ইসলামের দৃষ্টিতে সহিষ্ণুতা (Tolerance)

লিখেছেন লিখেছেন ড: মনজুর আশরাফ ১৬ মে, ২০১৩, ০৬:৪৮:৫৪ সকাল

"সহিষ্ণুতা" (Tolerance)

মূল বক্তব্য:: ইমাম আনোয়ার আওলাকি

ভাবান্তর: মঞ্জুর আশরাফ

আলহামদুলিল্লাহ! সর্বপ্রথম আমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে 'ইখলাস' কামনা করছি - সকল ব্যপারে দায়িত্বানুভুতি ও সচেতনতাসম্পন্ন হওয়া শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই কামনা করছি। কারণ কাজের প্রতিফল নির্ভর করে নিয়তের উপর । এজন্য আমাদের নিশ্চিত হতে হবে যে আমাদের সঠিক নিয়ত রয়েছে। আমাদের নিজেদের উপকারের জন্যই যা কিছু করব কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই করব। প্রথম যুগের মুসলিমদের (সাহাবী, তাবেইন, ইত্যাদি) এরকম মানসিকতাই ছিল - তারা যা করতেন তার পর আত্ম্সমালোচনা করতেন যে যা করেছেন সঠিক উদ্দেশ্যেই করেছেন কিনা!

হিশাম বিন আব্দুল মালিক তার আত্মীয় 'ওমর বিন আব্দুল আজিজ (রহ) ' সম্পর্কে বলেছেন, "আমি মনে করি না যে তিনি কোনো পদক্ষেপ নিবেন এটা না ভাবার পূর্বে যে (১) কেন তিনি কাজটি করছেন এবং (২) কাজটি করার পিছনে তার উদ্দেশ্য কি?'

হে আল্লাহ! আমরা আপনার কাছে 'ইখলাস'পূর্ণ মানসিকতা এবং এ ব্যপারে দায়িত্বানুভুতি ও সচেতনতাসম্পন্ন হওয়ার তৌফিক চাচ্ছি!

ক) মূলনীতি:

আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, " হে ঈমানদারগণ ! সত্যের ওপর স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত ও ইনসাফের সাক্ষদাতা হয়ে যাও৷ কোন দলের শত্রুতা তোমাদেরকে যেন এমন উত্তেজিত না করে দেয় যার ফলে তোমরা ইনসাফ থেকে সরে যাও৷ ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠিত করো৷ এটি আল্লাহভীতির সাথে বেশী সামঞ্জস্যশীল৷ আল্লাহকে ভয় করে কাজ করতে থাকো৷ তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত আছেন ৷" (মায়েদাহ: ৮)

অতএব ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় সকল ব্যপারে আমাদের ন্যায়-বিচারবোধ সম্পন্ন হওয়ার - বন্ধু অথবা শত্রু যেই হোক না কেন তার সাথে সঠিক ও ন্যায় আচরণ করার!

এবং আল্লাহ এ আয়াতে বলছেন যে যদিও তোমাদের কোন মানুষ বা দলের সাথে সমস্যা, ঘৃনা বা কোন্দল থেকে থাকে তোমাদের উপর তাদের অত্যাচার বা জুলুমের কারণে -- যেমনটি মক্কার কোরায়েশরা মুসলমানদের সাথে যাচ্ছেতাই দুর্ব্যবহার করছিল - জুলুম করেছিল - তবুও তাদের প্রতি 'ন্যায়-বিচার সম্পন্ন (FAIR) ' হতে হবে।

-- এটাই হল সহিষ্ণুতা (TOLERANCE)।

দুই ধরনের সহিষ্ণুতা আছে - (১) একটি হল মুসলমান এবং কাফেরদের (বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের) মাঝে; (২) আরেকটি মুসলমানদের মাঝে।

খ) কাফেরদের ব্যপারে মুসলমানদের সহিষ্ণুতা:

