পরাজয়ে ডড়ে না বীর (২)

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ১৭ জুলাই, ২০১৩, ১০:০৬:৩৭ সকাল

[দুই]

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুরা ইমরানে এরশাদ করেন:

১৪০) এখন যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে, তাহলে এর আগে এমনি ধরনের আঘাত লেগেছে তোমাদের বিরোধী পক্ষের গায়েও এ – তো কালের উত্থান পতন, মানুষের মধ্যে আমি এর আবর্তন করে থাকি ৷ এ সময় ও অবস্থাটি তোমাদের ওপর এ জন্য আনা হয়েছে যে, আল্লাহ দেখতে চান তোমাদের মধ্যে সাচ্চা মুমিন কে ? আর তিনি তাদেরকে বাছাই করে নিতে চান, যারা যথার্থ ( সত্য ও ন্যায়ের ) সাক্ষী হবে --কেননা জালেমদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না

১৪১) – এবং তিনি এই পরীক্ষার মাধ্যমে সাচ্চা মুমিনদের বাছাই করে নিয়ে কাফেরদের চিহ্নিত করতে চাইছিলেন ৷

১৪২) তোমরা কি মনে করে রেখেছ তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে ? অথচ এখনো আল্লাহ দেখেনইনি, তোমাদের মধ্যে কে তাঁর পথে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এবং কে তাঁর জন্য সবরকারী৷

১৪৩) তোমরা তো মৃত্যুর আকাংখা করছিলে ! কিন্তু এটা ছিল তখনকার কথা যখন মৃত্যু সামনে আসেনি৷ তবে এখন তা তোমাদের সামনে এসে গেছে এবং তোমরা স্বচক্ষে তা দেখছো

------------------

'পরাজয়ে ডড়ে না বীর' লেখার প্রতিপাদ্য হিসেবে মূলত সুরা ইমরানের উপরোক্ত ১৪০ থেকে ১৪৩ আয়াতের তত্ব আলোচিত হবে ইনশাল্লাহ।

সকল সময়ে আর স্থানে অত্যাচারী শাসক আর পরাশক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আল্লাহর পথের মুজাহিদদের ধৈর্যের সাথে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা আর কর্ম পদ্ধতি প্রদানে সক্ষম ওই আয়াতগুলো| এ থেকে মোট ৭টি শিক্ষা পরিবেশিত হবে ।

শিক্ষাগুলো ইসলামী আন্দোলনে প্রচেষ্টারত ঈমানদারদের শান্তি দিক , ভয়াবহ বিপদে দৃড়তা দান করুক, প্রগ্গা, ধৈর্য আর সাহসিকতার মাধ্যমে তাদের পরিচালিত করুক এই প্রত্যাশা করি।

শিক্ষা ১:

সুরা ইমরানের ১৪০ আয়াত থেকে আল্লাহ বলছেন, "এখন যদি তোমাদের আঘাত লেগে থাকে, তাহলে এর আগে এমনি ধরনের আঘাত লেগেছে তোমাদের বিরোধী পক্ষের গায়েও"

এর তাত্পর্য কি শুধু অতীত স্মৃতি চারণ ই কেবল? না। বরং অতীত ঘটনাকে যে ভবিষ্যতের কাজের স্পিরিটে পরিনত করা যায় - মহা কৌশলী আল্লাহ সেই শিক্ষাই দিচ্ছেন এখানে। নিচে খেয়াল করুন:

ইসলামের দুশমনরা বদরে নাজেহাল হয়েছিল, পরাস্ত হয়েছিল। পরাজিত হওয়ার পর কাফের বাহিনীর মনোবল ভেঙ্গে যাওয়ার কথা। শুধু পরাস্তই নয়, কাফেররা তাদের প্রায় সকল নেতাদেরকেই হারিয়েছিল বদর যুদ্ধে।

কিন্তু তারা কি মনোবল ভেঙ্গেছিল? হতাশ হয়েছিল?

আল্লাহ ওহুদের পরাস্ত মুসলমানদের বলছেন, কাফের রা যদি মনোবল না ভেঙ্গে প্রতিশোধ নিতে সৈন্য সামন্ত যোগাড় করে আগের চেয়ে আর ও বেশি শক্তি যোগে তোমাদের বিরুদ্ধে ওহুদের যুদ্ধ করতে আসতে পারে, তবে তোমরাও একই রকম কাজ ভবিষ্যতে করতে পারবে না কেন?

