ঈমানের তত্বগাথা (পুনর্জাগরণের মূলমন্ত্র) - (২)
লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ০৩ জুলাই, ২০১৩, ০৪:৪৮:০১ বিকাল
[দুই]
দ্বিতীয় গল্পটি হল জাদুকরদের নিয়ে।
ফেরাউনের জাদুকরবৃন্দ - যারা মুসা (আ) এর বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছিল ফেরাউনের প্রতিশ্রুত পুরস্কারের প্রলোভনে!
সুরা ত্বাহা তে এসেছে:
৫৭) “হে মূসা! তুমি কি আমাদের কাছে এ জন্য এসেছো যে, নিজের যাদুর জোরে আমাদের দেশ থেকে আমাদের বের করে দেবে?
৫৮) বেশ, আমরাও তোমার মোকাবিলায় অনুরূপ যাদু আনছি, ঠিক করো কবে এবং কোথায় মোকাবিলা করবে, আমরাও এ চুক্তির অন্যথা করবো না, তুমিও না৷ খোলা ময়দানে সামনে এসে যাও”৷
৫৯) মূসা বললো, “উৎসবের দিন নির্ধারিত হলো এবং পূর্বাহ্নে লোকদেরকে জড়ো করা হবে৷
'ইয়াউমুজ জিনা' নামক বিশেষ উত্সবের দিনে সবাই - সারা দেশের লোক সকল সমবেত হলেন।
তাফসিরকারকদের মতে (যেমন ইবনে কাসীর) ৭০-৮০ হাজার জাদুকর সমবেত হলেন এক দিকে আর মুসা (আ) ও ভাই হারুন (আ) অন্যদিকে। তাদের ঘিরে সারা দেশবাসী।
তত্কালীন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ জাদুকরেরা -- একজন দুইজন নয় - কম ধরলেও ৭০ হাজার জাদুকরের বিপক্ষে আল্লাহর দুই সহোদর নবী দাড়িয়ে।
চিত্রটি চিন্তা করুন। কি ভয়ঙ্কর অবস্থা! ঈমানদার মাত্র দুইজন আল্লাহর নির্দেশ ও নির্ভরতায় ৭০ হাজার কাফের দক্ষ জাদুকরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি! কি ঘটবে তা মহিয়ান নবী জানেন না। মনে শুধু বিশ্বাস ও কামনা - আল্লাহর সাহায্যে যদি এরা ইসলামের দাওয়াত পেত!
জাদুকরের বলে উঠল - "ফেরাউনের নাম শুরু করছি! আমরাই জয়ী হব।"
নবী বলে উঠলেন "বিসমিল্লাহ" (আল্লাহর নামে শুরু করছি) !
জাদুকরেরা তাদের সকল প্রকার বস্তু, লাঠি ইত্যাদি ছুড়ে ফেলল মহিয়ান দুই নবী বরাবর।
জাদুর প্রভাবে দৃষ্টিভ্রম তৈরী হল - ছুড়ে ফেলা জিনিসগুলো নড়াচড়া শুরু করল।
অন্যভাবে ভাবুন - আপনার বিরুদ্ধে ৭০ হাজারেরও বেশি জাদু-টোনা গ্রস্থ বস্তু যদি কার্যশীল হয় আপনার মনের অবস্থা কেমন হবে?
ঘটনাটি আল্লাহ বলছেন সুরা ত্বাহাতে:
৬৫) যাদুকররা বললো, “হে মূসা! তুমি নিক্ষেপ করবে, না কি আমরাই আগে নিক্ষেপ করবো?”মূসা বললো, “না তোমরাই নিক্ষেপ করো”৷
৬৬) অকস্মাত তাদের যাদুর প্রভাবে তাদের দড়িদড়া ও লাঠিগুলো ছুটাছুটি করছে বলে মূসার মনে হতে লাগলো
ফলে মুসা (আ) এর কি হল?
