উম্মাহাতুল মু'মিনীন (মুমিনদের মাতাগন) || রেসালতের প্রতি ঈমানের তত্ব্গাথা (১)
লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ৩১ জুলাই, ২০১৩, ১০:৪৮:২০ রাত
মূল: ইমাম আনোয়ার আওলাকি
ভাবান্তর: মঞ্জুর আশরাফ
পরম করুনাময়ের নামে শুরু করছি। এই বিষয়ে আমি আলোচনায় উত্সাহী কারণ
(১) নবীদের স্ত্রীগণ আমাদের মাতা। তারা আমাদের মাতা। আমাদের মাতাদের সম্পর্কে জানা উচিত।
(২) আবহমানকাল ধরে ইসলামের শত্রুদের দিয়ে প্রচুর প্রোপাগান্ডা মহানবীর (স) স্ত্রীগণের তথা মুমিনদের মাতাদের বিরুদ্ধে হয়েছে। এটি নতুন কিছু নয়। মহানবী (স) এর সময় মুনাফেক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই মা আয়েশা (রা) এর বিরুদ্ধে একটি বড় আক্রমন করেছিল চারিত্রিক প্রশ্ন এবং মিথ্যা অপপ্রচার ছড়িয়ে। আয়েশা (রা) এর পক্ষে সাক্ষী হিসেবে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বল আলামিন তা সুরা নুরে বলেছিলেন এবং ওই মিথ্যা চক্রান্ত বানচাল করেছিলেন।
রাসুল (স) কে আক্রমনের বিভিন্ন উপায় বর্তমান। যা আবহমান কাল থেকে শত্রুরা করে আসছে। কখন ও তাকে সরাসরি বা চরিত্রের উপর আক্রমনের মাধ্যমে, কখন ও তার পবিবারকে বা তাদের চরিত্রের উপর আক্রমনের মাধ্যমে, কখন ও তার সঙ্গী সাহাবীদের বা তাদের চরিত্রের উপর আক্রমনের মাধ্যমে।
আমাদের চিন্তা করা উচিত - মহানবী (স) এর ইমেজ তথা চরিত্রকে ধ্বংস করতে শত্রুদের এত চিরন্তন উত্সাহ কেন?
আবু হুরায়রা (রা) এর অনেক আক্রমন (হত্যার ষড়যন্ত্র) হয়েছিল। তার উপর এক অসফল আক্রমনকারী ধরা পরার পর স্বীকার করেছিল, " আমরা বাণী বাহককে হত্যা করতে চেয়েছিলাম যাতে মূল বাণী ই (ইসলাম) পৃথিবী থেকে ধ্বংস হয়ে যায়।"
"... এরা তোমাকে মিথ্যা বলে না বরং এ জালেমরা আসলে আল্লাহর আয়াতকেই অস্বীকার করছে৷" (আনআম ৩৩)
অর্থাৎ আপনার সাথে তাদের কোন সংঘর্ষ নয়, বরং তাদের শত্রুতা ইসলামের বিরুদ্ধে। ইসলামী জীবন বিধানের বিরুদ্ধেই তাদের সকল কুটকৌশল আর অপপ্রয়াস ।
এজন্যই আমদের মহানবী (স) এর পক্ষে দাড়াতে হবে - তার বিরুদ্ধে অপপ্রচারের বিরুদ্ধে সর্বতভাবে প্রতিবাদী হতে হবে। এর কারণ এই নয় যে তার চারিত্রিক অবয়বের 'ডিফেন্স' বা প্রতিরক্ষা প্রয়োজন। বরং এটি মানুষদের নিজেদের মঙ্গলের জন্যই প্রয়োজন। কারণ মানুষেরা নিজেরাই অধপতনের অতলে নিমজ্জিত হবে যদি তার বাণী গ্রহণ না করে।
প্রকৃতপক্ষে তার বিরুদ্ধে অপপ্রচার তার কোন ক্ষতিই করতে পারবে না। বিশ্বের যেকোন প্রান্তে কোন না কোন মসজিদে ঠিক এই মুহুর্তে মুয়াজ্জিন ডাকছেন 'আশ হাদু আন্না মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ ...' ।
প্রতি মুহুর্তে বিশ্বব্যপী তার মত অনবরত প্রশংসা যেকোন সময় বা স্থানের আর কে পেয়েছে বা পাবে?
