বহুদিন পরে মনে পড়ে আজি-৪
লিখেছেন লিখেছেন ফাতিমা মারিয়াম ০৩ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৫:০৪:০৫ বিকাল
একজন রহস্যময়ী
************************
'পুরনো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়...... '
আমি তখন ক্লাস থ্রিতে পড়ি। বাসা থেকে স্কুলের দুরত্ব একেবারে কম নয়। কিন্তু হেঁটে হেঁটেই যাওয়া আসা করতাম। আজকের দিনে এই দুরত্বে কোন পিতামাতাই তাদের সন্তানকে পায়ে হেঁটে স্কুলে যেতে দিবেন না। হয় স্কুল ভ্যান নয়তো বা রিকশা লাগবে। আমরা দলবেঁধে স্কুলে যেতাম এবং আসতাম। বর্তমান সময়ে এই দৃশ্যটি দেখাই যায়না । বেশি মজা হোত ছুটির সময়। একঝাঁক নীল রং এর ফ্রক পরা মেয়ে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে গল্প করতে করতে বাসায় ফিরছে। সেই সময় মনে হোত 'এই পথ যদি না শেষ হয়'!!!
রূপা আমার সাথেই পড়তো। একসাথেই যাওয়া-আসা করতাম। রূপা আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী ছিল না। একদিন স্কুল ছুটির পর রূপা বললো,
-“ চল্ আজ তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাব।”
-আমি বললাম, “কোথায় নিয়ে যাবি ?”
-' আরে চল্ না ! গেলেই দেখতে পাবি। '
- 'দেরী হবে না তো ?'
- 'না '
আমাদের বাসা এবং স্কুলের মাঝামাঝি একটি জায়গায় খুব সুন্দর লাল সিরামিক ইটের তৈরী কয়েকটি বিল্ডিং ছিল (বাড়িগুলো এখনো আছে).... ওগুলোর একটিতে রূপা আমাকে নিয়ে গেল। ঐ সময়ে সিরামিক ইটের তৈরী বিল্ডিংগুলো আভিজাত্যের প্রতীক ছিল। একটি চার তলা বিল্ডিং। এর দ্বিতীয় তলায় ও আমাকে নিয়ে গেল। বেল টিপে আমরা অপেক্ষা করছি । একজন মাঝবয়সি মহিলা দরজা খুলে দিলেন। পরে বুঝতে পেরেছি এই মহিলা এই বাসায় কাজ করেন । আমরা বসার ঘরে গিয়ে ঢুকলাম। সেখানে দেখি ১৫/১৬টি মেয়ে কার্পেটের উপর গোল হয়ে বসে আছে। সবাই আমাদের স্কুল ড্রেস পরা।দু-একজনকে আমি চিনতেও পারলাম। আমিও রূপা র সাথে একপাশে বসে পড়লাম।
আমি বেশ অবাক হয়ে ভাবছি ব্যাপারটা কি ?কিছুক্ষন পর একজন ভদ্র মহিলা রুমে আসলেন। তিনি একটি স্কার্ট পরে রয়েছেন। অনেক ফর্সা, গোলগাল মুখ, নাক একেবারেই বোঁচা এবং চোখ গুলো বেশ ছোট। তিনি ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলায় সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন , “ তোমরা কেমন আছ ?”
সবাই একসাথে চিৎকার করে বললো, 'ভালো আছি।'
আমি চুপচাপ বসে আছি । তারপর আরো দুএকটি কথা বলেই তিনি একটি গান গাওয়া শুরু করলেন। সবাই তার সাথে সেই গানটি গাইছে। আমি যেহেতু নতুন এসেছি তাই আমি চুপ করে বসে আছি। কারন এরা সবাই গানটি পারে ।প্রথম দিন আমি চুপই ছিলাম। গান শেষ হলে তিনি ভিতরে গেলেন এবং একটা ট্রেতে করে অনেক গুলি চকোলেট নিয়ে আসলেন। আমার আজও পরিস্কার মনে আছে তিনি নিজ হাতে প্রত্যেককে চারটি করে চকোলেট দিয়েছিলেন।
চকোলেট খেতে খেতে বাসায় ফিরলাম। যেহেতু ওখানে বেশিক্ষন ছিলাম না তাই বাসায় ফিরে কোন কৈফিয়ত দিতে হলো না। এভাবে আমরা প্রতিদিনই ঐ বাসায় যেতাম। তিনি একটি মোড়ায় বসতেন এবং হাত নেড়ে নেড়ে গান গাইতেন। কিন্তু কোন প্রচলিত গান ছিলনা। ভদ্রমহিলা যে গান গুলো শেখাতেন তার কোনটিই আমার মনে নেই।টেনে টেনে গাওয়া হতো।গানের ভাষা সম্ভবত বাংলা ছিল না।না হলে ঐ গানগুলো আমার একটুও মনে নেই কেন?আলহামদুলিল্লাহ আমার স্মৃতিশক্তি ভালো । কিছুক্ষন গান গাওয়ার পর প্রত্যেককে চারটি করে চকোলেট দিতেন । এভাবেই চলছিল।
ভদ্রমহিলার যে চেহারা আমার মনে আঁকা আছে তাতে মহিলাকে চীনা বা জাপানী বলেই ধারণা হয়।তবে গৃহকর্মী মহিলাটি বাংলাদেশীই ছিলেন।একদিন আমরা গিয়ে বসার ঘরে অপেক্ষা করছি। এমন সময় সেই গৃহকর্মী মহিলা আসলেন। তিনি আমাদের জানালেন যে ম্যাডামের একটু দেরী হবে। আজ তোমাদের আমি একটি গান শোনাবো । হাত তালি দিয়ে তিনি গান ধরলেন আর আমরা মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হাত তালি দিচ্ছিলাম। এই গানের কয়েকটি লাইন আমার বেশ পরিস্কার মনে আছে।
"আমার পরিবর্তন হয়েছে
যে স্কুলে পড়তাম আগে এখন পড়ি না
যে বই পড়তাম আগে এখন পড়ি না
যে জামা পরতাম আগে এখন পরি না আ আ আ আ।"
কিছুক্ষন পর ভদ্রমহিলা আসলেন। তিনি বললেন , “তোমাদের এতক্ষন গান শোনাচ্ছিল নাকি ?” তারপর ওর দিকে তাকিয়ে বললেন বেশ ভালোইতো গাও তুমি ।”
“না ম্যাডাম আমি ভালো গাইতে পারিনা আপনার গান কত সুন্দর হয়!!!”
এরপর চকোলেট দিয়ে আমাদের পরদিন সময়মত আসতে বললেন।
এভাবেই বেশ কয়েকদিন চললো আমাদের এই গান শিখা ও চকোলেট খাওয়া । একদিন আমরা গান শেষ করে আসার সময় উনি বললেন, “আমি ৫/৬ দিন থাকবোনা এই কয় দিন তোমরা এসো না।”
আমরা চলে আসলাম। এরপর আমাদের আর কোনদিনই ঐ বাসায় যাওয়া হয় নি। শেষ যেদিন গিয়েছিলাম তার কয়েকদিন পর রূপা বললো, “আমি কালকে ঐ বাসায় গিয়েছিলাম । উনি আর গান শিখাবেন না।”
বেশ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল কথাটা শুনে । স্কুলে যাওয়া আসার পথে বারবার ঐ বাসার দিকে তাকাতাম । যদি ভদ্রমহিলাকে একটু দেখা যায় !!! এখন এই ঘটনাটা লিখার সময় আমার মনে হচ্ছে চকোলেটের সাথে আমি হয়তো উনাকেও বেশ ভালোবেসে ফেলেছিলাম।
আমাদের খুব বেশি দেরি হতো না। তাই বাসায় কখনোই জবাবদিহি করতে হয় নি।আম্মা-আব্বা বা ভাইবোনদের কাউকে এ ব্যাপারে বললে ঐ বাসায় আর যাওয়া হত না, এটা জানতাম তাই কখনো বলিওনি। চকোলেট ছাড়াও ঐ মহিলার প্রতি কেমন যেন একটা আকর্ষণ কাজ করতো। তারপর ধীরে ধীরে ঘটনাটি আর তেমন মনে পড়তো না। অত ছোট বয়সে ব্যাপারটি নিয়ে তেমন প্রশ্নও তৈরিও হয়নি মনে।
আমার মনে কিছু প্রশ্ন এখন উঁকি দেয়---
-উনি কেন ছোট বাচ্চাদের গান শিখাতেন ?