৬৭) এবং মূসার মনে ভীতির সঞ্চার হলো।
তাফসিরবিদ সাইয়েদ আবুল আলা মউদুদী (রহ) এর বর্ণনায় বলেন, " মনে হচ্ছে, যখনই হযরত মূসার মুখ থেকে "নিক্ষেপ করো" শব্দ বের হয়েছে তখনই যাদুকররা অকস্মাত নিজেদের লাঠিসোটা ও দড়িদড়াগুলো তাঁর দিকে ফিঁকে দিয়েছে এবং হঠাৎই তাঁর চোখ ভেসে উঠেছে যেন শত শত সাপ কিল বিল করতে করতে তাঁর দিকে দৌড়ে চলে আসছে৷ এ দৃশ্য দেখে হযরত মূসা তাৎক্ষণিকভাবে নিজের মধ্যে যদি একটি আশংকার ভাব অনুভব করে থাকেন তাহলে এটা কোন অবাক হবার কথা নয়৷ মানুষ তো সর্বাবস্থায় একজন মানুষই৷ একজন নবী নবী হলেও মানবিক আবেগ-অনুভীতি এবং অন্যান্য মানবিক চাহিদা থেকে তিনি কখনোই মুক্ত নন৷ তাছাড়া এ সময় হযরত মূসা স্বাভাবিকভাবে এ আশংকাও করে থাকতে পারেন যে, মু'জিযার সাথে এতটা সাদৃশ্যপূর্ণ দৃশ্য দেখে জনসাধারণ নিশ্চয়ই বিভ্রাটে পড়ে যাবে এবং তদের পক্ষে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কঠিন হয়ে পড়বে৷
এখানে একটি কথা অবশ্যি উল্লেখযোগ্য৷ কুরআন এখানে এ কথার সত্যতা প্রমাণ করছে যে নবীও যাদু প্রভাবিত হতে পারেন৷ যদিও যাদুকর তাঁর নবুওয়াত কেড়ে নেবার অথবা তাঁর প্রতি নাযিলকৃত অহীর মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করার কিংবা যাদুর প্রভাবে তাঁকে পথভ্রষ্ট করার ক্ষমতা রাখে না, তবুও মোটামুটিভাবে কিছুক্ষণের জন্য তাঁর স্নায়ুর ওপর এক ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে পারে৷"
করুনাময় আল্লাহ সেই ভয়ঙ্কর অবস্থায় মুসা (আ) কে বললেন,
৬৮) আমি বললাম, “ভয় পেয়ো না, তুমিই প্রাধান্য লাভ করবে৷
৬৯) ছুঁড়ে দাও তোমার হাতে যাকিছু আছে ...
মুসা (আ) কি দেখলেন?
তার ছুড়ে ফেলা লাঠিটি একটি বিশাল সাপের আকার ধারণ করল এবং ৭০ হাজারের অধিক জাদুর বস্তুনিচয় গ্রাস করে ফেলল।
মুসা (আ) কি করলেন?
মুহুর্তে উল্টা দিকে ঘুরলেন এবং দিলেন দৌড়!কোন কিছু দেখার সময় এবং সাহস কোনটিই নেই তার!
চিন্তা করুন! ৭০ হাজারের অধিক মানুষ-সৃস্ট জাদুটোনার বস্তু প্রত্যয়ী মহিয়ান নবীকে যা করতে পারল না আল্লাহ প্রদত্ত একটি মুজেজা কি করল?
মুসা (আ) এর মাঝে অচিন্তনীয় এক ভয়াবহতা তৈরী করল যাতে তার সকল শক্তিযোগে দৌড় দেয়া ভিন্ন আর কোন উপায় থাকল না!
আর জাদুকরদের অবস্থা?
আল্লাহ বলছেন :
৭০) ... সমস্ত যাদুকরকে সিজদাবনত করে দেয়া হলো এবং তারা বলে উঠলোঃ “আমরা মেনে নিলাম হারুন ও মূসার রবকে”৷
আল্লাহ প্রদত্ত মুজেজা ৭০ হাজার অধিক কাফের জাদুকরদের গলিয়ে ফেলল! সেজদা দিয়ে আল্লাহর প্রতি সমর্পণ করে দিল নিজেদের।
অথচ তার পর ও পাষান ফেরাউনের কোন ভাবান্তর নেই!
সুরা ত্বাহাতে সঞ্চালিত হচ্ছে:
৭১) ফেরাউন বললো, “তোমারা ঈমান আনলে, আমি তোমাদের অনুমতি দেবার আগেই” দেখছি, এ তোমাদের গুরু, এ-ই তোমাদের যাদুবিদ্যা শিখিয়েছিল৷ এখন আমি তোমাদের হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কাটাচ্ছি এবং খেজুর গাছের কাণ্ডে তোমাদের শুলিবিদ্ধ করছি এরপর তোমরা জানতে পারবে আমাদের দু’জনের মধ্যে কার শাস্তি কঠিন ও দীর্ঘস্থায়ী”৷ (অর্থাৎ আমি না মূসা, কে তোমাদের বেশী কঠিন শাস্তি দিতে পারে)৷
অর্থাৎ ফেরাউন সবাইকে ইসলাম পরিত্তেগে ভয় দেখানো শুরু করল! অত্যাচারী ইসলাম বিরোধী ও স্বার্থান্বেষী শাসক যুগে যুগে এই কাজটিই করে থাকে!
