মুত্তাফাকুন আলাইহি-১৯

লিখেছেন লিখেছেন ফাতিমা মারিয়াম ০৬ নভেম্বর, ২০১৩, ০৭:৪৫:৩২ সকাল



আনুগত্যে ভারসাম্য রক্ষা করা-২

৬৫) হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল ‘আস রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণনা করেন, রাসূলে আকরাম কে জানানো হলো যে, ‘আমি বলে থাকি, ‘আল্লাহর কসম! যতদিন জীবিত থাকবো, ততদিন আমি (দিনে) রোযা রাখবো আর রাতে নামাজ পড়তে থাকব।’

রাসূলে আকরাম আমায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি নাকি এরূপ কথা বলে থাকো?’

আমি বললাম, ‘আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গীকৃত। হে আল্লাহর রাসূল! আমি ঠিকই একথা বলেছি।’

তিনি বললেন, ‘তুমি এরূপ করতে পারবে না। কাজেই, রোযাও রাখো, আবার তা ছেড়েও দাও। তেমনি রাতের বেলা নিদ্রাও যাও আবার রাতে জেগে নফল নামাযও পড়ো; আর প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখো। কারণ সৎকাজে দশগুণ সওয়াব পাওয়া যায়। এ নিয়মটি পালন করলে এটা প্রতিদিন রোযা রাখার মতো হয়ে যাবে।’

আমি বললাম, ‘আমি এর চেয়েও বেশি শক্তি রাখি।’

তিনি বললেন, ‘তাহলে একদিন রোযা রাখো ও দু’দিন পানাহার করো। এটি হচ্ছে হযরত দাউদ আলাইহিস সালাম-এর রোযা। আর এটিই হচ্ছে ভারসাম্যপূর্ণ রোযা।’

আমি বললাম, ‘আমি এর চেয়েও বেশি ক্ষমতা রাখি।’

রাসূলে আকরাম বললেন, ‘এর চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কোন রোযা নেই।’

(হযরত আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন বৃদ্ধ বয়সে উপনীত হন, তখন প্রায়শ বলতেন, ‘হায়! আমি যদি রাসূলে আকরাম এর কথা মতো সেই তিন দিনের রোযা মেনে নিতাম, তাহলে তা আমার পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদের চাইতেও আমার কাছে বেশি প্রিয় হতো!’

অপর এক রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, রাসূলে আকরাম বলেন, ‘আমাকে কি অবহিত করা হয়নি যে, তুমি প্রতিদিন রোযা রাখো এবং রাতভর নফল নামাজ পড়ো?’

আমি বললাম, ‘নিশ্চয়ই হে আল্লাহর রাসূল!’

তিনি বললেন,’ তুমি এরূপ করো না। রোযা রাখো আবার ভঙ্গও করো। ঘুমাও আবার ঘুম থেকে জেগে নফল নামাযও পড়ো। কারণ, তোমার ওপর তোমার শরীরের হক আছে, তোমার ওপর তোমার চোখেরও হক আছে, তোমার ওপর তোমার স্ত্রীরও হক আছে। তোমার ওপর তোমার অতিথির হক আছে। মূলত প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখাই তোমার জন্য যথেষ্ট। কেননা, প্রতিটি নেকীর পরিবর্তে তুমি দশগুণ সওয়াব পাবে। এটা সারা বছর বা প্রতিদিন রোযা রাখার সমান হয়ে যায়।’

আমি (আবদুল্লাহ) নিজেই নিজের ওপর কঠোরতা আরোপ করার ফলে আমার ওপর কঠোরতা চেপে বসেছে। আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো নিজের মধ্যে (প্রত্যহ রোযা রাখার মতো) সামর্থ রাখি।’

তিনি জবাব দিলেন, ‘আল্লাহর নবী দাউদের রোযা রাখো এবং তার চেয়ে বাড়িও না।’

আমি জানতে চাইলাম, ‘দাউদের রোযা কি রকম ছিল? ‘

তিনি জবাব দিলেন, ‘অর্ধ বছর।’ অর্থ্যাৎ একদিন রোযা রাখা এবং একদিন তা ভঙ্গ করা। বুড়ো বয়সে উপনীত হবার পর আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন,’ হায়! আমি যদি সেদিন রাসূলে আকরাম এর দেয়া সুবিধাটা গ্রহণ করতাম!’

