নরপশু[কল্পলোকের গল্প নয়]
লিখেছেন লিখেছেন ফাতিমা মারিয়াম ২৪ মে, ২০১৫, ০৩:৩৬:০৯ দুপুর
নাজমা মধ্যবিত্ত ঘরের গৃহিণী। স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার। মেয়েটি বড়। ক্লাস সেভেন এ পড়ে,নাম মুহসিনা। আর ছেলে মারুফের বয়স দশ। সে ক্লাস ফোরের ছাত্র। নাজমার স্বামী আসাদ ব্যাংকে চাকুরী করে। ফলে বাচ্চাদের স্কুলে আনা নেয়া থেকে শুরু করে সংসারের যাবতীয় কাজ নাজমাকে একাই সামলাতে হয়। এমনকি মাঝে মাঝে কাঁচাবাজারও স্কুলে আসা যাওয়ার পথে তাকেই সেরে নিতে হয়।
বাচ্চাদের স্কুলে নিয়ে যেতে তার খুব একটা সমস্যা হয় না। কারণ দুজনের স্কুল কাছাকাছি। মুহসিনাকে আগে তার স্কুলে নামিয়ে দিয়ে পরে সে মারুফকে তার স্কুলে পৌঁছে দেয়। এরপর বাসায় ফিরে ঘরের কিছু কাজ সেরে নেয়। সাড়ে এগারটায় মারুফের স্কুল ছুটি হয়। ঘরে তালা দিয়ে সে মারুফকে আনতে চলে যায়।
ছেলেকে বাসায় এনে ওকে গোসল করিয়ে কিছু খাইয়ে দিয়ে তাকে আবার ছুটতে হয় মেয়েকে আনার জন্য। মেয়ের ছুটি হয় দেড়টায়। মেয়েকে আনতে যাওয়ার সময় মারুফকে সাথেই নিয়ে যায়। কারণ এতটুকু ছেলেকে বাসায় একা রেখে যেতে তার মন কিছুতেই সায় দেয় না। ছেলে যা দুষ্টু! যদি কোন অঘটন ঘটায়!! তাই সে মারুফকে নিয়ে গিয়েই মুহসিনাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসে। এতে কোন সমস্যাও হচ্ছিল না। এভাবেই দিন বেশ কেটে যাচ্ছিল।
ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশে ও তো মেঘের আনাগোনা দেখা যায়, শুরু হয় প্রচণ্ড কালবৈশাখী। নাজমা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে তার জীবনে এরকম প্রচণ্ড ঝড়ে আক্রান্ত হয়ে তার পুরো পরিবারকে এমন ভয়ংকর বিপদে ফেলে দেবে। না; সেই দুর্ঘটনাকে আর যাই হোক ঝড় বলা যাবেনা। এটা হয়ত সুনামির চাইতেও ভয়ঙ্কর কিছু!
বাসাটি এমনিতে মোটামুটি নিরাপদ। দারওয়ান মনসুর সবসময় নীচে গেটের কাছে টুলে বসে থাকে। যদি কখনও কিছুক্ষণের জন্য বাইরে যায়ও তবে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে। তাই বাইরের লোক খুব একটা গেটের ভিতরে ঢুকতে পারে না।
যেদিন বাসার সামনেই রিকশা পেয়ে যায় সেদিন তো কোন সমস্যা হয়না। মা ও ছেলে আরামেই চলে যায়। কিন্তু যেদিন রিকশা পেতে অনেক পথ হাঁটতে হয় সেদিন মারুফের বেশ কষ্ট হয়ে যায়। একে তো বাচ্চা ছেলে তার উপর সে নিজেই কিছুক্ষণ আগে স্কুল থেকে ফিরেছে। আর যেদিন মাথার ওপর সূর্যটা গনগনে তাপ ছড়ায় সেদিন তো মারুফ কেঁদেকেটে অস্থির হয়ে যায়। নাজমা এর একটা বিকল্প সমাধান খুঁজতে থাকে।
সে তার স্বামী আসাদের সাথে পরামর্শ করে ঠিক করল যে দারওয়ান মনসুর তো নীচেই বসে থাকে। এই সময়টা মারুফকে যদি মনসুরের কাছে রেখে যাওয়া যায় তবে মারুফের এই কষ্টটা আর হবেনা। মনসুর কে এই কথা বলার পর সে বলল- কোন সমস্যা নাই আপা। আপনি ওকে আমার কাছে প্রতিদিনই রেখে যেতে পারেন।আপনি ফিরে না আসা পর্যন্ত আমি ওকে দেখে রাখব।
মনসুরের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে এখন নাজমা প্রতিদিনই মারুফকে তার কাছে রেখে যায়। এতে ছেলেটার কষ্ট কিছুটা কমল।
……..