ওহুদে যাই হোক, তোমরা থেমে থাকবে কেন? যাই ঘটুক না কেন - যতই দু:সময় আসুক না কেন - জিহাদ চালিয়েই যেতে হবে প্রগ্গা আর হেকমতের সাথে।

হতাশ হওয়া যাবে না। থেমে থাকা যাবে না। ধৈর্য ধর। নিজ আত্মাকে লালসার কাছে পরাজিত করা যাবেনা।

শিক্ষা ২:

১৪০ নং আয়াতে সঞ্চালিত হচ্ছে: " এ – তো কালের উত্থান পতন, মানুষের মধ্যে আমি এর আবর্তন করে থাকি ৷ এ সময় ও অবস্থাটি তোমাদের ওপর এ জন্য আনা হয়েছে যে, আল্লাহ দেখতে চান তোমাদের মধ্যে সাচ্চা মুমিন কে ? "

অথাৎ মুসলমানদের মাঝেও সকল সময়ে এমনটি ই ঘটবে এটি চিরন্তন বিষয় (universal fact)। একবার জয় আসবে আরেকবার পরাজয় আসবে। কিন্তু মুমিনদের সর্বশেষ ফলাফল হবে: "পরকালের চিরন্তন জয়" এবং এটাই সবচেয়ে উত্তম সফলতা।

অতএব, বর্তমান বিশ্বের কোন মুসলিম দলের উত্থানের বা সাময়িক পার্থিব সাফল্যের পর পুন: পতনে বা শাসকের তীব্র অমানবিক অত্যাচারের ফলে হতাশ হওয়ার কোন কারন নাই। উপরোক্ত প্রতিবাদ্য (বা সূত্র) আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।

ইবনুল কাইউম (রহ) বলেন যদি মুসলমানরা সব সময় জয়ী হতে থাকে, মানুষেরা বুঝে ফেলবে করা প্রকৃত ঈমানদার। স্বার্থবাদীরা তখন কৌশলে পার্থিব লোভে তাদের সাথে মিলিত হবে - দলে ভীর জমাবে। পক্ষান্তরে মুসলমানরা অনবরত পরাজিত হতে থাকলে রাসুল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য পূর্ণ হবে না ( "তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি তাঁর রসূলকে হিদায়াত এবং ‘দীনে হক’ দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি এ দীনকে অন্য সকল দীনের ওপর বিজয়ী করেন, চাই তা মুশরিকদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন৷" (সুরা সফ : ১৩))।

উপরোক্ত 'উদ্দেশ্যমুলক' আয়াতে 'বিজয়' বলতে 'ইসলামকে মানুষের মাঝে ছড়ানো', 'রাজনৈতিক শাসন ক্ষমতা দখল', বিশ্ব ব্যপী ইসলামী হুকুমত কায়েম অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।

সুক্ষ্ম ভাবে খেয়াল করুন: জয় এবং পরাজয়ের ক্রম আবর্তনে আল্লাহ খারাপ (তথা মোনাফেকদের এবং কাফেরদের ) মুসলমানদের থেকে আলাদাই করেন যা ঠিক পরবর্তী আয়াতের অংশেই বিবৃত হয়েছে:

শিক্ষা ৩:

"...আর তিনি তাদেরকে বাছাই করে নিতে চান, যারা যথার্থ ( সত্য ও ন্যায়ের ) সাক্ষী হবে --কেননা জালেমদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না " (১৪০ নং আয়াতের শেষাংশ)

সত্যিকারের ঈমানের পরীক্ষা হল: জিহাদে অংশ গ্রহণ বা না করা (যেমন- আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সৈন্য নিয়ে যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে এসে মুনাফিক প্রমাণিত হয়েছিল) ।

এর মাধ্যমেই (কে অংশ নিল আর কে নিল না তার মাধ্যমেই ) আল্লাহ সত্যকে তথা সত্যপন্থীদের অন্ধকার তথা জালেমদের (মুনাফেক মূলত) থেকে আলাদা করে দেন।

শিক্ষা ৪:

"... যারা যথার্থ ( সত্য ও ন্যায়ের ) সাক্ষী হবে ..." বাক্যে যে আরবি শব্দ ব্যব হৃত হয়েছে তা হল: "شُهَدَاءَ"

