ঈমানের তত্বগাথা (পুনর্জাগরণের মূলমন্ত্র) - (৩)
লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ০৫ জুলাই, ২০১৩, ০৬:০৮:৪০ সন্ধ্যা
[তিন: কর্মপদ্ধতি]
-১-
সাহাবা (রা) রা মহানবী (দ) এর নেতৃত্বে একটি পরিকল্পনা নিয়ে আগাতেন। সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যতই বাধার পাহাড় নেমে আসুক না কেন তার মোকাবেলা করতেন ধৈর্যের সাথে। মক্কার প্রাথমিক যুগের তীব্র অত্যাচারের সময়ে খাব্বাব বিন আরাক (রা) মহানবীর (স) সমীপে এসে একদিন বেদনাক্ষত মনে বললেন, 'আপনি কি আল্লাহর কাছে আমাদের ব্যপারে (অত্যাচার থেকে পরিত্রাণে তথা বিজয়ের জন্য) দোয়া করেন না ?
অন্য কথায়, যেন আমরা অনেক অত্যাচার সয়েছি। অনেক ধৈর্য ধরেছি। যথেষ্ট হয়েছে। তাই দ্রুত ইসলামের বিজয় দরকার!
রাসুল (স) কি বললেন?
তার চেহারা মোবারকে স্পষ্ট ক্রোধ ফুটে উঠল।
বললেন, "তোমাদের পূর্বে অনেক আল্লাহওয়ালা ছিলেন, যাদের একজনকে আনা হত - মাথা বরাবর করাত দিতে তাকে দুই টুকরা করা হত - তিনি ঈমান চ্যুত হতেননা।"
আরেকজনকে এনে লোহার চিরুনি দিয়ে সারা শরীর থেকে মাংস তুলে ফেলা হত । তবু মৃত্যু অবধি মুখে সঞ্চালিত থাকত 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ'!
আল্লাহ এই ধর্মকে অবশ্যই বিজয়ী করবেন যতক্ষণ পর্যন্ত না একজন নির্বিঘ্নে সানা থেকে হাজ্রমাউত পর্যন্ত চলতে পারবে আল্লাহ ছাড়া আর কাউকে ভয় না করে। কিন্তু তোমরা বড়ই তাড়াহুড়া কর!"
রাসুল (স) বলেছেন, একটি পরিকল্পনা অনুসরণ করতে। ইসলামকে বিজয়ী করার মানসে। এই উদ্দেশ্যটি স্বয়ং আল্লাহতায়ালা প্রদত্ত:
"তিনিই সেই মহান সত্তা যিনি তাঁর রসূলকে হিদায়াত এবং ‘দীনে হক’ দিয়ে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি এ দীনকে অন্য সকল দীনের ওপর বিজয়ী করেন, চাই তা মুশরিকদের কাছে যতই অসহনীয় হোক না কেন৷"(সুরা সফ: ৯)
সাহাবাদের (স) সকল পরিকল্পনা, কার্যক্রম, ইবাদত, যুদ্ধ, সন্ধি, কূটনীতি, দাওয়াতি কাজ, ইত্যাদির কেন্দ্রভূমিতে ছিল ওই একটি স্বপ্ন পূরণ (তথা ইসলামকে দুনিয়ার বুকে বিজয়ী করতে প্রানান্ত চেষ্টা চালানো) ।
