ঈমানের তত্বগাথা (পুনর্জাগরণের মূলমন্ত্র) - (১)

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ০১ জুলাই, ২০১৩, ০৭:০০:১৫ সন্ধ্যা

দুইটি গল্প পরিবেশিত হবে ইনশাল্লাহ। আপনারা চিন্তা করবেন কোন বিষয়টি এ দুই গল্পের মানুষদের (অথবা actors) এক আশ্চর্য পরিবর্তনের কারণ ছিল?

প্রথম গল্প - মুসা (আ) এর জননীকে নিয়ে। আমরা জানি ফেরাউন একটি স্বপ্ন দেখেছিল। তার মর্ম হল - সে তার রাজত্ব হারাচ্ছে বনি ইসরাইলের ঘরে জন্মগ্রহণকারী এক শিশু দ্বারা। ফেরাউন শাসকগোষ্ঠী ছিল ভয়ঙ্কর অত্যাচারী শোষক।

কোন সমস্যা নাই - ফেরাউন ডিক্রি জারি করল, সংখ্যালঘিষ্ঠ আবহমানকালের নিগৃহিত বনি ইসরাইলের সকল নবজাতক ছেলেশিশুকে হত্যা করা হবে। যেমন আইন তেমন কাজ। অল্প সময়েই শাসকগোষ্ঠী দেখল তাদের শ্রমজীবি শ্রেনীর মানুষ- সংখ্যা কমে যাছে। পিরামিড তৈরী, কৃষিকাজ ইত্যাদি কাজে প্রধানত নিযুক্ত বনি ইসরাইলের জনসংখ্যা হ্রাস পেতে থাকল। তাই ফেরাউন নতুন ডিক্রি জারি করল, 'ঠিক আছে এক বছর নবজাতক ছেলে-শিশু হত্যা করা হবে, পরের বছর বাঁচিয়ে রাখা হবে।

যেবছর ছেলে-শিশু হত্যা করা হবে না - সে বছরই হারুন (আ) জন্ম গ্রহণ করলেন। অপরদিকে হত্যার বছরে মুসা (আ) জন্মগ্রহণ করলেন।

জননী তার গর্ভাবস্থা গোপন রাখতে পারলেন ফেরাউনের ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট যতই শক্তিশালী হোক না কেন - যদি স্রষ্টা চান!

সময়ান্তে একটি ছেলে শিশু প্রসব করলেন - মুসা (আ) পৃথিবীতে আসলেন।

কিন্তু এখন জননী কি করবেন? এখন কিভাবে তাকে লুকিয়ে রাখবেন হায়না ফেরাউনের কবল থেকে?

আল্লাহ তায়ালা একটি সমাধান দিলেন। সুরা কাসাসের ৭ নং আয়াত থেকে নেয়া:

(.... وَأَوْحَيْنَا إِلَىٰ أُمِّ مُوسَىٰ) "আমি মূসার মাকে ইশারা করলাম, "একে স্তন্যদান করো, তারপর যখন এর প্রাণের ভয় করবে তখন একে দরিয়ায় ভাসিয়ে দেবে এবং কোন ভয় ও দুঃখ করবে না, (১) তাকে তোমারই কাছে ফিরিয়ে আনবো এবং (২) তাকে রসূলদের অন্তর্ভুক্ত করবো৷ "

লক্ষ্য করুন এখানে "ঐশী বাণী" অর্থে (আন্ডার লাইনড) ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়েছে - যার তাত্পর্য 'আল্লাহর নির্দেশনা'ই কেবল। অবশ্য অপরিহার্য এবং অদমনীয় নির্দেশ অর্থেও একই ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়েছে আরেক স্থানে (নাহল: ৬৮):

"আর দেখো (وَأَوْحَىٰ رَبُّكَ) তোমার রব মৌমাছিদেরকে একথা অহীর মাধ্যমে বলে দিয়েছেনঃ তোমরা পাহাড়-পর্বত, গাছপালা ও মাচার ওপর ছড়ানো লতাগুল্মে নিজেদের চাক নির্মাণ করো৷"

যাই হোক, প্রশ্ন হল: আপনি কি পারবেন? সেই নির্দেশ পালন করতে যা মুসা (আ) এর মাকে করা হয়েছিল? এমনকি একটি শক্ত নিরাপদ বাক্স বন্দী করেও? আপনার নবজাতক শিশুকে এভাবে ভাসিয়ে দিতে কি পারবেন?