-গৃহকর্মী মহিলাটি এমন একটি গান কোথা থেকে শিখলেন?
-হঠাৎ করে কেন বন্ধ করে দিলেন ?
-উনার পরিবার-পরিজন কোথায় ছিল ?
-উনার কি কোন বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল ?
-এটি কোন মিশনারী তৎপরতা ছিল কি?
-গানগুলি কি কোন প্রার্থনা সঙ্গীত ছিল ?
-না কি কেবল নিঃসঙ্গতা কাটানোর জন্য শিশুদের নিয়ে সময় কাটাতেন?
এই প্রশ্নগুলোর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের জবাবই মাথায় আসে। জানিনা কোনটি সত্য!!!!
[এই লেখাটি এসবি ব্লগে দিয়েছিলাম। কয়েকদিন ধরে বেশ ব্যস্ত...... তাই আগের এই লেখাটি দিলাম। যারা আগেও পড়েছিলেন তাদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।]
'ছেলেবেলার দিন ফেলে এসে সবাই আমার মত বড় হয়ে যায়
জানিনা ক’জনে আমার মতন মিষ্টি সে পিছু ডাক শুনতে যে পায়………'
বিষয়: বিবিধ
৩১৫০ বার পঠিত, ৫৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
বেশ মজার তো! মহিলাটি কোন ধর্মের এবং দেশের - তা জানতে পারলে কিছু ধারনা করা যেতো! তা, রূপাটাও কি হারিয়ে গেছে?
আর রূপা? সে-ও হারিয়ে গেছে তবে ভার্সিটিতে অন্য এক
রূপাকে পেয়েছিলা.... সে-ও হারিয়ে গেল। রূপারা বোধ হয় হারিয়েই যায়.........
আগেও পড়েছিলাম এটা! ঠিকআছে আপনি মাফ.. বদলে আপনাদের সাথে স্কাইপ হালাকাতে অংশগ্রহন করতে না পারার জন্য আমাকেও মাফ করে দেন। ইহাকে শোধ-বোধ বলে।
আমি শোধ-বোধের রাজনীতিতে নাই আবার কবে তোমাকে পাব তা জানাও...নইলে আবার বৃষ্টিতে ভিজাবো
আমি আগামী কাল ফ্রী আমি আপুনি। ফেবুতে জানাবো ইনশাআল্লাহ।
ইয়েস অফকোর্স, আমি আপনার সাথেই আছি আপুমণি। আপনি ছোটবেলা থেকেই কি বিদেশে? @আলোর আভা
পুনরায় না দিলে আমরা যারা এসবি তে পড়িনি, তারা পড়তে পারতাম না।
গানগুলি কি কোন প্রার্থনা সঙ্গীত ছিল ?
এমনটা হলে হতে পারে...। তবে কোথাও গেলে বাসায় বলাটা ভালো, তাহলে অনাকাংখিত বিপদ থেকে রক্খা পাওয়া যায়। আমি তো প্রথমে একটু ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম, আমি আবার ভীতু টাইপের কিনা .... ভালো থাকুন, আপুমনি।
আগে পড়িনি সন্দেহজনক লাগছে মহিলাটার মিশন।
তখন কিন্তু মনে কোন সন্দেহ আসেনি...এখন যতটা আসে। একাকীত্ব কাটানোর জন্য হতে পারে আবার হয়তবা এমনও হতে পারে যে উনি বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে পছন্দ করতেন। ধন্যবাদ
পুরোটা পড়া হয় নি...পরে পড়ে নিবো
মন্তব্য করতে লগইন করুন