সত্য ঘটনা অবলম্বনে (৩): রং বদলানো নদী

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ২১ অক্টোবর, ২০১৩, ০৪:১৮:৩২ বিকাল

শেষ বিকেলের আলো। মোহময় আকাশ। পাখিরা ফিরে যায়। কর্ণফুলির পার ঘেষে আমরা দাড়িয়ে। আব্বু, ভাইয়া আর আমি।

আব্বু আর ভাইয়া ইসলামী আন্দোলনের সাথে যেন মিশে আছে।

দিন রাত এদের মিছিল আর মিছিল।

প্রতিবাদ।

ইসলামের পতাকাবাহী আলোকিত মানুষদের জন্য যেখানে প্রকৃতি নিয়ত বন্দনা করছে - এর প্রতিদানে এই প্রকৃতির শোভা দেখার সময় এদের কই?

তাই জোর করে টেনে এনেছি এদের আমার অতি প্রিয় জায়গায়। পানি ঝিলিক মারছে -- রং বদলাচ্ছে মাঝ নদী।

মনের রং ও বদলাচ্ছে। মনে পড়ে যায় সেদিনের কথা।

মগবাজারে একটি বাসায় সেদিন সুরা রহমান থেকে আমাদের তাফসির হচ্ছিল। ছোট রুম। আমার ছাত্রী সংস্থার কয়েকজন এই নিয়মিত কোরআনের দারসের প্রোগ্রামে যথাসময়ে উপস্থিত ছিলাম। স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে দেশের মানুষ এখন প্রতিবাদি। জেগেছে কর্ণফুলির জোয়ারের মতই। আমরা ই বা বসে থাকব কেন?

কোরআনের তাফসির বন্ধ আওয়ামী সরকারের প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকেই।

যেন এক ফেরাউনের রাজত্ব শুরু হল।

বিবেক কি এমন অন্যায় সহ্য করবে? সে কি অপ্রতিবাদী বসে থাকবে?

তাই বুয়েটের এসাইনমেন্ট হাফ ডান করে চলে এসেছিলাম। এই সপ্তাহ হল ডেডলাইন। তবু ও এলাম। কোরআনের দারস শুনব বলে।

হটাত কিছু না বুঝার আগেই পুলিশ হুর মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ল। সিগেরেটের তীব্র গন্ধ আসছিল। খুব ই বাজে মুখের ভাষা। চেচাচ্চিল। এটা কি ক্রিমিনালদের আড্ডা ? এখানে বুয়েট, মেডিকেল আর বিশ্ব বিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রী মিলে কোরআনের কথা শুনছে মাত্র ।

আমার কেন জানি হাসি পেল। মুচকি হাসলাম ও। কারণ পুলিশের ওসির চেহারার সাথে নায়ক অনন্ত জলিলের অসম্ভব মিল।

কথাবার্তার লেভেল কিছুটা হলেও চলত। কিন্তু তার কথার মাঝে সবচেয়ে সুন্দর কমন শব্দাবলী হল: "কুত্তার বাচ্চা"।

কোন মেয়ে পুলিশ ছাড়াই গাড়িতে তোলা হল। আমাদের মাঝে একজন প্রেগনেন্ট মেয়ে ও ছিল। কিভাবে ২০ বছরের একটা প্রেগনেন্ট মেয়েকে তারা গাড়িতে তুলল? আমরা কি পরাধীন দেশে বাস করি? নাকি কোন চিড়িয়াখানায়?

আমার আব্বা বীর মুক্তিযোদ্ধা। আব্বা প্রায় ই বলে থাকেন, "কেন এদেশ স্বাধীন করতে প্রানান্ত চেষ্টা করলাম?"

আর দু"খে প্রায়ই কাদেন।

ইসলামের পথে থাকার জন্য তিনি আজ 'রাজাকার'।

কিট পতঙ্গ সম দেশের নেতাদের পা-চাটা শাহবাগী নতুন প্রজন্ম না বুঝে 'রাজাকার রাজাকার' বলে ই যাচ্ছে!

চিন্তা ভাবনা নাই।

হাওয়ার উপর জীবন চালানো এই প্রজন্মের ৪২ বছরের দেশজ হায়নাদের প্রমাণিত অত্যাচার চোখে পরে না।

হায় 'হওয়া-মে-উরতা দোপাট্টা প্রজন্ম'!

কারাগারে থেকে ছোট জানালা দিয়ে আকাশ দেখি।

ঘুরি কাটাকাটি দেখি।

শব্দহীন চারিদিক।

শব্দহীন জীবনের কাটাকাটির একটা স্বপ্ন হটাত দেখা শুরু করি।

মনে হয় আমি শত বছর আগের আরব সম্রাজ্য দূর থেকে দেখছি।

আমার মাঝে হেলুসিনেশন তৈরী হচ্ছে।

রোমানদের কারাগারে বন্দী এক মুসলিমার আর্তনাদ খলিফার কাছে এক অশ্বারোহী পৌছে দিতে ঘোড়ায় ছুটে চলছে।

আমি যেন সত্যিই দেখছি সেই মানুষটির শক্ত চোখ।

আমি দেখছি সেই ঘোড়ার ক্ষুরে ছিটিয়ে পরা উপত্যকার বালু।

আমি দেখছি কথা শোনা মাত্রই দাড়িয়ে পরা খলিফার রুদ্র মূর্তি - পরক্ষনেই তার শক্ত চোখে গড়িয়ে পড়া পানি।

আমি দেখছি মুহুর্তে সৈন্যদের প্রস্তুতি -- যুদ্ধযাত্রার সুচনা।

এক মুসলিমার প্রতি অন্যায় আচরণে ইসলামের পতাকাবাহিদের আর্তনাদ এবং কর্মসূচি -- পরাশক্তির বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ!

কত সহজে জীবন বিলিয়ে দেয়ার প্রত্যয় এদের!

কত গর্বিতা সেই জেলবন্দী রমনী!

হটাত মনে হয় -- আমি নিজেই সেই জেলবন্দী রমনী।

আমি যেন দেখছি --

রাজপথে শিবিরের বজ্রমুঠি আর সেই মুসলিম সেনাদের বজ্রমুঠি - এক মাপে গড়া!

সেই অস্বারহির চোখ প্রস্ফুটিত হয়ে যায় 'নারায়ে তাকবির' বলা অচেনা কোন শিবিরের ভাইয়ের চোখে!

ঠিক এক শক্ত চোখ।

ঠিক এক প্রত্যয়।

কি আস্চর্জ মিল।

হটাত দেখি ১৩০০ বছর আগের নেকাব দেয়া কোন মহিলা-তাবেঈ আহত এক সৈন্যের বাহুর রক্ত মুছে দিচ্ছে। শক্ত পট্টি বেধে দিচ্ছে। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে রক্ত-বান বাধার তীব্র প্রয়াস চালাচ্ছে।

হটাত দেখি আমি সেই মহিলার মাঝে অনুপ্রবিস্ট। সেই তাবেই-সৈন্যের চেহারায় শিবিরের ই এক ভাইয়ের প্রতিচ্ছবি!

চিনি না।

তবু মনে হয় কত যুগের পরিচিত।

চোখ বন্ধ করে আছে কেন?

লজ্জা পাচ্ছে?

চোখ তুলে দেখলে হয়ত দেখত --

আহত আপন ভাইয়ের মতই পুলিশের গুলিতে আহত এক তরুনের বাহুর রক্তবন্ধে এক বোনের সর্বত প্রচেষ্টা।

আর এই গল্পের লেখক কল্পনায় দেখছেন অসম্ভব সুন্দরী একজন মায়াবতী কি প্রানান্তই না করে যাচ্ছেন!

আর আহত ভাইটি অসম্ভব সুরে তেলাঅয়াত করে যাচ্ছেন -- ''আর রাহমান। আল্লামাল কুরআন। খালাকাল ইনসান ...."

-----------

ঠিক একই সময়ে কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

এ সন্ধা-লগ্নে বাংলাদেশের অন্য এক প্রান্তে একটি ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে।

ঘটনাটি একটি যুবকের।

ঘটনাটি এরকম:

আমি পিস্তল হাতে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিচ্ছি।

কয়েক বার কপালে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চাপব চাপব করে আর চাপা হয়নি।

সাহস ও পাচ্ছি না।

ইয়াবার প্রভাব এখন ও কাটে নাই পুরপুরি।

আমি ভার্সিটির ছাত্রলীগের আহ্বায়ক। ভয়ঙ্কর ক্যডার। শাহবাগী এক পরিচিত ব্লগারের ছোট ভাই আমার চোখের শত্রু। সেও নিজকে একই জায়গায় লীগের আহবায়ক দাবি করে বসে আছে।

আমি নিশ্চিত কাজটি ওই হারামি ই করেছে।

আমার সাথীদের টাকা খাওয়ায়ে এই ভয়ঙ্কর কাজটি করল।

আমাকে মদে বুদ করল।

ইয়াবায় বুদ করল।

কামাইল্লা বলল, 'ঘরে একটা মাল রশি দিয়ে বাধা আছে। এমন মজা আর কই পাবি?"

ধর্ষণের সেন্চুরিয়ান ছাত্রলীগের মানিকের উত্সবের পুরো আয়োজন করেছিল এই কামাইল্লা।

বন ভয়াজ করেছিল জাহাঙ্গীর নগর ভার্সিটির অনতিদূর এক কটেজে।

'ধর্ষণের মত এমন মজার কাম আর নাই।' কামাইল্লা বলল।

আমি তখন ঘোরে।

মদ, ইয়াবার প্রতিক্রিয়ার আমার পশুভাব তখন পুরোপুরি দৃশ্যমান।

এক ধাক্কায় দরজা খুললাম।

ঘর অন্ধকার করা।

কোন লাইট নাই।

'ওই মাগী। এদিক তাকা।'

বাইরে হালকা হাসি শুনি কেন?

কামাইল্লার হাসির শব্দ না?

ফোনে কি কার সাথে কথা বলছে?

ওরা ও কি মদ আর ইয়াবায় বুদ?

আমি একটানে বেল্ট খুললাম।

কাছে যাচ্ছি।

টর্চ মারলাম।

ঝাপসা দেখছি -- ঘন চুল -- চেহারা দেখা যাচ্ছে।

রেনু!! হায় আমার আপন বোন্!!

এক দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলাম ।

দৌড়াচ্ছি।

জঙ্গলের ঝোপ ঝাড়ের কাটায় শরীর কেটে যাচ্ছে কি?

হৃদয় তো তখন ই কেটে গিয়েছে!

কামাইল্লা কি কাজটাই না করল!

কি প্রতিশোধ নিল।

..... মনটা খান খান ভেঙ্গে গিয়েছে ।

লেকের পাড়ে থামলাম। পিস্তল বের করলাম আত্ম্হথ্জা করতে হবে।

আর কোন উপায় কি আছে?

অনেক ভাবছি।

প্রতিশোধ নিব?

একই প্রতিশোধ?

সব গুলোকে হত্যা করব?

-----------------------

সূর্য ডুবে যাচ্ছে। মাগরিবের আজান দুরে ভেসে আসছে।

'নামাজের পথে এস। কল্যানের পথে এস।' কি সুমধুর আহ্বান।

কর্ণফুলির পাড়ে ১৯৭১ এর এক মুক্তিযোদ্ধা পিতা ২০১৩ এ আরেক মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যয়ে দুই বাহুতে আল্লাহর পথের ছেলে আর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে আছেন।

আল্লাহর কাছে গোপন দোয়া করছেন।

বেয়ে চলে অশ্রুধারা।

অপরুপা মেয়েটি পরম মমতায় পিতার হাত ধরে থাকে। তার চোখের জল কেউ দেখে না ।

আর একই সময়ে জাহাঙ্গীর নগর অনতিদুর থেকে একটি গুলির শব্দ ভেসে আসে।

কা কা ডেকে উঠে কতগুলো কাক।

বিষয়: বিবিধ

১৫৩৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File