প্রথম ধরনের সহিষ্ণুতার ক্ষেত্রে আমার মতামত হল - যদিও আমি ভুল হতে পারি - এটি এমন একটি মূলনীতি যা শাসক তথা শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত লোকদের জন্য প্রযোজ্য - শোষিতের জন্য নয়। এবং এজন্যই আমি মনে করি না যে এটি একটি গুরুত্বপূর্ন বিষয় যা নিয়ে মুসলমানদের কথা বলা উচিত। কারণ মুসলমানেরা বর্তমান বিশ্বে কোন অবস্থাতেই শাসন-ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত নয়! অর্থাত আপনি যদি

মুসলমানদের দেখেন - যাদের নিজ বাড়িঘর, মাতৃভূমি থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে - এ অবস্থায় তাদেরকে যদি 'সহিষ্ণু' হতে বলেন - তবে তা একেবারেই হাস্যকর ও অযৌক্তিক হবে।

পক্ষান্তরে মুসলমানেরা যখন শাসন-ক্ষমতায় ছিলেন - তখন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের সাথে তাদের অআচরণ ও সহিষ্ণুতা কি রকম ছিল - এ সম্পর্কে জানতে আমাদের ইতিহাসের পাতায় ফিরে যেতে হবে। দেখতে হবে সেক্ষেত্রে শাসক মুসলমানেরা বিধর্মীদের সাথে কি কাজ করেছিলেন - কি আচরণ করেছিলেন। এ ক্ষেত্রে ইতিহাসের প্রতিপাদ্য হল - যা অতিরঞ্জন নয় বরঙ এক বাস্তবতা - মুসলমানেরা কেবল সহিষ্ণুই ছিলেন না - পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বতকৃস্ট সহিষ্ণু জাতি হিসেবে সকলের কাছে কাজেকর্মে প্রমান দিয়েছিলেন।

চোখ মেলে দেখুন মুসলমানেরা কিভাবে শাসক হিসেবে স্পেনের সংখ্যালঘুদের সাথে আচরণ করেছিলেন; ইহুদি ও খ্রিস্টানদের সাথে, ক্যথলিকদের সাথে, বলকানের অর্থডক্সদের সাথে, ভারতের হিন্দুদের সাথে ব্যবহার করেছিলেন। সমগ্র মুসলিম-বিজিত অঞ্চলে ইহুদিরা বসবাস করতেন - কেউ কখনো দেশান্তরী হননি - বরঙ শত শত বছর ধরে নিরাপদে নির্বিঘ্নে মুসলিম শাসকের অধীনে নিজ মাতৃভূমিতেই বসবাস করেছিলেন।

অতএব আমি মনে করি আমাদের সবচেয়ে বেশি যে ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিতে হবে - কারণ সে বিষয়েই আমাদের সবচেয়ে দুর্বলতা বিদ্যমান - তা হল নিজেদের মাঝে (মুসলমানদের মাঝে) সহিষ্ণুতার অভাব। কারণ ইতিহাসের চরম সত্য হল মুসলমানদের চির-সহিস্নুতার অজস্র প্রমান বিদ্যমান যা অনেক ক্ষেত্রেই প্রচারের অভাবে আর মিথ্যা প্রপাগান্ডায় অনেকেরই অজানা।