বা "শহীদ"।

ইবনুল কাইউমের (রহ) মতে শহীদ হওয়া হল স্রষ্টার চোখে সর্বোচ্চ সন্মানের ব্যপার ।আল্লাহ তার দ্বীন প্রতিষ্ঠায় শহীদদের সবচেয়ে কাছে টেনে নেন - সবচেয়ে সন্মানিত জায়গা দান করবেন জান্নাতে।

অতএব এই সন্মাননা অর্জিত হবে কেবলি জেহাদে অংশ গ্রহনের মাধ্যমেই। যেমন ওহুদের ময়দানে আল্লাহ ৭০ জনকে (শহীদ হিসেবে) সে সৌভাগ্যে সন্মানিত করেছিলেন।

শিক্ষা ৫:

" এবং তিনি এই পরীক্ষার মাধ্যমে সাচ্চা মুমিনদের [বাছাই] করে নিয়ে কাফেরদের চিহ্নিত করতে চাইছিলেন ৷ " (আয়াত: ১৪১)

এখানে [বাছাই] শব্দটি 'খাটিকরণ' (purify) অর্থেও অনেক তাফসীরকারক বলেছেন।

ইবনুল কাইয়ুম (রহ) বলেন, 'আল্লাহ তার কিছু বান্দাহকে এতই ভালবাসেন যে তিনি তাদের জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তরে জায়গা দিতে চান। কিন্তু তার কৃতকর্ম এমনটি নয় যে সে এমন উচ্চ স্তরে পৌছতে পারবে। এক্ষেত্রে উপায় কি?

রাব্বুল আলামিন তাদের দুদশায় তথা পরীক্ষায় ফেলেন। ক্রমাগত বিভিন্ন পরীক্ষায় তাদের ফেলেন। তাদের জিহাদের ময়দানে উপনীত করেন। সেখানে তাদের হতাশাজনক পরিস্থিতিতে পতিত করেন। অন্যান্য আপন দ্বীনি ভাই ও সহযোগীদের শহীদি মৃত্যু দান করে তাদের মনোবলের পরীক্ষা করেন। এমনকি তাকেও শহীদি মরণ দান করতে পারেন। এভাবে পদক্ষেপের পর পদক্ষেপে তাদের তিনি পরিশুদ্ধ (purify) করেন যাতে সরাসরি তারা জান্নাতের সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হতে পারেন। সুবহানাল্লাহ।

পক্ষান্তরে, ইবনুল কাইয়ুমের মতে, "ধ্বংস কাফেরদের" বলতে যা বুঝানো হয়েছে তা হল নিম্নরূপ:

আল্লাহ কিছু কাফের ও মুনাফিকদের এতই অপছন্দ করেন যে তাদের জাহান্নামের সর্বনিম্ন স্থানে নিয়ে যেতে চান প্রকৃত প্রমানের ভিত্তিতে।

যেমন ধরুন, উতবা ইবনে আবি ওয়াক্কাস বা ইবনে কায়মিয়ার কথা! যারা ওহুদের ময়দানে রাসুল (স) কে আহত করেছিল। এটা কি তাদের জন্য ভাল কোন কিছু ? আল্লাহ তাদের দুনিয়াতেই খারাপির মাধ্যমে প্রমানসহ এমন ভাবে রেখে দিতে চান যাতে বিন্দুমাত্র ক্ষমার যোগ্য এরা না হয় পরকালে!

ওই দুই কুলাঙ্গার মহানবী (স) কে আহত করার জন্য কি জাহান্নামে চির-আফসোস করবে না? ভয়ঙ্কর শাস্তি কি তারা অনন্ত কাল উপভোগ করবে না ওই ভয়ানক খারাপ কাজের সুবাদে?

একই ভাবে কোন কোন পরাশক্তি মুসলমানদের পিপড়ার মত হত্যা করে - পিষে মারে। মুনাফিক শাসকেরা পরাশক্তির আশ্রয়ে প্রশ্রয়ে ঈমানদারদের জেলে পুরে - রাখে অত্যাচার করে বছরের পর বছর - হত্যা করে। ঈমানদারদের জীবন দুর্বিসহ করে দেয়। এগুলো কি পরকালের জন্য ভয়ঙ্কর অত্যাচারের প্রমান স্বরূপ থেকে যাচ্ছে না?

স্বৈরাচারদের মহা কৌশলী আল্লাহ এমন ই সুযোগ স্তরে স্তরে দেন যে, ঐ দুষ্ট শাসকেরা অত্যাচারের দরিয়া বইয়ে দেয় ইসলামপন্থীদের উপর অথবা নিগৃহিত দেশবাসীর উপর। যাতে করে জালেম শাসকেরা খারাপির চূড়ায় উন্নীত হয়ে যায় অজস্র প্রমান সহকারে। ফলশ্রুতিতে পরকালে তাদের বিন্দুমাত্র সুযোগ দেয়া হবেনা।

যেমন, ফেরাউন বছরের পর বছর বনি ইসরায়েলকে কল্পনাতীত ভয়ঙ্কর অত্যাচার করেছে। এভাবে মূলত আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে কেইসের (case) পর কেইস প্রস্তুত করছেন। আল্লাহ তাদের অন্তর জানেন এবং তাদের মনের অবস্থা তাদের কাজের মাধ্যমেই বেরিয়ে আসে। তারা অত্যাচার করে ভাবে তারা জয়ী হচ্ছে - শাসন ক্ষমতা পাকাপোক্ত করছে। মূলত আল্লাহ তাদের নিয়ে মজাদার খেলা খেলছেন।অজস্র অত্যাচারের প্রমান প্রস্তুত করছেন। যাতে বিচারের দিবসে কোন সুযোগ দেয়া ছাড়াই স্রষ্টা তাদের জানাবেন:

﴿يَا أَيُّهَا الَّذِينَ كَفَرُوا لَا تَعْتَذِرُوا الْيَوْمَ ۖ إِنَّمَا تُجْزَوْنَ مَا كُنتُمْ تَعْمَلُونَ﴾

হে কাফেরগণ! আজ ওযর প্রকাশ করো না৷ তোমরা যেমন আমল করছিলে তেমনটি প্রতিদানই দেয়া হচ্ছে৷

(তাহরিম: ৭)

... তাদের সমস্ত কর্ম নষ্ট হয়ে গেছে, কিয়ামতের দিন তাদেরকে কোনো গুরুত্ব দেবো না৷"

(সুরা কাহাফ ১০৫)

"পৃথিবীতে অপরাধ করার সময় তোমরা গোপন করতে তখন তোমরা চিন্তাও করোনি যে, তোমাদের নিজেদের কান, তোমাদের চোখ এবং তোমাদের দেহের চামড়া কোন সময় তোমাদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেবে৷ তোমরা তো বরং মনে করেছিলে, তোমাদের বহু সংখ্যক কাজকর্মের খবর আল্লাহও রাখেন না৷

তোমাদের এই ধারণা যা তোমরা তোমাদের রব সম্পর্কে করেছিলে তোমাদের সর্বনাশ করেছে এবং এর বদৌলতেই তোমরা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছো৷

এ অবস্থায় তারা ধৈর্য ধারণ করুক (বা না করুক ) আগুনই হবে তাদের ঠিকানা৷ তারা যদি প্রত্যাবর্তনের সুযোগ চায় তাহলে কোন সুযোগ দেয়া হবে না৷"

(হা-মীম আস সাজদাহ: ২২-২৪)

পরকালে ওই ঘৃণ্য স্বৈরাচারেরা আর তাদের তাবেদারেরা কোন যুক্তিই দিতে পারবে না!

ইনসাফের দৃষ্টিকোণ থেকে কোন সুযোগই পাবে না।

শিক্ষা ৬:

"তোমরা কি মনে করে রেখেছ তোমরা এমনিতেই জান্নাতে প্রবেশ করবে ? অথচ এখনো আল্লাহ দেখেনইনি, তোমাদের মধ্যে কে তাঁর পথে প্রাণপণ যুদ্ধ করতে প্রস্তুত এবং কে তাঁর জন্য সবরকারী৷ " (আয়াত ১৪২)

এটিই সফলতার মূলনীতি । এটি সহজ কোন বিষয় নয়। কিন্তু অধিকাংশ মানুষই এ বিষয়টা বুঝে না। তারা ভাবে কিছু জিকির - আজকার - নামাজ, রোজা ইত্যাদি ইবাদত করে জান্নাত অর্জন করে ফেললাম। অথচ এ আয়াতে জান্নাত অর্জনের জন্য আল্লাহ এক কঠিন শর্ত জুড়ে দিয়েছেন। তা হল: আল্লাহর পথে জীবন দেয়ার শতভাগ অভিপ্রায় এবং নির্যাতনে সবর/ধৈর্য ধরার প্রয়াস।

জান্নাত সহজ কোন বিষয় নয়। জান্নাত হল মহা-মূল্যবান। মূল্যবান জিনিস অর্জনে পৃথিবীর জীবনেই অনেক সাধনা করতে হয়। আর অনন্তকালের কল্পনাতীত সুখভোগের স্থান জান্নাত লাভের জন্য কি আপনার সর্বোচ্চ ত্যগ করতে হবে না?

(রাসুল স) স্বয়ং বলেছেন "এমনকি আমি জান্নাতে যাব কেবল আল্লাহর দয়ার বলেই"।

শিক্ষা ৭:

"তোমরা তো মৃত্যুর আকাংখা করছিলে ! কিন্তু এটা ছিল তখনকার কথা যখন মৃত্যু সামনে আসেনি৷ তবে এখন তা তোমাদের সামনে এসে গেছে এবং তোমরা স্বচক্ষে তা দেখছো৷" (আয়াত ১৪৩)

এ আয়াত এটাই নির্দেশ দেয় যে প্রকৃত যুদ্ধ বা লড়াই পূর্বশর্ত এটা প্রমান করার জন্য যে, তোমরা জিহাদের নিয়্যত করেছিলে যার মাধ্যমে জান্নাত অর্জন করতে চাও।

মূলত, আল্লাহ-দ্রোহিদের বিরুদ্ধে রাজপথে বা যুদ্ধ ক্ষেত্রে লড়াইয়ের মাধ্যমে আল্লাহ প্রমান রেখে দিতে চান -

কারা মনের আর কর্মের উভয় দিক থেকে নীতিগতভাবে আল্লাহর পথে জীবন বিসর্জনে প্রত্যাশী। যাতে তিনি তাদের উপযুক্ত পুরস্কৃত করতে পারেন।

জিহাদের গুরুত্ব বুঝানোর জন্য একটি বিস্ময়কর হাদিস বলেই এ লেখার সমাপ্তি টানব।

হাদিসটি বনি ইস্রাইল দের সম্পর্কিত। রাসুল (স) বলেছেন, 'বনি ইস্রায়লদের অনেক আশ্চর্য ঘটনা ঘটেছিল'।

রেসালতের প্রতি ঈমানের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রশ্নাতীতভাবে মেনে নেয়াই ঈমানদারদের বৈশিষ্ট।

আবু দাউদ ও আহমদ থেকে হাদিসটি সংকলিত। জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা) থেকে হাদিসটি বর্ণিত। রাসুল (স) বলেন বনি ইসরাইলের এক দল লোক কোন কবরের কাছাকাছি ২ রাকায়াত নামাজ পড়ল এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করলেন কোন মৃত ব্যক্তিকে উত্থানের জন্য (অলৌকিক উপায়ে) যাতে তারা 'মৃত্যু' বিষয়ে জানতে পারেন। একজন শ্যমল বর্ণের (সাদা কালো মিশ্রিত) লোক উঠলেন। তার কপালে সিজদার চিহ্ন বর্তমান।

উত্থিত ব্যক্তিটি বললেন "আমার কাছে আপনারা কি চান? আমি ১০০ বছর পূর্বে মারা গিয়েছিলাম এবং কবরের আজাবের উত্তাপ মাত্র শেষ হয়েছে। দয়া করে আল্লাহর কাছে দোয়া করুন যাতে তিনি আমাকে আমার প্রথম অবস্থায় নিয়ে যান।"

চিন্তা করুন। একজন নামাজী। তবুও কবরের ভয়াবহ আজাবের মধ্য দিয়ে পরিচালিত হয়েছে (হয়ত অন্যান্য গুনাহ এর কারণে )।

এ অবস্থা থেকে কেবল একটি অবস্থাই মানুষকে নি:সন্দেহে বাচাতে পারে - তা হল শাহাদাতের মরণ। কারণ যে ৬ টি উপকার শাহাদাতের মরণের পর রয়েছে (তিরমিজি, ইবনে মাজাহ থেকে বর্ণিত এক হাদিস অনুযায়ী) তার একটি হল কঠিন সময়ের মুক্তিলাভ তথা কবরের আজাব ও হাশরের ভয়াবহতা থেকে মুক্তিলাভ!