কিভাবে মুসা (আ) এর মা তা পেরেছিলেন ? কেন ই বা তিনি ওই নির্দেশ পালনে সম্মত হয়েছিলেন?

আল্লাহ তায়ালা তাকে কি ওয়াদা করেছিলেন?

যে দুটো ওয়াদা করা হয়েছিল ((১) তাকে তোমারই কাছে ফিরিয়ে আনবো এবং (২) তাকে রসূলদের অন্তর্ভুক্ত করবো) তা কি স্বাক্ষরিত ছিল? কোন চুক্তি কি আল্লাহতায়ালা আর মুসা (আ) এর জননীর মাঝে আদৌ হয়েছিল?

কিভাবে একজন জননী তার সদ্যপ্রসূত প্রানপ্রিয় সন্তানকে নিজ হাতে একটি বাক্সে বন্দী করে প্রমত্তা নীলনদে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন?

এভাবে নিজ সন্তানকে আল্লাহর নির্দেশে ভাসিয়ে দেয়ার ভয়ঙ্কর সাহস রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন? এটা কি প্রমান করে?

এটা কেবল একটি জিনিসই প্রমান করে - আর তা হল আল্লাহর প্রতি তার প্রগাড় 'ঈমান' 'তথা 'বিশ্বাস' বা 'একিন'।

তিনি শতভাগ বিশ্বাস করেছিলেন - আল্লাহর ওয়াদা অবশ্যই পূর্ণ হবে। নি:সন্দেহে! পরিস্হিতি যাই থাকুক না কেন - সারা বিশ্বের একীভূত বিজ্ঞ-মনন-সমূহ যেই ধারনাই করুক না কেন!

যাই হোক, মুসা (আ) এর পরে কি হয়েছিল? জননী মুসা (আ) এর বড় বোনকে বললেন "স্রোতে প্রবাহমান বাক্স অনুসরণ কর"।

কিন্তু বাক্সটি কোথায় পৌছল? অগণিত সম্ভাবনা থাকা স্বত্তেও বাক্সটি একেবারে ফেরাউনের প্রাসাদে গিয়েই ঠেকল!

এক মুহুর্তের জন্য ভাবুন! মুসা (আ) এর মা কেন মুসাকে বাক্সবন্দী করে নদীতে ভাসিয়ে দিলেন? ছেলেকে বাচাতে। ফেরাউনের কবল থেকে সন্তানের প্রাণ রক্ষার্থে। করুনাময়ের নির্দেশে বাক্স নদীতে ভাসতে তা একেবারে ফেরাউনের কবলেই গিয়ে পড়ল। অথচ আল্লাহ তাকে ওয়াদা করেছেন যে তাকে তিনি বাচবেন!

এটা কি আল্লাহর ওয়াদাকে নিয়েই মনের মাঝে এক সংশয়বোধ জাগায় না? মুসা (আ) এর জননী যখন নিজ চোখে ফেরাউনের সৈন্যদেরকে নদী থেকে বাক্সটি তুলতে দেখলেন তার মনের অবস্থা তথা সংশয়বোধই বা কেমন হয়েছিল?

মূলত এটা ছিল আল্লাহর তরফ থেকে এক মহা ঈমানী পরীক্ষা। ভয়ঙ্কর কঠিন পরীক্ষা! মুসা(আ) এর জননী এই পরিক্ষায় ফেল ই করতেন যদি না আল্লাহ তাকে সাহায্য করতেন:

"ওদিকে মূসার মায়ের মন অস্থির হয়ে পড়েছিল৷ সে তার রহস্য প্রকাশ করে দিতো যদি আমি তার মন সুদৃঢ় না করে দিতাম (আল্লাহর সাহায্য), যাতে সে (আমার অংগীকারের প্রতি) বিশ্বাস স্থাপনকারীদের একজন হয়৷" (কাসাস: ১০)

কেন আল্লাহ তার মনকে সুদৃর করে সাহায্য করলেন? কারণ মুসা (আ) এর জননী প্রথম ক্ষেত্রেই আল্লাহর প্রতি ইমান এনে দায়িত্ব সম্পন্ন করেছিলেন। প্রথম পদক্ষেপ আল্লাহর প্রতি দৃঢ় একিনের মাধ্যমে সম্পন্ন করেছিলেন - আর তা হল মুসা (আ) কে বাক্স-বন্দী করে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া। যার দরুন পরবর্তী পদক্ষেপে আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ) এর জননীকে সাহায্য করেন সুদৃরভাবে।

