বহুদিন পরে মনে পড়ে আজি-৩

লিখেছেন লিখেছেন ফাতিমা মারিয়াম ০৩ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৪:৫২:৪৯ বিকাল



'ছেলেবেলার দিন ফেলে এসে সবাই আমার মত বড় হয়ে যায়

জানিনা ক’জনে আমার মতন মিষ্টি সে পিছু ডাক শুনতে যে পায়………'
Music Music Music

ছোটবেলায় নানার বাড়ীতে যখন বেড়াতে যেতাম তখন কী যে মজা করতাম!!! উঠানে দলবেঁধে খেলা করার মজাই অন্যরকম। আমার নানারবাড়ীর উঠানটা বেশ বড় ছিল। এখনও আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই একদল নানান বয়সী ছেলেমেয়ে সারা উঠানময় হৈচৈ করে বেড়াচ্ছে। দলে দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন ধরণের খেলা চলত আমাদের। কানামাছি, বরফ-পানি, বৌ-চি, কুতকুত, রুমাল চুরি, ফুলটোকা, ওপেনটি বায়স্কোপ এবং আরও অনেক খেলা। অবশ্য এই খেলাগুলো ঢাকায়ও খেলতাম। তারপরও গ্রামে মজা বেশি পেতাম এই জন্য যে এখানে খালাত- মামাত ভাইবোনদের সান্নিধ্য পাওয়া যেত।

গ্রামে আমরা অল্প কয়েকদিন থাকতাম...... কিছুদিন নানারবাড়িতে আর কিছুদিন দাদারবাড়িতে থেকে তারপর ঢাকায় চলে আসতাম। একবারের একটা ঘটনা মনে পড়লেই খুব হাসি পায়। আমি তখন বেশ ছোট। কিছুদিন হল নানারবাড়িতে এসেছি। একদিন আমার সমবয়সী এক খালাতো বোন আমাকে বলল,’ চল! আজ মসজিদে শিরনি দেবে। ওখানে যাই।‘ এই মসজিদটি নানাদের নিজস্ব মসজিদ। বাড়িতে ঢুকার মুখেই মসজিদের অবস্থান।

এই শিরনি দেয়ার বিষয়টি যে কি তা আমি জানতামনা। ও আমাকে বুঝিয়ে দিল। আমিতো কোনভাবেই যাবনা...... কারণ আমি ভেবেছিলাম আম্মা জানলে খুব রাগ করবে। আব্বা আম্মা সব সময় আমাদের ভাইবোনদের এই শিক্ষা দিতেন কখনও কারও কাছ থেকে কোন কিছু নেয়া যাবেনা এবং কারও কাছে কখনও কোন কিছু চাওয়াও যাবেনা। ফলে আমার মনে এই ভয়টা কাজ করছিলো যে যদি আমি সবার সাথে ওখানে যাই, তবে হয়তোবা আম্মা রাগ করবেন।

কিন্তু ও আমাকে জোর করে নিয়ে গেল। যাওয়ার আগে আমার জন্য এবং ওর জন্য প্লেট নিয়ে নিলো। ওখানে গিয়ে দেখি ২০/২২টি ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে মসজিদের সামনে হইচই করছে। এখানে আমাদের অন্যান্য ভাইবোনরাও (কাজিন) ছিল। এমন সময় আমাদের এক মামা (আম্মার জ্ঞাতি ভাই) বড় একটি গামলায় করে কি যেন নিয়ে আসলেন। সবাইকে বসতে বললেন। সবাই ঝটপট বসে পড়লো। মামা একহাতে গামলা ধরে রেখে অন্যহাতে চামচ দিয়ে সবার প্লেটে প্লেটে সেই ক্ষীর দিলেন। আমি লজ্জায় মরে যাচ্ছিলাম! এই খাবারটাতো উনি আমাদেরকে তার ঘরে ডেকেও দিতে পারতেন!! সবাইত বাড়িরই ছেলেমেয়ে!!! এইভাবে মসজিদের সামনে কেউ দেয়?

কয়েকজনকে দেখলাম ওখানে বসেই খাওয়া শুরু করেছে। আমি প্লেট নিয়ে একদৌড়ে ঘরে চলে গেলাম। প্লেট আম্মার হাতে দিয়ে আমি নিরাপদ দুরত্বে দাঁড়িয়ে রইলাম। অন্যান্য কাজিনরাও ঘরে আসলো। আমার মামা, খালা, আম্মা বা নানী কেউই কাউকে কিছু বলছেনা দেখে এবার আমি কিছুটা সাহস পেলাম। পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছি যে এটা গ্রাম্য সংস্কৃতিরই একটি অংশ। এতে সব পরিবারের বাচ্চারাই অংশ নেয়। এখনও ঘটনাটা মনে পড়লে বেশ মজা লাগে। জানিনা এখনও গ্রামে এই প্রথা আছে কিনা?

