ইসলামী দাওয়াতের কর্মপদ্ধতি (৫)

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ০৯ জুন, ২০১৩, ০৯:৫৩:১৭ রাত

[পাচ]

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সুরা ইমরানে এরশাদ করেন:

৫০) আমি সেই শিক্ষা ও হিদায়াতের সত্যতা ঘোষণা করার জন্য এসেছি, যা বর্তমানে আমার যুগে তাওরাতে আছে ৷ আর তোমাদের জন্য যেসব জিনিস হারাম ছিল তার কতকগুলো হালাল করার জন্য আমি এসেছি ৷দেখো, তোমাদের রবের পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে আমি নিশানী নিয়ে এসেছি ৷ কাজেই আল্লাহকে ভয় করো এবং আমার আনুগত্য করো৷

৫১) আল্লাহ আমার রব এবং তোমাদেরও রব৷ কাজেই তোমরা তার বন্দেগী করো৷ এটিই সোজাপথ৷

মহিয়ান রাসুল ঈসা ইবনে মারয়াম (আ) এর দাওয়াত সম্পর্কিত আল্লাহর বাণী!

(শিক্ষনীয় ১: রেসালোতের প্রমানের স্বপক্ষে যুক্তি) সহজ সরলভাবে অতীতের আসমানী কিতাবগুলোর সত্যতা প্রমাণকারী স্মারক নিয়ে আগমনকারী রাসুলের অকপট স্মীকারোক্তি।

সাইয়েদ আবুল আলা (রহ) এর সমার্থক একটি যুক্তি অনুযায়ী 'যাকে নিজের বলে চালিয়ে দিলেও তার উত্স বের করার ক্ষমতা কারো নেই - বরং তিনি পাবেন এক সুন্দর সমাধান প্রদানের জন্য জনগনের প্রশংসা - সেই তিনি সকল ক্রেডিট (আসমানী গ্রন্থের) দিলেন আরেকজন তথা আল্লাহকে। সকল প্রতিবাদ আর অত্যাচারের মুখেও তিনি আজীবন একথার কোন রদ বদল করেন না!

একজন মিথ্যাবাদী আর লোভীর পক্ষে কি এত বড় আত্মত্যাগ করা সম্ভব? আবহমানকাল ধরে সকল নবী আর রাসুলের দাওয়াতি কর্মপদ্ধতি 'রেসালতের পক্ষে' কি এই একটি অকাট্য যুক্তিই তুলে ধরে না? ৫০ নং আয়াত এ তত্ব ই বহন করে।

ঈসা (আ) এ দাওয়াত কাদের দিলেন? যেসব লোক প্রথমে দাওয়াত পায় তারা দাওয়াত গ্রহনের বেলায় পিছনে পড়ে থাকে। আর যারা দাওয়াত পরে পায় তারা দাওয়াত কবুল করার ব্যপারে সবার আগে থাকে।

ঈসা (আ) এর নিজের কথা অনুসারে, "কত লোক অগ্রবর্তী হয়ে আছে তারা পিছনে থেকে যাবে আর কত লোক আছে যারা পিছনে রয়েছে, তারা সামনে এসে যাবে।"

(শিক্ষনীয় ২)

সহজ কথায়, নবীরা সর্বপ্রথম সমাজের প্রতিপত্তিশালী লোকদের সামনে দাওয়াত পেশ করতেন। এদের বাড়াবাড়ি, অহংকার আর একগুয়েমি যখন তাদের নিরাশ করে দিত তখন আর সাধারণ মানুষের কাছে দাওয়াত নিয়ে উপস্থিত হতেন। মাওলানা আমিন আহসান ইসলাহী তার "দাওয়াতে দ্বীন ও তার কর্মপন্থা" বইয়ে সবিস্তারে বিষয়টি উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ইসা (আ) এর দাওয়াতি কাজের মাধ্যমে এ বিষয়টি সরাসরি উল্লেখ করেছেন - যা এই পর্বের একটি মৌলিক শিক্ষনীয় বিষয় দাওয়াতি কাজের কর্মপদ্ধতি নিরুপনে।

সকল নবী সমসাময়িক নেতাদের সর্বপ্রথম সম্বোধন করেছেন। উদাহরণ হিসেবে:

ইব্রাহিম (আ) সর্বপ্রথম নিজ বংশের লোকদের কাছে দাওয়াত পেশ করেন। সেসময় তারাই ধর্মীয় নেতার পদে আসীন ছিলেন। অতপর সমসাময়িক রাজা নমরুদের কাছে দাওয়াত পেশ করেন:

" তুমি সেই ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করোনি, যে ইবরাহীমের সাথে তর্ক করেছিল ? তর্ক করেছিল এই কথা নিয়ে যে, ইবরাহীমের রব কে ? এবং তর্ক এ জন্য করেছিল যে, আল্লাহ তাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছিলেন ৷ "(বাকারা ২৫৮)

মুসা (আ) এর কাছে আল্লাহর নির্দেশ ছিল:

"যখন তার রব তাকে পবিত্র ‘তুওয়া’ উপত্যকায় ডেকে বলেছিলেন , “ফেরাউনের কাছে যাও , সে বিদ্রোহী হয়ে গেছে৷" (নাযিয়াত: ১৭-১৮)

হজরত দানিয়াল (আ) তার সমসাময়িক রাজা নবুখাজ নসরকে, ইর্মিয়া নবী সামালের বাদশাহর কাছে সর্বপ্রথম দাওয়াত পেশ করেন।

আমাদের নবীজি (সা) কোরায়েশ (তথা আরবের ধর্মীয় ও গোষ্ঠী-শাসিত রাষ্ট্রের কর্নধার) দের কাছে সর্বপ্রথম দাওয়াত পেশ করেন।

প্রত্যেকে গুরুত্ব সহকারে সমসাময়িক সমাজপতি ও প্রভাবশালী মানুষদের সর্বপ্রথম আল্লাহর দ্বীনে আহবান করেন এবং তাদের দ্বারা মূলত প্রভাবিত সমাজের চিন্তাধারা ও মতবাদের উপর আঘাত হানেন।

একই ধারাবাহিকতায় ইসা (আ) সর্বপ্রথম ইহুদি আলেমদের সম্বোধন করেন।

কেন সমসাময়িক নেতাদের সর্বপ্রথম সম্বোধন করা হয়েছে? সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে নিচের যুক্তিটি এর উত্তর:

যদি সমাজের প্রতিভাবান স্তরকে বাদ দিয়ে সাধারণ লোকদের মাধ্যমে কোন আন্দোলন শুরু করা হয়, তারা একসময় সন্দেহ ও সংশয়ের শিকারে পরিনত হন। একধরনের হীনমন্যতার রোগে আক্রান্ত হয়ে পরে এবং যতক্ষণ না উচু শ্রেনীর প্রতিভাবানরা এই আন্দোলনের অনুসারী না হন, ততক্ষণ তাদের অতটা আত্মপ্রত্যয় সৃষ্টি হতে পারেনা। (আমিন আহসান ইসলাহী)

[ সেন্টপলের জীবন এর বাস্তব উদাহরণ। মেধা আর ক্ষমতার বলে তার পক্ষে খ্রিস্ট ধর্ম অতি দ্রুত বিকৃত করা কি সহজই না হয়েছিল! (নিচে পাদটিকা দেখুন)]

ইমরানের ৫২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বিষয়টি তুলে ধরেছেন:

"যখন ঈসা অনুভব করলো, ইসরাঈল ( ইহুদি আলেমরা) কুফরী ও অস্বীকার করতে উদ্যেগী হয়েছে, সে বললোঃ ‘‘কে হবে আল্লাহর পথে আমার সাহায্যকারী? হাওয়ারীগণ বললোঃ আমরা আল্লাহর সাহায্যকারী৷ আমরা আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি ৷ সাক্ষী থাকো, আমরা মুসলিম ( আল্লাহর সামনে আনুগত্যের শির নতকারী) ৷

হাওয়ারী কারা? সাধারণ ঝিলের পারের জেলে।

অদমিত চেষ্টা সাধনার পর ও যখন ঈসা (আ) ইহুদি আলেম তথা সমাজ পরিচালনার কর্ণধারদের মনকে গলাতে ব্যর্থ হলেন - তখন তিনি তাদের পরিত্যগ করে ঝিলের পারের জেলেদের বললেন

"হে মাছ শিকারিগন! এস আমি তোমাদেরকে মানুষ শিকারী বানিয়ে দেই।"

আল্লাহ তায়ালা তাদের মধ্য থেকে একটি আলোকিত ঈমানদার সম্প্রদায় দিয়ে পরিশ্রান্ত রাসুল ঈসা (আ) কে সাহায্য করলেন - যারা শত বাধা বিপত্তিতেও ইসলামের ঝান্ডা সমুন্নত রাখেন নিরত।

যেই দাওয়াত জেরজালেমের দক্ষ শিক্ষিত, সুবিধাবাদী সমাজপতিদের টলাতে পারল না - তাইই অতি সাধারন সুবিধাবঞ্চিত অসহায় মানুষদের গলিয়ে দিল - সত্যের সাক্ষী হওয়ার মত সৌভাগ্যের অংশীদার বানিয়ে দিল।

আর আমাদের জন্য উপদেশস্বরূপ সুরা সফে আল্লাহ বলেন,

হে ঈমানদাগণ! তোমরা আল্লাহর সাহায্যকারী হয়ে যাও৷ ঠিক তেমনি, যখন ঈসা ইবনে মারয়াম হাওয়ারীদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন : আল্লাহর দিকে (আহবান করার ক্ষেত্রে) কে আমার সাহায্যকারী? তখন হাওয়ারীরা জবাব দিয়েছিলো : আমরা আছি আল্লাহর সাহায্যকারী৷ সেই সময় বনী ইসরাঈল জাতির একটি দল ঈমান আনয়ন করেছল এবং আরেকটি দল অস্বীকার করেছিল৷ অতপর আমি ঈমান আনয়নকারীদেরকে তাদের শত্রুদিগের বিরুদ্ধে শক্তি যোগালাম এবং তারাই বিজয়ী হয়ে গেল৷ (আয়াত ১৪)

:::পাদটিকা::

"বনি ইসরাইলের আলেম সমাজ ও প্রতিভাবান ব্যক্তিবর্গ কেউ ঈসা (আ) এর দাওয়াত গ্রহণ করেনি। সাধারণ স্তরের কিছু সংখ্যক অনুসারী ঈসা (আ) এর সহযোগী হন যাদের নিষ্ঠা, খোদাভীতি ও দায়িত্বপালনের ব্যপারে কোন সন্দেহ নেই। তারা দাওয়াতকে প্রসারে যথাসাধ্য চেষ্টাও করেন। তবুও সেন্টপল অচিরেই ঈসা (আ) এর ধর্মকে বিকৃত করে দেয়। সে অপপ্রচার করে যে, ঈসার অনুসারীগণ ছিল অশিক্ষিত সাধারণ লোক। একারণে তারা ঈসা (আ) এর শিক্ষার ভেদ ও তাত্পর্য অনুধাবনে অক্ষম। সেন্ট পল নিজে ছিল গ্রীক দর্শন ও তাসাউফের বিশেষজ্ঞ। তার দাবি অনুযায়ী যারা ঈসা (আ) এর সাক্ষাত অনুসারী যারা ছিল তাদের তুলনায় সে তার শিক্ষার তাত্পর্য অধিক ভাল বুঝে। জনমনে জাদু খেলে গেল। তার অপপ্রচারের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করা সম্ভব হয়নি। ঈসা (আ) এর ধর্ম অতি দ্রুত বিকৃত রূপ ধারণ করল।"

[আমিন আহসান ইসলাহী (১৯০৪ - ১৯৯৭); তাফসীরে কোরআন 'তাদাব্বুরে কোরআন' এর রচয়িতা। ]

বিষয়: বিবিধ

১৪১২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File