একটি হাদিসে কুদসীর বর্ণনা অনুযায়ী আল্লাহ বলেন, "যদি তুমি আমার দিকে হেটে আস - তবে আমি তোমার দিকে দৌড়ে আসি .... "

আল্লাহ শুধু চান আমাদের প্রথম পদক্ষেপ - তথা তার নির্দেশ অনুযায়ী আমাদের কর্ম-পালন! পরবর্তী কঠিনতর অবস্থায় তখন তিনি ই সাহায্য করবেন! মহা শক্তিশালী আল্লাহ আমাদের বাকি সবকিছুর নিয়ন্ত্রক ও সংরক্ষক হবেন ই হবেন!

যে আল্লাহর কাছে হেদায়েত চায় আল্লাহ তাকে হেদায়েত দান করেন। কিন্তু আমাদের প্রথম পদক্ষেপটি নিতে হবে। উদ্যোগ পুরোমাত্রায় আমাদেরই নিতে হবে।

--------------------

মুসা (আ) সমেত বাক্স ফেরাউনের সৈন্যরা তুলে নিল ঠিকই, কিন্তু আল্লাহর সৈন্য জায়গামত উপস্তিত থাকবেই যদি না আলাহ কিছু করতে চান!

কারণ "একমাত্র আল্লাহই জানেন তার সৈন্যদের সম্পর্কে"!

এক্ষেত্রে কে ছিল আল্লাহর সৈন্য? ফেরাউনের স্ত্রী 'আসিয়া (আ)'!

মুসাকে দেখামাত্রই প্রগাড় ভালবাসায় পড়ে গেলেন। মাতৃস্নেহে আচ্ছন্ন হলেন। ফেরাউনের কাছে প্রবল মিনতি পেশ করলেন 'শিশুটিকে সন্তান হিসেবে দত্তক নেয়ার মানসে'।

অনেক আপত্তির বাধা পেরিয়ে আসিয়া (আ) সফল হলেন। কিন্তু বাধা পড়ল অন্যত্র। মুসা (আ) কারো মাতৃদুগ্ধ সেবনে নারাজ!

বুদ্ধিমতি মুসা (আ) এর বোন এগিয়ে আসলেন:

"স্মরণ করো, যখন তোমার বোন চলছিল, তারপর গিয়ে বললো, “আমি কি তোমাদের তার সন্ধান দেবো যে এ শিশুকে ভালোভাবে লালন করবে?”এভাবে আমি তোমাকে আবার তোমার মায়ের কাছে পৌছিয়ে দিয়েছি, যাতে তার চোখ শীতল থাকে এবং সে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ না হয়৷ ..... " (ত্বাহা: ৪০)

তিনি মুসা (আ) এর জননীকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলেন। জননীকে পাওয়া মাত্রই আল্লাহর ইশারায় মুসা (আ) দুধপান শুরু করলেন।

ফেরাউন-পত্নী মুসা এর জননীকে থেকে যেতে অনুনয় করলেন - কিন্তু মুসা (আ) এর জননী সুযোগের ব্যবহার করলেন। বললেন, "না! আমার পরিবার আছে! যদি আমার বাড়িতে তাকে নিয়ে আসেন তবেই আমি তাকে দুধপান করাতে পারি।" পরন্তু এর বিনিময়ে তিনি পারশ্রমিকও পাবেন - পাবেন রাজ পরিবারের বিশেষ সুবিধাও!

সুবহানাল্লাহ! যেই শিশুকে কিছুক্ষণ আগে মৃত্যুভয়ে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া হয়েছিল আল্লাহর নির্দেশ - মুসা (আ) এর জননীর কোলেই এখন সেই শিশু নিশ্চিন্তে দুগ্ধপান করছে - একেবারে রাজ পরিবারের গার্ড-অব-অনার সহকারে, পারশ্রমিক সমেত, নিশ্চিন্ত-নির্ভরতায়!

-----------

চিন্তা করুন - আরেক অবস্থা! যদি মুসার জননী নদীতে না ভাসাতেন তাহলে কি হত? হয়ত কিছুকাল বাচাতে পারতেন লুকিয়ে থেকে - দু:সহ পলাতক জীবন-যাপনের মধ্য দিয়ে! ধরা পরে মারা যাবারই থাকত অপার সম্ভাবনা!

অতএব, কোন জিনিষটা মুসা (আ) এর জননীকে রক্ষা করেছে? আল্লাহর প্রতি তার ঈমান!

এটাই হল ঈমানের মূল্যমান। এভাবেই ঈমান একজন মানুষকে পরিবর্তন করতে পারে - তাকে সৌভাগ্যের স্বর্ণশিখরে সহজে নিতে পারে।

------------

এখন আমাদের অবস্থান চিন্তা করুন! আলাহ আমাদের সন্তানদের বাক্সবন্দী করে নদীতে ভাসাতে বলেন নি। বরঞ্চ আল্লাহ আরও অনেক সহজ নির্দেশ আমাদের দিয়েছেন। আল্লাহ আমাদের অনেক ওয়াদা করেছেন -- কিন্তু আমরা তা কি বিশ্বাস করছি?

আল্লাহ বলেছেন যদি আমরা সত্যাশ্রয়ী জীবন যাপন করি আমরা জান্নাতের বাসিন্দা হব। তারপর ও কিভাবে আমরা হারাম কাজ করি?

আল্লাহ ওয়াদা করেছেন - "যে আল্লাহ কে ভয় করে চলে আল্লাহ তাকে (বিপদ থেকে) উদ্ধার করে দেন এবং তাকে এমন দিক থেকে রিজক দেন যা সে কল্পনাও করতে পারবে না (সুরা তালাক)"

আমরা কি এই ওয়াদা আসলেই মন থেকে মেনে চলি বা আদৌ এর প্রতি ঈমান (বিশ্বাস) রাখি ?

আল্লাহ ওয়াদা করেছেন,

"হে ঈমান আনয়নকারীগণ! আমি কি তোমাদেরকে এমন একটি ব্যবসায়ের সন্ধান দেবো যা তোমাদেরকে কঠিন আযাব থেকে মুক্তি দেবে? তোমরা আল্লাহ ও তার রসূলের প্রতি ঈমান আন এবং আল্লাহর পথে অর্থ-সম্পদ ও জান-প্রাণ দিয়ে জিহাদ করো এটাই তোমাদের জন্য অতিব কল্যাণকর যদি তোমরা তা জান৷ আল্লাহ তোমাদের গোনাহ মাফ করে দেবেন এবং তোমাদেরকে এমনসব বাগানে প্রবেশ করাবেন যার নীচে দিয়ে ঝর্ণাধারা বয়ে চলবে৷ আর চিরস্থায়ী বসবাসের জায়গা জান্নাতের মধ্যে তোমাদেরকে সর্বোত্তম ঘর দান করবেন৷ এটাই বড় সফলতা৷ আর আরেক জিনিস যা তোমরা আকাংখা করো আল্লাহ তাও তোমাদের দেবেন আল্লাহর পক্ষ থেকে সাহায্য এবং অতি নিকটবর্তী সময়ে বিজয়৷হে নবী! ঈমানদারদেরকে এর সুসংবাদ দান করো৷(সুরা সফ)"

আমরা কি এই আদেশ ও ওয়াদার প্রতি ঈমান (বিশ্বাস) রাখি? আমাদের কাজ-কর্ম কি আদৌ তা প্রমান করে?

অথচ এই আদেশ পূরণের মাধ্যমে আল্লাহ কত ব্যপক জিনিসই না দেয়ার ওয়াদা করেছেন! মুসা(আ) জননী কত ব্যপক উত্সর্গ করার মাধ্যমেই না সফলতা পেয়েছিলেন - পুরস্কৃত হয়েছিলেন!

আমাদের আসলেই আলাহকে ভয় করা উচিত! তার প্রতি সুদৃর বিশ্বাস তথা একীন থাকা উচিত।

আর এটাই হল ঈমানের মূলনীতি এবং ইসলামের পুনর্জাগরণের মুলমন্ত্র!

(চলবে)

[শহীদ আনোয়ার আওলাকির বক্তব্য অনুসরণে ভাবান্তরিত]

(উত্সর্গ: ইসলামের ঝান্ডা উচিয়ে আন্দোলনরত বাংলাদেশ সহ সারা বিশ্বের মজলুম মানবাত্মাদের প্রতি। ঈমানী-পরীক্ষায় সফলতার মাধ্যমে পরম করুনাময় তাদের দুই জগতের সন্মানীয় করে দিক। আমিন।)

বিষয়: বিবিধ

১৯৩৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File