তার অনুসারীরা তাকে নিজেদের প্রানের চেয়ে ও বেশি ভালবাসে। আমার পরিচিত নাইজেরিয়ান এক ব্যক্তির নাম মোহাম্মদ আশারা। অর্থাত মোহাম্মদ দশম। আমি তার নামের তাত্পর্য বা কারণ জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন তার পিতা মহানবী (স) কে এটি ভালবাসেন যে তার প্রত্যেক সন্তানের নাম রেখেছে মোহাম্মদ। ভাইদের পৃথক করতে 'এক', দুই, ইত্যাদি যোগ করেছেন মোহাম্মদ নামের শেষে: যেমন মোহাম্মদ ওয়াহেদ (১), ..... মোহাম্মদ আশারা (১০) ইত্যাদি। চিন্তা করুন: মহানবীর জন্য কেমন ভালবাসা!
********************************
মহানবী (স) এর মা আয়েশা (রা) এর সাথে বিয়ে প্রসঙ্গে বলা হয়: তিনি কিভাবে একজন আট বছরের শিশু বিয়ে করলেন?
এক্ষেত্রে কি যুক্তি দিতে পারি?
অনেক মুসলিম যুক্তি দেন যে, ওই হাদিসের সনদে দুর্বলতা আছে। অনেকে বয়স ১৮ হবে যুক্তি দেয়ার প্রয়াস চালান।
কিন্তু আমরা একটি অথেন্টিক বর্ণনা অনুসারে বলতে পারি - আয়েশা (রা) ছিলেন ৬ বছর এবং তাকে ঘরে তুলে নেয়ার সময় বয়স ছিল ৮।
ঠিক আছে - আমরা তবে এ বিষয়ে কি যুক্তি পারি?
আমি মনে করি অমুসলিমদের সাথে বা ইসলাম বিদ্বেষীদের এ বিষয়ে বিতর্ক করা পুরোপুরি অর্থহীন।
কেন?
কারণ আয়েশা (রা) এর সাথে রাসুল (স) এর বিয়ে রাসুল (স) নিজ উদ্যোগে করেননি। প্রকৃতপক্ষে যে দুটো বিয়ে (১) আয়েশা (রা) এবং (২) জয়নব বিনতে জাহশ (রা) নিয়ে ইসলাম বিদ্বেষী বা বিধর্মীদের এত মাথা ব্যথা -- সেই দুটো বিয়েই সরাসরি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশের তিনি বাস্তবায়ন করেছিলেন।
প্রথমত: সুরা আহযাবে জয়নব বিনতে জাহশ (রা) এর সাথে বিয়ে বিষয়ে স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের নির্দেশ প্রদত্ত। এমনকি জয়নব বিনতে জাহশ (রা) গর্বিত ছিলেন এবং বলতেন, 'আমি গর্ব বোধ করি যে আর কেউ মহানবী (স) কে বিয়ে করেননি একমাত্র আমি ছাড়া স্বয়ং আল্লাহর সরাসরি নির্দেশে।'
দ্বিতীয়ত: বুখারী(৫৬:৬৭৭), মুসলিম, আহমদ ইত্যাদি হাদিস থেকে এসেছে: রাসুল (স) বলেন, "আমাকে স্বপ্নে আয়েশাকে (ছবি) দেখানো হয়েছিল এবং জিব্রাইল (আ) বলেছিলেন, 'ইনি আপনার স্ত্রী এই দুনিয়ায় এবং আখেরাতেও'।
এই স্বপ্ন নবীজি (স) তিন দিন দেখেন।
আর নবীদের স্বপ্ন কি? উত্তর হল: 'ওহি' (আরবি: রুহিয়াল আম্বিয়া ওয়াহী (আল হাদিস))
অতএব, এই দুইটি বিয়ে যা নিয়ে ইসলাম-বিদ্বেষীদের এত বিস্ময় আর অপপ্রচার - তা নবীজি (স) নিজ উদ্যোগে করেননি। বরং স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার নিজ পরিকল্পনার এবং জ্ঞানে তা সংঘটিত করেছিলেন। ছিল আল্লাহর সরাসরি নির্দেশ আর রাসুল (স) এর বাস্তবায়ন।
অতএব, ইসলামের শত্রুদের কাছে আমরা সময় নস্ট করব না (বোকার মত) - প্রমান আর যুক্তি দেয়ার জন্য যে কেন মহানবী (স) এই বিয়ে করলেন বা তিনি ঠিক কাজ করেছেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি।
আমরা তাদের সামনে সরাসরি উপস্থাপন করব যে, এ কাজটি স্বয়ং আল্লাহর তরফ থেকে ঐশিবাণী। এটা সরাসরি আল্লাহর নির্দেশ। এখন আল্লাহর এ নির্দেশ তারা পছন্দ করুক আর নাই করুক, তা কেবল তার ই ব্যক্তিগত বিষয়। যদি এই নির্দেশটি সে অপছন্দ করে তবে উপসংহার হল: ওই লোকটির মূল সমস্যা 'কোরআন আল্লাহ প্রদত্ত সত্য বাণী কিনা তা নিয়েই তার আসল সংশয়'!