ঐতিহাসিক জেমস রাস্টেন 'ওয়ারিয়র্স অফ গড' (২০০১) বইতে সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এবং রিচার্ড দা লায়ন হার্ট সম্পর্কে বলেছেন। ক্রুসেডের উপর তথ্য নির্ভর আলোচনাতে তিনি মুসলিম সেনাপতি সালাহউদ্দিন আইয়ুবী সম্পর্কে চমকপ্রদ তথ্য দিয়েছেন। তিনি বলেন যে, সালাহউদ্দিন আইয়ুবী এক মারাত্মক ভুল করেছিলেন। তিনি শত্রুদের সাথে অতি মাত্রায় ভাল আচরণ করেছিলেন। অতি-মাত্রার সহিষ্ণুতা ছিল তার চরিত্র যা শেষের দিকে তার পরাজয়ের মূল কারণ ছিল বলে তিনি প্রমান করেন। যখনি সালাহউদ্দিন আইয়ুবী ক্রুসেডারদের কোন দুর্গ জয় করতেন, তিনি সবাইকে (শত্রু-সৈন্য সহ) মুক্ত করে দিতেন। ফলশ্রুতিতে শত্রুরা একতাবদ্ধ হয়ে থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে ফিলিস্তিনের সমুদ্র্ তীরবর্তী অঞ্চল দখল করে নেয়। অতএব, এটা সালাহউদ্দিন আইয়ুবীর কি পরিমান সহিষ্ণুতা ছিল তা নয় - বরং অনেক ক্ষেত্রে অতি মাত্রার সহিষ্ণুই তিনি ছিলেন যা তার পরাজয়ের কারন হয়ে দাড়ায় শেষ পর্যন্ত (অথচ তাকে নিয়ে ইসলাম-বিদ্বেষীদের বাজে কথাবার্তার অন্ত নেই!)।

গ) মুসলমানদের মাঝে পরমত-সহিষ্ণুতা:

অতএব আমাদের নিজেদের (মুসলমান দল/গ্রুপ, ইত্যাদি) মাঝে সহিষ্ণুতার ব্যপারে জোড় দিতে হবে। এটি একটি বিষয় যেখানে

(১) আমাদের সৎ হতে হবে এবং

(২) কেবল আমাদের নিজস্ব আচরনকে তিক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সমালোচনা করতে হবে। এ বিষয়ে আমাদের ব্যপক উন্নতকরণের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

প্রশ্ন হল: আমাদের নিজেদের মাঝে অসহিষ্ণুতা কেন থাকতে পারে? উত্তর হল: কারন আমরা সবাই চিন্তার জগতে আলাদা বৈশিষ্ট সম্পন্ন। এখন দুইটি সমাধান হতে পারে।

(এক) নিজেদের মাঝে সকল প্রকার ভিন্ন মতের বিলোপ ঘটানো;

এই পয়েন্টে বলা যায় যে -

[১] এটি অসম্ভব!

[২] যখন ই কোন সময়ে এ প্রক্রিয়া দিয়ে মানুষেরা অগ্রসর হতে চেয়েছে, তা অধিকতর সমস্যা তৈরী করেছে। কেন? কারণ আপনি লোকদের ওই বিষয়ে একতাবদ্ধ করতে চাচ্ছেন যা আপনি মনেপ্রাণে একমাত্র 'সঠিক' বলে বিশ্বাস করেন এবং আপনি গুরুত্ব/চাপ প্রয়োগ করছেন যাতে সবাই তা মেনে নেয়!!

ফলশ্রুতিতে সমাধানের পরিবর্তে এটি আরও সমস্যা তৈরী করে ।

(দুই) মতামতের ভিন্নতা একটি চিরন্তন ব্যপার। এটি এমন বাস্তবতা যা আমরা অবশ্যই মোকাবেলা করব। অতএব আমরা মতামতের ভিন্নতা দূর করার চেষ্টা না করে বরং কিভাবে ভিন্ন ভিন্ন মতকে নিয়ে সহাবস্থানের ভিত্তিতে অগ্রসর হব সেই চেষ্টাই করা উচিত।

মতামতের ভিন্নতা সাহাবীদের মাঝেও ছিল। প্রসঙ্গত, মতামতের ভিন্নতা ফেরেশতাদের মাঝেও ছিল! বুখারীর একটি হাদিস অনুযায়ী একজন লোক যিনি ৯৯ জনকে হত্যা করেছিলেন এবং পরে একজন দরবেশকে হত্যা করে শত পূর্ণ করেছিলেন; পরবর্তিতে তওবা করে মারা গিয়েছিলেন - দুইজন ফেরেশতা এসেছিল এবং তাদের একটি মতানৈক্য হয়েছিল- সে জান্নাতি নাকি জাহান্নামী তা নিয়ে। অতএব ফেরেশতাদের মাঝেও মতামতের ভিন্নতা থাকতে পারে।