মহানবী (স) নিজে শহীদ হতে আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন।

আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত, রাসুল (স) বলেছেন, আমি সেই আল্লাহর নামে শপথ করছি যার হাতে আমার জীবন, আমি আশা করি যে আমি আল্লাহর পথে লড়াই করে শহীদ হব, তারপর আবার (দুনিয়ায়) ফিরে আসব, আবার লড়াই করব, আবার শহীদ হব, পুনরায় ফিরে আসব, লড়াই করব এবং শহীদ হব।" (বুখারী ও মুসলিম)

এভাবে তিন তিন বার শহীদ হয়ে মরণের আকাঙ্খী ছিলেন। যেহেতু পবিত্র কোরআনে স্বয়ং আল্লাহ মহানবী (স) কে জয়ী করার ওয়াদা দিয়েছেন তিন জায়গায় (সুরা সফ, ফাতহ এবং তওবা) তথা নিরাপত্তার ঘোষণা স্বয়ং আল্লাহতায়ালা দিয়েছেন, তাই মহানবী (স) সুরক্ষিত ছিলেন শত্রু থেকে এই দুনিয়ায়।

বুখারী ও মুসলিমের একটি হাদিসে এসেছে:

জান্নাতে প্রবেশকারী কেউ ই আর দুনিয়ার জীবন প্রত্যাশী হবেনা। কেবলমাত্র শহীদ ছাড়া। জান্নাতে যে সন্মান সে দেখবে তাতে চাইবে দুনিয়ায় ফিরে এসে দশ বার শহীদ হতে। আরেক বর্ণনায় এসেছে শাহাদাতের মর্যাদায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সে এমনটি প্রত্যাশা করবে। (আবু হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত)

*****************

এরূপ মরণজয়ী মানসিকতার একদল আরব মহানবী (স) এর নেতৃত্বে পৃথিবী জুড়ে বেরিয়ে পড়ার এবং ইসলামকে দুনিয়ার বুকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার এক দুরহ সাহস দেখিয়েছিলেন। 'শহীদ হওয়ার' অমোঘ প্রত্যাশী সাহাবাদের এজন্য ইসলামের শত্রুদের সৈন্য-সংখ্যা, কুট -চাল, পার্থিব প্রলোভন, কিছুই পরাস্ত করতে পারেনি। পৃথিবীর লালসার প্রতি নির্মোহ মুজাহিদরা মৃত্যুকে আলিঙ্গনে হাসিমুখে প্রস্তুত ছিলেন। আর তাই, সারা পৃথিবীর সম্পদ তাদের পায়ে লুটিয়ে পড়েছিল। তবু তারা সবই পরিত্যাগ করেছিলেন। প্রায় প্রত্যেক সাহাবী তাদের জীবনান্তে শাসক, বিচারক, যুদ্ধের সেনাপতি কিংবা অধ্যাপনা করে আল্লাহপ্রদত্ত এক সন্মানজনক ভুমিকা পালন করেন।আর অন্যভুবনে তারা আল্লাহর প্রিয় পাত্রই থাকবেন ইনশাল্লাহ। আর সব কিছুর মূলে যে দৃড় সংকল্প তাদের কর্মক্ষেত্রে ভুমিকা রাখতে সাহায্য করেছে তা হল: আল্লাহর জমিনে আল্লাহ প্রদত্ত জীবন ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠায় 'শহীদ' হওয়ার চেতনায় আমরণ সংগ্রাম!

একমাত্র দয়ালু আল্লাহর কৃপায় সুরা ইমরানের ১৪০-১৪৩ নং আয়াতকে প্রতিপাদ্য করে 'পরাজয়ে ডরে না বীর' নামক রচিত লেখাটি। ভুল ত্রুটি থেকে থাকলে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।

সকল সময়ে আর স্থানে অত্যাচারী শাসক আর পরাশক্তির রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আল্লাহর পথের মুজাহিদদের ধৈর্যের সাথে ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা আর কর্ম পদ্ধতি প্রদানে সক্ষম ওই আয়াতগুলো।

পরম দয়ালুর কাছে নিবেদন করছি, আপনি আপনার পথের মুজাহিদ দের বর্ণিত শিক্ষাগুলো হৃদয়ে বদ্ধমূল করে দেয়ার তৌফিক দান করুন।

তাদের ক্ষমা করুন। দুই জগতের বিজয়ী হসেবে তাদের গ্রহণ করে নিন।আমিন।

সূত্র:

[১] ড: আলী মুহাম্মদ আস-সালাবি, দা নোবেল লাইফ অফ দা প্রফেট (স), ভলিউম-২

বিষয়: বিবিধ

১৩২২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File