প্রায় মাস খানেক পরের কথা। একদিন মারুফকে গোসল করাতে গিয়ে নাজমা দেখল যে তার পিঠে, ঘাড়ে,পেটে কিসের যেন দাগ! এটা দেখে সে ছেলের কাছে জানতে চাইল এগুলো কি? ছেলে কোন সন্তোষজনক জবাব দিতে পারল না। আমতা আমতা করে এটা সেটা বলল। নাজমা ধরেই নিলো খেলতে গিয়ে হয়ত পড়ে ব্যথা পেয়েছে। তাই এখন ভয়ে মায়ের কাছে স্বীকার করছে না। ছেলেকে আরও সাবধানে খেলাধুলা করার পরামর্শ দিল নাজমা।
কয়েকদিন পর আবারও নাজমা একই অবস্থা দেখল........তারপর....... আবার। এবার নাজমা বেশ জোরালো ভাবে ছেলের কাছে জানতে চাইল- ঘটনা কি? মারুফ কাঁদতে কাঁদতে মায়ের কাছে বলল-তুমি যখন প্রতিদিন আমাকে মনসুর আঙ্কেলের কাছে রেখে আপুকে আনতে যাও তখন সে আমাকে তার রুমে নিয়ে যায়। তারপর............।'
স্তম্ভিত নাজমা জানতে চাইল- এই ঘটনা কি প্রথম থেকেই ঘটছে?
মারুফ বলল-না, প্রথম প্রথম সে আমাকে চিপস, চকলেট এসব কিনে দিত। খেলা করত। গল্প শোনাত। বলত যে তার একটি ছেলে আছে। ঠিক আমার মতই বয়স। এই জন্য সে আমাকে এত ভালবাসে। বেশ কয়েকদিন পর আমাকে তার রুমে নিয়ে বলে বাইরে গরম, তুমি এখানে বসে খেলা কর। এরও কয়েকদিন পর থেকে সে আমার সাথে এসব করে আসছে।
-তুমি আমাকে প্রথম থেকে এইসব কথা জানাও নি কেন?
- আঙ্কেল আমাকে বলেছিল যে এসব কথা যদি তোমাকে বা আব্বুকে জানাই তবে আমাকে সে মেরে ফেলবে। আমি তাই ভয়ে তোমাদেরকে কিছু বলিনি। এমনকি আমাকে যে এটা সেটা কিনে খাওয়ায় তা-ও যেন তোমার কাছে না বলি সে কথাও বলেছিল।
নাজমা তার স্বামী আসাদ অফিস থেকে ফেরার পর সব ঘটনা জানাল। আসাদ ঘটনাটি শুনে বজ্রাহতের ন্যায় বসে রইল।
কিছুক্ষণ পর তার সিদ্ধান্ত নিলো তারা আগে বিষয়টি বাড়িওয়ালাকে জানাবে এবং আইনের সহায়তা নেবে। তাই তারা বিষয়টি বাড়িওয়ালাকে জানিয়েই থানায় গেল। পুলিশ এসে বদমাশ টাকে ধরে নিয়ে গেল।
এরপর নাজমারা আর বেশিদিন ঐ এলাকায় থাকে নি। অল্প কয়দিন পরেই বাসা শিফট করে অন্যত্র চলে যায় তারা।
………..
আমার আজকের এই লেখার উদ্দেশ্য হল- আমরা সাধারণত দেখি যে মেয়ে শিশুদের নিয়ে অভিভাবকরা বিশেষ করে মা যতটা উদ্বিগ্ন বা সচেতন থাকেন ছেলে শিশুদের ব্যাপারে ততটা থাকেন না। তাই অনায়াসেই ছেলেকে যে কোন কারও কাছে কিছু সময়ের জন্য থাকতে দেন। কিন্তু আসলে সব শিশুর প্রতিই সমান সচেতনতা প্রয়োজন। মা, বাবা, বড়ভাই, বড়বোন কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যরা শিশুদের প্রতি যত্নশীল হলে, সচেতন হলে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা হয়ত এড়ানো সম্ভব।
[এটি কিন্তু গল্প নয়; সত্যি ঘটনা। অন্য ঘটনাগুলোর মতই নামগুলো চেঞ্জ করে দিয়েছি। ঘটনাটা গতবছরের অর্থাৎ ২০১৪ সালের।]
বিষয়: বিবিধ
২২৭৯ বার পঠিত, ৪৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
''দর্শনার্থীরা চাইলে এদেরকে পাথর মারতে পারবে'' - এরকম একটা অপশন চালু রাখা উচিত।
আসলে শিশুদের সকলের ব্যাপারেই সাবধানতা অবলম্বন জরুরি। হোক সে মেয়ে বা ছেলে শিশু।
যাদের হাতে নিয়ন্ত্রণের চাবি, তারাও অন্ধকারের সহযাত্রী। মুক্তির জন্যে যারা লড়ছে তাদেরকে তুলে ধরা হচ্ছে প্রশ্নবোধক হিসেবে।
নরপশুরা ভদ্রতার ছদ্মবেশে আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় । এ ব্যাপারে যেমন সবার সচেতনতা প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন নরপশুদের উপযুক্ত শাস্তি ।
ধন্যবাদ সবুজ ভাই।
বাংলাদেশের মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০০১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত পাঁচ বছরের কম বয়েসী ২৮৬ জন শিশু সেক্সুয়াল অ্যাবিউজের শিকার হয়েছে, যার মধ্যে ৯৯ ভাগ শিশু ধর্ষণের শিকার।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত যে ৩৯৬ জন শিশু (অনূর্ধ্ব ১৮) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টার, ব্রেকিং দ্যা সাইলেন্স ও ঢাকা শিশু হাসপাতালের কাউনসেলিংয়ের আওতায় আসে তাদের ৮৬ ছেলেশিশু। ছেলেশিশুরাও শংকার বাইরে নয়।
আমরা এসবের সমাধান নিয়ে কাউন্সিল করতে পারি।
হ্যাঁ তোমার সাথে একমত যে এই ব্যাপারে যথাযথ কাউন্সিলিং শুরু করা প্রয়োজন। এলাকা ভিত্তিক উদ্যেগ নেয়া যেতে পারে। কিছুদিন আগে রাহনুমা চাইল্ড এ্যাবিউজমেন্ট এর উপর একটা চমৎকার আর্টিকেল লিখেছিল। তুমি কি ওটা পড়েছ? ওখানে শিশু ও অভিভাবকদের সচেতনতার বিষয়ে লিখেছে।
ধন্যবাদ ভাইছা।
সুচিন্তিত মতামতের জন্য ধন্যবাদ মুন্সিভাই।
ইশশশ মনে চায়_____ ______কিন্তু করতে পারি নাহ কিচছু ই
খুবি কষ্টের ঘটনা! তারচাইতে বেশি কষ্ট ঐ শিশুটির যে কিনা এতোবড় শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হলো! কে জানে কতো দিন এই ভয় তাকে বয়ে বেড়াতে হবে?
সচেতনতামূলক পোস্টের জন্য শুকরিয়া!
সময় পেলে 'ঘেটুপুত্র কমলা' ছবিটি দেখে নিও।
মন্তব্য করতে লগইন করুন