মহানবী (দ) এর সাহাবাদের মাঝেও বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যপক মতামতের ভিন্নতা ছিল। নবীজির (দ) দুই উপদেষ্টা আবু বকর ও ওমর (রা) এর মাঝে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রায় দিবা-রাত্র মতামতের ভিন্নতা ছিল। দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল আলদা বিভিন্ন ইস্যুতে। কারণ, মানুষ হিসেবে আমার আমাদের অন্তর্দৃষ্টিকে আমাদের আহরিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার আলোকে গড়ে তুলি। এর মাধ্যমেই আমরা বিশ্বকে দেখি - ঘটনাকে মূল্যায়ন করি। প্রত্যেক মানুষের সুনির্দিষ্ট/স্বতন্ত্র ধরনের জ্ঞান ও অভিগ্গতা বিদ্যমান। আর সেকারণেই প্রত্যেকেই এক স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী হয়ে থাকে - ঘটনা প্রবাহকে মূল্যায়নের প্রেক্ষিতে। যেমন আবু বকর (রা) এর দৃষ্টিভঙ্গি ও বিবেচনাবোধ ছিল দয়ালু ও নরম প্রকৃতির। পক্ষান্তরে ওমর (রা) ছিলেন শক্ত প্রকৃতির - তুলনামূলকভাবে কঠোর ধরনের। একারণে মহানবী (দ) আবু বকর (রা) এবং ওমর (রা) কে যথাক্রমে ইসা (আ) এবং মুসা (আ) এর সাথে তুলনা করেছিলেন। অর্থাৎ আল্লাহর আম্বিয়া দের মাঝেও মতামতের ভিন্ন ভিন্ন মাত্রা বিদ্যমান ছিল - ছিল দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা।

অনুরূপে আমাদের মাঝেও মতামতের ভিন্নতা বিদ্যমান। এ নিয়ে ভয়ঙ্কর দুশ্চিন্তার কোন কারণ নেই। এ জন্য আমাদের সকলকে একই মতের অধীনে আনয়নের প্রবল প্রচেষ্টাও নিস্প্রয়োজন। চোখ মেলে দেখুন 'ফিকহ' এর বহুমাত্রিক ভিন্নতার দিকে - যা আসলেই এই উম্মতের জন্য মহামূল্যবান সম্পদ-স্বরূপ। আমাদের ইমামদের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন মতামতের সংকলন - যেন এক বহুদা-বিস্তৃত জ্ঞানের প্রস্রবন। চিন্তা করুন, যদি কেবল একটি ফিকহ (নিয়ম কানুন) বিদ্যমান থাকত সকল কাজের জন্য - আমাদের জীবন কত ভয়ঙ্কর কঠিন ই না হত ! এ বিষয়টা কখন ও কি চিন্তা করেছেন?

মতামতের ভিন্নতার কারণে ইসলাম এমনি এক ধর্মরূপে বিদ্যমান যা সকল সময় ও অঞ্চলে সহজ সাবলীল এক জীবন ধারা রূপেই বিদ্যমান। এটাই ইসলামের শক্তি। এজন্য আমাদের নিজেদের মতামতের ভিন্নতাকে উপকারীস্বরূপ গড়ে তুলতেই প্রচেষ্টা করা কর্তব্য।

অতএব অসহিষ্ণুতার সমস্যাকে সমাধানের জন্য আমাদের শেখা উচিত কিভাবে মতামতের ভিন্নতাকে উপকারী উপায়ে মোকাবেলা করব - এ জ্ঞানকে বলে 'ফিকহ-উল-খিলাফ'।

এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ন সমাধান হল 'ফিকহ-উল-আউলিয়াত' এর জ্ঞানার্জন।