-----
কিছু সময় পূর্বে কি হয়েছিল তা একটু ভাবুন।
প্রতিযোগিতার পূর্বে জাদুকরের ফেরাউনের কাছে বলেছিল , " আমরা যদি জয়ী হই আমাদের কিভাবে পরস্কৃত করবেন?"
ফেরাউন বলেছিল, "আমি তোমাদের সম্পদশালী করব, তোমাদের পদমর্যাদা বৃদ্ধি করব এবং তোমাদের আমার নিকট-উপদেষ্টাদের অন্তর্ভুক্ত করব!"
সেই ফেরাউন এখন সব কিছু কেড়ে নিচ্ছে -- সম্পদ, পদমর্যাদা তো দুরের - কথা এখন তাদের প্রাণ বাঁচানোই দায় হয়ে পরেছে।
ফেরাউন ইসলাম গ্রহণকারী সকল জাদুকরদের নির্দয়ভাবে প্রাণে হত্যা করতে মরিয়া হয়ে পরেছে - তাদের ভয় দেখাচ্ছে।
তার পর ও জাদুকরের কি বলল? আল্লাহ তায়ালা বলছেন:
৭২) যাদুকররা জবাব দিল, “সেই সত্তার কসম! যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন, উজ্জ্বল সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী সামনে এসে যাওয়ার পরও আমরা (সত্যের ওপর) তোমাকে প্রাধান্য দেবো, এটা কখনো হতে পারে না৷ তুমি যা কিছু করতে চাও করো৷ তুমি বড় জোর এ দুনিয়ার জীবনের ফায়সালা করতে পারো ।
৭৩) আমরা তো তোমাদের রবের প্রতি ঈমান এনেছি, যাতে তিনি আমাদের ভুল ক্রুটিগুলো মাফ করে দেন৷ এবং এ যাদু বৃত্তিকেও ক্ষমা করে দেন, যা করতে তুমি আমাদের বাধ্য করেছিলে৷ আল্লাহই শ্রেষ্ঠ এবং তিনিই স্থায়িত্ব লাভকারী”৷
চিন্তা করুন! কোন বিষয়টি নিকৃস্ট, লোভী, প্রতারক জাদুকরদের মনোজগতে একটি আশ্চর্জজনক পরিবর্তন ঘটাল?
এক-দুই জন নয়, হাজার হাজার জাদুকরের মনের উপর পূর্ণ দখল নিয়ে নিল এক আদর্শ?
সকল কিছুর উপর প্রভাব বিস্তার সহজসাধ্য একমাত্র মনোজগত ভিন্ন!
অথচ কোন জিনিসটি এই অসাধ্য সাধন করল? এমনই পরিবর্তন ঘটাল যে সম্পদ, পদমর্যাদা, রাজ-উপদেষ্টা ইত্যাদি প্রলোভন প্রত্যাখ্যান তো সামান্য ব্যপার - ভয়ঙ্কর অত্যাচারের মাধ্যমে মৃত্যুকে হাসিমুখে আলিঙ্গন করতে সকলে প্রস্তুত হয়ে গেল?
কি অথবা কোন বিষয়টি এই আশ্চর্য পরিবর্তনটি ঘটাল?
এর উত্তর হল: "আল্লাহর প্রতি তাদের ঈমান"!
এটি ই হল ঈমানের তত্ত্ব্গাথা -- ঈমানী পরীক্ষায় উর্তির্ন ভাগ্যবানদের প্রকৃত চিত্র! পার্থিব সকল স্বার্থ সহজে ফেলে দিয়ে সর্বশক্তিমান স্রষ্টার সন্তুষ্টিতে মৃত্যুকে খুব সহজে হাসিমুখে গ্রহনের দৃড় প্রত্যয় ও প্রয়াস! ইসলামী পুনর্জাগরণের এটিই আসল মুলমন্ত্র!
----------
হে আল্লাহ! ঈমানের এ আসল মূল্যমান ও চিত্রকে আপনার পথে প্রচেষ্টারত মুসলমানদের মাঝে ধারণ করার তৌফিক দান করুন। তাদের ভুল ত্রুটি ক্ষমা করে দিন। আপনার ভালবাসার চাদরে তাদের সুরক্ষিত করে দিন! তাদের আপনার মুজাহিদ হিসেবে গ্রহণ করে নিন। কাফের ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে তাদের বিজয় দান করুন। আমিন!
বিষয়: বিবিধ
১৪০২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন