ইসলামী দাওয়াতের কর্মপদ্ধতি (২)

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ০২ জুন, ২০১৩, ০৪:৫৯:২৩ বিকাল

[দুই]

বুখারী ও মুসলিম থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে: সাহাবারা রাসুল (স) কে জিজ্ঞাসা করলেন, 'সবচেয়ে অভিজাত ও উন্নত চরিত্রের (noble) মানুষ কে?'

রাসুল (স) বললেন, "সবচেয়ে অভিজাত ও উন্নত চরিত্রের তিনি যিনি আল্লাহকে সবচেয়ে বেশি ভয় করেন।"

সাহাবারা বললেন, "আমরা সেটা বুঝাইনি।"

রাসুল (স) তখন বললেন, "নবী ইউসূফ, ইবনুল কারিম (অভিজাত বা উন্নত ব্যক্তির ছেলে), ইবনুল কারিম, ইবনুল কারিম" (তিনবার বলার অর্থ: ইব্রাহিম (আ), তার ছেলে ইসহাক (আ), তার ছেলে ইয়াকুব (আ) এবং তার ছেলে ইউসুফ (আ) সবাই উন্নত চরিত্রের মানুষ )

নিচে ইউসুফ (আ) এর একটি ঘটনার মাধ্যমে তার দাওয়াতি কাজের একটি পদ্ধতি দেখানো হবে ইনশাল্লাহ।

আমরা জানি ইউসুফ (আ) কে সম্পুর্ন অন্যায়ভাবে তত্কালীন সরকার কারাগারে নিক্ষেপ করে।

সুরা ইউসুফের ৩৬ নং আয়াত থেকে শুরু হওয়া গল্পটি:

"কারাগারে তার সাথে আরো দু’টি ভৃত্যও প্রবেশ করলো৷ একদিন তাদের একজন তাকে বললো, “আমি স্বপ্নে দেখেছি আমি মদ তৈরী করছি৷” অন্যজন বললো, “আমি দেখলাম আমার মাথায় রুটি রাখা আছে এবং পাখিরা তা খাচ্ছে৷” তারা উভয়ে বললো, “আমাদের এর তা’বীর বলে দিন৷ আমরা আপনাকে সৎকর্মশীল হিসেবে পেয়েছি৷”"

৩৭ নং আয়াতে:

ইউসুফ বললো : “এখানে তোমরা যে খাবার পাও তা আসার আগেই আমি তোমাদের এ স্বপ্নগুলোর অর্থ বলে দেবো৷ আমার রব আমাকে যা দান করেছেন এ জ্ঞান তারই অন্তরভূক্ত৷ আসল ব্যাপার হচ্ছে, যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না এবং আখেরাত অস্বীকার করে তাদের পথ পরিহার করে৷

লক্ষ্য করুন আল্লাহর প্রতি ঈমানে বলিয়ান ইউসুফ (আ) এর কথা:

(১)

طَعَامٌ تُرْزَقَانِهِ

"তোমরা যে খাবার রিজক হিসেবে পাও (আল্লাহর তরফ থেকে)"

অর্থাত আল্লাহর তরফ থেকে যে রিজক আসে তার সত্যতা প্রদান অথবা মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয়া শুরুতেই/ দাওয়াতি কাজের সুযোগেই।

(২) ذَٰلِكُمَا مِمَّا عَلَّمَنِي رَبِّ

" আমার রব আমাকে যা দান করেছেন এ জ্ঞান তারই অন্তরভূক্ত৷"

অর্থাত আল্লাহ-প্রদত্ত জ্ঞান এবং যোগ্যতার জন্য সকল ক্রেডিট আল্লাহর প্রতি সমর্পণ করা, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা, মানুষকে তা বলা এবং শেখানো।

(৩)

إِنِّي تَرَكْتُ مِلَّةَ قَوْمٍ لَّا يُؤْمِنُونَ بِاللَّهِ وَهُم بِالْآخِرَةِ هُمْ كَافِرُونَ

যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে না এবং আখেরাত অস্বীকার করে তাদের পথ পরিহার করছি।

মূলত আলোচনার শুরুতেই এই তিনটি পয়েন্টেই ইউসুফ (আ) স্বপ্নের কোন তাবির বা ব্যখ্যা দেননি। সুচনা ছিল 'নিখাদ ইসলামের দাওয়াত'।

তিনি আলোচনার শুরুতেই স্থাপিত করলেন (i) আল্লাহর প্রতি ঈমান, (ii) আখেরাতের প্রতি ঈমান এর বিশেষ গুরুত্ব ও স্মারক।

(৪) ৩৮ নং আয়াতে:

“আমি আমার পিতৃপুরুষ ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূবের পথ অবলম্বন করেছি৷ আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা আমাদের কাজ নয়৷ আসলে এটা আমাদের এবং সমগ্র মানব জাতির প্রতি আল্লাহর অনুগ্রহ (যে, তিনি আমাদের তাঁর ছাড়া আর কারোর বান্দা হিসেবে তৈরী করেননি) কিন্তু অধিকাংশ লোক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না৷”

অর্থাত রেসালতের প্রতি তার ঈমান প্রকাশ করলেন। মিশরের লোকেরা ইব্রাহিম, ইয়াকুব (আ) এর তাওহিদ-ভিত্তিক ইসলামী জীবনবিধান সম্পর্কে অবগত ছিলেন। যেখানে ছিলনা শিরকের সংমিশ্রন। সেই আল্লাহ প্রদত্ত একমাত্র নির্ভেজাল তাওহিদ ভিত্তিক ইসলামী জীবনবিধান এর দিকে দাওয়াত দিলেন - যেখানে আল্লাহই একমাত্র সার্বভৌম ক্ষমতার একমাত্র অধিপতি।

একইভাবে মক্কার কোরায়েশদের সামনে বর্ণিত এ ঘটনা যেন বনি ইসরাইলিদের প্রতিভু রূপে তাদের প্রতি উপদেশেরই নামান্তর। ইউসুফ (আ) এর জাতি যেভাবে তাদের জীবন-ব্যবস্থায় আল্লাহর ক্ষমতা ও অধিকারে শিরকের সংমিশ্রন ঘটিয়েছিল - ঠিক তেমনই মক্কাবাসীরাও ইব্রাহিম (আ) আনীত নির্ভেজাল তাওহিদ্ ভিত্তিক ব্যবস্থাতে শিরকের প্রচলন ঘটিয়েছিল।

উপরিল্লিখিত ৪টি পয়েন্টে ইয়্সুফ (আ) ভূমিকাই বর্ণনা করেছেন।

এরপর ইউসুফ (আ) জেলখানার অধিবাসীদের সম্বোধন করছেন:

(৫)

"হে জেলখানার সাথীরা!"

লক্ষ্য করুন, সম্বোধন এবং শব্দ চয়ন! ইউসুফ (আ) কিভাবে কি আন্তরিকভাবে ও ঘনিষ্ঠতার সাথে নরমভাবে অভিভাষণ জানাচ্ছেন।

(৬-ক )

"তোমারা নিজেরাই ভেবে দেখো, ভিন্ন ভিন্ন বহু সংখ্যক রব ভালো, না এক আল্লাহ, যিনি সবার ওপর বিজয়ী (الْقَهَّارُ)"

তিনি তাদের প্রশ্ন করার মাধ্যমে চিন্তার সুযোগ দিচ্ছেন। এটি একটি গুরুত্বপূর্ন দাওয়াত দেয়ার পদ্ধতি যে চিন্তার সুযোগ তৈরির মাধ্যমে মানুষের মনে মূল বিষয় বা প্রতিপাদ্য বদ্ধমূল করে দেয়া যায়। তাকে চিন্তার ও বলার সুযোগ দেয়ার মাধ্যমে দায়ী (যিনি দাওয়াত দিচ্ছেন) তার নিজের বক্তব্য ও তার সারমর্ম মানুষের কাছে সুন্দর ভাবে পৌছে দিতে পারেন ।

(৬-খ)

"তাঁকে বাদ দিয়ে তোমরা যাদের বন্দেগী করছো তারা শুধুমাত্র কতকগুলো নাম ছাড়া আর কিছুই নয়, যে নামগুলো তোমরা ও তোমাদের পিতৃ-পুরুষরা রেখেছো, আল্লাহ এগুলোর পক্ষে কোন প্রমাণ পাঠাননি৷"

অর্থাত আল্লাহ এগুলোর পক্ষে কোন সনদ বা প্রমান পাঠাননি। এগুলো (যেমন 'লাত', 'উজ্জা', ইত্যাদি) কেবল কিছু নাম মাত্রই - মূল্যহীন ও শক্তিহীন।

(৭) এর পর পরই ইউসুফ (আ) মূল দাওয়াত দিলেন - বিশ্বজনীন দাওয়াত - যে বাণীতে প্রতিক্রিয়াশীল খরগহস্ত হয় - দায়ীর উপর নেমে আসে স্বার্থবাদী শাসকের চিরন্তন ক্ষোভ ও অত্যাচার!