এখন আমি এর 'কারন' ও 'প্রতিকার' বিষয়ে উল্লেখ করব।

ঘ) প্রায়োরিটি নির্ধারণে ভ্রান্তি:

অন্যের মতের প্রতি অসহিষ্ণুতার একটি কারন হল প্রায়োরিটি বা সময়ানুগ-গুরুত্ব অনুযায়ী কাজ নির্বাচনের ভুল করা (জ্ঞান না থাকার জন্য)|

এটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ফিকহ। কুফার একটি প্রতিনিধি দল হজ্জের মৌসুমে আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) এর কাছে এসেছিলেন একটি ফতোয়া জানার ব্যপারে। আমরা জানি যে, ইহরাম অবস্থায় কোন পোকা মাকড় মারা যায়না।

প্রতিনিধি দল জিজ্ঞাসা করলেন, "ইহরাম অবস্থায় কি মশা মারা যাবে?"

আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা) বললেন, "আপনারা কোথা থেকে এসেছেন?"

তারা বললেন, "আল-ইরাক।"

তিনি বললেন, "সুব্হানাল্লাহ! আপনারা রাসুলুল্লাহ (স) এর নাতি হুসাইন (রা) কে হত্যা করেছেন; এখন আমাকে মশা মারার ব্যপারে জিজ্ঞাসা করতে এসেছেন?"

অতএব আমাদের ইসলামে প্রায়োরিটি বা সময়ানুগ-গুরুত্ব অনুযায়ী কাজ নির্বাচনের ব্যপারে ভয়ঙ্কর ভ্রান্তি ও ধারণা বিদ্যমান।

আমাদের প্রত্যেকের জীবনে একই রকম উদাহরণ বর্তমান। আমাদের প্রায়োরিটি নির্ধারিত নয়। আমাদের ক্ষুদ্র ইস্যু নিয়ে সুন্দর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা আর যুক্তিতর্ক করা অনুচিত যেখানে মুসলিম উম্মাহ অনেক বড় বড় সমস্যায় হাবুডুবু খাচ্ছে। বিশ্ব জুড়ে কোটির ও বেশি মুসলমান ইসলামের মৌলিক ভিত্তি সম্পর্কে অবগত নয়। একজন স্কলারের মতে, মক্কা নগরীর কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে লোক পাওয়া যাবে যারা সুরা ফাতিহা জানেনা। পক্ষান্তরে আমরা আমাদের সময় নস্ট করছি ব্যপক আলোচনা আর গৌন বিষয় নিয়ে তর্কবিতর্কের মাধ্যমে।

অনেক মুসলিম দেশে ক্রিস্টান মিশনারী কাজ এত ব্যপক আয়োজনে চলছে যে আশ্চর্য হতে হয় -- গ্রামের পর গ্রাম অবহেলিত লোকজন সামান্য সুবিধার আশায় ধর্মান্তরিত হয়ে যাচ্ছে।

যখন আমাদের একটি জাতি - ইরাককে - মৃত্যুকূপে পরিনত করেছে পরাশক্তি - সেখানকার ভাইয়েরা রক্তাত্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত -- তাদের জন্য আমরা কি করতে পারছি?

অথচ আমাদের উম্মাহকে সন্মানের উচু স্তরে নেয়ার জন্য সর্বোচ্চ পরিশ্রম বিনিয়োগ করা কর্তব্য - নিজেদের মাঝে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে আলোচলা আর তর্ক বাদ দিয়ে!

ফিলিস্তিন এমন এক ইস্যু যা নিয়ে আমাদের দিবারাত্র ভাবা প্রনিধানযোগ্য।

আরব বসন্তের আবির্ভাবে আমাদের সর্বোচ্চ শক্তিতে বেগবান হওয়া প্রয়োজন -- বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পরাশক্তিদের পুতুল সরকার কর্তৃক গ্রেফতার কৃত ইসলামী আন্দোলনের ভাইবোনদের মুক্তির জন্য তীব্র আন্দোলন ও চাপ প্রয়োগে সব ধরনের কর্মতত্পরতা চালিয়ে যাওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ন বিষয়!

এটাই হল ফিকহ-উল-আওলিয়াত। আমাদের প্রায়োরিটি এর ব্যপারে পরিচ্ছন্ন ধারণা ও কর্ম তত্পর থাকা বাঞ্চনীয়।

ঊম) বাস্তবতা-বিবর্জিত বিষয় এড়ানো:

ওমর বিন খাত্তাব (রা) এর কাছে কয়েকজন এসেছিলেন সুদুর ইয়েমেন থেকে কিছু ফতোয়ার ব্যপারে জিজ্ঞাসা করতে! ওমর (রা) জিজ্ঞাসা করলেন, "এই ঘটনা কি ঘটেছে (অর্থাত যে বিষয়ে ফতোয়া জানতে তারা এসেছিল)? উত্তর ছিল "না"।

ওমর (রা) বলেন, "ইয়েমেনে ফিরে যাও! যখন এ ধরনের কোন অবস্থার মুখোমুখি হবে বাস্তবে, তখন আমার কাছে ফিরে এস! আমি বদরের যোদ্ধাদের নিয়ে কাউন্সিল করে এর ফতোয়া বের করার চেষ্টা চালাব!"

অতএব, প্রসিদ্ধ সাহাবাদের বাস্তবিক জীবনের কর্ম্পদ্দতি কিরূপ ছিল চিন্তা করুন! তারা কিভাবে অপ্রয়োজনীয় বিষয় এড়িয়ে চলতেন দেখুন!

অথচ আমরা তাত্বিক বিষয় নিয়ে আলোচনার ঝড় তুলি। আমাদের অনেক বিষয় করনীয়! দয়া করে তত্ব (থিওরি) নিয়ে সময় নস্ট করবেন না। ওমর (রা) এর বক্তব্য ছিল যে, দয়া করে তত্ব নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সময় নস্ট করবেন না। যদি বিষয়টি আসলেই সংঘটিত হয় তবেই আমি উত্তর দেয়ার চেষ্টা করব!

চ) ব্যক্তিগত জীবনে সহিষ্ণুতা অর্জনের পথে বাধা:

সময়ের স্বল্পতায় বিষয়টি শেষ করতে হচ্ছে! তবে দুইটি বিষয় যা ব্যক্তিগত জীবনে সহিষ্ণুতা অর্জনের পথে বাধাস্বরূপ - তা -হল (অ) স্বল্প বিদ্যা, এবং (২) পর-হিংসা!

ছ) সমাধানের চাবিকাঠি - 'আমাদের হৃদয':

শেষ যে বিষয়ে আমি ইঙ্গিত দিব মূলত আমি মনে করি -- "চাবিটি সেখানেই!" অর্থাত সমাধানের চাবিকাঠি একটি জায়গাতেই অবস্থিত! সে জায়গাটি হল - 'আমাদের হৃদয়'!

রাসুলুল্লাহ (দ) একবার সাহাবাদের বললেন এখন একজন লোক আসবেন যিনি হলেন জান্নাতি!

এটি আল্লাহ প্রদত্ত ওহি - যার মাধ্যমে রাসুলুল্লাহ (স) অবগত হয়েছিলেন যে একজন জান্নাতি মানুষ এখন মসজিদে প্রবেশ করবেন।

একজন আনসার আসলেন। লোকটি অচেনা ছিলেন। এমনকি হাদিস্ টিতে (যা মুসনাদ বিন আহমদ থেকে বর্ণিত) তার নামও উল্লেখ নেই!

পরের দিন রাসুলুল্লাহ (স) সাহাবাদের বললেন, এখন একজন লোক আসবে যে জান্নাতি। সেই একই মানুষের দেখা পাওয়া গেল।

তৃতীয় দিন রাসুলুল্লাহ (স) বললেন, জান্নাতি একজন লোক মসজিদে প্রবেশ করবেন। গত দুই দিনের মত আবারও ওই একই ব্যক্তি প্রবেশ করলেন।

তিনবার রাসুলুল্লাহ (স) উল্লেখ করলেন যে ওই মানুষটি জান্নাতি!

আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা) উত্সাহী হলেন ওই মানুষটির বিশেষত্বের ব্যপারে জানার জন্য। তিনি ওনাকে বললেন যে আমার পিতার সাথে একটি ব্যপারে সমস্যা এবং আমি শপথ করেছি যে তিন দিন আমি তার বাড়িতে প্রবেশ করবনা। আপনি কি আমাকে তিন দিনের জন্য আপনার বাড়িতে মেহমানদারী করতে পারবেন?

তিনি সম্মত হলেন।

আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা) মূলত ওই মানুষটির ব্যক্তিগত জীবন দেখতে চেয়েছিলেন। তার কি বিশেষত্ব?

আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা) ভাবলেন ওই মানুষটি হয়ত সারারাত নামাজ পরবেন। কিন্তু তিনি শুধু ফজরের পূর্বে উঠে কিছু নামাজ পড়লেন। তিনি ভাবলেন যে ওই মানুষটি রোজা রাখবেন। কিন্তু তা না করে নাস্তা করলেন। আব্দুল্লাহ (রা) ভাবলেন তবে তার বিশেষত্ব কি?

তিনি এও ভাবলেন হয়ত পরের দিন উনি উত্তম ইবাদত করবেন। কিন্তু তা হলনা। তিনি রাতে ঘুমালেন এবং সকালে নাস্তাও করলেন। তৃতীয় রাতও ওই মানুষটি একই কাজ করলেন।

আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা) ওনার কাছে বললেন যে, আসলে আমার পিতার সাথে আমার কিছু হয়নি। আমি আসলে জানতে চেয়েছিলাম যে আপনার ব্যক্তিগত জীবনের কি এমন বিশেষত্ব যে রাসুলুল্লাহ (স) স্বয়ং আপনাকে জান্নাতি বলে সম্বোধন করেছেন। আপনি কি আপনার বিশেষ কোন গুন উল্লেখ করবেন (যা আমি বুঝতে পারিনি) যা আপনাকে এরূপ স্বাতন্ত্রমন্ডিত করেছে?

ওই সাহাবী বললেন, " এটাই আমার জীবন"! "আপনি যা দেখেছেন"!

আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা) চলে আসলেন। কিন্তু তখন লোকটি আব্দুল্লাহ (রা) কে ডাকলেন এবং বললেন, "দেখুন! আপনি যা দেখেছেন তার চেয়ে অন্য রকম আমি জীবনযাপন করিনা কিন্তু একটি ব্যতিক্রম ছাড়া!

যখনি আমি রাতে ঘুমাতে যাই- আমি আমার পরিচিত/অপরিচিত সকল মুসলমান ভাইদের ব্যপারে 'ঘৃনা' এবং 'হিংসা' পরিত্যগ করেই ঘুমাতে যাই"!

আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন আস (রা) বলেন, 'এটাই! এটাই সেই বিশেষত্ব! এটাই সেই কারণ!"

অতএব, সমাধানের মূল চাবিকাঠি আমাদের হৃদয়েই অবস্থিত!

যখনি অপর মুসলিম ভাই/গ্রুপের সাথে সমস্যা তৈরী হয়, আমাদের বলা উচিত যেমনটি ইসা বিন মারয়াম (আ) বলেছেন, "তুমি তোমার ভাইয়ের একটি চুল না দেখে পারনা (অর্থাত কোন ক্ষুদ্র ভুল ও মাফ করতে পারনা!) অথচ তোমার চোখে যে সমস্যা/ ময়লা আছে তা ঠিকই খেয়াল করনা! "

অপর মুসলিম ভাই বা গ্রুপের বা দলের সমস্যা আমরা অনেক বড় করে দেখি এবং ভাবি যে আমরাই সঠিক পন্থায় "সৎ কাজের আদেশ আর অন্যায়ের প্রতিরোধ করে যাচ্ছি"।

কিন্তু আসল সমস্যা হল যে, আমরা নিজেদের সমস্যা নিয়ে মোটেও চিন্তিত নই! আমরা ভুলে যাই যে -- 'একদিন আমরা প্রত্যেকে আল্লাহর কাছে ""একাকী" হিসাবনিকাশ দিতে দাড়াবো'।

অতএব মূল সমসার সমাধান আমাদের হৃদয়েই অবস্থিত।

অবশ্য কিছু মানুষ আছে যারা সব সময় সমস্যা তৈরী করে (troublemaker)। যেমন আল-হাফিয়া। সে এখন বিখ্যাত কবি এবং ভয়ঙ্কর খারাপ প্রকৃতির লোক! সে সবার সাথে সমস্যা তৈরী করত। একদিন সে সিদ্ধান্ত নিল যে সে বাইরে যাবে এবং সবাইকে অভিশাপ দিবে। সে ঘর থেকে বের হল এবং যাকে পেল তার সাথেই খারাপ আচরণ করল কিন্তু কাউকে পেল না যে তার সাথে মারামারি করবে (যা সে চাচ্ছিল)! দুঃখ মনে সে বাড়ি ফিরল এবং আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজকে বলল, " আল্লাহ তোমাকে এক বাজে চেহারা দিয়েছে। আল্লাহ তাকে আরও বাজে করুক!" ইয়ামেনে কিছু মানুষ আছে যারা কার সাথে মারামারি না করতে পারলে নিজের পায়ের সাথে মারামারি শুরু করে দেয়!

এরা হল সমস্যা তৈরিকারী লোকজন! আপনি এদের সাথে কিছু করতে পারবেন না!

জ) পরিচ্ছন্ন হৃদয়:

রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন "কিছু মানুষ আছে যারা সকল ভাল কাজের চাবিকাঠি (key) স্বরূপ এবং সকল খারাপ কাজের তালা (lock) স্বরূপ। আবার অনেক মানুষ আছে যারা সকল ভাল কাজের তালা/প্রতিবন্ধক স্বরূপ এবং সকল খারাপ কাজের চাবিকাঠি স্বরূপ।"

কিছু মানুষ খারাপের পর খারাপ কাজের নমুনা চিহ্ন রেখে যায় দুনিয়ার যেখানেই তারা যাক না কেন!

আবার কিছু মানুষ আজীবন ভাল কাজের পদরেখা একে যায় যেখানেই তারা থাকুক না কেন!

আমাদের শেষ ধরনের মানুষের পদান্ক অনুসরণ করা উচিত। আমাদের সব সময় ভাল কাজের অংশীদার হওয়া কর্তব্য!

আমাদের সবার ভাল কাজের চাবি স্বরূপ হওয়া উচিত। সব সময়! সব জায়গায়! সব পরিস্থিতিতে!

আর সব কিছু আসে পরিচ্ছন্ন হৃদয় থেকেই।

আমাদের অপর মুসলিম ভাইদের প্রতি - মুসলিম দল ও গ্রুপের প্রতি - সহৃদয়বান ও সহিষ্ণু-সম্পন্ন হওয়া অপরিহার্য কর্তব্য হিসেবে মানা উচিত! হে আলাহ! সকল মুসলিম দলকে সহমর্মিতার ভিত্তিতে একতাবদ্ধ হয়ে জুলুমের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ানোর সুযোগ দিন !

আমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে পরিচ্ছন্ন হৃদয় প্রত্যাশা করি!

হে আল্লাহ! আপনি যাদের পরিচ্ছন্ন হৃদয়ের অধিকারী হিসেবে গ্রহণ করেছেন তাদের কাতারে আমাদের শামিল করুন!

আমিন!

সল্লেল্লাহু আলায়হি ওয়ালা আলিহী ওয়াসাল্লিম!

বিষয়: বিবিধ

২৯১১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File