ইসলামী দাওয়াতের কর্মপদ্ধতি (১)

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ০১ জুন, ২০১৩, ০৭:৩০:৪১ সন্ধ্যা

সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ তায়ালার প্রতি -- যিনি আমাদের প্রতি নিরত দয়াশীল। দরুদ ও সালাম মানবতার মুক্তিদূত রাসুলুল্লাহ (সা), তার পরিবার পরিজনের প্রতি। আল্লাহর অশেষ রহমত বর্ষিত হোক যুগ-যুগান্তরের ইসলামের পথে অবিচল আলোকিত মানুষ ও তাদের পরিজনদের প্রতি।

নবী-রাসুলদের জীবনী-গল্প (কোরআনের আলোকে) থেকে ইসলামী দাওয়াতের কর্মপন্থা সম্পর্কিত মূলনীতি বের করার চেষ্টা করব ইনশাল্লাহ।

[এক]

প্রথম গল্পটি হল নমরুদ / নিম্রদের সাথে ইব্রাহিম (আ) এর কথোপকথন। নমরুদ ছিল ব্যবিলনের রাজা। শক্তিশালী স্বৈরাচার। পক্ষান্তরে ইব্রাহিম (আ) ছিলেন যুবক|

ইব্রাহিম (আ) কিভাবে এই স্বৈরাচারী রাজাকে ইসলামের দাওআত প্রজ্ঞার সাথে দিয়েছিলেন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক তর্ক করেছিলেন তা সুরা বাকারায় ২৫৮ নং আয়াতে এসেছে:

বাকারা ২৫৮:

তুমি সেই ব্যক্তির অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করোনি, যে ইবরাহীমের সাথে তর্ক করেছিল ? তর্ক করেছিল এই কথা নিয়ে যে, ইবরাহীমের রব কে ? এবং তর্ক এ জন্য করেছিল যে,

آتَاهُ اللَّهُ الْمُلْكَ

আল্লাহ তাকে রাষ্ট্রক্ষমতা দান করেছিলেন ৷

যখন ইবরাহীম বললোঃ

رَبِّيَ الَّذِي يُحْيِي وَيُمِيتُ

যার হাতে জীবন ও মৃত্যু তিনিই আমার রব৷

জবাবে সে বললোঃ

أَنَا أُحْيِي وَأُمِيتُ

জীবন ও মৃত্যু আমার হাতে ৷

কাতাদাহ ও ইবনে ইসহাক থেকে বর্ণিত: নমরুদ ২ জন মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত লোককে আনল কয়েদখানা থেকে। একজনকে মুক্ত করে দিল আর আরেকজনকে মৃত্যু দিল। অতপর ইব্রাহিমের কাছে বলল যে, দেখ! এভাবেই আমি জীবন ও মৃত্যু দিয়ে থাকি!

বস্তুত ইব্রাহিম (আ) 'জীবন ও মৃত্যু' দানের এই বোকার মত অর্থ ও স্থুল চিন্তার যুক্তি (যা নমরুদ দিয়েছিল) কল্পনাও করেননি। ইব্রাহিম (আ) জীবন ও মৃত্যুর অলৌকিকত্ব (miracle) বলতে বুঝিয়েছিলেন - যা প্রতি মুহুর্তে বিশ্বব্রম্মান্ডের প্রতিটি প্রানে দিবা রাত্র ঘটছে -- সাগরের গহীন তলদেশ অথবা বহমান বাতাসে - পৃথিবীর আনাচে কানাচে সংঘটিত হচ্ছে নিরত! প্রতিটি মুহুর্তে অগণিত বৃহদাকার প্রাণী/উদ্ভিদ থেকে শুরু করে অদেখা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রানে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন জীবন ও মৃত্যু ঘটাচ্ছেন।তিনি 'জীবন ও মৃত্যু' বলতে এটিই বুঝিয়েছেন।

এ অবস্থায় ইব্রাহিম (আ) নমরুদের সাথে কি তর্ক করলেন?

তিনি কি তর্কে আরও আগালেন? না! ইব্রাহিম (আ) আর এ বিষয়ে যুক্তি দিতে আর এগোননি। বিরোধী পক্ষকে যদি তুচ্ছ গুরুত্বহীন পয়েন্টে যুক্তিতর্ক করতে দেখেন তবে সবচেয়ে উত্তম - তর্ক ছেড়ে দেয়া। এ অবস্থায় ইব্রাহিম (আ) এ কাজটি ই করলেন নমরুদের সাথে। 'জীবন ও মৃত্যুর' অর্থ বিশ্লেষণে নমরুদের সাথে আর কোন তর্কে জড়ালেন না। বরং তিনি বিষয় পরিবর্তন করলেন।

ইব্রাহিম (আ) ভাবলেন যেহেতু নমরুদ বুদ্ধি, লজিক আর চিন্তা-ভাবনার দৃষ্টিকোণ থেকে একরোখা নাছরবান্দা ধরনের - তিনি নমরুদ কে পুরোপুরি অন্য দিক দিয়ে আক্রমন করলেন 'জীবন ও মৃত্যু' বিষয়ক আলোচনা/তর্ক শেষ করতে।

পরের আয়াতাংশেই রয়েছে:

“ইবরাহীম বললোঃ তাই যদি সত্য হয়ে থাকে তাহলে, আল্লাহ পূর্ব দিক থেকে সূর্য উঠান ,দেখি তুমি তাকে পশ্চিম দিক থেকে উঠাও ৷ একথা শুনে সেই সত্য অস্বীকারকারী হতবুদ্ধি হয়ে গেলো কিন্তু আল্লাহ জালেমদের সঠিক পথ দেখান না ৷

فَبُهِتَ الَّذِي كَفَرَ

“একথা শুনে সেই সত্য অস্বীকারকারী হতবুদ্ধি হয়ে গেলো”

وَاللَّهُ لَا يَهْدِي الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

“আল্লাহ জালেমদের সঠিক পথ দেখান না “

তাফহিমুল কোরানের ব্যখ্যা অনুযায়ী "যদিও হযরত ইবরাহীমের (আ) প্রথম বাক্যের একথা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় আর কেউ রব হতে পারে না তবুও নমরুদ ধর্মিতার পরিচয় দিয়ে নির্লজ্জের মতো তার জবাব দিয়েছে৷ কিন্তু দ্বিতীয় বাক্যের পর তার জন্য আবার হঠধর্মী হবার আর কোন সুযোগই ছিল না৷ সে নিজেও জানতো, চন্দ্র-সূর্য সেই আল্লাহরই হুকমের অধীনে যাকে ইবরাহীম রব বলে মেনে নিয়েছে৷ এরপর তার কাছে আর কি জবাব থাকতে পারে? কিন্তু এভাবে তার সামনে যে দ্ব্যর্থহীন সত্য আত্মপ্রকাশ করেছিল তাকে মেনে নেয়ার মানেই ছিল নিজের স্বাধীন সার্বভৌম প্রভুত্ব ও শাসন কর্তৃত্ব পরিহার করা৷ আর এই কর্তৃত্ব পরিহার করতে তার নফসের তাগুত মোটেই প্রস্তুত ছিল না৷ কাজেই তার পক্ষে নিরুত্তর ও হতবুদ্ধি হওয়াই স্বাভাবিক ছিল৷ আত্মপূজার অন্ধকার ভেদ করে সত্য প্রিয়তার আলোকে প্রবেশ করা তার পক্ষে সম্ভবপর হলো না৷ যদি এই তাগুতের পরিবর্তে আল্লাহকে সে নিজের সাহায্যকারী ও পৃষ্ঠপোষক হিসেব মেনে নিতো, তাহলে হযরত ইবরাহীমের প্রচার ও নসিহত প্রদানের পর তার জন্য সঠিক পথের দ্বার উন্মক্ত হয়ে যেতো৷

তালমূদের বর্ণনা মতে, তারপর সেই বাদশাহর নির্দেশে হযরত ইবরাহীমকে বন্দী করা হয়৷ দশদিন তিনি কারাগারে অবস্থান করেন৷ অতপর বাদশাহর কাউন্সিল তাকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে৷"

অর্থাত নমরুদ ইব্রাহিম (আ) এর যুক্তি মেনে নিতে পারছিল না অহংকারের জন্য। যুক্তি গ্রহণে দ্বিধান্বিত হচ্ছিল যার জন্য নমরুদ নিজেই দায়ী - একরোখা অন্ধ বিশ্বাসী হওয়ার জন্য।

লক্ষ্য করুন, ইব্রাহিম (আ) বলতে পারতেন, 'আমি 'জীবন-মৃত্যুর' অর্থ বলতে তা বুঝিনি যা আপনি বলছেন। এভাবে এটি একটি অসমাপ্ত অর্থহীন সংলাপেই কেবল পরিনত হত!

ইব্রাহিম (আ) বিরোধী পক্ষের মনমানসিকতাকে সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষন করেই যৌক্তিক ও প্রগ্গাভিত্তিক সঠিক কাজটি করেছিলেন - তাকে যুক্তির মাধ্যমে থামিয়ে দিয়েছিলেন - করেছিলেন 'হতবুদ্ধিসম্পন্ন'।

জায়েদ বিন আসলাম (রা) থেকে বর্ণিত, নমরুদ ঐ দেশে পন্য দ্রব্য বিশেষ করে খাদ্য -সরবরাহ নিজেই নিয়ন্ত্রণ করতেন। ইব্রাহিম (আ) সেদিন খাবার নিতে গিয়েছিলেন পরিবারের জন্য।

যুক্তি-তর্কে পরাস্ত নমরুদ এতই ক্ষেপে গিয়েছিল যে, সে ইব্রাহিম (আ) কে কোন খাবার দেয়নি কোন কারণ ছাড়াই!

তাই ইব্রাহিম (আ) কোন খাবার ছাড়াই বাড়ি রওনা দেন। পথিমধ্যে বালি দিয়ে ব্যগ পূর্ণ করেন পরিবারকে বুঝ দিতেএবং বাড়ি প্রবেশ করেন । তিনি ঘুম দেন এবং ঘুম থেকে উঠলে তার স্ত্রী সারা (আ) বললেন "আপনার খাবার তৈরী! আপনি যে খাবার নিয়ে এসেছেন তা আমি তৈরী করেছি!!"

আল্লাহ বলেন:

“ যে ব্যক্তিই আল্লাহকে ভয় করে চলবে আল্লাহ তার জন্য কঠিন অবস্থা থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় সৃষ্টি করে দেবেন৷ এবং এমন পন্থায় তাকে রিযিক দেবেন যা সে কল্পনাও করতে পারে না৷ যে ব্যক্তি আল্লাহর ওপর নির্ভর করে আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট৷ আল্লাহ তাঁর কাজ সম্পূর্ণ করে থাকেন|" (সুরা তালাক্)

(চলবে)

বিষয়: বিবিধ

১৫৯০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File