إِنِ الْحُكْمُ إِلَّا لِلَّهِ

"হুকুম (বা শাসন কর্তৃত্ব) আল্লাহ ছাড়া আর কারোর নেই" - অর্থাত সার্বভৌম ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর - কারো নয়! পরিস্কার শাব্দিক অর্থবোধক কোরআনের বাণী - কোন উপমাভিত্তিক বক্তব্য বা অস্পস্ট বক্তব্য নয়!

মূলত বিশ্বময় আমরা একটি অপুর্নাঙ্গ ইসলামী জীবনধারা অনুসরন করছি। আমরা প্রাত্যহিক ইবাদত সম্পন্ন করছি - অথচ মূল যে ইসলামী জীবনব্যবস্থা তথা শরীয়ত সিদ্ধ নিয়মকানুন রাষ্ট্রের বুকে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি!

আমাদের কমপক্ষে আন্তরিক ইচ্ছা থাকতে হবে যেন নবুয়তের ধারায় ইসলামী শরীয়ত প্রতিষ্টার আন্দোলনে শরিক থাকতে পারি আমৃত্যু।

চিন্তা করুন:

আমরা কি ব্যবসা বানিজ্যে আলাহ প্রদত্ত হুকুম আহকাম অনুসরণ করতে পারছি?

আমাদের ফৌজদারি আইন, পররাষ্ট্র নীতি, সম্পত্তি বন্টন আইন, ইত্যাদি কি আল্লাহ প্রদত্ত বিধান (ইসলামী আইন) অনুযায়ী নিস্পন্ন?

আমাদের অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ্নীতি, ইত্যাদি কি শরীয়তের বিধান মোতাবেক অনুসৃত?

এর কারণ কি?

পরের আয়াতাংশে আছে:

" তাঁর হুকুম- তোমরা তাঁর ছাড়া আর কারোর 'ইবাদত' করবে না৷"

অতএব উপরোল্লিখিত অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ্নীতি, ইত্যাদি শরীয়তের বিধান মোতাবেক অনুসরণ করাও ইবাদত!

আমরা যদি আল্লাহ প্রদত্ত হুকুম আহকাম সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনীতি, রাজনীতি, ইত্যাদিতে অনুসরন না করি তার অর্থ হল আমরা আল্লাহর সাথে অন্য কাউকে (যেমন মানুষকে) উপাস্য হিসেবে স্থাপন করছি।

উদাহরণ হিসেবে উদাই বিন হাতিমের কথা বলা যেতে পারে। সে ছিল খ্রিস্টান।

রাসুল (স) তাকে বলেন " তোমরা তোমাদের ধর্ম -যাজকদের উপাস্য বা খোদা হিসেবে আল্লাহর সাথে শরিক করেছ।"

উদাই বলল, "না, আমরা তো তাদের উপাসনা করি না।"

রাসুল (স) বললেন, "তোমাদের ধর্ম -যাজকেরা কোন কিছু হালাল বা হারাম বললে তোমরা কি তা (দলিল ছাড়াই) হালাল বা হারাম হিসেবে মেনে নাও না?"

উদাই বলল, “হা"!

রাসুল (স) বললেন, "এটাই হল তাদের উপাসনা করা!"

আপনি যদি একজন মানুষ বা শাসককে কোন কিছু হালাল বা হারাম করার পূর্ণ ইখতেয়ার দেন - তথা আইন করার অনুমতি দেন ও তা মেনে চলেন - সেটাই হল তাকে উপাস্য হিসেবে আল্লাহর সাথে তাকে শরিক করার ই নামান্তর!

এটিই আমরা আমাদের জীবনের অধিকাংশ ক্ষেত্রে করছি নিরত! মূলত জীবনের অধিকাংশ বিষয়ের নিযম কানুন তৈরী ও নিয়ন্ত্রনের পূর্ণ ক্ষমতা মানুষের কাছেই প্রদান করছি -- ফলশ্রুতিতে তৈরী হচ্ছে আল্লাহ প্রদত্ত আইনের সাংঘর্ষিক নিয়ম-নীতি ।

অথচ আল্লাহ বলেন - যা আলাহ প্রদান করেছেন তাই সঠিক পদ্ধতি - "এটিই সরল সঠিক জীবন পদ্ধতি, কিন্তু অধিকাংশ লোক জানে না৷"

উপরে বর্ণিত দাওয়াতি কাজের আর ও দুটি শিক্ষনীয় বিষয় হল:

(১) মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দেয়ার ক্ষেত্রে মানুষের কর্ম , তার কথা বা উপদেশের থেকে উত্তম!

মানুষকে ইসলামের দিকে আহবান করার ক্ষেত্রে একটি মৌলিক ভুল যা করে থাকি তা হল আমরা ভাবি যে আমাদের লেকচার দিয়ে যেতে হবে। উপদেশ/সবক দিনের পর দিন দিয়েই যেতে হবে। অথচ মূল সমস্যা হল সমাজে আমরা আমাদের গুরুত্ব স্থাপন করতে ব্যর্থ হয়েছি। আমরা কারা - আমরা যে মুসলিম জাতি - তা প্রমান করতে পারিনি। আমাদের আখ্লাক্চরিত্র সময়ানুবর্তিতা মানুষের প্রতি উত্তম আকর্ষনীয় আচরণ প্রমানে ব্যর্থ হয়েছি। চাকুরি/ব্যবসাতে নিয়মানুবর্তিতা, উত্কর্ষতা, উত্তম প্রচেষ্টা ইত্যাদিতে বহুগুনে ব্যর্থ আমরা !

আমার অমুসলিমদের কাছে দেখাতে পারিনি -

* আমাদের দানশীলতা

* গরিবদের প্রতি দায়িত্ববোধ

* এতিমদের প্রতি সহানুভুতি

* বৃদ্ধ দের প্রতি দায়িত্ব বোধ, ইত্যাদি।

অথচ এ বিষয়গুলোই আল্লাহর কাছে অতি উত্তম কাজ রূপে পবিত্র কোরানেই বিবৃত!

একাজ গুলোর অভাবেই আমাদের দাওয়াত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অর্থহীন হচ্ছে - কার্যকর হচ্ছে না!

ইউসুফ (আ) কে দেখুন: তিনি ছিলেন অতি উন্নত চরিত্রের - অন্য কিছু না হোক, দয়া এবং কোমলতা ছিল জেলের সাথীদের কাছে শুরু থেকেই প্রকাশিত!

তিনি দাওয়াত দেয়ার জন্য প্রথমে মুখ খুলেননি। তার চারিত্রিক মাধুর্যে সাথীরাই বলে উঠল - "আমরা তাকে মুহসিনিন বা অতি উত্তম চরিত্রের অন্তর্ভুক্ত পেয়েছি"।

এরূপ উত্তম আচরণের প্রতিষ্ঠা পাবার পরই স্বপ্নের ব্যখ্যা জনিত আলোচনার সুবাদে ইউসুফ (আ) ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য মুখ খোলার সুযোগ নিলেন। যাতে তার প্রতিটি বাক্য শ্রোতাদের মনকে সহজেই জয় করে নিতে পারে!

(২) ইসলামের দাওয়াত যাকে দেয়া হবে তাকে সুবিধাজনক 'সময়' ও 'স্থানে' দাওয়াত দেয়া অবশ্যই প্রয়োজন। তরিঘরি করে শ্রোতার সুবিধা ও মনের অবস্থা চিন্তা ছাড়া ইসলামের দাওয়াত দেয়া 'উলু বলে মুক্ত ছড়ানোর মতই অকার্যকর অধিকাংশ সময়ে!

জেলখানায় খাবার দেয়ার সময় সবাই জানত। তাই ইউসুফ (আ) সময় ও স্থান নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করলেন - যাতে তার কথা (ইসলামের দাওয়াত) শুনতে তৈরী থাকে।

-------------

তথ্য সূত্র

[১] ইমাম ইবনে কাসীর, "stories of the prophets"

[২] ইমাম আনোয়ার আওলাকি, "লাইফ অফ প্রফেটস" লেকচার

বিষয়: বিবিধ

১৬২৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File