ওই লোকের নবীজি (স) এর আয়েশা (রা) কে নিয়ে বিয়ে নিয়ে আসলে সমস্যা নেই। বরং তার সমস্যা আরও ভয়ঙ্কর: তা হল তার সমস্যা আল্লাহকে নিয়ে - তার নির্দেশকে স্বীকার করা নিয়ে!
অতএব, সমাধান কি?
তাকে একথা বলা যে, এটি আল্লাহর একটি আদেশ - যেমন নামাজ পরা, রোজা রাখা ইত্যাদি আদেশ। ঠিক এই বিয়ে দুটো ও সম মানের আদেশ নবীজি (স) এ জন্য। নামাজ, রোজার যৌক্তিকতা নিয়ে ইসলাম-দ্রোহী দের প্রশ্ন যেরকম হাস্যকর হবে - একই যুক্তিতে তার বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন ও একই রকম হাস্যকর হবে।
তাকে বলবেন আপনি ইসলামের বেসিকে আসুন। ইসলামের আকিদা বা প্রাথমিক কনসেপ্টে শিক্ষা নিন।আমরা যদি বলে, আল কোরআন সত্য - এ বিষয়টি সমাধা হয়ে যাবে। কিভাবে? কোরআন সত্য সঠিক এবং বিশ্ব-প্রতিপালকের থেকে এসে থাকলে এর সব কিছুই সত্য এবং সব চেয়ে উত্তম। তা অস্বিকার করা হল: তার ঈমান অস্বিকার এরই নামান্তর। অতএব, কেউ যদি মহানবী (স) এর বিয়ে সংক্রান্ত কোরআন এবং হাদিসের নির্দেশ অস্বিকার করে সে এক বিরাট সমস্যাতে ইতিমধ্যেই হাবুডুবু খাচ্ছে -- আর তা হল সে ইতিমধ্যেই ঈমান-চুত। তাই তার সামনে ঈমানের থেকেও অনেক গৌন বিষয় - যেমন রাসুল (স) এর বিযে সংক্রান্ত লজিক উপস্থাপন কোন অর্থে যৌক্তিক?
কারণ আল্লাহ যদি বিশ্ব-স্রষ্ঠা হন, তার সৃষ্টিকে 'একাজ কর' বা 'একাজ করবে না' বলার পূর্ণ ইখতেয়ার স্রষ্টার থাকবে। আমি বা আপনি সেখানে বিরোধিতা করা বা অভিযোগ করা নিতান্তই বোকার মত আচরণ ভিন্ন আর কিছুই নয়! এই হাস্যকর কাজটি ই বোকার মত ইসলাম-দ্রোহীরা করছে নিরন্তর!
অতএব, ইসলাম-বিদ্বেষী বা কাফেরদের সাথে রাসুল (স) এর বিয়ে সংক্রান্ত 'গৌন' বিষয় নিয়ে বিতর্কে দয়া করে সময় নস্ট করবেন না -- যেখানে তারা সরাসরি 'মুখ্য সমস্যাতে' (কোরআনের বিশ্বাসযোগ্যতাতেই তারা এ বিশেষ ক্ষেত্রে সন্দিহান - লজিকটি উপরে বিস্তারিত দেয়া হয়েছে ) জর্জরিত।
সরাসরি কোরআনেই যান -- সেখানের উক্তি দিয়েই তাদের উত্তর দিন। এতটুকুই যথেষ্ট!
-- দুই--
বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে এর উত্তর কেমন হবে?
এই ইস্যুটি এমন এক সমস্যা যা মুসলিম দেশে মুসলিমদের মাঝে উত্তোলিত হয়না।
বরং পাশ্চাত্যে মুসলিমদের মাঝে উত্তোলিত হয়।
কিভাবে এর উত্তর দিব?
আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত বুখারীর একটি হাদিস দিয়ে শুরু করছি:
একবার নামাজের পর (ফজর) রাসুল (স) সাহাবাদের দিকে ঘুরলেন এবং একটি গল্প বলা শুরু করলেন: একটি গরু ছিল। তার মনিব তাকে মারধর করত এবং তাকে দিয়ে যানবাহনের কাজ করত।
একদিন গরুটি কথা বলে উঠল: "আমি এ কাজের জন্য তৈরী হইনি। আমি তৈরী হয়েছি কৃষি কাজের জন্য।"
সাহাবারা বিস্ময়ে বললেন: "সুবহানাল্লাহ! একটি গরু কিভাবে কথা বলে উঠে?"
রাসুল (স) এর উত্তর কি ছিল?
"ফা ইন্নি উমিনু বি হাজা ওয়ানা আবি বকর ওয়া ওমর"
অর্থাত: "আমি এটি বিশ্বাস করি, আবুবকর এবং ওমর (ও বিশ্বাস করে)"
হাদীসটির রাবি "আবু হুরায়রা (রা)" বলেন: সে সময় আবু বকর এবং ওমর (রা) উপস্থিত ছিলেন না।
নবিজি (স) আরেকটি গল্প বলা শুরু করলেন: একটি নেকড়ে ছিল।যে একবার মেষপাল থেকে একটি মেষ চিনিয়ে নিল। রাখালটি অনেক কষ্টে ওই মেষ টিকে নেকড়ে থেকে ছাড়িয়ে আনল।
নেকড়ে বলে উঠল: "আজ না হয় মেষ টিকে ছাড়ালে।কিন্তু সে সময় কি করবে যখন এই মেষপালের কোন রাখল থাকবে না - কেবল নেকড়েই থাকবে!
সাহাবারা বিস্ময়ে বললেন: "সুবহানাল্লাহ! একটি নেকড়ে কিভাবে কথা বলে উঠে?"
রাসুল (স) এর উত্তর এখন ও ছিল:
"ফা ইন্নি উমিনু বি হাজা ওয়ানা আবি বকর ওয়া ওমর"
অর্থাত: "আমি এটি বিশ্বাস করি, আবুবকর এবং ওমর (ও বিশ্বাস করে)"
এই হাদিসটি তে রাসুল (স) নক্ষত্র তুল্য সাহাবাদের কি শিক্ষা দিচ্ছেন?
শিক্ষা বুঝার জন্য আগে খেয়াল করুন সুরা নাজমে আল্লাহ কি বলছেন নবিজি (স) প্রসঙ্গে?:
৩) সে নিজের খেয়াল খুশীমত কথা বলে না৷
৪) যা তার কাছে নাযিল করা হয় তা অহী ছাড়া আর কিছুই নয়৷
রাসুল (দ) বুঝাচ্ছেন / শিখাচ্ছেন যে, তিনি যা বলেন বা যা করেন তা আল্লাহর জ্ঞান বা নির্দেশ প্রদত্ত বলেই বলেন বা করেন। অতএব, প্রশ্নাতীতভাবে তা মেনে নিও যদিও না
- তুমি পছন্দ কর বা ন কর
- তোমার যুক্তিতে তা না বুঝে আসুক বা আসুক
- সবকিছুই তুমি বঝবে - লজিকাল মনে হবে তা সত্য নাও হতে পারে।
বরং অনন্ত জ্ঞানের অধিকারী এবং কৌশলময় আল্লাহর তরফ থেকে অহীপ্রাপ্ত হয়ে আমি (রাসুল (স)) তোমাদের যা দেই তা অকপটে গ্রহণ কর যেমনটি আবু বকর এবং ওমর (রা) করেন।
এ ঘটনাটি আবু বকর এবং ওমর (রা) এর অতি উচ্চ স্তরের ঈমানের ও নির্দশনা দেয়। তিনি বলছেন যে, তারা এখানে নেই। কিন্তু রাসুল (স) এর কোন নির্দেশ বা বিষয় তারা অবগত হলে সন্দেহাতীত ও প্রস্নাতিত্ভাবে মেনে নেয়াই আবু বকর, ওমরের মত ঈমানদারদের পরিচয়।
অতএব, রাসুল (স) এর সিরাতের / জীবনীর যেকোন বিষয় যদি মনে আমাদের মুসলিমদের মনে প্রশ্ন জাগায় -
যেমন তার বিয়ে, বনু করায়্জার হত্যা, ইত্যাদি তবে আমাদের একমাত্র উত্তর হবে: স্রষ্টা আল্লাহর নির্দেশে নবিজি (স) যা করেছেন তা অপটিমাল এবং সর্বোত্তম ছিল নি:সন্দেহে।
এটাই হল 'একিন - এটাই হল 'রেসালতের প্রতি ঈমানের তত্ব্গাথা' !
[২২ শে রমজান দিবাগত রাত্রি, ২০১৩]
(চলবে)
বিষয়: বিবিধ
২৩৭২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন