেবল! চল ভাই -- দেরী কেন?
এত দেরী কি করতে আছে এসময়?
সবাই যে অপেক্ষা করছে!
চল -- তারাতারি চল।
ভাই আমার!
আমি হাসান ভাইয়ের হাত ধরলাম। আহা কি শান্তি!
*****************************************
পারস্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়েছে আমাদের!
ভয়ঙ্কর আক্রমন আর তাদের ও প্রতিরোধ!
চারিদিকে আর্ত চিত্কার। হাহাকার।
তাদের সংখ্যা শেষ হয় না।
আমি প্রানান্ত করে যাচ্ছি।
সারা শরীর মনে হয় কেটে গেছে।
তাতে কি?
আল্লাহ কি আমায় ক্ষমা করবেন?
প্রানপ্রিয় নবী (স) কি আমার দিকে তাকিয়ে সেরকম হাসবেন -- যেমনটি সেই প্রথম জীবনে হেসেছিলেন ?
যুদ্ধের অন্ধকার!
ঘোলা হয়ে আসছে।
আমি কি শত্রু পরিবেষ্টিত হয়ে পরেছি?
আমি কি অনুভূতিহীন হয়ে পরেছি?
এত আরাম লাগছে কেন?
আমি কি নবিজি (স) এর স্মিত হাসি দেখছি?
আহারে -- সেই প্রিয় হাসি।
আমার প্রানপ্রিয় ব্যক্তি!
আপনার হাত মোবারক ধরব এর চেয়ে সুখ আর কিছু কি আছে?
হে প্রানপ্রিয়! আপনার প্রতি কোটি কোটি সালাম!
বিষয়: বিবিধ
১৫৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন