উম্মাহাতুল মু'মিনীন (মুমিনদের মাতাগন) || রেসালতের প্রতি ঈমানের তত্ব্গাথা (২)

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ০১ আগস্ট, ২০১৩, ০৯:০৬:০৩ রাত

পর্ব- ২

আপনি যদি মনে করেন যে নবিজি (স) এমন কিছু -করেছেন যা না করলে ভাল হত অথবা তা করা উচিত হয়নি, অথবা অন্যভাবে করা যেত তবে আপনি শুধু গুনাহ ই করলেন না বরং ঈমান থেকে সহজেই বিচ্যুত হলেন। ইসলাম থেকে অগোচরেই সরে গেলেন।

মুসলিম হিসেবে আমাদের কাছে রেসালতের প্রতি ঈমানের দাবি এই যে, রাসুল (স) যা করেছেন একজন মানুষ হিসেবে সর্বোচ্চ অবদানই রেখেছেন। অনুরূপে ঈমানের দৃষ্টিকোণ ও দাবি অনুযায়ী তার বিয়ে সংক্রান্ত প্রগ্গা হল: তিনি এক্ষেত্রে সবচেয়ে উত্তম কাজটি করেছেন মানবিক কর্ম-ক্ষমতা এবং উত্কর্যতার দৃষ্টিকোণ থেকে।

মা আয়েশা (রা) এর সাথে মহানবী (স) এব নিয়ে প্রসঙ্গে বলা যায়, সুবহানাল্লাহ, শয়তান সবসময়েই প্রফেশনাল বা দক্ষ ভাল কে মন্দ আর মন্দ কে ভাল রূপে মানুষের সামনে তুলে ধরতে।

এই বিয়ের ঘটনায় নাম মাত্র মুসলমানদের কথা বাদ ই দিলাম, ঈমানের ঘাটতি যাদের আছে তারা ও অনেক সময় সংশয়ে নিমজ্জিত হয়। লজ্জিত হয়। প্রসঙ্গ বদলাতে চায়।যে মন ইসলাম কে কেবল মামুলি ধর্ম হিসেবে চিন্তা করে, সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ইত্যাদিসহ সকল ক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা যে জীবনের আসল লক্ষ্য হওয়া উচিত - সে সম্পর্কে কোন ধারনা অনুপস্থিত, সে বিষয়ে চিন্তাও করেনা, সে মনকেই কেবল তা স্বল্প জানার কারণে আক্রান্ত করতে পারে। তাদেরকেই শয়তান সংশয়ে ফেলে দেয় এক্ষেত্রে।

কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যপার হল: আবহমান কাল থেকে এই মুসলিম উম্মাহর যে কয়টি সর্বতকৃস্ট এবং সর্বোত্তম ঘটনা ঘটেছে 'রহমত' হিসেবে সেই লিস্টের মধ্যে একেবারে প্রথম দিকে থাকবে মহানবী (স) এর সাথে আয়েশা (রা) এর বিয়েটি। এটি প্রকৃতপক্ষে মহানবী (স) এর সকল বিয়ের মাঝে সর্বোত্তম বিয়ে।

কেন?

এর উত্তর বুঝার জন্য চিন্তা করুন এই বিয়েটি যদি না হত, তবে আমরা , এই উম্মাহ কি বা কোন সম্পদ হারাত?

মহিয়সী আয়েশা (রা) হলেন চতুর্থ নম্বরে সবচেয়ে বেশি হাদিস বর্ণনার দিক থেকে।

অর্থাত আবু হুরায়রা, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর এবং আনাস বিন মালিক (রা) এর পরপরই সর্বোচ্চ হাদিস বর্ণনাতে এই জ্ঞানী মহিয়সী নারীর অবস্থান।

এমন কোন ফিকহ এর বই পাওয়া যাবে না যেখানে আয়শা (রা) এর বর্ণিত হাদিস বা মতামত নেই।

হাজর আসকালানী (র) এর মতে, পৃথিবীর বুকে জ্ঞানের দিক থেকে মা আয়েশা (রা) সবচেয়ে বড় মহিলা-স্কলার । অধিকাংশ স্কলারের মতে, তিনি খাদিজা (রা) এর থেকেও বেশি জ্ঞানী।

চিন্তা করুন: আমাদের ধর্ম আসলেই ভিন্ন রকমের হত যদি মহানবী (স) এর সাথে আয়েশা (রা) এর বিয়ে না হত।

কিভাবে একজন মুসলমান সাহস (dare) করে অথবা সন্দেহে পড়ে এই বিয়ের বিষয়ে যখন এ বিয়েটি সবচেয়ে উত্তম ও উপকারী (blessed ) ঘটনা পুরো মুসলিম উম্মাহ এর জন্য?

কখন ও সুক্ষ্মভাবে কি চিন্তা করে দেখেছেন?

রাসুলুল্লাহর এ বিয়ের বিষয়ে কোন অন্তর্নিহিত কার্যকারণ বা উদ্দেশ্য নিহিত ছিল পরম কৌশলী আল্লাহর তরফ থেকে সেটা মুসলমানদের ভাবা উচিত -- যেই উদ্দেশ্য বুঝাও মনে করি এই উম্মাহর জন্য এক ব্যপক পথনির্দেশনা স্বরূপ!

ভেবে দেখুন: সাধারনভাবে রাসুলুল্লাহ (স) তার বিপ্লবী জীবনে যা কিছু করেছেন - তার মূল উদ্দেশ্য কি ছিল?

এর একমাত্র উত্তর হল: ইসলামের প্রচার ও প্রসার - এবং পরিশেষে ইসলামের বিজয় ও প্রতিষ্ঠা।

এমনকি নবুয়াতের পূর্বেও মহানবী (স) যা কিছু করেছেন -- সব ই আল্লাহর সুক্ষ্ম পরিকল্পনার আলোকে ই হয়েছিল -- যার শেষ টার্গেট ছিল ইসলামের বিজয়। মহানবী (স) জানতেন না কখন ই তার ভবিস্যত। এমনকি বিবি খাদিজা (রা) এর সাথে তার বিয়ে ও আল্লাহর পরিকল্পনা অনুসারে হয়েছিল - যার ভিত্তিমূল ছিল: ইসলামের প্রচার ও প্রসার।

মহানবী (স) ১৫ বছর কম বয়সী ছিলেন বিবি খাদিজা (রা) থেকে - কিন্তু মহা কৌশলী আল্লাহ তায়ালার পরিকল্পনা হল তাদের বিয়ের মাধ্যমে ইসলামের বিজয়ের জন্য প্রেক্ষাপট প্রস্তুত করণ। মহানবী (স) এর জীবনের প্রতিটি ঘটনায় সকল চরিত্র (actors) এবং ঘটনা সেই বিজয়ের টার্গেটেই ধাবিত হয়েছে।

আয়েশা (রা) এর সাথে মহানবী (স) এর বিয়ে প্রসঙ্গে সেই সময়কার প্রেক্ষিত একটু ভেবে দেখুন:

(১) একই রকমের বিয়ে তখন প্রচলিত ছিল। এমনকি আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের মত ইসলামের চরম শত্রু ও মুনাফেক সর্দার ও এই বিয়ের বিরোধিতা করেনি।

মুনাফিক বা কাফেররা মহানবী (স) এবং তার পরিবারদের নিয়ে অনেক অপপ্রচার চালিয়েছে। অনেক বর্ণনা ও বিদ্যমান। অথচ মজার ব্যপার, আয়েশা (রা) এর সাথে মহানবী (স) এর বিয়ের বয়স-ঘটিত ব্যপারে কোন একটি বর্ণনাও পাওয়া যায় না।

(২) তথাকথিত নারীবাদী ও প্রগতির নামে উলঙ্গপনাবাদিরা (যারা এক অর্থে ইসলামের চির শত্রু) যারা মহানবী (স) এর সাথে আয়েশা (রা) এর বিয়েকে ঘৃণ্য বলে মন্তব্য করে তাদের জানা উচিত যে, "যখন মা আয়েশা (রা ) এর মত মহিয়সী নারী এবং জ্ঞানের তারকা এতই সন্মানিত (honored) এবং খুশি (pleased) ছিলেন বিশ্বনবী (স) এর সাথে বিয়েতে - সেখানে ওই তথাকথিত প্রগতিবাদীরা কোন ছাড়!!?