অপর এক রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, রাসূলে আকরাম বলেন, আমাকে তো খবর দেয়া হয়েছে- তুমি সারা বছর (অর্থ্যাৎ প্রতিদিন) রোযা রাখো এবং প্রতি রাতে কুরআন খতম করে থাকো! আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কল্যাণ লাভের আকাঙ্খাই এ কাজটা করে থাকি।’

তিনি বললেন, ‘তাহলে তুমি আল্লাহর নবী দাউদের (নিয়মে) রোযা রাখো। কারণ মানুষের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয় বড় ইবাদতকারী। আর প্রতি মাসে একবার কুরআন খতম করো।’ আমি বললাম হে আল্লাহর নবী! আমি তো এর চাইতেও বেশি কুরআন পাঠের ক্ষমতা রাখি। তিনি বললেন,’ তাহলে দশ দিনে (কুরআন) খতম করো। ‘

আমি বললাম, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি এর চেয়েও বেশি ক্ষমতা রাখি।’

তিনি বললেন,’ তাহলে এক সপ্তাহে কুরআন খতম করো এবং এর চেয়ে বেশি বাড়িও না।’

এভাবে আমি নিজেই নিজের ওপর কঠোরতা চাপাতে চাইলাম এবং তা চাপানো হয়েই গেল। রাসূলে আকরাম আমায় বলেছিলেন,’ তুমি জানো না, হয়তো তোমার বয়স দীর্ঘতর হবে।’

আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘রাসূলে আকরাম যা বলেছিলেন, অবশেষে আমি সেখানে পৌঁছে গেলাম। আর আমি যখন বার্ধক্যে পৌঁছে গেলাম, তখন আমার আফসোস হলো, আমি যদি রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দেয়া সুবিধা গ্রহণ করতাম!’

অপর এক রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, ‘তোমার ওপর তোমার ছেলেরও হক রয়েছে। ‘

আরেক রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে,’ যে ব্যক্তি প্রত্যহ রোযা রাখে, মূলত সে রোযাই রাখে না। (এ কথা তিনি তিনবার বলেন)’

অপর এক রেওয়ায়েতে বলা হয়েছে, আল্লাহর দৃষ্টিতে সবচেয়ে পছন্দসই রোযা হচ্ছে দাউদের রোযা আর সবচেয়ে পছন্দনীয় নামায হচ্ছে দাউদের নামায। তিনি রাতের অর্ধাংশে ঘুমাতেন, এক তৃতীয়াংশে (আল্লাহর) বন্দেগী করতেন এবং ষষ্ঠাংশে আবার ঘুমাতেন। অনুরূপভাবে, তিনি একদিন রোযা রাখতেন এবং একদিন রোযা ভঙ্গ (ইফতার) করতেন।’

অপর এক রেওয়ায়েত অনুসারে আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমার পিতা একটি শরীফ খান্দানের মেয়ের সাথে আমায় বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ করান। আমার পিতা তার পুত্রবধু থেকে শপথ নিয়ে তাকে তার স্বামী সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন। আমার স্ত্রী তার জবাবে বলতেন, তিনি খুব ভালো লোক; এতো ভালো যে, আমি তার কাছে আসার পর থেকে এ পর্যন্ত আমার সাথে বিছানায় শয়ন করেননি এবং আমার পর্দাও খোলেননি।’

অবশেষে আমার পিতা রাসূলে আকরাম র কাছে বিষয়টি উত্থাপন করলেন। তিনি বললেন, ‘তাকে আমার কাছে পাঠিয়ে দাও?’

এরপর আমি তাঁর সাথে সাক্ষাত করলাম। তিনি প্রশ্ন করলেন,’ তুমি কিভাবে রোযা রাখো? ‘

আমি বললাম, ‘প্রতিদিন।’

‘ কিভাবে কুরআন খতম করো?’

জবাব দিলাম,’ প্রতি রাতে।’

এরপর তিনি আনুপূর্বিক সমস্ত ঘটনা বর্ণনা করলেন। আবদুল্লাহ যখন আরাম করতে চাইতেন, তখন কয়েক দিন হিসাব করে রোযা ভঙ্গ করতেন এবং পরে আবার সেগুলোর রোযা পূরণ করে দিতেন।

রাসূলে আকরাম থেকে পৃথক হওয়ার পর (তাঁর সাথে ওয়াদাকৃত) তাঁর খেলাফ করাকে তিনি অপছন্দ করতেন।

[বুখারী ও মুসলিম]

[ইমাম নববী (রহ) বলেন, এ বর্ণনাগুলোর অধিকাংশই বুখারী ও মুসলিম উভয় গ্রন্থে বর্ণিত এবং মাত্র সামান্য অংশ এ দুটি গ্রন্থের কোন একটি থেকে গৃহীত হয়েছে।]

[ রিয়াদুস সালেহীন থেকে সংগৃহিত। হাদিস নং ১৫০]

মুত্তাফাকুন আলাইহি-১৮

এ বিষয় সংক্রান্ত আরো হাদিস পড়তে চাইলে দেখতে পারেন আলোকের ঝর্ণাধারা

বিষয়: বিবিধ

১৪২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File