রাসুল (স) তাদের উপদেশ দিচ্ছেন যে, তাড়াহুড়া করা যাবে না। উপযুক্ত সময়ের পূর্বে প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া যাবেনা। এমন পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হবে না যা সময়-কাল-স্থান অনুযায়ী ঠিক নয়। এর জন্য যদি বহু বছর অপেক্ষা করতে হয় - সুস্থিরতার সাথে সেই অপেক্ষাই করতে হবে। তা না হলে ভুল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
অনেক সময় মনে হতে পারে অমুক দিন থেকে 'খেলাফত' শুরু করতে হবে! অগ্র-পশ্চাত চিন্তা ব্যতিরেকেই। কিন্তু তা কি ঠিক? বাস্তবতা হল অনেক চড়াই উতরাই পাড় হওয়া প্রয়োজন ওই অবস্থায় উপনীত হওয়ার স্বার্থে! পৃথিবীর ইতিহাস ও নবী (স) এর সিরাত আমাদের এ শিক্ষাই দেয়।
ওই অবস্থায় উপনীত হতে আমাদের ভুমিকা কি ছিল তাই বিবেচ্য - আল্লাহর কাছে আমাদের জবাবদিহিতা সেটাই! এই বোধদয়ই কেবল আমাদের বুদ্ধিমত্তার সাথে ইসলামের জন্য ভুমিকা রাখতে তথা পরকালের জবাবদিহিতার ব্যপারে প্রস্তুত করে তুলবে ইনশাল্লাহ।
এই জীবন ব্যবস্থা বিজয়ী হবেই হবে। এটা আল্লাহর ওয়াদা। আল্লাহ তাদের ব্যপকভাবে পুরস্কৃত করবেন যারা এই দ্বীন বিজয়ে অগ্রণী ভুমিকা রাখবেন। কিন্তু প্রশ্ন হল: পুরস্কারের ক্ষেত্রে আমাদের অংশ কেমন হবে? নিজেদের কেমন ভুমিকা থাকবে যার বিনিময়ে আল্লাহ আমাদের পুরস্কৃত করবেন? আমরা কি আন্তরিকতার সাথে যে যার সর্বোচ্চ শক্তিমত্তার প্রয়োগে অগ্রণী ভূমিকায় থাকব? নাকি সাইড লাইনে থাকার মত নিরব, সুবিধাবাদী দর্শকের ভূমিকায় থাকব? সুবিজ্ঞ ও কৌশলী স্রষ্টার দৃষ্টি কি তা এড়িয়ে যাবে?
-২-
সাহাবাদের দায়িত্ব বোধ তথা কমিটম্যন্ট ছিল দৃড় ও নিখুত।
খন্দকের যুদ্ধে রাসুল (স) হুদায়্ফা (রা) কে শত্রু-শিবিরে প্রেরণ করেন গোয়েন্দাহিসেবে।
বললেন, 'শুধু তথ্য নিয়ে আসবে -- আর কিছু করবে না।'
ঝড়ের রাত! প্রচন্ড ঠান্ডা! অন্ধকার চারিদিক।এমনকি পাশের সঙ্গী কেও দেখা যায়না! চৌকস শত্রু সেনাপতি আবু সুফিয়ান সবাইকে বললেন, 'তোমরা পাশের জনকে অবশ্যই জিজ্ঞাসা করবে (তথা তার সম্পকে অবগত হবে)'।
ক্ষিপ্রবুদ্ধি সম্পন্ন সাহাবী হুদায়্ফা (রা) তাত্ক্ষনিকভাবে একজনকে জিজ্ঞাসা করলেন "তুমি কে?" (যাতে কেউ কোন সন্দেহ না করতে পারে তার উপস্থিতি সম্পর্কে!). চিন্তা করুন: ঈমানী যোগ্যতার পাশাপাশি শাণিত বুদ্ধি আর ক্ষিপ্র কর্মদক্ষতা মহানবী (স) এর সঙ্গীদের কেমন ছিল!