ওই ছাড়দের কত বড় সাহস তাকে (আয়েশা (রা)) প্রটেক্ট করা বা ডিফেন্ড করার মত ভন্ডামি করা নিয়ে!

যখন রোমান সম্রাট হিরাকল- যে কিনা বর্তমান যুগের পরিশক্তি-রাজদের মত অশিক্ষিত নয়। বরং ধর্মীয় জ্ঞান ও রাজ-পরিচালনা দুই দিক থেকেই পটিয়সী ছিলেন। সেই বিজ্ঞ রাজপতির উক্তি হল (যা 'হিরাকলের হাদিস (বুখারী) নামেও প্রচলিত): "আমি যদি সেখানে থাকতাম তবে আমি তার (মহানবী (স)- এর ) পা ধুয়ে দিতাম! এরকম প্রায় অর্ধ-পৃথিবীর রাজপতি যেখানে সন্মান বোধ করতেন যদি মহানবী (স) এর পা ধুয়ে দিতে পারেন -

প্রত্যেক নারী মনেপ্রাণে সন্মানিত বোধ করতেন যদি মহানবী (স) এর সাথে সম্পক জুড়তে পারতেন -- সেখানে তোমরা কোন ছাড় আসছ - নারীবাদের নাম কুলাঙ্গার আসছ - মহানবী (স) এর সাথে আয়েশা (রা) এর বিয়ে নিয়ে সমালোচনা করতে? আয়েশা (রা) কে ডিফেন্ড করার নামে ইসলাম কে গালি দিতে? যদি মহিয়সী আয়েশা (রা) মনেপ্রানে প্রচন্ড ভালবাসতে পারেন মহানবী (স) কে - অজস্র বর্ণনা আর ঘটনা যার সুস্পস্ট সাক্ষী -- সেখানে তুমি কে আসছ তাদের বিষয়ে কথা বলতে? কমন সেন্স না থাকলেই কেউ মুর্খের মত এমন কাজ করতে পারে।

(৩) আল্লাহ আয়েশা (রা) এর মনকে স্কলার-এর ধাঁচে প্রস্তুত কর্রেছিলেন। সকল নারীই এই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবে না।

তার যোগ্যতা ছিল একেবারে স্বতন্ত্র। আয়েশা (রা) নিজেই বলেন: "যখন সাহাবারা মহানবী (স) এর যেকোন নির্দেশ শুনে মুহুর্তে পালন করতে সদা প্রস্তুত থাকতেন একেবারে এক সৈন্যবাহিনীর মত"।

কোন প্রশ্ন নয়। প্রশ্নই আসে না! সেখানে একমাত্র আয়েশা (রা) মহানবী (স)কে প্রশ্ন করতেন নির্দিধায়। তিনি বলেন: "যদি মহানবী (স) কিছু বলতেন আমি জিজ্ঞাসা করতাম এবং তার সাথে সে ব্যপারে আরও বিশদ আলোচনা করতাম।" কারণ তাদের মাঝে ইনফরমাল সম্পর্ক ছিল (স্বামী-স্ত্রীর)।

ঘটনা কেন ঘটেছিল? কেন এভাবে করতে হবে? কেন অন্যভাবে নয়? হাজার প্রশ্ন করতেন সহজে - যা একটি চিন্তাশীল বিজ্ঞ গবেষকের মননের ই প্রতিবিম্ব! এরুপ নিরন্তর ঘটনাই আয়েশা (রা) কে তৈরী করেছিল তাবেইদের জন্য একজন মহান শিক্ষিকা হিসেবে, একজন ফকিহ হিসেবে।

ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, "আমাকে আল্লাহ একটি বিজ্ঞ জবান দিয়েছেন" - অর্থাত হিকমাহ (wisdom) এবং সকল ঘটনা বিশ্লেষণের এক অনবদ্য যোগ্যতা তার ছিল।