..

গরু আতঙ্ক ও দুঃস্বপ্ন

*****************************

গরু বিষয়ক একটা অভিজ্ঞতা সবার সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে হলো। আমার বয়স তখন চার বা পাঁচ । খুব হালকা ভাবে মনে পড়ে ঘটনাটা। কী যেন একটা উপলক্ষ্যে নানাবাড়ী বেড়াতে গিয়েছি। একদিন আমার বড় বোন , আমার এক খালা (আম্মার ফুপাতো বোন হীরু খালা) ,আমার আরো কিছু কাজিন (আমার ঠিক মনে নেই কে কে ছিল?) এবং আমি আমার সেজ খালার বাড়ী যাচ্ছিলাম। পাশাপাশি গ্রাম তাই সবাই হেঁটেই যাচ্ছি।

আমরা ঢাকায় বড় হয়েছি।অত হাঁটার অভ্যেস নেই।যেহেতু আমি ছোট তাই মাঝে মাঝে হীরু খালা কোলে নেয়ায় আমার কষ্ট কম হচ্ছিল। একজন কৃষক তার গরুর পাল নিয়ে আমাদের পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একটা গরু আমাদের দিকে তেড়ে আসে। কালো একটা গরু। দলের সবাই দিক বিদিক জ্ঞান হারিয়ে এদিক ওদিক ছুটে গেল।

ছুটতে গিয়ে আমার বড় আপা একটা গর্তের মধ্যে পড়ে গেল। মুহুর্তের মধ্যে আমি আমাকে হীরু খালার কোলে দেখতে পেলাম। আমি হাত পা ছুড়ছি দৌড়ানোর জন্য।কিন্তু খালা আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছেন।তিনি হাসছেন। খালা গ্রামের মেয়ে। তিনি শহুরে ভীতুদের মত ভয় পেয়ে দৌড় প্রতিযোগিতায় নামেননি। বরং মাথা ঠান্ডা রেখে একপাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ।

তারপর সেই লোক এসে তার গরুকে সরিয়ে নিয়ে যায়। সবাই নিরাপদে খালার বাড়ী পৌঁছালাম। এই ঘটনা আমার সম্পূর্ণ মনে নেই। বার বার এই-ই মনে পড়ে…. গরু দৌড়াচ্ছে, সবাই দৌড়াচ্ছে আর হীরু খালা আমাকে কোলে নিয়ে হাসতে হাসতে হাসতে ভেঙ্গে পড়ছেন। পরবর্তীতে আমার আপা ও অন্যদের মুখে এই ঘটনা এত শুনেছি যে আমি যেন এখনও সবটাই চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। এই ঘটনা উল্লেখ করার পিছনে কারণ হলো এই যে আজো আমার গরু আতঙ্ক কাটেনি। এখনো রাস্তায় গরু দেখলে আমি ভয়ে চুপসে যাই। কুরবানী ঈদের তিন চার দিন আগে থেকে বাইরে যাওয়া কমিয়ে দেই। যদি কোন কারনে বাইরে যাওয়া হয় তবে সারাক্ষন একটা আতঙ্কের মধ্যে কাটে এই বুঝি কোন গরুর খপ্পরে পড়লাম !!!

আমি ছোট বেলা থেকেই কখনো কুরবানীর গরু দেখতে গরুর সামনে যাইনা। দূর থেকেই দেখি। এখনো সামনে যেতে পারিনা । আমার গরু আতঙ্কের আর একটি বিশেষ দিক হলো আমি প্রায়ই স্বপ্নে গরু দেখি। আমি দেখি যে আমি রাস্তায় একা হাঁটছি। হঠাৎ একটা বিশাল আকৃতির কালো গরু আমাকে তাড়া করছে। আমি বাসায় যেতে পারছিনা। আমি দৌড়াই আর দৌড়াই…. আমার মোটামুটি বুঝজ্ঞান হওয়ার পর থেকেই এই স্বপ্ন দেখে আসছি। অত ছোট বেলার সেই স্মৃতি আজো আমার অবচেতন মনে কেমনে রয়ে গেছে। মনের কিছু দিক আসলেই রহস্যময়। জানিনা আমার এ আতঙ্ক কী ভাবে কাটবে!!!

[ শেষের লেখাটা এসবি ব্লগে দিয়েছিলাম। প্রথমে ভেবেছিলাম যে আগের লেখাগুলো এখানে আর দিবনা। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আগের গুলোও এই ব্লগে আবার দিয়ে দিই........]।

‘ছোট্টবেলার শত রঙ করা মুখ

সুর তোলে আজও এই মনকে ঘিরে....’

বিষয়: বিবিধ

৩১৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File