সেনাপতি আবু সুফিয়ান আর হুদায়্ফা (রা) এর মাঝে ছিল মাত্র কয়েক হাতের দুরত্ব। তবুও নেতার আদেশ অনুযায়ী আর কোন পদক্ষেপ তিনি নেন নি - যা করা হয়ত তার জন্য সহজই ছিল। (তিনি নিজেই পরে বলছেন, "আমি সহজেই আবু সুফিয়ানকে হত্যা করতে পারতাম। তা করতে উদ্যত ও হয়েছিলাম কিন্তু হটাত মনে পরে যায় নবীজির (স) আদেশ - 'শুধু তথ্য নিয়ে আসবে।' তাই আমি নিজকে সংবরণ করে নেই।)
- ৩-
ঈমান আনার পর পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাব অনেককে উগ্র করে দিতে পারে। এক্সট্রিমিস্ট (চরমপন্থী) -এর অবস্থানে নিয়ে যেতে পারে। রাসুল (স) এর সময়েও এ সমস্যা ঘটেছিল।
তিন জন লোক রাসুল (স) এর স্ত্রীর কাছে এসে নবীজির (স) ইবাদত-পন্থা সম্পর্কে জানতে এসেছিলেন।
তাদের একজন বললেন ' আমি কখন ও রাতে ঘুমাব না - সারা রাত নামাজ পড়ব।'
দ্বিতীয় জন বললেন, ' আমি কখন ও বিয়ে করব না।'
শেষ জন বললেন, 'আমি প্রতিদিন রোজা রাখব।'
একথা শুনে রাসুল (স) হতাশ হলেন। বললেন, ' আমি রাতে নামাজ পড়ি আবার ঘুমাইও, আমি রোজা রাখি আবার রোজা ভেঙ্গেও ফেলি, আমার স্ত্রীগণও রয়েছে। এটিই আমার পথ। যেই এই পথ অনুসরন করবে না সে আমার দলভুক্ত নয়।"
অর্থাত রাসুল (স) তাত্ক্ষনিকভাবে ওই কঠোর ট্রেন্ড বা নিয়ম ভেঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন - এভাবেই প্রস্তুত করছিলেন 'দুনিয়া আর আখেরাত' - এই দুই জগতের বিজয়ী এক দল মানুষদের!
আলী ও উসমান (রা) ও পৃথিবীর বিষয়াদি ছিন্ন করে কেবল ই আখেরাত নির্ভর উদাসী জীবন যাপন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মহানবী (স) কঠোরভাবে তা নিষেধ করেছিলেন।
সালমান ফার্সি (রা) একবার আবু দারদা (রা) এর বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। আবু দারদা (রা) এর স্ত্রী অভিযোগ করেন যে, আবু দারদা পৃথিবীর জীবন যাপন করেন না - একেবারে আখেরাতের জীবনযাপন করেন।
আবু দারদা (রা) দিনের বেলা রাজা রাখতে চাইলেন। সালমান ফার্সি (রা) জোড়পূর্বক তাকে নাস্তা করালেন।
আবু দারদা (রা) রাতে জেগে নামাজ পড়তে চাইলেন। কিন্তু সালমান ফার্সি (রা) বললেন, 'না! ঘুমাতে যাও!'
নবীজি (স) যখন ঘটনা শুনলেন, তখন সালমান ফার্সির পক্ষেই রায় দিলেন। তার বিবেচনা বোধকেই সায় দিলেন।
এভাবে রাসুল (স) সব সময় মধ্যম পন্থী জীবনযাপনে সাহাবাদের অনুপ্রাণিত করতেন, নির্দেশ দিতেন।
পক্ষান্তরে, আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) সম্পর্কে রাসুল (স) বলেছিলেন, "তিনি একজন উত্তম আল্লাহর বান্দা। তবে তার রাত্রিবেলায় আরও বেশি নামাজ পরা উচিত!"
যেই কোন বিষয়ে চরমপন্থী হয় (বেশির দিকে না হয় কমের দিকে) তাকেই নবীজি (স) মধ্যমপন্থী জীবনযাপনে ধাবিত করতে প্রয়াস চালাতেন।
*****************************
আর এভাবেই মহানবী (স) গড়ে তুলেন একদল আদর্শ মানুষ -- জমিনের বুক যাদের পদধুলোয় ধন্য হয়েছিল।
সারা পৃথিবীর বুকে যারা প্রজ্বলিত করেছিলেন ইসলামের অমলিন আদর্শ!
বর্তমান বিশ্বের আল্লাহর পথের সৈনিকদের ঈমানের এই প্রকৃত শিক্ষা আর আদর্শ ধারণ করার মাধ্যমে করুনাময় তাদের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল দান করুন - এই কামনা করার মাধ্যমে ঈমানের তত্ব্গাথা আলোচনার সমাপ্তি টানছি।
রাব্বুল আলামিনের কাছে ভুল ত্রুটি ক্ষমা চাচ্ছি! দরুদ ও সালাম মানবতার মুক্তিদূত রাসুলুল্লাহ (স) এর বরাবর পেশ করছি: সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়ালা আলিহী ওয়াসাল্লিম!
বিষয়: বিবিধ
১২৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন