ইসলামী দাওয়াতের কর্মপদ্ধতি (৪)

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ০৭ জুন, ২০১৩, ০৫:৩২:২১ বিকাল

[চার]

-১: আত্মত্যাগী এক মানুষ -

দেশ-জনপদের বাধা ছিন্ন করে বিশ্বব্যপী দাওয়াতি কাজের মূর্ত প্রতিক সাইয়েদানা ইব্রাহিম (আ) তার সন্তান এবং ভাইএর পুত্রকে ভিন্ন ভিন্ন দেশে প্রেরণ করেন।

আজীবনের প্রানান্ত পরিশ্রমের পর পিতা জীবনের যে সময়ে সন্তান-সন্ততিদের নিয়ে আরামে কাটিয়ে দিতে চায় - সে সময়ে সন্তান-সন্ততিদের পাঠিয়ে দিলেন ভিন্ন ভিন্ন দেশে 'দায়ী' করে!

আজীবন কোন দেশে যিনি স্থিত হতে পারেন নি - কারণ কোথাও তিনি সমাদর পাননি - মানুষকে এত আপন করে আল্লাহর দিকে ডেকে পেয়েছেন কেবলি বঞ্চনা - কেউ তার বন্ধু হননি! জীবন-জীবিকার সংস্থান হয়নি!

চিন্তা করুন -মানুষকে আল্লাহর পথে ডাকার ক্ষেত্রে আত্ম ত্যাগী এক মানুষের জীবন গাথা!

এই মানুষটির কেউ বন্ধু হয়নি -- তাই দয়ার আধার আল্লাহ তায়ালা স্বয়ং তাকে 'বন্ধুবর' হিসেবে টেনে নিয়েছেন!

আর নিজ সন্তান-সন্ততিদের আল্লাহর পথে উজার করে দেয়ার ফল? কেয়ামত পর্যন্ত সকল মুসলিমের জন্য আল্লাহ তাকে দিলেন 'মুসলিম জাতির পিতার' উপাধি!

আহারে, এমন নি:স্বার্থ লোকের জন্যই তো কেবল জাতির পিতার সন্মাননা যুক্তিযুক্ত!

-২: লুত (আ) -

সাইয়েদানা ইব্রাহিম (আ) তার ভাই-এর ছেলে লুত (আ) কে পাঠালেন 'সোডম' নামক শহরে (বর্তমান 'মৃতসাগর') ইসলামের দা'য়ী হিসেবে।

সেখানে মানুষেরা ইতিহাসের এক জঘন্যতম বিকৃত ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত ছিল। মূলত তারা ছিল এক বিকৃত মানসিকতার পাষন্ডতুল্য।

মানব ইতিহাসে তারা সর্বপ্রথম 'সমকামিতা' (homosexuality) র মত জঘন্য বিকৃত কাজ শুরু করে।

(শিক্ষনীয় বিষয় ১) এরকম একটি জঘন্য সমাজে বহিরাগত লুত (আ) তার দাওয়াহ-মিশন শুরু করেন। এটা কি তার জন্য এক বিরাট পরীক্ষা ছিল না?

সাইয়েদানা লুত (আ) তাদের আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করতে আপ্রাণ অনুনয় চালিয়ে যান। সেই সাথে সমকামিতার মত জঘন্য বিকৃতাচার পরিত্যগে লোকদের বুঝাতে থাকেন।

কঠোর হৃদয়ের সমাজের পক্ষ থেকে হুংকার আসে --

"লূতের পরিবার বর্গকে তাদের নিজেদের জনপদ থেকে বের করে দাও, এরা বড় পাক পবিত্র সাজতে চাচ্ছে" (২৭:৫৬)

লক্ষ্য করুন,কি ভয়ঙ্কর সমাজ! পুত পবিত্র থাকা অপরাধ! যার জন্য তাকে দেশছাড়া করতে চাচ্ছে সমাজ!

(শিক্ষনীয় বিষয় ২) যুগ যুগ ধরে ইসলামের পথে অবিচল আলোকিত মানুষদের এভাবেই দেশ-ছাড়া করতে উদ্যত হয় প্রভাবশালী ইসলাম-বিদ্বেষী শাসক-চক্র ও নেতৃ-বৃন্দ ! এর মাধ্যমে লুত (আ) এর সমাজের চিন্তা ও কর্মের বিকৃতাচারও (perversion) অনুমেয়।

এই কাজ ছাড়াও তারা রাজপথে বহিরাগতদের থেকে উন্মুক্ত ডাকাতি করত, দুর্বলদের ঠকাত, নির্যাতন করত, উন্মুক্তভাবে সবার সামনেই পাপাচারে লিপ্ত হত।

অনবরত লুত (আ) এর সতর্কবাণী আর সাবধানতার পর ও তাদের একমাত্র উক্তি ছিল

"তার সম্প্রদায়ের কাছে এ ছাড়া আর কোন জবাব ছিল না যে, তারা বললো , “নিয়ে এসো আল্লাহর আযাব যদি তুমি সত্যবাদী হও” ৷ (২৯:২৯)

যেন সীমা লঙ্ঘিত এক জাতির দম্ভোক্তি!

আল্লাহ তায়ালা সুরা আরাফে বলেন:

৮০) আর লূতকে আমি পয়গম্বর করে পাঠাই৷ তারপর স্মরণ করো, যখন সে নিজের সম্প্রদায়ের লোকদেরকে বললোঃ “তোমরা কি এতই নির্লজ্জ হয়ে গেলে যে, দুনিয়ার ইতিপূর্বে কেউ কখনো করেনি এমন অশ্লীল কাজ করে চলেছো?

৮১) তোমরা মেয়েদের বাদ দিয়ে পুরুষদের দ্বারা কামপ্রবৃত্তি চরিতার্থ করছো? প্রকৃতপক্ষে তোমরা একেবারেই সীমালংঘনকারী গোষ্ঠী৷”

৮২) কিন্তু তার সম্প্রদায়ের জওয়াব এ ছাড়া আর কিছুই ছিল না যে, “এদেরকে তোমাদের জনপদ থেকে বের করে দাও৷ এরা বড়ই পবিত্রার ধ্বজাধারী হয়েছে৷”

৮৩) শেষ পর্যন্ত আমি লুতের স্ত্রীকে ছাড়া -যে পেছনে অবস্থানকারীদের অন্তরভুক্ত ছিল তাকে ও তার পরিবারবর্গকে উদ্ধার করে নিয়ে আসি

৮৪) এবং এ সম্প্রদায়ের ওপর বৃষ্টি বর্ষণ করি৷ তারপর সেই অপরাধীদের কী পরিণাম হয়েছিল দেখো৷

৩: সমকামী জাতির উপর আল্লাহর আযাব:

আল্লাহ প্রেরিত ফেরেশতারা মানুষের বেশে প্রথম ইব্রাহিম (আ) এর বাড়িতে যান এবং এক পুত্রের সুসংবাদ দেন এবং লুত (আ) এর জাতির উপর ভবিতব্য আজাবের সংবাদ দেন।সুদ্দী, ইবন ইসহাক প্রমুখ থেকে বর্ণিত,

ইব্রাহিম (আ) বললেন "আপনারা এমন এক জাতি ধংস করবেন যেখানে ৩০০ এর মত ঈমানদার রয়েছে?"

ফেরেশতারা বলল, "না!"

ইব্রাহিম (আ) বললেন "তবে ৪০ জন ঈমানদার?"

ফেরেশতারা বলল, "না!"

ইব্রাহিম (আ) বললেন "তবে ১৪ জন ঈমানদার?"

ফেরেশতারা বলল, "না!"

ইব্রাহিম (আ) বললেন "তবে ১ জন ঈমানদার?"

ফেরেশতারা বলল, "না!"

তখন বিচলিত ইব্রাহিম (আ) বললেন "কিন্তু লুত তো সেখানে রয়েছে"

ফেরেশতারা বলল, "আমরা ভালই জানি কে কে সেখানে রয়েছে"

সুরা হুদে আল্লাহ-তায়ালা এরশাদ করছেন,

৭৭) আর যখন আমার ফেরেশতারা লূতের কাছে পৌঁছে গেলো তখন তাদের আগমনে সে খুব ঘাবড়ে গেলো এবং তার ভয়ে জড়সড় হয়ে গেলো৷ সে বলতে লাগলো, আজ বড় বিপদের দিন৷

৭৮) (এ মেহমানদের আসার সাথে সাথেই) তার সম্প্রদায়ের লোকেরা নির্দ্বিধায় তার ঘরের দিকে ছুটে আসতে লাগলো৷ আগে থেকেই তারা এমনি ধরনের কুকর্মে অভ্যন্ত ছিল৷ লূত তাদেরকে বললোঃ “ভাইয়েরা ! এই যে, এখানে আমার মেয়েরা আছে, এরা তোমাদের জন্য পবিত্রতর৷ আল্লাহর ভয়-ডর কিছু করো, এবং আমার মেহমানদের ব্যাপারে আমাকে লাঞ্ছিত করো না, তোমাদের মধ্যে কি একজনও ভালো লোক নেই?”

৭৯) তারা জবাব দিলঃ “তুমি তো জানোই, তোমার মেয়েদের দিয়ে আমাদের কোন কাজ নেই এবং আমরা কি চাই তাও তুমি জানো৷”

৮০) লূত বললোঃ “হায়! যদি আমার এতটা শক্তি থাকতো যা দিয়ে আমি তোমাদের সোজা করে দিতে পারতাম অথবা কোন শক্তিশালী আশ্রয় থাকতো সেখানে আশ্রয় নিতে পারতাম৷”

(শিক্ষনীয় বিষয় ৩ ) ৭৮ নম্বর আয়াত লক্ষ্য করুন! কি ভয়ানক বিকৃত পচন ধরা মানুষগুলো। তবুও আলাহর পথে নিবেদিত দায়ী জনগনের জন্য দু:খ ভারাক্রান্ত মনে সমকামিতার ঘৃণ্য আচরণ থেকে তাদের মনোযোগ অন্যদিকে সরাতে আর (তাদের হাত থেকে) মেহমানদের সন্মান রক্ষার্থে শেষ পর্যন্ত সব রকম প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন।

মুজাহিদ, সাইদ বিন জুবায়ের, ইবন ইসহাক, সুদ্দী, এবং কাতাদাহ অনুযায়ী লুত(আ) এর স্ত্রীদের বুঝানো হয়েছে। বিশ্লেষন ইবনে কাসীরের 'স্টোরিস অফ দা প্রফেটস এর পৃ: ২০৮ থেকে নেয়া:

লুত (আ) মূলত তাদের মনোযোগ অতিথি যুবকদের (ফেরেশতা) থেকে অন্যদিকে সরাতে একথা বলেছিলেন। ইবনে কাসীরের বিশ্লেষন অনুযায়ী, লুত (আ) বলেন, তোমাদের স্ত্রীগণ রয়েছে। আর যদি না থাকে তবে কাউকে বিয়ে করতে পার যাতে এরকম বিকৃতাচার (সমকামিতা) না করতে হয়। যদি তাদের বিয়ে করতে, তাহলে তোমাদের সম্পর্ক খাটি হত। এটাই ওই আয়াতের তাত্পর্য: "তিনি বললেন, "হে আমার লোকেরা! এখানে আমার কন্যারা রয়েছে।তারা তোমাদের জন্য পবিত্র (যদি তাদের বিয়ে করতে)।"

আরেকটি মতামত যা আহলে কিতাবদের থেকে নেয়া - তা মূলত বিকৃত এক ব্যখ্যা।এক বড় ভুল তারা করেছে এটা বলে যে, লুত (আ) তার মেয়েদেরকে ওই সমকামী লোকদের কাছে সরাসরি তুলে দিতে চাইলেন। (বাইবেল, জেনেসিস ১৯)

যাহোক, বিকৃত জবরদস্তির পশুরা তাতেও থামেনি (আয়াত ৭৯)।

তাই অসহায় নবী (স) আফসোস করছেন ভবিতব্য আজাবের সন্ধিক্ষণে - অক্লান্ত দিনের পর দিনের পরিশ্রম - ভিন দেশে এসে নি:স্বার্থ আল্লাহর পথে মানুষকে নিরত ডাকার পরও নিগ্রহ ভিন্ন কোন সাড়া না পেয়ে - দেশবাসীকে আল্লাহর আজাব থেকে বাচাতে সব রকম প্রচেষ্টা করেও সফলতা না পেয়ে!

আহারে, পোড়া-কপালের জাতি না বুঝল স্বার্থ-উজার কারী জনদরদী মানুষটির কদর - না বুঝল শক্তিমান আল্লাহর আজাবের ভয়াবহতা!

যখন সে সময় চলে আসল না পেল তারা কোন অবকাশ!

সুরা হুদে আল্লাহ বলছেন,

৮২) তারপর যখন আমার ফায়সালার সময় এসে গেলো, আমি গোটা জনপদটি উল্টে দিলাম এবং তার ওপর পাকা মাটির পাথর অবিরামভাবে বর্ষণ করলাম,

৮৩) যার মধ্য থেকে প্রত্যেকটি পাথর তোমার রবের কাছে চিহ্নিত ছিল৷ আর জালেমদের থেকে এ শাস্তি মোটেই দূরে নয়৷

৪) ফিকহ - সমকামিতার শাস্তি:

(শিক্ষনীয় বিষয় ৪)

এরূপ শাস্তির জন্যই ইমাম শাফি (রহ), আহমদ (রহ) সহ অনেক স্কলারদের মতে, সমকামিতার শাস্তি হল পাথর দিয়ে হত্যা করা। এই যুক্তির পেছনে তারা আহমাদ থেকে নেয়া ইবনে আব্বাস (রা) বর্ণিত এই হাদীসটিকে গ্রহণ করেন, "যারাই লুতের জাতির লোকদের মত ঘৃণ্য কাজ করবে (তথা সমকামী হবে), তখন তাদের হত্যা করবে। (আহমদ: ১:৩০০, তিরমিজি, ইবনে মাজা:২৫৬১)

ইমাম আবু হানিফার ফিকহ হল: "যারাই সমকামিতা করবে তাদেরই উচু পাহার থেকে ফেলে দিতে হবে। অতপর পাথর দিয়ে হত্যা করতে হবে।" (তথ্য: ইমাম ইবনে কাসীর: স্টোরিস অফ দা প্রফেটস: পৃ: ২১৩)।

অতএব, সমকামিতার শাস্তি ভয়ঙ্কর এবং সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়াই শরীয়তসিদ্ধ।

এ শাস্তি অস্বীকার করলে কুফরী হবে।

বিষয়: বিবিধ

১৭৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File