ঠিক একই ভাবে আয়েশা (রা) এর ছিল এক সুক্ষ্মদর্শি বিজ্ঞ মনন এবং দূরদর্শিতা।

(৪) মানুষ যত কম বয়সী হবে তত তার মাথা-মগজ শক্তিশালী হবে কোন কিছু স্মরণ রাখতে। আমাদের ধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ন দিক হল মুখস্ত করা বা রাখা। যেমন কোরআন হাদিস মনে রাখা যাতে ইসলামের প্রচারক হিসেবে অনবদ্য ভুমিকা রাখা যায়। এ জন্য সবচেয়ে উত্তম বয়স হল ৬ এবং উর্ধ। এজন্য স্কুল শুরু হয় ৬ বছর থেকে। আপনি যদি একজনকে স্কুলে আনেন ১৮ বছর বয়সে -- তবে তা ইতিমধ্যে অনেক দেরী হওয়া ছাড়া আর কিছুই নয়।

এজন্য আল্লাহ আয়েশা (রা) এর ভাগ্যে বিয়ে রাখলেন ৬ বছর বয়সে এবং তিনি ঘরে উঠলেন ৯ বছর বয়সে।

এজন্যই মা আয়েশা বিরাট মাপের সাহাবা যেমন আবু বকর, ওমর, ওসমান, আলী (রা) সবার থেকে অনেক অনেক বেশি হাদিস বর্ণনা করতে পেরেছেন - মুসলিম উম্মাহর জন্য জ্ঞানের সম্ভার রচনা করতে পেরেছেন। এই উম্মাহ তার মত মহিয়সী ত্যগী নারীর কাছে চির ঋণী থাকবে।

চার খলিফাই অল্প কিছু দিনই বেচে ছিলেন। একমাত্র আয়েশা (রা) ই জ্ঞানের সম্ভার আর মহানবী(স) প্রশিক্ষিত দূরদর্শীতা আর বিচক্ষনতা নিয়ে "তাবেয়ী" দের যুগে প্রবেশ করেছিলেন শিক্ষিকা হিসেবে।

সাহাবারা কেবল কাজই করেছিলেন। কারণ তারা ছিলেন প্রকৃত কর্মী। যেখানে মহানবী (স) এর মত জ্ঞানের শহর তাদের প্রশিক্ষকের ভূমিকায় বিদ্যমান তখন আর চিন্তার কি? তারা করে গিয়েছেন কাজ আর কাজ - ইসলামকে দুনিয়ার প্রতিষ্ঠায় জিহাদ আর সর্বত সংগ্রাম।

কিন্তু তাবেয়ীনরা পেলেন প্রস্তুত রাজ্য। তাই তারা মনোযোগী হলেন জ্ঞানের উত্কর্সতায়। তারা ছিলেন জ্ঞানের প্রজন্ম - দুনিয়া আর মানবতা যাদের পেয়ে জ্ঞানে ধন্য হয়েছিল।

কিন্তু তাদের শিক্ষক কোথায়? কোন কোন সাহাবা প্রশিক্ষকের ভূমিকায় এই জ্ঞানের বহুদাবিস্তৃত প্রজন্ম তৈরিতে অনবদ্য ভুমিকা রেখেছিলেন?

উত্তরে বলা যায়:

- আব্দুল্লাহ ইবনে মাসুদ (রা)

- আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা)

- আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা)

- আয়েশা (রা)

অতএব কম বয়সে বিয়ের সুফল হিসেবে মহিয়সী জ্ঞানী ও রাসুলুল্লাহর তত্বাবধানে প্রশিক্ষিত আয়েশা (রা) তাবেইনদের শিক্ষিকা হিসেবে এক জ্ঞানে উত্কর্ষ প্রজন্ম বিনির্মাণে অনবদ্য ভুমিকা রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর সকল প্রশংসা মহা পরিকল্পনাকারী, সুকৌশলী এবং পরাক্রান্ত আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের জন্য।

(চলবে)

বিষয়: বিবিধ

১৩৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File